যাকাত ও যাকাতুল ফিতর

প্রকাশ | ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৫৫ | আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:০০

মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী

প্রিয় পাঠক,
রোজা ফরজ হওয়ার আগে দ্বিতীয় হিজরীতেই যাকাত ফরজ করা হয়েছে। যাকাত হলো ঈমানের পর ইসলামের দ্বিতীয় মৌলিক স্তম্ভ। প্রথম হলো নামাজ। যাকাত আজ আমাদের সমাজে অবহেলিত একটি বিধান। যারা পালন করে তাদের বিরাট একটি অংশ লৌকিকতা থেকে মুক্ত নয়। প্রকৃত যাকাত আদায়কারী খুবই কম দেখা যায় সমাজে।


অথচ সঠিকভাবে যাকাত আদায় করা হলে সমাজে গরিব মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর হবে। প্রত্যেক মুসলমানের এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, ইসলামের মূল বিষয় সমূহ থেকে যাকাত একটি অন্যতম বিষয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং রুকুকারীদের সঙ্গে রুকু কর’। (সূরা বাকারা, আয়াত- ৪৩)


আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, ‘তাদের সম্পদ হতে যাকাত গ্রহণ করুন। যাতে আপনি তাদেরকে গুনাহমুক্ত ও পবিত্র করতে পারেন এবং তাদের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় এ ব্যাপারে আপনার দোয়া তাদের শান্তি ও স্বস্থি দান করবে। আর আল্লাহ তো সর্বশ্রেতা ও সর্বজ্ঞ।’ (সূরা তওবা, আয়াত- ১০৩)


রাসূল সা. এরশাদ করেন, ‘ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বিষয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত- ১. এ কথা স্বাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নাই এবং মুহাম্মদ সা. তার বান্দা ও রাসূল। ২. নামাজ কায়েম করা, ৩. যাকাত প্রদান করা, ৪. বাইতুল্লাহর হজ্জ্ব করা এবং ৫. রমজানের রোজা রাখা। (বুখারী ও মুসলিম)


আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. মুআয রাদিয়াল্লাহু আনহুেেক ইয়ামনে পাঠান এবং বলেন, ‘তুমি ইয়ামনবাসীদেরকে এ কথা সাক্ষ্য দেওয়ার প্রতি দাওয়াত দাও যে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ এবং আমি তার রাসূল। যদি তারা এ ব্যাপারে তোমার আনুগত্য করে (অর্থাৎ দাওয়াত গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে যায়) তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, আল্লাহ রাত দিনে তাদের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। এ ব্যাপারেও যদি তারা তোমার আনুগত্য করে তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দিবে যে, আল্লাহ তাদের ওপর যাকাত ফরজ করেছেন। যা তাদের ধনীদের থেকে নিয়ে দরিদ্রদের মধ্যে বন্টন করা হবে। (বুখারী ও মুসলিম)


আল্লাহ তায়ালা কয়েকটি কারণে মূলত যাকাত ফরয করেছেন। যা হচ্ছে ১. নফসকে কৃপণতা ও স্বার্থপরতা হতে পবিত্র করা ২. বান্দাহকে গুনাহমুক্ত করা ৩. নিঃস্ব ও বঞ্চিত মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশ করা ৪. সমাজের সাধারণ কল্যাণ সাধন করা ৫. সম্পদকে হালাল ও পবিত্র করা। কাজেই যে ব্যক্তি যাকাত দিতে অস্বীকার করবে, সে কুফুরীতেই লিপ্ত হয়ে যাবে এবং যে ব্যক্তি কৃপণতা করে যাকাত আদায় করা থেকে বিরত থাকে, তার কাছ থেকে জোর করে তা আদায় করতে হবে এবং যাকাত না দিয়ে আল্লাহর আইনের অবমাননা করার জন্য তাকে শাস্তি দিতে হবে। যদি কেউ যাকাত অস্বীকার করে যুদ্ধ ঘোষণা করে তবে তার বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। যতক্ষণ না সে আল্লাহর আদেশের সামনে অবনত মস্তকে আত্মসমর্পন করে।


যাকাত না দেওয়ার পরিণাম: আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা স্বর্ণ রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না (অর্থাৎ ঠিকভাবে যাকাত দেয় না) তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং এর দ্বারা তাদের কপাল পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ (ছ্যাকা) দেওয়া হবে সেদিন বলা হবে এটা ওই জিনিস যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করে রাখতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তার স্বাদ গ্রহণ কর।’ (সূরা তওবা, আয়াত: ৩৪-৩৫)


রাসূল সা. এরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা কোনো ব্যক্তিকে সম্পদ দান করার পর যদি সে যাকাত প্রদান করা হতে বিরত থাকে তা হলে কেয়ামতের দিন তার ওই সম্পদকে তার জন্য একটি লোমহীন বিষাক্ত সাপে পরিণত করা হবে। যার চক্ষুর ওপর দুইটি কালো দাগ থাকবে, কেয়ামতের দিন সাপটি তাকে পেছিয়ে ধরে দর্শন করতে থাকবে এবং বলবে আমি তোমার সম্পদ আমি তোমার সংরক্ষিত অর্থ। অতপর রাসূল সা. সূরা আলে ইমরানের ১৮০ নম্বর আয়াত পাঠ করেন অর্থাৎ যারা আল্লাহ তায়ালার দেয়া (ফজলে) সম্পদে কৃপণতা করে, তারা যেন মনে না করে যে ইহা তাদের জন্য উত্তম বরং ইহা তাদের জন্য মন্দ। অতি শীঘ্রই কিয়ামতের দিন তাদের গলায় পেচিয়ে দেওয়া হবে যা নিয়ে কৃপণতা করেছে। (বুখারী)


আবু বকর রা. যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন আল্লাহর কসম, তারা যদি আমাকে ওই উটের রশি দিতে ও অস্বীকার করে যার যাকাত তারা রাসূল সা. এর কাছে দিতো তাহলে আমি তাদের বিরুদ্ধে যাকাত অস্বীকার করার কারণে যুদ্ধ ঘোষণা করবো। (বুখারী ও মুসলিম)
যাকাত ওয়াজিব হওয়ার শর্ত: যাকাত ওয়াজিব হওয়ার কতিপয় শর্ত রয়েছে আর তা- হলো;
১. ব্যক্তিকে মুসলমান ও স্বাধীন হতে হবে
২. নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে
৩. সম্পদ এক বছর অতিক্রান্ত হতে হবে। এখানে চন্দ্রবছর (৩৫৪) দিন ধর্তব্য।


স্বর্ণ রৌপ্য ও নগদ টাকা-পয়সার যাকাত: এক. স্বর্ণের নেসাব হচ্ছে ২০ মিছকাল। বর্তমান হিসাবে সাড়ে সাত ভরি অর্থাৎ ৮৫ গ্রাম। দুই. রৌপ্যের নেসাব হচ্ছে দুইশত দেরহাম বর্তমান হিসাবে ৫২ তোলা। অতএব কারো নিকট যদি ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ বা ৫২ তোলা রৌপ্য অথবা দুটোর মধ্যে থেকে যে কোনো একটার সমপরিমাণ নগদ অর্থ (টাকা-পয়সা) এক বৎসর পর্যন্ত জমা থাকে এবং সে ঋণগ্রস্ত না হয় তাহলে তার ওপর শতকরা আড়াই টাকা হিসাবে অর্থাৎ চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দেয়া ওয়াজিব।


যাকাত বণ্টনের খাত: আল্লাহ তায়ালা কোরআনে করীমে যাকাত বন্টনের খাত বর্ণনা করেছেন আর এর সংখ্যা ৮টি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় সাদাকাত (যাকাত) শুধু ১. অভাবীদের জন্য, ২. নিঃসম্বল ব্যক্তিদের জন্য, ৩. যাকাত উসুলকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য, ৪. কোনো অমুসলিমকে ইসলামের প্রতি ভালবাসা পোষণ করে ইসলাম গ্রহণে অনুপ্রাণিত করার জন্য, ৫. দাসদের দাসত্ব মুক্ত করণে, ৬. ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ করার জন্য, ৭. আল্লাহর রাস্তায় (যারা লড়াই সংগ্রাম করে জেহাদ করে), ৮. (সাময়িক অভাবে পতিত) মুসাফিরদের জন্য। (সূরা তওবা, আয়াত, ৬০) আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে যাকাত প্রদান করার তৌফিক দান করুন।


যাকাতুল ফিতর বা ফেতরা: ইবনু উমর রা. এর বর্ণিত হাদিস অনুযায়ী ছোট, বড়, নারী, পুরুষ, স্বাধীন, দাস সকল মুসলমানের জন্য যাকাতুল ফিতর ওয়াজিব। তিনি বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বাধীন, দাস, পুরুষ, নারী, ছোট, বড় সকল মুসলমানের উপর এক ছা’ পরিমাণ খেজুর বা যব যাকাতুল ফিতর প্রদান করা ফরয করেছেন।’ (বুখারি: হাদিস নম্বর- ১৫০৪, মুসলিম: হাদিস নম্বর- ৯৮৪)


পরিমাণ: আবু সাইদ খুদুরী রা. বলেন, ‘‘আমরা যাকাতুল ফিতর হিসেবে এক ছা’ পরিমাণ খাবার, বা এক ছা’ পরিমাণ যব অথবা এক ছা’ পরিমাণ কিশমিশ প্রদান করতাম।” (বুখারি: হাদিস নম্বর- ১৫০৬, মুসলিম: হাদিস নম্বর- ৯৮৫)


ছা’ বলতে মদীনাবাসীর ছা’ বুঝতে হবে। ইবনু উমর রা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “ওজন করার সময় মক্কার ওজন ব্যবহৃত হবে; পরিমাপ যন্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে মদীনাবাসীর পরিমাপ-যন্ত্র ব্যবহৃত হবে।” (আবু দাউদ: হাদিস নম্বর- ৩৩৪০) বর্তমান সময়ে এর পরিমাণ দাড়ায় ৩ কেজির মতো। এক ছা’ সমান চার মুদ।


আদায়ের সময়: ইবনু আব্বাসের (রা.) হাদিস, তিনি বলেন, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোজাদারের থেকে ঘটে যাওয়া অশ্লিল ও বেহুদা কথা-কাজের পরিচ্ছন্নতা ও মিসকিনদের আহার স্বরূপ যাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন। যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে এটা আদায় করবে সেটি মাকবুল যাকাতে ফিতর হিসেবে গৃহীত হবে। আর যে ব্যক্তি এটি নামাজের পরে আদায় করবে সেটি সাদকাহ হিসেবে গণ্য হবে।” (আবু দাউদ: হাদিস নম্বর- ১৬০৯)
কোনো কোনো আলেম বলেন, মিসকিনদের সঙ্গে সঙ্গে যাকাত ব্যয়ের বাকি খাতগুলোতেও এটি ব্যয় করা যাবে। যাকাত ব্যয়ের বাকি খাতগুলো হল ফকির, যাদের মন জয় করা প্রয়োজন, ঋণগ্রস্ত, ক্রীতদাস মুক্তির জন্য, আল্লাহর পথে সংগ্রামের জন্য এবং মুসাফিরের জন্য।


মহান আল্লাহ আমাদেরকে যাকাত ভিত্তিক অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাকাত ও যাকাতুল ফিতর উত্তমভাবে সঠিক খাতে ব্যায় করার তাওফিক দান করুন। আমীন। লেখক: খতিব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর ০১।

(ঢাকাটাইমস/০৯এপ্রিল/এসআইএস)