উপন্যাস
রক্তপলাশের স্রোতে
প্রকাশ | ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৫৯ | আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:৪৮
মানুষ কি মানুষকে চেনে? জানে? এমনকি নিজেকে? মানুষ প্রকৃতপক্ষে নিজেকে চেনে না, জানেও না। কেবল নিজেকে চেনার ভান করে যায়। স্বামী স্ত্রী- দীর্ঘ চল্লিশ বছর পাশাপাশি এক বিছানায় শুয়ে, সংগম করে, সন্তান উৎপাদন করেও অনেক সময়ে একে অপরকে চেনে না। এক সময়ে মনে হয় স্ত্রীর- এই লোকটা আমার স্বামী? আমি তার স্ত্রী? আমরা এতদিন একসঙ্গে যাপন করেছি দিন ও রাত্রি? আমরা জন্ম দিয়েছি চার-চারটে সন্তান?
এটাই সত্য মানুষের পৃথিবীতে।
মানুষের নাতিদীর্ঘ জীবনে একজন পিতা ও দাদার নাম পর্যন্ত মাত্র জানে। দাদার পিতার নাম জানে খুব কম সংখ্যক মানুষ। তাহলে মানুষের বংশ-পরম্পরার দৌড় কতটুকু? এই সামান্য দৌড় নিয়ে মানুষের কত দৌড়াদৌড়ি, আস্ফালন আর চিটিংবাজি!
ইদানীং চিটিংবাজি তো নিদারুণ শিল্পকলায় পরিণত হয়েছে। মানুষ যে কতভাবে চিটিংবাজি করতে পারে, ধর্মের নামে, প্রেমের নামে, সম্পর্কের নামে, ধারের নামে, প্রতারণার নামে, বন্ধুত্বের নামে- এর কোনো শেষ নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কালে মানুষ হারিয়েছে সকল ধরনের মানবিকতাবোধ ও সম্পর্কের সরলরেখা।
রাস্তায়, অফিসে, আদালতে, দোকানে, আধুনিক বাহারী শপিংমলে, সুসজ্জিত বাসা-বাড়ির চারদেওয়ালের মধ্যে রঙিন মানুষগুলোর মধ্যে ভান ও ভনিতার খেলা দেখলে ও শুনলে মানুষ হিসেবে কান্না পায়। মানুষ মূলত বেঁচে থাকে ব্যর্থতায় ও কান্নায়। কান্না, মানে চোখের জলের চেয়ে পবিত্র ও সুন্দর কোনো মায়া নেই এই মাটি মাখা দুনিয়ায়! আবার মানুষ বিদ্রুপ করে মানুষের সুন্দরের সাধনায়, ঘৃণা করে সুন্দরের শিল্পকলায়- নাটকে-গানে, সিনেমায়-গল্পে-উপন্যাসে, কবিতায়-নৃত্যে ও চৌষট্টিকলায়।
আপনি দৌড়াচ্ছেন? একজনকে দেখে প্রশ্ন করে।
দেখতে পাচ্ছেন না, আমি দৌড়াচ্ছি। আবার প্রশ্ন করেন কেন?
সত্যি আপনি দৌড়াচ্ছেন?
না।
তাহলে কী করছেন?
কাঁদছি।
কাঁদছেন?
হ্যাঁ কাদছি, দেখছেন না?
দেখছি তো, আপনি তো দৌড়াচ্ছেন- কাঁদছেন, হাসছেন...
আপনি সব দেখতে পাচ্ছেন?
না, দেখছি না।
দেখছেন না?
না।
তাহলে এসব বলছেন কী করে?
কী বলছি আপনাকে?
আপনি দৌড়াচ্ছেন, কাঁদছেন, হাসছেন... সবই বলছেন।
বলছি?
হ্যাঁ, বলছেন তো।
কীভাবে সম্ভব? আমি তো অন্ধ। চোখে দেখতে পাই না হাজার বছর ধরে...
মানুষ এভাবেই গাঁথে রক্তপলাশের সম্পর্ক!
হ্যালো?
বস্ বলছেন?
হ্যাঁ। খবর কী?
কাজ শেষ।
সত্যি।
হ্যাঁ বস্। তিন তিনটি গুলি একবারে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছি। লোকটার পায়জামা সাদা শার্ট মুহূর্তে রঙিন- যাকে বলে রক্তলাল-আর কি?
লোকটা মারা গেছে- এ ব্যাপারে তুমি কি নিশ্চিত?
জ্বী। ফোনের ওপাশে খুনি লোকটা একটু বিরক্ত। সে বলে- বস্ লোকটা সবেমাত্র তার গাড়ি থেকে বের হয়ে অফিসের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়েছে, আমি গেটের পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলাম- লোকটা গাড়ির ড্রাইভারকে কী যেন বলল সামান্য নুয়ে, সোজা হয়ে দাঁড়াতেই মাত্র পাঁচ-ছয় হাতের দূরত্ব থেকে বুকের মধ্যে কালো সিসা ঢুকিয়ে দিয়েছি পরম যত্নের সঙ্গে, বুঝলেন বস্, লোকটা, যে আপনার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু, একটি শব্দ উচ্চারণ করার সময় পায় নাই। ধরাম করে মাটিতে আছড়েপড়া দেখেই- আমি পাশে স্ট্রার্ট করা বেবিটেক্সিতে উঠি এবং অনেক রাস্তা ঘুরে, সাত ঘাটের পানি খেয়ে আস্তানায় এসেছি। এসেই আমি আমার লোক পাঠিয়েছি অবস্থা রেকি করার জন্য। আমার লোক আমাকে কিছুক্ষণ আগে, ফোনে কনফার্ম করেছে বস্-
কী কনফার্ম করেছে?
আপনার বন্ধু কিশওয়ার আলি মারা গেছে, হাসপাতালে নেয়ার পথে, এ্যাম্বুলেন্সে। মৃত্যুর সময় পাশে আপনজন কেউ ছিল না। বলতে পারেনি কোনো অন্তিম কথা। আর বলবে কী করে- কিশওয়ার আলি মৃত্যুর জন্য তো প্রস্তুত ছিল না। আর হ্যাঁ স্যার, আপনার বন্ধু কিশওয়ার আলি পানিও খেতে পারেনি-
রমেশ?
বস্।
তুই আর আগামী তিন মাসে আমার সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ রাখবি না।
রাখব না।
তিন মাস পর তোর ব্যাংক এ্যাকাউন্টে জমা হবে-
যদি জমা না হয়?
কামরুল ইসলামের কথা কখনো নড়চড় হয় না।
ঠিক আছে বস্। তবে নড়চড় হলে আমার কোনো অসুবিধা নাই। আমি ঠিকই আদায় করব। বিপদে পড়বেন বস্ আপনি-
রমেশ?
বস্।
তুই কি আমায় ভয় দেখাচ্ছিস?
না বস্। পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দিছি মাত্র। বেয়াদবি হলে মাফ করে দেবেন। আপনাদের সঙ্গে টেক্কা দেয়া কঠিন বস্। রাখি-
রমেশ ফোন কেটে দিয়ে টেবিলের উপর পা দুটা তোলে। প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে আগুন ধরায় এবং ছোট্ট ঘরটার মধ্যে একের পর এক ধোঁয়ার মায়াবী রিং বানিয়ে মাথার উপর ছাড়ে। সিগারেটের ধোঁয়ার রিংটা অজানা বিষধর সাপের মতো একেবেঁকে উপরে উঠতে থাকে। উঠতে উঠতে ধাক্কা খায় ছাদে। রিংটা গলে গলে কোথায় যেন হারিয়ে যেতে থাকে এবং যেতে যেতে এক সময়ে আর দেখতে পায় না রমেশ।
রমেশ ভাবলেশহীন চোখে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করে নিজেকে, অনেকটা নাটকীয় ঢংয়ে- শালার ধোঁয়ার রিংটা গেল কোথায়?
সকাল ন’টা থেকে কামরুল ইসলামের টেনশনে মেরুদণ্ড সোজা ছিল। অফিসে, নিজের চেয়ারে বসে এক মুহূর্তের জন্যও স্থির থাকতে পারেনি। মুখে যতটা নিজেকে স্থির রাখার ভান করেছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে উত্তপ্ত কড়াইয়ে কাটা মাছের মতো ছটফট করছিল সে। কাল অর্থাৎ গতকাল রাতে রমেশের হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকার বান্ডিলটা ধরিয়ে দিয়ে নিজেকে অনেকটা হালকা ভেবেছিল। আগামীকাল, দুপুর বারোটানাগাদ পথের কাঁটা ধুলোয় মিশে যাবে। তারপর? বিজয়ের নিশান উড়িয়ে আপন নাগরদোলায় দুলতে থাকবে।
শালা রমেশ ব্যাটা প্রথমে রাজি হতে চায়নি। ওকে জোগাড় করে দিয়েছে এক বন্ধু। কথা প্রসঙ্গে কামরুল বলেছিল- আচ্ছা, এই শহরে প্রতিদিন, প্রতি রাতে এত খুন হয়- কারা করে?
কেন? তাতে তোর কী?
না। এমনি জানতে চাইছি-
কাউকে খুন করতে চাস নাকি?
যাহ্। কী বলছিস পাগলের মতো? আমি খুন করাতে যাব কেন?
বন্ধু, পথের বাঁকে কখন কাকে প্রয়োজন, কেউ বলতে পারে না। একটা ফোন নম্বর রাখ- কামরুলের বন্ধুটি টেলিফোন নম্বর ডাইরিতে লিখে বলেছিল- লোকটার নাম রমেশ ভাণ্ডারী। ভাড়াটে খুনি। জীবনে এ পর্যন্ত ত্রিশটি খুন করেছে। পুলিশ কোনো সাক্ষী প্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি আজ পর্যন্ত। আর কাজ করে নিজে। অনেক ভেবে-চিন্তে কাজ করে। তবে ও এক কথায় খুনি। তোর কাছ থেকে টাকা নিয়ে যদি বলে সে খুন করবে, করবেই। এমনকি তুই টাকা দিয়ে যদি বলিস তোকে খুন করতে, রমেশ ভাণ্ডারী রাজি হলে, অবশ্যই করবে। তবে-
তবে কী?
ওর সঙ্গে বিট্রে করলে কপালে খারাবি আছে।
তুই এতকথা আমাকে বলছিস কেন?
রমেশকে যদি তোর কোনো কাজে লাগে?
না বাবা। ওর কথা শুনেই ভয় লাগছে আমার। ওকে আমার কাজে লাগাতে যাব কোন সাহসে?
ভয়ের কিছু নেই। রমেশ, রমেশ ভাণ্ডারী মানুষ হিসেবে কিন্তু চমৎকার। আড্ডাবাজ, তুখোড় গাল্পিক। বিবাহিত। তিনটি সন্তানের জনক। বৌ-ছেলেমেয়েকে দারুণ ভালোবাসে। বাচ্চাদের কারো অসুখ হলে রমেশ ভাণ্ডারী বাসা থেকে বের হয় না। সবসময় বাচ্চাদের পাশে থাকে। সেবা করে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। খুন করা হচ্ছে ওর পেশা। বছরে ঠাণ্ডা মাথায়, দীর্ঘদিন ভেবে, পরিকল্পনা করে সে খুন করে। ধর, প্রতি খুনে সে তিন লাখ টাকা পায়, তিনটে খুন করলে নয় লাখ। চারজন মানুষের ছোটোখাটো একটা সংসার চালানোর মতো- যথেষ্ট, নয়?
ঠিক।
তাছাড়া রমেশের আরো যুক্তি আছে-
খুন করার জন্য যুক্তি?
কেন নয়? ভালো মন্দ সবকিছুর পেছনে একটা না একটা যুক্তি থাকে। ওর যুক্তি হলো- যদি সে খুন না করে, অন্য কেউ নিশ্চয়ই করবে। তাহলে? ওর করতে দোষ কোথায়? যে খুন করায় তার নিশ্চয়ই ভীষণ উপকার হয়-
বন্ধুটিকে কামরুল ইসলাম ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। হাসতে হাসতে চলে যায় বন্ধুটি। চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে সে, নিজের চেয়ারে, নিজের অফিসে। ইনডেন্টিং ফার্ম তার। জাপান থেকে আনা তিন-চারটি মেশিনারি ইকুইপমেন্ট এদেশে মোটামুটি চলছে। গাজীপুরে একটা প্লাস্টিক কারখানা স্থাপন করেছে। মাথায় আরো কিছু ইন্ডাস্ট্রি করার পরিকল্পনা তার আছে। মতিঝিলে একটি সুউচ্চ টাওয়ারের পাঁচ তলায় তার অফিস। সামাজিকভাবেও সে প্রতিষ্ঠিত। বন্ধু কিশওয়ার আলির সহযোগিতায় ব্যবসায় ফুলে ফেঁপে উঠছে। তার ফুলে ফেঁপে ওঠার ব্যাপারটি নষ্ট রাজনীতির কোকিল রাজনীতিবিদদের কয়েকজনের নেক নজরে এসেছে। নিট ফলাফল কামরুল ইসলাম এখন রাঘব বোয়ালের পিঠে এক চমৎকার সওয়ারি।
সবকিছুর পেছনে বন্ধু কিশওয়ার আলির যথেষ্ট অবদান। কামরুল সময় সুযোগ পেয়ে বন্ধুকৃত করতে পিছপা হয় না। গেলাসে ঠোঁট ভিজিয়ে, সিগারেটের ছাই ঝাড়তে-ঝাড়তে, কারণে-অকারণে ব্যাকরণ মেনে অথবা না মেনে কিশওয়ার আলির বদান্যতাকে স্বীকার করে। পরিচিত সকল, আত্মীয়-পরিজন, এমনকি দু’জনার ছেলে মেয়ে স্ত্রী’রা পর্যন্ত কিশওয়ার আলি ও কামরুলের বন্ধুত্বকে উপহাস করে থাকে। অপরের উপহাস দু’জনে, কিশওয়ার আলি এবং কামরুল ইসলাম হেসে উড়িয়ে দেয়, কখনো কখনো উপভোগও করে। সেই কামরুল কেন, বন্ধু কিশওয়ার আলিকে হত্যা করার জন্য তুখোড় অব্যর্থ এক ভাড়াতে খুনি রমেশ ভাণ্ডারীকে নিয়োগ করেÑ পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে?
টাকা-পয়সা কি দু’জনার মধ্যে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেছিল? নাকি রাজনৈতিক প্রভাব ছড়াতে গিয়ে কিশওয়ার আলির কাছে হেরে গিয়েছিল কামরুল ইসলাম? নাকি আন্ডারওয়ার্ল্ডের লেনদেন করতে গিয়ে দু’জন দু’জনের শত্রুতে পরিণত হচ্ছিল? কারণটা কী?
এই কারণটা রমেশ ভাণ্ডারীও জানতে চেয়েছিল। রমেশ ভাণ্ডারী পেশাদার খুনি। শিল্পের নিপুণ সৌকর্যে সে প্রতিটি খুন পুরোপুরিভাবে সম্পন্ন করে নিখুঁতভাবে। সে মানুষ খুন করাটাকে রীতিমতো উপভোগ করে। খুন করেই সে আনন্দ পায়। কারণ জানতে চায় না। পেশাদার খুনির সেটা জানার প্রসঙ্গও নয়। কিন্তু যখন কামরুল ইসলাম তার মতিঝিলের অফিসে ডেকে, রাত দশটায় খুন করতে বলল- চমকে উঠেছিল রমেশ ভাণ্ডারী।
বন্ধুটি রমেশ ভাণ্ডারীর টেলিফোন নম্বরটা রেখে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কামরুল ইসলাম অনেকক্ষণ নম্বরটার দিকে তাকিয়ে থাকল। ঘটনাটা কী? বন্ধু কায়সার মাহমুদ কীভাবে জানল- গত কয়েকদিন ধরে সে একজন খুনিকে খুঁজছে? কীভাবে জানল? নাকি ব্যাপারটা কাকতালীয় কোনো উপাখ্যান? রমেশ ভাণ্ডারীর গাল-গল্প অনেক শুনেছে সে। পুলিশ বেশ কয়েকবার তাকে গ্রেফতার করেছে, কোর্টে চালান দিয়েছে- কিন্তু কয়েকদিন পর রমেশ ভাণ্ডারী রাজহাঁসের মতো বেরিয়ে এসেছে। কেউ আটকাতে পারেনি। সাাক্ষী প্রমাণের অভাবে আদালত তাকে খালাস দিতে বাধ্য হয়েছে। সাংবাদিকেরা পত্র-পত্রিকায় রমেশ ভাণ্ডারীকে নিয়ে অনেক অনেক এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তারপরও সে এক অসামান্য রাজহাঁস। জলে শরীর ডুবিয়ে গোসল করে রমেশ ভাণ্ডারী- কিন্তু শরীরের পালকে একফোটা পানিও পাওয়া যায় না।
সেই রমেশ ভাণ্ডারীর টেলিফোন নম্বর কোন কায়সার মাহমুদ রেখে গেল তার টেবিলে, ডাইরির ছেঁড়া পাতায়? দীর্ঘদিনের চেনা, ইউনিভার্সিটির বন্ধু, কায়সার মাহমুদ কি কোনো গোপন ফাঁদ পেতেছে তাকে বধ করবার জন্য? কোনো নিখাদ নির্জন ষড়যন্ত্র? টেলিফোন নম্বরটি কি ছিঁড়ে ফেলবে? কামরুল ইসলাম ভাবতে ভাবতে আনমনে টেলিফোন নম্বরটি মুখস্থ করে ফেলে। নম্বরটিও মনে রাখার জন্য চমৎকার। প্রথমে একটি অঙ্ক, তারপর তিনটি শূন্য। আশ্চর্য- শেষের তিনটি অঙ্ক প্রথম অঙ্কটি। মনে রাখার জন্য খুব সহজ। বলা যায় না- ভুলে যেতে পারে, ভেবে- কামরুল ইসলাম টেলিফোন ইনডেক্সে সাংকেতিক নামে ও অঙ্কে নম্বরটি লিখে রাখে। যেদিন থেকে নম্বরটি লিখে রাখল এবং মুখস্থ করল সেদিন, সেই মুহূর্ত থেকে অকারণে, অপ্রয়োজনে নম্বরটি আক্ষরিক অর্থে তাকে ডাকতে থাকে হাতছানি দিয়ে। দুর্বোধ্য, অসহায় এক বিপন্ন যন্ত্রণার বাজপাখি বাসা বাঁধে কামরুল ইসলামের মানসভূমিতে, ভোগ-উপভোগের চৈতন্যে।
তার অফিসে প্রতি বৃহস্পতিবার, দুপুর বারোটার দীপালির ফোন আসে। দীপালি- এটা আসল নাম নয়। তাদের ফোনের সুবিধার্থে, যোগাযোগটাকে নির্বিঘ্ন রাখার জন্য দীপালি নামটা দিয়েছে কামরুল ইসলাম। কাকতালীয় হলেও সত্য কায়সার মাহমুদ যেদিন ফোন নম্বর দেয়, সেদিনও ছিল বৃহস্পতিবার। কামরুল ইসলাম বসে আছে সামনে রমেশ ভাণ্ডারীর টেলিফোন নম্বর নিয়ে। ফোন আসে দীপালির।
হ্যালো?
আমি দীপালি।
কেমন আছো?
দীপালি, টেলিফোনের ওপাশে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে- আমায় বাঁচাও।
কী হয়েছে? উদ্বিগ্ন কণ্ঠ কামরুলের!
আমি আর পারছি না। গতরাতে আমাকে মেরে ডান হাতের বুড়ো আঙুল জখম করে দিয়েছে। রক্ত ঝরছে, ব্যথায়-
ডাক্তারের কাছে যাওনি?
না।
কেন?
আমাকে আর কোনোদিন ডাক্তার দেখাবে না। এইভাবে, আস্তে আস্তে আমাকে মেরে ফেলবে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আমাকে এই রাক্ষসটার হাত থেকে বাঁচাও-
একটু ধৈর্য ধর লক্ষ্মীসোনা। তোমাকে চিরকালের জন্য উদ্ধার করে নিয়ে আসব আমার কাছে- অভয় দেয় কামরুল।
সতি?
কামরুল ইসলাম কখনো বাজে কথা বলে না। দীপু, দীপালি?
বল।
তোমার ছেলে-মেয়েরা কোথায়?
রানুকা স্কুলে, অর্নব খেলছে, বারান্দায়।
তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে দীপু।
কেন? বউকে দেখে সাধ মেটে না?
রাখো বউ। বল, কবে দেখা হবে? কখন?
আমার স্বামী জানতে পারলে তোমাকে কচুকাটা করবে। লোকটা খুব ভালোবাসে আমাকে- হাসে দীপালি।
সেই অমৃত ভালোবাসার জন্যই তোমাকে নির্যাতন করে বুঝি? রক্তাক্ত করে?
কথাটা ঠিকই বলেছ। এর নাম রক্তাক্ত ভালোবাসা।
চমকে ওঠে কামরুল ইসলাম- কী বলছ তুমি?
সত্যি বলছি। ধরো, তুমি যদি কোনোভাবে জানতে পারো তোমার বউ তোমার খেয়ে, তোমার অলংকার পরে, গাড়িতে চড়ে, অন্যের সঙ্গে ইয়ে করে বেড়ায় তুমি তাকে কী করবে?
খুন। স্রেফ খুন করব- হিস-হিস করে বলে কামরুল ইসলাম।
চমৎকার জলতরঙ্গ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে দীপালি- টেলিফোনের অপর প্রান্তে। হাসির ঢেউয়ে কামরুল ইসলাম সমুদ্রের ঝড়ে দিকভ্রান্ত নাবিকের মতো তোতলায়- হাসছো কেন? হাসির কী বলছি?
হাসি থামায় দীপালি- নিজের বউকে খুন করবে আর অপরের বউয়ের সঙ্গে লুটোলুটি খাবে, গাল টিপবে, চুমু খাবে, অভিসারে যাবে-
কী করব বলো- আমি তো এসব চাইনি- কৈফিয়তের সুরে বলে কামরুল ইসলাম। তুমিই তো আমায় সর্বনাশের সফেন সমুদ্রে টেনে নামালে।
আঁতকে ওঠে দীপালি- আমি নামিয়েছি?
ইয়েস। তুমি! আমাকে নিয়ে এখন ঠাট্টা করো-
না গো তৈমুর লঙ্গ। দীপালির কণ্ঠে আবেগের সাম্পান- তুমি আছো বলে আমি বেঁচে আছি। নইলে?
কী?
মরে যেতাম, হারিয়ে যেতাম নক্ষত্রলোকের দেশে। তোমাকে নিয়ে ঠাট্টা করব কেন?
আচ্ছা, বল কবে দেখা হচ্ছে-
দেখা হওয়া কি খুবই দরকার?
দীপালি, তুমি বুঝতে পারছ না- কী অবিরাম ফাঁসির দড়িতে আমি ঝুলছি- কেবল তোমার জন্য। এই মধ্যবয়সে এসে, তোমার জন্য বুকটার মধ্যে এক অসম্ভব আগুনের বাণ ডাকছে। দীপালি আমাকে পোড়াও, কিন্তু ছাইয়ে পরিণত করো না, প্লিজ।
তৈমুর! সত্যিই তুমি আমার ইতিহাসের তৈমুর লঙ্গ। আমার মুমূর্ষু সময়ে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলে বাঁচার প্রেরণা পাই। মনে হয় এখনো আমাকে কেউ কামনা করে, কেউ আমার অপেক্ষায় থাকে আন্তরিক অগ্নিতে ভালোবেসে। অন্তত একজন মানুষ, একজন সুদর্শন পুরুষ আমার সঙ্গ পাওয়ার জন্য বাঘের ক্ষুধায় ব্যাকুল অপেক্ষায় থাকে- আমি নারী হিসেবে, মানুষ হিসেবে এখনো নিঃশেষ হয়ে যাইনি- একটানা কথা বলে যায় দীপালি।
তোমার স্বামী, আমার প্রিয় বন্ধুর দুর্ভাগ্য যে- সে তোমার মতো নারীকে সন্দেহ করে, পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি তোমার উপর। তুমি যদি আমার স্ত্রী হতে-
থামলে কেন?
তোমার জীবন আমি কানায়-কানায় ভরে দিতাম-
নিজের স্ত্রীকে কতটুকু দিয়েছ? তৈমুর লঙ্গ!
ঠাট্টা সবসময় ভালো লাগে না দীপালি। কণ্ঠে অনেকটা অনুযোগ কামরুল ইসলামের- আমি মধ্যবয়সে তোমার ডানার নিচে এসে অসহায় পাখির ছানার মতো আশ্রয় চাইছি। প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে ভাঙা-গড়া উত্থান-পতন আছে। বল আছে না?
তা আছে- স্বীকার করে দীপালি। দেখ তৈমুর- তোমাকে কয়েকটা কথা বলা দরকার।
বল।
আমার এক বিমূর্ত বেদনাক্রান্ত সময়ে হঠাৎ তুমি এসে দাঁড়ালে সামনে, সাহসের হাত বাড়ালে- আমিও একটা জায়গা পেলাম। আমরা দু’জনেই জানি এক নিষিদ্ধ কিন্তু অসম্ভব আকর্ষণীয় সম্পর্কের সেতুতে যাতায়াত করছি। একদিন না একদিন এই সেতু ভেঙে পড়বে। কারণ এই সেতু কৃত্রিম।
না। মৌলিক সম্পর্ক-
তর্কে এখন যাব না। কারণ নিচে গাড়ির শব্দ পেয়েছি। হয়েতো অর্নবের বাবা এসেছে।
দেখা কবে হবে?
হবে, আমি ফোনে জানাব, পরে। আজ রাখি লক্ষ্মীটি- দীপালি ফোন রাখে।
কামরুল ইসলাম অসহায় আক্রোশে নিজের হাতে ধরা রিসিভারটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার শরীর উত্তেজনায়, নিস্তব্ধতায়, কামুক আবেগে কাঁপে। এক সোনালি মুহূর্তে অর্নবের বাবা এসে হাজির। কতদিন দীপালির হাতের স্পর্শ পায় না। হাজার বছরের তৃষ্ণা কামরুল ইসলামের কণ্ঠে ঝুমুর তালে নাচতে থাকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস কক্ষে। না, এভাবে জীবনের এই নাটক, চলতে পারে না। অবশ্যই এর সমাধান হওয়া দরকার। অজস্র পিঁপড়ার কামড় অনুভব করে কামরুল ইসলাম তার শরীরে, অস্তিত্বে। চেয়ার ছেড়ে সে উঠে পায়চারি করতে থাকে কক্ষের মধ্যে। কতদিন অপেক্ষার দড়িতে ঝুলতে হবে তাকে, এভাবে?
টেলিফোনটা বেজে যাচ্ছে, এক নাগাড়ে, অনেকক্ষণ। কপালে বিরক্তির রেখা ফোটে কামরুল ইসলামের। রমেশ ভাণ্ডারী নামের একজন নিপুণ খুনি কি এই নাম্বারে থাকে না? থাকলে নিশ্চয়ই ফোন ধরত। অথবা তার সঙ্গে ইয়ার্কি করেছে বন্ধু কায়সার। মনে মনে বিরক্তিতে যখন তিক্ততার স্বাদ নিয়ে ফোনটি রাখতে যাবে- তখন, ঠিক সেই মুহূর্তে কেউ একজন ওপাশ থেকে রিসিভারটি তুলল। উত্তেজনায় বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় কামরুল ইসলাম।
হ্যালো- উত্তেজিত কণ্ঠে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় সে উচ্চারণ করে।
কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।
অপেক্ষায় থাকে। কয়েক সেকেন্ড পার হয়ে যাবার পর কামরুল ইসলাম আবার বলে- হ্যালো?
অপর প্রান্ত থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসে। এবার নিজের উপর কামরুল ইসলামের একটু রাগ হয়। সেকি কোনো লুকোচুরি খেলায় অংশ নিচ্ছে!
হ্যালো? কথা বলছেন না কেন?
না, এবারও কোনো সাড়া পায় না কামরুল ইসলাম।
ঠিক আছে আমি ফোন রাখলাম। একটা ব্যবসা সংক্রান্ত চুক্তিতে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সাড়া-শব্দ না পেলে আমি কী আর করতে পারি?
কে বলছেন আপনি? সাড়া মিলল ওপাশের প্রান্ত থেকে। কণ্ঠটা চেনা অথবা অচেনা দুটোই মনে হচ্ছে তার। সে কি উত্তর দেবে- বুঝতে পারে না। কিছুটা সময় নেয়।
আমি রমেশ ভাণ্ডারীর সঙ্গে কথা বলতে চাই- বলে কামরুল ইসলাম।
কে বলছেন আপনি? আবারও তিনটি শব্দ। দুই খণ্ড বিরাট পাথরের মাঝে চাপা খেয়ে আর্তনাদ করলে যে প্রতিধ্বনি ওঠে- কণ্ঠস্বর অনেকটা ওই রকম, চাপা, আর্তনাদে পূর্ণ, ভয়ার্ত। কামরুলের কণ্ঠ শুকিয়ে কাঠ। এই কণ্ঠটাই তাকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে।
আমি কামরুল ইসলাম।
কী ইসলাম?
কামরুল ইসলাম।
কোত্থেকে বলছেন?
মিরপুর। ইচ্ছে করেই মিথ্যা বলে সে মতিঝিলের অফিসে বসে।
মিরপুর অনেক বড়ো জায়গা, নির্দিষ্ট করে বলুন-
মিরপুরের তেরো নম্বর থেকে।
আপনি কাকে চান?
রমেশ ভাণ্ডারীকে।
এই টেলিফোন নম্বর কীভাবে পেলেন?
আমার এক বন্ধু দিয়েছে।
কী নাম তার?
কামরুল ইসলাম দোটানায় পড়ে? নাম বলাটা কি ঠিক হবে? তাছাড়া সে কার সঙ্গে কথা বলছে? ফোনের অপর প্রান্তে যে লোকটা আছে, সেই লোকটাই কি রমেশ ভাণ্ডারী? নাকি অন্য কেউ?
কথা বলছে না কোনো। লোকটা রীতিমতো ধমক দিচ্ছে।
কায়সার।
পুরো নাম বলুন।
কায়সার মাহমুদ।
পুরোনো ঢাকার মানুষ?
হ্যাঁ।
কোন ব্যান্ডের সিগারেট খায় সে?
সিগারেট ব্যান্ডের নাম বলে কামরুল ইসলাম।
আমি কার সঙ্গে কথা বলছি- সেটা জানতে চাই আগে।
আপনি যদি ব্যবসা করতে চান, তাহলে এসব কৌতূহল থাকলে চলবে না। কারণ- প্রকাশ্যে আমরা প্রকাশ হই খুবই কম। বলুন কামরুল সাহেব, আপনার ব্যবসাটা কেমন?
না মানে- তোতলায় কামরুল ইসলাম।
আপনি ঘাবড়াচ্ছেন কেন? যেন টেলিফোনের ঐ প্রান্তের লোকটি ঈশ্বর। তাকে অভয় দিচ্ছে। আপনি তো জানেন- আমরা কি নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করে থাকি। এবং আপনি সেটা জেনেই তো ফোন করেছেন নাকি?
অবশ্যই।
তাহলে বলুন, আপনি যার মাথাটা ব্যবসা করতে চান- তার ঠিকানাটা-
তার আগে-
আগে ঠিকানাটা বলুন। ব্যবসায় চুক্তি করার আগেই যাচাই-বাছাই করে, আপনাকে জানাব আপনার দেওয়া ব্যবসাটা আমরা করব কি, করব না? বলুন- নাম কি তার?
কিশওয়ার আলি-
বাসা?
মোহাম্মদপুর।
বাড়ির ঠিকানা?
তাজমহল রোড, ১০/১০ নম্বর বাড়ি।
পুরো বিবরণ দিন।
কয়েক মুহূর্ত পার হয় কামরুল ইসলামের। বাঘের গুহায় পা বাড়িয়ে দিয়েছে, এখন আর ফিরে আসার সুযোগ নেই। তাছাড়া সে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে অনেক, অনেকবার ভেবেছে। এছাড়া তার সামনে আপাতত কোনো উপায় নেই। কিশওয়ার আলিকে বাঁচতে দেওয়া যাবে না। সে বাঁচলে, বেঁচে থাকলে কামরুল ইসলামের জীবন অপূর্ণ থেকে যাবে। জগতের এটাই নিয়ম- প্রতিপক্ষকে কখনো সুযোগ দিতে নেই। সুযোগ দিলে, কিংবা বিশ্বাস করলে প্রতিপক্ষ তাকে ঘায়েল করবেই। সুতরাং কোনো দ্বিধা নয়। নয় কোনো দ্বন্দ্ব। তাছাড়া সে নিজের হাতে কাজটা করছে না। কাজটা করছে বায়বীয় এক আততায়ী তার নিপুণ কারুকার্যময় চাতুর্যে। যেখানে থাকবে না কোনো প্রমাণ। মনে হবে বাজপাখির মতো কেউ আকাশ থেকে এসে কিশওয়ার আলির প্রিয় প্রাণটা নিয়ে অচেনা জগতে নিমেষে পালিয়ে গেছে।
দেখুন, আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চাইলে এত ভাবনা চলবে না। ওপাশের কণ্ঠস্বর অসহিষ্ণু- বললে বলুন, নইলে ফোন রাখলাম।
বলছি।
হ্যাঁ, দিন বাড়ির সম্পূর্ণ বিবরণ।
তাজমহল রোডের একেবারে শেষের বাড়িটা কিশওয়ার আলির, লাল সিরামিকের চারতলা বাড়ি। কিশওয়ার আলি থাকে তিনতলায়। হ্যাঁ- অবশ্যই সপরিবারে।
কে কে আছে তার?
একটি মেয়ে, একটি ছেলে। এবং-
এবং?
তার স্ত্রী।
কয় নম্বর স্ত্রী এটি?
না, না। কিশওয়ার আলির একমাত্র স্ত্রী। লম্বা, গায়ের রঙ উজ্জ্বল ফরসা- আমরা কোনো স্ত্রীলোক শিকার করি না। সুতরাং তার বিবরণ থাক-
আচ্ছা। আর কিছু প্রয়োজন?
হ্যাঁ।
কী বলুন- কথা বলতে বলতে কামরুল ইসলাম অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সে মামুলী একটা কিংবা আর পাঁচটা ব্যবসার মতো প্রতিপক্ষের সঙ্গে অথবা ক্লায়েন্টের সঙ্গে আলাপ করছে ব্যাপারটা এমন। কত টাকা বিনিয়োগ করলে কত টাকা নিট লাভ হবে- তারই চুলচেরা হিসেব-নিকেশ চলছে।
তার অর্থাৎ শিকারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা অফিস কোথায়?
মতিঝিলে।
ঠিকানা?
শাপলা চত্বর থেকে ডানে, বিশতলা বিল্ডিংটার এগারো তলায়। অফিসের নাম-
হ্যাঁ বলুন।
ফ্রেন্ডস ইন্টারন্যাশনাল।
সে কখন অফিসে আসে?
ঠিক নেই। বাইরে ওর বেশ কয়েকটা কারখানা আছে, সেসব দেখে-টেখে আসে, তবে প্রতিদিন বারোটা থেকে একটা নাগাদ ওর গাড়ি অফিসের সামনে পৌঁছে।
গাড়ির রঙ?
সাদা।
নম্বর?
ঠিক মনে করতে পারছি না।
ঠিক আছে- আর কিছু প্রয়োজন নেই। রাখি- কাজটা করলে আমরাই যোগাযোগ করব আপনার সঙ্গে।
আর যোগাযোগ না করলে-
বুঝতে হবে, আমরা কাজটা করব না।
কতদিনের মধ্যে জানতে পারব?
আজ থেকে সাত দিন সাত রাতের মধ্যে।
কিন্তু-
কিন্তু কী?
আমার পরিচয়, আমার উদ্দেশ্য সব আপনারা জেনে গেছেন। এখন যদি কোনো বিপদ হয় আমার?
বজ্রপাতের মতো হাসির শব্দ শুনতে পায় কামরুল ইসলাম- হাসি শেষে লোকটা বলে- প্রতিটি ব্যবসার একটা আইডোলজি থাকে- আমাদের আইডোলজি হলো- ক্লায়েন্টের স্বার্থ দেখা। আমরা আপনার কাজ করি আর না করি- আপনার স্বার্থ গোপন রাখাই আমাদের ব্যবসার প্রধান বৈশিষ্ট্য। আশা করি- নিশ্চিত হয়েছেন!
তা হয়েছি।
আর হ্যাঁ- ওপাশ থেকে আদেশের কণ্ঠস্বরÑ আপনি আর কখনো যোগাযোগ করবেন না।
ফোন রাখার শব্দ পায় কামরুল ইসলাম। সে বোকার মতো নিজের হাতে ধরা টেলিফোনের রিসিভারটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই রিসিভার কত অজানা গোপন ঘটনার সাক্ষী- যদি একবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে সে বলতে শুরু করে- কামরুল ইসলাম ঘামতে থাকে। এয়ারকুলারের মধ্যে বসে সে ঘামে। কাজটা কি সে শেষ পর্যন্ত ঠিক করল? রমেশ ভাণ্ডারীর লোক কি যোগাযোগ করবে? নাকি টেলিফোনের সব কথা টেপ করে পৌঁছে দেবে কিশওয়ার আলির কাছে। কে কথা বলল? রমেশ ভাণ্ডারী নিজে? নাকি ওর অন্য কোনো লোক? কথাবার্তায় কিছু বোঝা গেল না।
কামরুল ইসলামের মধ্যে একটা শূন্যতা দানাবাঁধতে থাকে অস্থির গতিতে। সে কি একবার কিশওয়ারকে ফোন করবে?
সে কিশওয়ার আলিকে ফোন করে অফিসে। পাওয়া গেল। কামরুল ইসলামের কণ্ঠস্বর খুশি হলো- কিশওয়ার।
কেমন আছ দোস্ত- গমগমে কণ্ঠ কিশওয়ার আলির।
ভালো। কী করছ?
আমার টেবিলের সামনে একটা পার্টি আছে, নেপালের। তাদের সঙ্গে কথা বলছি।
নেপালের পার্টি। কোনো ব্যবসা-
তা না হলে সময় নষ্ট করে কথা বলব কেন? কামরুল?
বল।
নেপালে যাবি?
হঠাৎ নেপালে কেন?
ওরা নিয়ে যেতে চায়। অবশ্য ব্যবসার প্রয়োজন নেই।
ব্যবসাটা কী?
নেপালের একটা সিমেন্টের ফ্যাক্টরি তৈরি করব। ওরা দেবে কাঁচামাল- আমি দেবো যন্ত্র-যন্ত্রাংশ-
যাবি কবে?
আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে। যাবি নাকি?
কামরুল ইসলাম নিজেকে একটু বিশ্লেষণ করে জানায়- না দোস্ত, আমার একান্ত কিছু কাজ আছে। তুই একবার ঘুরে আয়Ñ পরের বারে যাব-
ঠিক আছে। আজ সন্ধ্যায় আসবি নাকি?
কোথায়?
প্লাটফরমে।
কামরুল ইসলাম সামান্য ভাবে এবং সম্মতি জানায়- আসব। নতুন কিছু আছে নাকি?
নাহ্। এমনি- কিশওয়ার আলির কণ্ঠ স্বাভাবিক।
আচ্ছা আসব। ছাড়ি।
টেলিফোন ছেড়ে দেয় কামরুল ইসলাম। ফোনে কিশওয়ার আলির সঙ্গে কথা বলায় সে একটু শান্ত হয়- মানসিকভাবে। যাবে সে প্লাটফরমে। প্লাটফরম মানে- বার। লোকজনের সামনে নামটা সরাসরি না বলে প্লাটফরম শব্দটা ব্যবহার করে ওরা। আগের চেয়ে বেশি মিশতে হবেÑ কিশওয়ার আলির সঙ্গে। যাতে খুনের কাজটা সম্পন্ন হওয়ার পর কেউ কোনো সন্দেহ করতে না পারে। কামরুল ইসলাম পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমণ করেছে। অথচ বাড়ির পাশে নেপালে এখনো যাওয়া হয়নি। কিশওয়ারের সঙ্গে নেপালে যাওয়ার ব্যাপার নিয়ে বেশ কয়েকবার কথাও হয়েছে। অথচ যাবার সময় সে, কামরুল ইসলাম গেল না।
কামরুল ইসলাম একটা লম্বা ছুটি চায়।
ছুটির অবকাশে দীপালি কাম পরাগের সঙ্গে দীর্ঘদিনের লালিত হানিমুন করে ফেলবে। কিশওয়ার আলি নেপালে গেলে সুযোগটা হাতে আসবে এবং সে সুযোগটা ব্যবহার করবে ষোলো আনা।
ঘটনাটা ঘটেছে হঠাৎ, কোনো কিছু বোঝা কিংবা অনুভব করার আগেই- অনেকটা বিশাল বনের মধ্যে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ ক্ষুধার্ত বাঘের মুখোমুখি হওয়ার মতো। ব্যবসায়ী এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে পিকনিকের আয়োজন হয়েছে। কিশওয়ার এবং কামরুল ইসলাম দু’জনের সপরিবারে অংশ নেবে। চাঁদা পরিশোধ করেছে কামরুল। পিকনিক স্পট গাজীপুর, ভাওয়ালের গড়ে-শালবনে, পিকনিকের তিনদিন আগে ইস্তাম্বুল থেকে একটি ব্যবসায়ী সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পায় কিশওয়ার। সে বন্ধু কামরুলের উপর স্ত্রী ছেলে মেয়েকে নিয়ে পিকনিকে যাওয়ার ব্যবস্থা করে ইস্তাম্বুলের উদ্দেশে বিমানে চেপে বসে। ঠিক হয় তাঁর স্ত্রী পুত্র নিয়ে বড়ো মাইক্রোবাসে যাবে। সেই সাথে কিশওয়ার আলির স্ত্রী পরাগ, মেয়ে রানুকা এবং ছেলে অর্নব সঙ্গী হবে। সেভাবে প্রস্তুতি চলে।
পিকনিকের আগের দিন কামরুল ইসলামের ছেলে তামীম জ্বরে আক্রান্ত হলো। অবস্থার বিচারে কামরুলের পিকনিকে যাওয়ার পরিকল্পনাটাই বাতিল করতে চায়।
স্ত্রী শামীমা বাধা দেয়- না, তুমি রানুকাদের নিয়ে যাও।
কী অবাক করা কথা বলছ তুমি? তামীম অসুস্থ- ওকে অসুস্থ রেখে আমি যাব পিকনিকে?
ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো- শামীমা বলে- কিশওয়ার ভাই তোমার বন্ধু। মানুষটা বিপদে আপদে তোমার কম উপকার করেনি। তার ছেলেমেয়েরা- ভাবী প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষায় থাকবে।
ফোন করে জানিয়ে দেবো- অসহিষ্ণু কামরুলের গলা। তাছাড়া মানুষের অসুখ হতেই পারে।
তামীমের তেমন কিছু হয়নি। সামান্য জ্বর।
সামান্য জ্বর বেশি হতে কতক্ষণ?
আমি তো আছি বাসায়। তাছাড়া ডাক্তার পরিতোষ দাদা তো আছেই। তাকে ফোন করলে বাসায় এসে তামীমকে দেখে যাবে। আর পিকনিকে যাওয়ার তোমার ব্যবসার জন্য, ক্যারিয়ারের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
মানে?
তুমি না আগামী বছর তোমাদের এসোসিয়েশন থেকে প্রার্থী হবে?
হ্যাঁ- ইচ্ছে আছে।
তাহলে পিকনিকে যাও। অন্যান্যের সঙ্গে আড্ডার মাঝে তোমার প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছাটা জানিয়ে দাও। দেখ- প্রতিক্রিয়া বা সাড়া কেমন পাও-
কামরুল ইসলাম অবাক বিস্ময়ে শামীমার দিকে তাকায়।
তোমার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে আজকাল তুমি ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে চিন্তা করো-
করবই তো। তুমি আমাকে মূল্যায়ন করতে না পার- আমি তো তোমার ভালোটাই চাই। তোমার সাফল্য মানে আমার, তামীমের- সংসারের সাফল্য।
শামীমা?
শামীমা ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তাকায় কামরুলের দিকে।
তোমার কথায় আমি উৎসাহ পাচ্ছি।
কীসের উৎসাহ?
ঐ যে বললে- এসোসিয়েশনে প্রার্থী হবার কথা। প্রতি বছর আমি ভোট দেই। দেখি না একবার নিজে প্রার্থী হয়ে- জীবনটা তো একটা চ্যালেঞ্জ।
মৃদু হাসে- শামীমা।
সকাল সাতটায় নিজের মাইক্রোবাস নিয়ে উপস্থিত হয় কামরুল ইসলাম মোহাম্মদপুরে, তাজমহল রোড, কিশওয়ার আলির বাড়িতে। কিশওয়ারের স্ত্রী পরাগ, মেয়ে রেনুকা এবং ছেলে অর্নব প্রস্তুত হয়েই ছিল। গাড়ির শব্দ পেয়ে নিচে নেমে আসে। পরাগ অবাক কণ্ঠে একলা কামরুলকে দেখে জিজ্ঞেস করে- ভাবী-বাচ্চা কোথায়?
ওরা আসবে না।
কেন?
কাল রাতে হঠাৎ তামীমের শরীরে জ্বর এসেছে।
ও।
গাড়িতে উঠে বসে সবাই। মাইক্রোবাসে সামনের সিটে বসে রেনুকা আর অর্নব। পেছনের সিটে কামরুলের পাশে বসে পরাগ। ড্রাইভার গাড়ি ছাড়ে। সকালের মিহি মিষ্টি রোদ। সবুজ পাতারা হেলেদুলে ঝুলতে থাকে। ড্রাইভার প্রশান্ত কুমার ক্যাসেটে পুরোনো দিনের গান ছাড়ে। গাড়ির ভেতরটা স্বপ্ন এবং সুষমার মায়াবী রঙে ভরে যায়। মাঠ-ঘাঠ বাড়ি ঘর পার হয়ে নতুন কেনা সবুজ রঙের গাড়ি ওঠে বড়ো রাস্তায়। স্পিড বাড়ায় প্রশান্ত কুমার। গাড়ি ছুটছে অনাদিকালের পথে বাতাস কেটে কেটে।
যাচ্ছি- কিন্তু ভালো লাগছে না- প্রথম কথা পরাগের।
কেন?
খালি খালি লাগছে। আপনার বন্ধু নেই। তার উপর আপনার স্ত্রী- ভাবী-তামীম নেই। কেমন যেন লাগছে। শুধু যাচ্ছি বাচ্চাদের জন্য- ওরা অনেকদিন ধরে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিল। না গেলে খারাপ লাগবে-
আসলে জীবনটাই এমন।
কেমন? চোখ তুলে তাকায় কামরুলে দিকে পরাগ।
কামরুল ইসলাম সকালের মিহি রোদের উষ্ণ ডাঙায় বসে এই প্রথম আবিষ্কার করে- কিশওয়ারের বৌ পরাগ ভাবীর চোখ দুটো অসাধারণ- সুন্দর। গভীর। কালো শান্ত-শীতল এবং রহস্যময়!
চোখের ভেতরে ডুবতে ডুবতে কামরুল জবাব দেয়- সবকিছু মনের মতো হয় না। চাই এক রকম হয়ে যায় অন্যরকম। যোগ-বিয়োগের সূত্র মেনে জীবনের তরী চলে না ভাবী।
হাসল পরাগ- কথা তো বলছেন দার্শনিকের মতো।
না, দার্শনিক নয়। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। জীবনটা ছোটো- কিন্তু কমতো দেখিনি। হতে চেয়েছিলাম কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান অধ্যাপক-
কিন্তু হলেন পাকা ব্যবসায়ী- হাসে পরাগ।
সে হাসিতে যোগ দেয় কামরুল- হ্যাঁ। তবে পাকা ব্যবসায়ী আমি হতে পারিনি। পাকা ব্যবসায়ী জনাব কিশওয়ার আলি। ব্যাটা- বোঝে কখন কোথায় এক টাকা ঢাললে- পাঁচ টাকা যোগ হয়ে পকেটে ফিরে আসবে। বাতাসে নাক রেখে ব্যবসার গন্ধ খোঁজ পায়। জানেন ভাবী- কিশওয়ার কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবসায় ব্যর্থ হয়নি। যেখানে টাকা বিনিয়োগ করেছে, সেখানেই লাভ করেছে। একেই বলে ডায়মন্ড ভাগ্য।
কামরুল ভাই?
বলেন ভাবী।
আজ এই ব্যবসা, টাকা পয়সার প্রসঙ্গটা একটু বাদ দেওয়া যায় না?
কেন?
যাচ্ছি পিকনিকে। গভীর অরণ্যে টাকা-পয়সার হিসেব-নিকেশের বাইরে, একটু হিসেব ছাড়া সময়ের সাধ নিতে-
সরি ভাবী। কিছু ভেবে বলিনি। কথা প্রসঙ্গে বলছিলাম-
দু’জনার মধ্যে অথবা গাড়ির মধ্যে নির্জন নীরবতা। দু’জন মানুষ পাশপাশি বসা হঠাৎ তাদের সব কথারা নিঃশেষ হয়ে গেছে মুহূর্তে। কেউ কোনো কথা বলছে না। আড় চোখে তাকায় কামরুল। দেখে পরাগকে। কতদিন দেখেছে তাকে কিন্তু আজকে এই মুহূর্তের দেখাটা বিশেষ কোনো ব্যঞ্জনা নিয়ে ধরা দিচ্ছে ওর চোখে। পরাগ লম্বা দেহের আকর্ষণীয় গড়নের মেয়ে। দুটো বাচ্চার মা- বড়ো বাচ্চাটা রেনুকা ক্লাস ফাইভের ছাত্রী অথচ পরাগকে দেখে বোঝার উপায় নেই। গায়ের রঙ টকটকে ফর্সা। মাথায় অজস্র কাজল কালো চুল। কোনো আহামরি সাজ-সজ্জা নেই। ফর্সা মানুষ পরেছে কালো শাড়ি। কানে ছোটো দুটো দুল। গলায় একটা চেইন। বাম হাতে বাঁধা কালো বেল্টের একটি সাধারণ ঘড়ি। মনে হচ্ছে ঘড়িটা চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরেছে পরাগের মাখন-মসৃণ বালুচরী হাত। কত নিরাভরণ- অথচ কত আকর্ষণীয়, কোমল, দ্যুতিময়-
কোনো ব্যবসায়ী হতে চাননি?
পরাগের কথায় নিজের ভেতরে ফিরে আসে কামরুল- বড়ো ঝামেলা ভাবী। নিজের বলে কোনো কিছু থাকে না। অথচ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম- স্যারদের বাসায় যেতাম, দেখতাম কি সুন্দর ছিমছাম জীবন তাদের। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। স্যার ক্লাসে পড়াচ্ছেন, বাসায় আসছেন। কোনো কোনো স্যার আবার সাহিত্য চর্চা করছেন- বাইরে প্রচুর নাম-দাম। সৎ জীবনযাপন-
ব্যবসায় কীভাবে এলেন?
আমি তো আসিনি- হাসে কামরুল।
মানে?
আমাকে ব্যবসায় নিয়ে আসা হয়েছে।
কে নিয়ে এসেছে?
ঐ ব্যাটা কিশওয়ার আলি।
কীভাবে?
আমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে মাস তিনেক পর বিসিএস পরীক্ষাও দিয়ে দিলাম। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো রেজাল্ট করতে পারি- তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে যাব। নইলে বিসিএস দিয়ে অন্য কোথাও। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো করতে পারলাম না। বিসিএস-এ সাকসেস হলাম ঠিকই কিন্তু চয়েজ মতো হলো না।
আপনি কি চেয়েছিলেন?
প্রশাসন ছিল আমার পছন্দ। অথচ আমাকে দেওয়া হল পুলিশ-
ভালোই তো।
না ভাবী। পুলিশের চাকরি আমার বিবেচনায় সবচেয়ে জঘন্য চাকরি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ক্যাম্পাসে অনেক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি। তখন ওরা বলেছে- পুলিশের চাকরি করে দু’ধরনের মানুষ। এক ধরনের মানুষ খুব বুদ্ধিমান, চতুর এবং লোভী।
অন্য ধরন?
যারা একেবারে বোকা- ফুলিশ- হাসিতে ফেটে পড়ে কামরুল। হাসি শেষে- যখন আমি কী করব কী করব না- এই সিদ্ধান্তহীনতায় ডুবে বসে আছি- তখন ব্যাটা কিশওয়ার বলল আয়- ব্যবসা করি। জানেন তো কিশওয়ারের বনেদী ব্যবসায়ী। বলল- চাকরির গোনা পয়সার কি জীবন চলবে? অবারিত জীবনের সুখ চাইলে- ব্যবসায় নামো। নামলাম-
কিন্তু জানেন- আমি কিন্তু আপনার মতো একটি জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলাম। হঠাৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বরে, রূপান্তরিত মাত্রায় কথা বলে পরাগ- খুব শান্ত, ছোট্ট নির্জন নিরিবিলি জীবন বা সংসার আমার পছন্দ ছিল না। অথচ পেলাম- পুরোপুরি উল্টো জীবনের ধারাপাত-
আপনি সুখী নন- এই জীবনে- ছেলেমেয়ে নিয়ে? তাছাড়া আমি যতটুকু জানি কিশওয়ার আপনাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। অবাক কণ্ঠে কামরুল প্রশ্ন করে পরাগকে।
প্রচণ্ড ভালোবাসে! আমাকে! আপনার বন্ধু! পরাগের মুখে বিষণ্ন হাসির সঙ্গে বিদ্রƒপের বসবাস দেখতে পায় কামরুল ইসলাম। সুখ- সুখ উপচে পড়ছে। সুখের ভার আর সহ্য করতে পারছি না!
গাড়ি প্রধান সড়ক ছেড়ে গাজীপুরের শালবনে ঢুকে পড়েছে। সবুজ ছায়ায়, মসৃণ কংক্রিকেটের রাস্তায় গাড়ি চলছে। অনেক ভেতরে পিকনিক স্পট। কামরুল ভেতরে ভেতরে উল্টে যায়-পাল্টে যায়। কী বলছে পরাগ? সে, মানে কিশওয়ার আলির বৌ, পরাগ সুখী নয় দাম্পত্য জীবনে দেখে শুনে তো এমন মনে হয়নি কখনো। কিন্তু কতটুকুই বা আমি জানিÑ আপন মনে ভাবে কামরুল ইসলাম। বন্ধু হতে পারে কিশওয়ার। দীর্ঘদিনের পরিচিত বন্ধু। তাই বলে কি কিশওয়ারের ভেতরের সব খবর সে জানে? না- জানাও সম্ভব নয়। আর বন্ধুদের স্ত্রীদের নিয়ে কথাবার্তা হয় খুবই কম। কখন যে কোথায় কী দুর্ঘটনা অপেক্ষা করে আছে- জানে না কেউ। সে কারণে কামরুলের স্ত্রী শামীমা সম্পর্কে যেমন কোনো অতি আগ্রহ দেখায় না কিশওয়ার, সে রকম কামরুলও শীতল থাকে সবসময় পরাগ সম্পর্কে। নানা রকম আচার অনুষ্ঠানে হঠাৎ কখনও দেখা হলে টুকটাক কথাবার্তা হয় আর কী! সেই টুকটাক কথার জালে জীবনের গভীর অতলান্তের মানচিত্র সবসময় আঁকা সম্ভব হয় না।
আপনি মনে হয় খুব ভাবনায় পড়ে গেলেন! পরাগের ঠোঁটে হালকা হাসির করাত।
হ্যাঁ- ভাবনা হচ্ছে।
কেন?
আমার যতটুকু ধারণা- আপনারা, আপনি আর কিশওয়ার খুব সুখী জীবন যাপন করছেন।
ধারণাটা আপনার কী করে হলো?
ধারণা কী করে হলো- ব্যাখা দিতে পারব না। বলা যায়- আপনাদের বাসায় যতবার গিয়েছি অথবা আপনারা স্বামী-স্ত্রী যতবার মিলে আমাদের বাসায় এসেছেন- আপনাদের দু’জনকে পাশাপাশি দেখে-
পাশাপাশি দেখলেই মনে করতে হবে- আমরা বা অন্যরা খুব সুখী জীবনযাপন করছে- কামরুলের কথা কেড়ে নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন রাখে পরাগ।
সরলীকরণ ব্যাকরণে তো তাই।
বুকের গভীর প্রান্তসীমা থেকে দীর্ঘনিশ্বাস বেরোয় পরাগের- মানুষ সাদা চোখের সামনে কত অসহায়।
কথাটার মানে বুঝতে পারলাম না।
আমরা সাদা চোখে সরাসরি যা দেখি- ঐ দেখার মাঝে অনেক ফাঁক থাকে। অনেক নাটক- নাটকের অকল্পনীয় দৃশ্য লুকিয়ে থাকে। লুকিয়ে থাকে ছবির মতো অনেক কালো কুৎসিত বর্ণনাতীত দঘদগে ঘা-
কথা শেষ হতে না হতেই গাড়িটির মধ্যে ভয়ংকর এক ওলট-পালট দৃশ্যপটের সৃষ্টি হয়। সামনের সিটে বসা রেনুকা এবং অর্নব চিৎকার করে ওঠে। চিৎকার শুনে কামরুল এবং পরাগ সামনে তাকায়। ওদের মাইক্রোবাসের মুখোমুখি মাল বোঝাই একটি ট্রাক। ড্রাইভার প্রশান্ত কুমার প্রাণপণ চেষ্টায় গাড়িটাকে ব্রেক কষিয়ে থামায়। মাইক্রোবাসটা হঠাৎ উপরের দিকে প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনি খেয়ে ট্রাকটার মুখোমুখি দাঁড়ায়। ট্রাক এবং মাইক্রোবাসটার মধ্যে সামান্য সংঘর্ষও হয়েছে। ধাতব শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। গাড়ির ভেতরের তীব্র ঝাঁকুনির পরে কামরুল এবং পরাগ দু’জনকে আবিষ্কার করে সিটের নিচে, একজন আর একজনের উপর। কামরুল একেবারে নিচে সটান সোজা-শোয়া। মাথায় ব্যথা পেয়েছে এবং কামরুলের শারীরিক সংগীতে অপূর্ব ভঙ্গিতে শুয়ে আছে পরাগ। পরাগের মসৃণ মাখন দুর্লভ গন্ধ সৌরভে নৃত্যরত উষ্ণ বুকজোড়া কামরুলের মুখের উপর। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে আকস্মিক যান্ত্রিক ঘটনা তাদের দু’জনকে অসহ্য সুন্দর এক প্রান্তসীমায় নিয়ে যায়। দুটো শরীরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে এই ঘটনা- কেবলমাত্র কয়েক মুহূর্ত। গাড়ি স্থির দাঁড়িয়ে।
মা? অর্নব চিৎকার করে ডাকছে।
পরাগের মুখে কথা নেই।
পরাগ তাকিয়ে আছে কামরুলের দিকে। কামরুলের হাত মাথার নিচে আঘাত পাওয়া স্থানে হাত বুলায়। সেও তাকায় পরাগের চোখে।
স্যার- ড্রাইভার প্রশান্ত কুমারের গলা শোনা যায়।
দু’জনে একই সঙ্গে উঠে বসার চেষ্টা করছে। সামান্য চেষ্টায় পরাগ উঠে বসে। শরীর এবং মন ঝনঝন করছে- আঁটি বাঁধা টিনের তলোয়ারের মতো। গাড়ির দরজা খুলে ঢোকে প্রশান্ত।
স্যার?
মাথার নিচ থেকে হাত নিয়ে আসে চোখের সামনে কামরুল- হাতে টাটকা লাল রক্ত। কামরুলের হাতে রক্ত দেখে হাত ধরে পরাগ- কোথায় কেটেছে?
উঠতে উঠতে জবাব দেয় কামরুলÑ সম্ভবত মাথায়। প্রশান্ত?
স্যার?
রেনুকা আর অর্নবের খবর কী? কামরুল হামাগুড়ি দিয়ে ব্যথায় কোকাতে কোকাতে সিটে বসে।
ওরা ভালোই আছে। রেনুকার সামান্য ঠোঁট কেটেছে স্যার।
গাড়ির চারপাশে অজস্র লোক এসেছে। কামরুলদের এসোসিয়েশনের গাড়িও কয়েকটা পেছনে এসে থেমেছে। গাড়ির লোকজন নেমেছে। ট্রাক ড্রাইভার উধাও। লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে ট্রাকের কাচ ভাঙছে। রক্ত পড়ছে কামরুলের মাথা থেকে ফোঁটায় ফোঁটায়। সাদা শার্টটি ভিজে লাল লাল হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে শার্টটা শিল্পীর আঁকা একটি ছবিতে রূপ নেয়।
এসোসিয়েশনের দু’জন নেতা গাড়িতে ওঠে কামরুলের জখম পরীক্ষা করে। কে একজন কোত্থেকে চিনি জোগাড় করে কামরুলের মাথার জখমে লাগিয়ে দেয়। কামরুল চিনির কামড়ে ব্যথায় ককিয়ে ওঠে। পরাগ খুব আন্তরিকতার সঙ্গে মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করছে- খুব ব্যথা?
সামান্য।
মা তোমার কিছু হয়েছে? সামনের সিট থেকে উদ্বিগ্ন জিজ্ঞাসা রেনুকার।
না মা। আমার কিছু হয়নি। তোমার আংকেলের মাথা কেটেছে।
ও।
এসোসিয়েশনের একজন নেতা বলে- কামরুল ভাই, চলুন ডাক্তারের কাছে যাই।
না। থাক।
কেন?
সামান্য কেটেছে। রক্ত ঝরা বন্ধ হয়েছে। কোনো সমস্যা হবে না- চলুন-
ঠিক আছে। ব্যথা কমে যায়।
প্রশান্ত?
জ্বি স্যার।
গাড়ির কি কোনো সমস্যা হয়েছে?
না স্যার।
তাহলে গাড়ি চালাও।
গাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে। অবসন্ন শরীরে বসে আছে কামরুল। মাথাটার মাঝখানে কেটেছে। কিন্তু কীভাবে বসা ছিল? হঠাৎ তীব্র ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে আবিষ্কার করে গাড়িতে বসা নিজের সিটের নিচে। আর উপরে-
আমাদের জন্যই আপনার এই দুর্ভোগ- সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে অপরাধী কণ্ঠে বলে পরাগ।
হাসে কামরুল- আমার জন্য সুখ ভোগ।
যেমন?
আমি কি হাজার বছরের সাধনায় আপনাকে পেতাম- এইভাবে- ।
পুরুষ মানুষগুলোর এক দোষ- কপট তাকায় পরাগ- এটাতো কোনো ঘটনা নয়। দুর্ঘটনা মাত্র!
দুর্ঘটনা-কী সুখের ঘটনা- তাতে কিছু যায় আসে না। সামান্য মাথা কেটেছে আমার। কিন্তু যে সুখ পেয়েছি, পেয়েছি অনাবিল আনন্দ- সে তো অসীম। আর ভালো কিছু পাওয়ার জন্য রক্তপাত হবেই।
পরাগ নিস্তব্ধ আনন্দ মুখের প্রান্তে সরল হাসি নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। গাড়ি ছুটে চলেছে।
ভাবী?
বলুন।
কতক্ষণ আর বসে থাকব? চলুন, একটু হেঁটে বেড়াই-
হাঁটতে পারবেন তো?
তা পারব।
যদি হঠাৎ পড়ে-টড়ে যান?
যদি পড়ে যাই- আপনি তো আছেনই।
আমার উপর এত ভরসা?
জীবনে যা কিছু সুন্দর মনোরম আর মধুর- ঘটে এক নিমিষে, চোখের পলকে। আমিও আপনাকে বিশ্বাস করি এক পলকে।
একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?
আচ্ছা- বাড়াবাড়ি ছাড়া কি জগতে মহত্তম কিছু হয়? হয়েছে কখনো? কথায় কথা বাড়বে- ধরুন তো হাতটা। উঠি। শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না। কোথায় পিকনিক করতে এসে পুরো শালবনে ঘুরে বেড়াব ময়ুরপঙ্খী নায়ে চড়ে- সেখানে ক্যাবলাকান্তের মতো শুয়ে আছি-
পরাগ হাত ধরে কামরুলের। উঠে দাঁড়ায় সে।
রেনুকা আর অর্নব কোথায়?
ওরা খেলছে।
কোথায়?
ইশারায় সামান্য দূরে খোলা জায়গা দেখিয়ে বলে পরাগ- ঐ যে, মাঠে। কোথায় যাবেন?
বনের মধ্যে। আগে শালবনে কখনো আসেননি?
না।
শালবনের মধ্যে খুব সুন্দর সুন্দর বসার জায়গা আছে। কিংবা হেঁটেও বেড়ানো যায়।
চলুন তাহলে।
গাড়ি এক্সিডেন্ট করার পর পিকনিক স্পটে থামে। এসোসিয়েশনের লোকজন এসে কামরুলকে দেখে। কামরুলের মাথায় ব্যথা। একজন ডাক্তার সঙ্গে এনেছে এসোসিয়েশন কর্তৃপক্ষ। ডাক্তার কামরুলকে দেখে সামান্য ওষুধ এবং একটি ইনজেকশন পুশ করে। শালগাছের ছায়ায় বিছানা পেতে কামরুলকে শোয়ানো হয়েছে। কামরুল অবশ্য আপত্তি করেছে। কিন্তু এসোসিয়েশনের নেতারা রিস্ক নিতে চায়নি। ইনজেকশন দেওয়ার পর এক ঘণ্টা ঘুমিয়েছে কামরুল। ঘুম ভেঙেই বিছানার পাশে পরাগকে দেখছে। পরাগ উদ্বেগাকুল চোখে তাকিয়ে আছে। ঘুম ভাঙার পর হাত মুখ ধয়ে ফ্লাস্কে আনা এক কাপ চা দেয় পরাগ। চা খাওয়ার পর কামরুলের শরীরে মন সতেজ শক্তিটা ফিরে আছে।
দু’জন হাঁটছে।
শুধু হাঁটছে গভীর বনের পায়ে চলা সরু পথে। ঈষৎ স্পর্শ, গাছের পাতা ঝরার শব্দ, বাতাসের ফিসফিসানিÑ সবকিছু মিলিয়ে অদ্ভুত আলো আঁধারের খেলা দু’জনকে ঘিরে ধরে। কেউ কোনো কথা বলছে না। কোনো কথা তাদের বলার নেই। সব কথারা হারিয়ে গেছে। এক অজানা আনন্দে কামরুল ভাসছে সমুদ্রের পাড়ভাঙা জোয়ারে। কামরুল এবং পরাগ হাঁটতে হাঁটতে একটি শানবাঁধানো পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়ায়। চারপাশে শালগাছ। সামান্য দূরে কয়েকটি খড়ের ঘর। ঘরের লাগোয়া দুটি গরু আপন মনে ঘাস খাচ্ছে। পুকুরের চারপাশে ছড়ানো ছিটানো মানুষজন। বোঝা যায়- কামরুলদের মতোÑ ওরাও এসেছে শালবনে, একদিনের পিকনিকে অতিথি হয়ে।
ভাবী?
পরাগ অন্য কোথাও ডুব দিয়েছিল বিশাল পুকুরের মধ্যে স্বচ্ছ টলমল পানি দেখতে দেখতে। কামরুলের ডাকে সে বাস্তবে ফিরে আসে। তাকায় কামরুলের দিকে- কী?
বসবেন?
কোথায়?
এই যে শানবাঁধানো ঘাটে।
চলুন, বসি।
দু’জন বসে, পাশাপাশি। কামরুল লক্ষ করছে পরাগের মধ্যে হঠাৎ একটা পরিবর্তন এসেছে। কেমন গম্ভীর, স্থির, অচঞ্চল যা পরাগের চরিত্রের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান। ঘাটে বসেও পরাগ ছবির মানুষ। নড়ে না, চড়ে না, কথা বলে না, চোখ তুলে তাকায় না। পুকুরের মোহন রঙ পানি দেখে পরাগ। ভাসমান নুড়ির পেছনে পেছনে কয়েকটি মাছ ওলট পালট খাচ্ছে, ডুব সাঁতার খেলছে, পরাগ দেখছে। কেবল দেখছে মাছেদের অপরূপ ছন্দময় খেলা।
ভাবী! দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে কামরুল।
পানির শরীর থেকে চোখ ফেরায় পরাগ- কিছু বলছেন?
আপনার বোধহয় ভালো লাগছে না!
কে বলল আপনাকে?
না, আপনি কেমন অন্যমনস্ক-
আসলে চারপাশটা, পুকুর, পুকুরের স্বচ্ছ টলটলে পানি, মাছদের খেলা- আমার অসম্ভব ভালো লাগছে। আর হঠাৎ কিছু ভালো লাগলে আমি ধ্যানস্থ হই- যেমন হয়েছি, এখন।
পরাগের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে কামরুল। কী বলছে পরাগ! সাধারণত কিশওয়ার আলির বাসায় গেলে যেসব মামুলি কথাবার্তা হতো, কিংবা বন্ধুর স্ত্রী হিসেবে সামান্য হাসি ঠাট্টা- তাতে পরাগকে চেনা খুব কঠিন। আসলে পরাগের শারীরিক কাঠামোর মধ্যে অন্য এক অলৌকিক, অসাধারণ পরাগ লুকিয়ে আছে। যে পরাগ শাল বনের গভীর সবুজ মৌনতা, পুকুরের মাছেদের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়। ধ্যানস্থ হয়। পরাগ প্রাচীনকালের কোনো এক নাম না জানা পাখি হয়তো। যে পাখির গল্প পাখি বিশারদ সলিম আলি, রেজা খান কিংবা হালের শরীফ খান অথবা এ্যান্টার্কটিকার প্রথম বাঙালি ভ্রমণকারী, পাখি প্রেমিক ইনাম আল হকও জানেন না।
বন্ধুর স্ত্রীর দিকে বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকা কি ভালো? শোভন? পরাগের মুখে পালতোলা হাসি।
হতভম্ব কামরুলের ইচ্ছে হয় চোখ দুটো খুলে পুকুরে টুপ করে ফেলে দেয়। হোক মাছদের আধার। লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ফেরায় সে।
ধরা পড়ে যাওয়া কামরুলকে অভয় দেয় পরাগ- আমি না হয় কিছু বললাম না। কারণ- কোনো পুরুষ যখন মুগ্ধ চোখে তাকায়, যে-কোনো নারীর তা ভালো লাগে। কখনও কখনও উপভোগও করে থাকে। আমারও ভালো লাগে। আমি উপভোগ করি। কিন্তু আমাদের সঙ্গে যারা এসেছেন পিকনিক করতে তারা দেখলে-
ঠিক আছে, চলুন। কামরুল উঠে দাঁড়ায়।
খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে পরাগ- সামান্য ভয় দেখালাম। আর তাতেই ভয় পেলেন?
কামরুল কী করবে বুঝতে পারে না। পুকুরের পাড় দিয়ে হাত ধরাধরি করে দুটি ছেলেমেয়ের চলে যাওয়া দেখে আনমনে।
বসুন- কামরুলে হাত ধরে পরাগ।
বসে কামরুল। অবাক সে। পরাগ তার হাত ধরেছে। তার শরীরের কোষে-কোষে নাগের বাঁশি বাজে।
ভয় পাওয়ার কী আছে?
না না। আমি ভয় পাইনি- কৈফিয়তের ঢংয়ে বলে কামরুল।
পাননি?
না।
সত্যি কথা বলছেন? পরাগ কামরুলের সাহস পরীক্ষা করছে বুঝি। কামরুল টলে যায়Ñ কিন্তু আপনার কথাটা তো সত্যি।
কোন কথাটা?
আমরা দু’জন নির্জনে পাশাপাশি বসে আছি- সত্যি কেউ যদি দেখে?
দেখলে? পরাগ এই মুহূর্তে এক কিশোরী বালিকায় রূপান্তরিত। বেণী দুলিয়ে হাসছে। হাসির দমকে দু’কানের ললিতে ঝুলানো দুটো ঝুমকো দুলছে। না, দুলছে না, হাসছে ঝুমকো দুটো। সোনা রঙ সরল হাসি।
দেখলে- থেমে যায় কামরুল।
আচ্ছা, এই আপনাদের, পুরুষদের সাহস! সত্যি কথাটা বলতেও ভয় পান? ধরুন, কোনো একজন যদি আপনার বন্ধু, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কিশওয়ার সাহেবকে বলে- আমার সঙ্গে আপনাকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছে শালবনের গভীর অভ্যন্তরে শানবাঁধানো পুকুর ঘাটে। ঠিক আছে, দেখেছে। তাতে কী আসে যায়? পরাগ গভীরভাবে তাকায় কামরুলের দিকে।
বলুন, কী আসে যায়?
কামরুল কথা খুঁজে পায় না। অথচ কামরুলের সঙ্গে তর্কে পারাটা কঠিন। ইউনিভার্সিটিতে সে তুখোড় বক্তা ছিল। দলের হয়ে অনেক দিন সে হারতে বসা দলকে শেষ মুহূর্তের তার্কিকে-যুক্তিতে, বিপক্ষের বক্তব্যকে খণ্ডন করে জিতিয়ে এনেছে। আজ সেই কামরুল আটপৌরে এক গৃহিণী, যার শিক্ষাগত যোগ্যতা ইন্টারমিডিয়েট পড়া পর্যন্ত, তার কথার উত্তর দিতে পারছে না।
মানুষের মন তো!
বুঝলাম। আপনার সঙ্গে আমার কিংবা আমার সঙ্গে আপনার মেলামেশা, যাকে বলে অন্তরঙ্গ মেলামেশার গল্প শুনে আপনার বন্ধুর মন খারাপ হবে, আপনার প্রতি অবিশ্বাস আনবে- কিন্তু আমি যদি আপনার পক্ষে থাকি, তাহলে?
ঠিক বুঝলাম না।
পুকুরের টলটলায়মান পানিতে ক্রীড়ায় মগ্ন মাছেদের কাঁপিয়ে আবার হেসে ওঠা পরাগ- বুঝলেন না! এত কম বুদ্ধি নিয়ে পুরুষেরা কী করে পৃথিবী শাসন করে আমি বুঝতে পারি না। আপনার বন্ধু যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে- ঘটনাটা কি সতি? আমি বলব- হ্যাঁ।
হ্যাঁ- বলবেন? অবাক চোখে তাকায় কামরুল।
কেবল হ্যাঁ বলব না, বলব তোমার বন্ধু, বিজনেস পার্টনার মি. কামরুলকে আমি পরীক্ষা করছিলাম। কিন্তু লোকটা- পরাগের মুখে অচেনা শব্দহীন হাসির আগুন জ্বলে ধিকিধিকি।
বলুন-
কিন্তু লোকটা বন্ধুর স্ত্রী নয়, বন্ধুর প্রতি চরম বন্ধুভাবাপন্ন। তাই আমাকে কাছে পেয়ে, বাগে পেয়েও হাত ধরেনি, বাড়িয়ে ধরা ওষ্ঠে চুমু খায়নি। বরং আমি তার হাত ধরেছি- পরাগ আবার হাত ধরে কামরুলের শক্তভাবে, গভীর আবেগে, উঠে দাঁড়ায় ঘাটে বসা কামরুলের মুখোমুখি- চলুন, ওদিকে খাবার দাবার বুঝি শেষ। বেলা দুটো বাজে।
মুহূর্ত, সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিন, মাস, বছর- পার হয়ে এক একজন মানুষ বাঁচে ষাট বছর সত্তর বছর। কোনো কোনো মানুষ একশো কিংবা তারও অধিক বছর বাঁচে। হঠাৎ সেইসব মানুষের মধ্যে কোনো একজনের জন্য একটা মাত্র দিন, পুরো জীবনটাকে পাল্টে দিতে, এমনকি উল্টে দিতেও পারে।
কামরুলের চোখে ঘুম নেই। রাত দশটায় পিকনিক থেকে ফিরে এসেছে। স্বাভাবিক নিয়মে স্ত্রী শামীমা অপেক্ষায় ছিল। ছেলে তামীম ঘুমিয়ে পড়েছে।
বাসায় ঢুকে, জামা কাপড় ছাড়তে-ছাড়তে শামীমাকে জিজ্ঞেস করে- তামীম কোথায়?
ঘুমিয়েছে।
ওর জ্বর?
এখন ভালো।
ডাক্তার এসেছিল?
হ্যাঁ। পরিতোষ দাদাকে ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে এসে দেখে গেছে। বলছে ভয়ের কিছ নেই। ফ্লু। এখন বাচ্চাদের এসব হচ্ছে।
ও।
জামা-কাপড় গুছিয়ে আলনায় রাখতে রাখতে শামীমা জিজ্ঞেস করে- রাতে খাবে?
হ্যাঁ, ক্ষুধা লেগেছে! তাড়াতাড়ি খাবার দাও। আমি বাথরুমে গেলাম।
আচ্ছা।
বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছাড়ে কামরুল। একেবারে ন্যাংটো। গোসল করার সময় কামরুল শরীরে কোনো কাপড় রাখে না। বাথরুম এক একজন মানুষের সার্বভৌম রাষ্ট্র। কামরুলের সার্বভৌম রাষ্ট্রও বাথরুম। এখানে ঢুকলে কামরুল বাথরুম নৃপতি ভাবে নিজেকে। কোনো শালা এখানে এসে কোনো আইন ফলাতে পারবে না। বলতে পারবে না তুমি ন্যাংটো হয়ো না। আমি এখানে ন্যাংটো হব, নাকি হব না- তাতে শালা তোমাদের কী? আমি কি তোমাদেরটা খাই? না পরি? আর নিজেকে আয়নায় দেখে একজন মানুষ নিজের সম্পর্কে একটা ধারণা নিতে পারে। বাথরুম জুড়ে আয়না। ঝরনার পানি পড়ছে মাথায়। পানি শরীর বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। কামরুলের খুব ভালো লাগে। প্রতি সকালে ঘুম থেকে ওঠে গোসল করে। আবার রাতে বাসায় ফিরেও গোসল করে। এতে শরীরের যাবতীয় ক্লান্তি, ক্লেদ দূর হয়। ক্লেদ? নিজেকে দেখে আয়নায় কামরুল। বাস্তবে ন্যাংটো কামরুল নিজেকে আয়নায় দেখে। শরীরের ক্লেদ গোসল করলে না হয় ধুয়ে মুছে যায়। কিন্তু মনের ক্লেদ?
বাথরুমের দরজায় ধাক্কা শামীমার- এ্যাই কী করছো?
আয়নার ভেতরে ঢুকে যাওয়া কামরুল নিজের ভেতরে আসে- আসছি।
তাড়াতাড়ি আসো, টেবিলে খাবার নিয়ে বসে আছি।
খাবার টেবিলে শামীমা এবং কামরুল।
শামীমা একজন আদর্শ গৃহিণী। চমৎকার দায়িত্বশীল স্ত্রী। মমতাময়ী মা। কামরুলকে শামীমা অসম্ভব ভালোবাসে। দিনে না হোক, প্রতি রাতে শামীমা স্বামীর সঙ্গে টেবিলে, একসঙ্গে খেতে চায়। ধীরে ধীরে খেতে খেতে শামীমা টুকটাক প্রশ্ন করে কামরুলের সারাদিনের নির্ঘণ্ট জেনে নেয়।
কখনও কখনও কামরুলের বিপদে শামীমা পরামর্শ দিয়েও সাহায্য করে।
তোমাদের পিকনিক কেমন হলো?
ভালো।
খাবারের মেনু কী ছিল?
বিরিয়ানি।
শুধু বিরিয়ানি?
না না। মুরগির মাংস, ডিম, সালাদ, দই আর পানীয়।
তোমাকে কেমন অন্যমনস্ক লাগছে?
চমকে ওঠে কামরুল। খেতে খেতে তাকায় শামীমার দিকে- শরীরটা খারাপ লাগছে।
জ্বর-টর আসবে নাকি?
বুঝতে পারছি না। তোমার কথায় আমাকে পিকনিকে যেতে হলো- কামরুল কণ্ঠে খানিকটা অনুযোগ করে বলল।
যে জন্য গিয়েছিলে-
শামীমার কথা শেষ হওয়ার আগেই কথার মধ্যে ঢুকে পড়ে কামরুল- কী জন্য?
আগামী নির্বাচনে তুমি না এসোসিয়েশনের প্রার্থী হবে!
কামরুল মাথা ঝাঁকায়- হ্যাঁ। হব।
সে বিষয়ে আলাপ করেছ?
করেছি।
এসোসিয়েশনের লোকজন কী বলেছে?
ওরা আমাকে সাপোর্ট করবে, বলেছে।
তাহলে পিকনিকে গিয়ে লাভ হলো কার? আমার না তোমার?
শামীমার কথায় কামরুল মৃদু হাসি মুখে তাকায়, মুখে মাংস। শামীমাও প্রতি-উত্তরে হাসে।
ভাবী গিয়েছিল?
কে?
রেনুকার মা!
গিয়েছিল।
আর কে কে গিয়েছিল?
রেনুকা, রেনুকার মা, অর্নব। কিশওয়ারের সঙ্গে বোধহয় ভাবীর খুব একটা বনিবনা হচ্ছে না।
কে বলল তোমাকে? শামীমা খাবার মুখে কথা বলছে- কথা অস্পষ্ট। তার মধ্যেও একটা ভিন্নতা বুঝতে পারল কামরুল।
কেউ বলেনি।
খাবারটা গিলে শামীমা কড়া গলায় প্রশ্ন করে- কেউ বলেনি তাহলে বুঝলে কী করে?
ভাবীর দু’একটা কথায়।
সেই দু’একটা কথা কী?
শামীমা, আমি নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। তবে ভাবীর কথায় আমার যা মনে হয়েছে, আমি তোমাকে তাই বললাম।
শামীমা কোনো প্রশ্ন না করে থালার সামান্য ভাত নাড়াচাড়া করে। কামরুল নিজেকে নিজে গাল দিচ্ছে- শুয়োরের বাচ্চা, খানকির পোলা, কুত্তার বাচ্চা- সামান্য একদিনের একটা ঘটনা বৌয়ের কাছে গোপন রাখতে পারিস না! কেমন মানুষ তুই? আহাম্মক? কলুর বলদ-
দীর্ঘদিনের অভ্যাসে কামরুল কথায় কথায় বলে ফেলেছে। কিন্তু সে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত ছিলÑ এসব বিষয়ে না বলার জন্য। তূণ থেকে তীর ছুটে গেছে। কিচ্ছু করার নেই এখন। শামীমা বাকি ভাত না খেয়েই উঠে পড়ে। বিস্মিত কামরুল জিজ্ঞেস করে- ভাত খেলে না যে!
বেসিনে হাত ধুতে ধুতে শামীমা অসম্ভব শান্ত গলায় উত্তর দেয়- খেতে ইচ্ছে করছে না।
কামরুল নিজের খাবার রেখে শামীমার সামনে যায়- শামীমা, এমন করছ কেন?
কী করছি?
ভাত না খেয়ে উঠছ কেন?
বললাম তো- খেতে ইচ্ছে করছে না।
আমার মনে হয়- তুমি সত্যি কথা বলছ না।
চোখে চোখ রাখে শামীমা- আমিও যদি কথাটা ঐভাবে বলি?
কোনভাবে? কামরুল ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে ভেতরে।
তুমিও আমার কাছে সত্যি বলছ না!
কে বলল তোমাকে?
আমি বলছি।
দেখ শামীমা, আমাদের বারো বছরের বিবাহিত জীবনে এ রকম কখনো হয়নি। আজ আমাকে কেন অবিশ্বাস করছ? বাইরে যা কিছু ঘটে- আমি সবই তোমাকে বলি। আজকেও বলেছি-
বলছ। কিন্তু সবটা বলনি।
কামরুল অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে শামীমা, তার দীর্ঘদিনের দেখা স্ত্রীর দিকে। কেমন ঝাপসা লাগছে। শামীমার এই মুখ চোখ গ্রীবা ঠোঁট আগে কখনো দেখেনি। অপরিচিত লাগছে। আজকের দিনটি কি কামরুলের জন্য অশুভ? নাকি শুভ? শুভ-অশুভ’র দোলায় দুলতে থাকে সে- শামীমার সামনে।
শোন, তুমি আমার কাছে গুরত্বপূর্ণ কিছু লুকাচ্ছো- শামীমার কণ্ঠে স্পষ্ট দৃঢ়তা।
আমি?
হ্যাঁ।
কিন্তু আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।
তোমার শার্টে রক্ত কেন?
নিজের মুখে সিনেমার দিশেহারা নায়কের মতো অস্ফুট বলতে থাকে কামরুল- রক্ত, আমার শার্টে রক্ত- রক্ত কেন! স্বগত সংলাপের সঙ্গে সঙ্গে নিজের মাথায় ডান হাত চলে যায়। যেখানে আঘাত লেগেছিল- সেখানে।
মাথায়ও তোমার আঘাত আছে- আমি দেখেছি- শামীমা তার স্ত্রী নয়, বাদী পক্ষের জাঁদরেল আইনজীবী।
মুখে হাসি ফোটে কামরুলের। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে সে। ওর মুখে হাসি অবাক চোখে দেখে শামীমা।
তুমি হাসছ কেন?
কামরুলের হাসি আরো প্রসারিত- কী আশ্চর্য! আজ আমার কী হয়েছে? অথচ এই ঘটনাটা তোমাকে আগেই বলা উচিত ছিল। পিকনিকে ছেলেমেয়েরা মিলে লাঠিমারা মানে ডাংগুলি খেলছিল। লাঠিমারা বা ডাংগুলি খেলা বুঝতো? ছোট্ট একটা লাঠিকে বড়ো একটা লাঠির আঘাতে দূরে ফেলা। তারপর গোনা-
হ্যাঁ, ছোটোবেলায় আমরা অনেক খেলেছি।
ওর একটা লাঠি আমার মাথায় পড়েছিল। বসে বসে এসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন। ডাক্তার ছিল, সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা-ইনজেকশন দিয়েছে। এইটা তো শুরুতেই বলার কথা- শামীমার মুখের উপরে সন্দেহের মেঘ অনেকটা সুরে যায়।
আমি তো ভাবছি, কেন আগে বলিনি তোমাকে?
শামীমা আবার সহজ স্বাভাবিক হয়ে যায়। দু’জনে খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে শুয়ে পড়ে। বিছানায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে কাদা শামীমা। নাইটি উঠে এসেছে কোমরের উপর। উদোম দুটি মাংসল থাই। ডিম লাইটের সবুজ আলোয় শামীমার নরম চকচকে থাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিছানা ছাড়ে কামরুল। রাত তিনটে। ঘুম ভেঙেছে। চোখে আর ঘুম আসছে না। সে বারান্দায় যায়। উদাস পৃথিবী। আকাশ ভরা তারা। সারা শহর জুড়ে আলোর মিছিল। রাস্তায় কয়েকটা কুকুর ঘোরাঘুরি করছে। পাহারাদারেরা কোথাও নেই। বারান্দা থেকে সে বারবার ফিরে যাচ্ছে, শালবনে, গাড়ির ভেতরে, এক্সিডেন্টের মুহূর্তে, শালবনের পুকুর ঘাটে, মাছেদের খেলায়, পরাগের স্পর্শে- ইস, জীবন এত আকর্ষণীয়! মধুর! ভয়ংকর সুন্দর! কামরুলের কাছে গভীর রাতের এই নিস্তব্ধতায়, স্ত্রী, সন্তান-তামীম, ব্যবসা-বাণিজ্য, টাকা-পয়সা, সংসার, সব বৃথা মনে হচ্ছে। তার কাছে এখন একমাত্র অনিবার্য সত্য- পরাগ, পরাগের হাসি, পরাগের স্পর্শ...। সে কোথায় যাচ্ছে! কামরুল ফিরে আসে নিজের মধ্যে- পরাগ আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর স্ত্রী! তাকে নিয়ে ভাবা কি ঠিক হচ্ছে? পাশের বিছানায় আমার সুশোভন স্ত্রী শামীমা শুয়ে আমার অপেক্ষায়-
তাতে কী? তুমি তো আর ইচ্ছে করে পরাগের দিকে হাত বাড়াওনি! বরং পরাগই তোমাকে ডাকছে!
কে! কে কথা বলছে?
আমরা।
আমরা কে?
আমরা-কালো গোলাপ।
বারান্দায় শামীমার গোলাপের বাগান। দশ বারো রকমের গোলাপের টব। খুব যত্ন করে শামীমা প্রতি সকালে উঠে পানি দেয়, আগাছা পরিষ্কার করে। কয়েকদিন আগে মাত্র কালো গোলাপের টবে গোলাপ ফুটেছে। কালো গোলাপ সাধারণত পাওয়া যায় না। ফোটার দিন শামীমা হৈচৈ করেছিল। বন্ধুদের ডেকে কালো গোলাপ দেখিয়েছিল। পত্রিকাওয়ালারা খবর পেয়ে এসেছিল। তারা ছবি তুলেছে। কালো গোলাপের সঙ্গে দাঁড়িয়ে পোজ দিয়েছে শামীমা। চার-চারটে কালো গোলাপের সঙ্গে শামীমার চার কালারের ছবি- অম্ভব সুন্দর অথবা সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়েছিল। পত্রিকার পাতায় শামীমাকে মনে হচ্ছিল- কোনো ছবিতে গানের দৃশ্যে অভিনয় করছে।
শামীমার অনেক যত্নে, স্পর্শে, ফোটা কালো গোলাপ শামীমার বিপক্ষে কথা বলছে!
কামরুল কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না।
দেখুন কামরুল ইসলাম আপনি নিজে তো হাত বাড়াননি? বাড়িয়েছেন? আত্মপক্ষ সমর্থন করে কামরুল- না।
তাহলে? তাহলে এত ভাবছেন কেন? দু’দিনের দুনিয়া। একজন বিখ্যাত পারসিক কবি ছিলেন না- যিনি বলেছেন, খাও দাও ফুর্তি করো। আর জানেন তো পরকীয়া প্রেমে আছে সীমাহীন আকর্ষণ, আনন্দ আর উপভোগের শিকার।
কিন্তু কিশওয়ার আমার বন্ধু।
অস্বীকার কে করেছে?
স্বীকার-অস্বীকারের প্রশ্ন নয়। বন্ধু হয়ে বন্ধুর সংসারে বাঘ হয়ে ঢুকতে পারি না।
কালো গোলাপ চারটি একসঙ্গে আকাশ-মাটি কাঁপিয়ে হেসে ওঠে- জগৎ সংসারে বন্ধুরাই বন্ধুকে খুন করে। কারণ- একজন বন্ধু জানে অন্য বন্ধুর যাবতীয় দোষ, গুণ। ভেতর আর বাইরের কার্যকলাপ। আর বন্ধু যখন বন্ধুকে খুন করে- তখন কাক-পক্ষী তো ভালো, বাতাসও পর্যন্ত টের পায় না।
কালো গোলাপ, আমি তোমাদের ছিঁড়ে ফেলব- এখনই।
গোলাপের- নানা রঙে ঢংয়ে হাসে- ছিঁড়ে ফেললেই কি সব শেষ? হৃদয়টাকে কি বুকের ক্যাম্পাস থেকে উৎপাটন করতে পারবেন? তারপর স্মৃতি-স্পর্শ, শালবনের পুকুর পাড়, শানবাঁধানো ঘাট, পুকুরে মাছেদের ঘাই- খেলা সবকিছু মুছে দিতে পারবেন মি. কামরুল ইসলাম?
রাতের শেষ প্রহরে কামরুল বুক চেপে বারান্দার মেঝেতে বসে পড়ে। কী দীর্ঘ যন্ত্রণার চাষবাস শুরু হয়েছে- বুকে, অস্তিত্বের ঘাসে, গোলাপের ঘ্রাণে, আকাশের নীলে। সে যেদিকে তাকায় কেবল পরাগকেই দেখতে পায়। দেখতে পায় শালবনের পুকুরের শানবাঁধানো ঘাট, মাছেদের ক্রীড়া-
পিকনিক শেষে সন্ধ্যার সামান্য আগে ফিরছে তারা। গাড়ি ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে যায় রেনুকা আর অর্নব। ড্রাইভারের পেছনে দুটি সিটে ভাইবোন গভীর ঘুমে বিভোর। বাতাস কেটে কেটে সাঁই সাঁই এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। পেছনের সিটে পাশাপাশি বসা পরাগ এবং কামরুল।
প্রশান্ত কুমার বাজাচ্ছে ক্যাসেটে পুরোনো দিনের গান। গাড়ির ভেতরে গান, গানের কথা আর তীব্র আকুল সুর ছাড়া কিছু নেই। দু’জন মানুষ ভুলে গেছে তাদের অস্তিত্ব। তারা, কামরুল এবং পরাগ পাশাপাশি বসা। দু’জনে নিচ্ছে দু’জনের ঘ্রাণ। দু’জনে নিচ্ছে দু’জনের নীরবতার কুসুম কোমল স্বাদ। মাঝে-মাঝে চোখ তুলে তাকায় একজন, অন্যজনের দিকে। চোখে চোখ পড়লে নিমিষে দৃষ্টি নেয় ফিরিয়ে। দেখে বাইরের পৃথিবীতে ঘনায়মান রাতের ঘন অন্ধকার। পাখিদের ঘরে ফেরা। অবিরাম অজস্র মানুষের যাতায়াত।
কামরুল এক সময় হাত বদল করে সিটের উপর অলস হাত রাখে। হাতটা পড়ে পরাগের হাতের উপর। পরাগ হাত সরায় না। সরায় না কামরুলও। একটি হাতের উপর আর একটি হাত। অথচ কেউ তা জানে না। দু’জন নির্বিকার দৃষ্টি মেলে জানালার বাইরে তাকিয়ে হাত দুটির অস্তিত্বই তারা ভুলে গেছে। গাড়ি চলছে অনন্তকাল ধরে শালবনের পথে পথে। কখনো কোনোদিন এই গাড়ি থামবে না। থামার কোনো সময় নেই। থামলে ধ্যান ভেঙে যাবে আজ শালবনের পথে হঠাৎ পরিচয় হওয়া দু’জন মানুষের। যারা এখন গভীর মৌন ধ্যানে নিমগ্ন।
নিমগ্নতার ধ্যান অবশেষে, সন্ধ্যা পার হয়ে, রাত নটায় ধ্যান ভাঙায় ড্রাইভার প্রশান্ত কুমার- স্যার?
চমকে ওঠে কামরুল- কী?
গাড়ি কোথায় যাবে?
আমরা কোথায় এসেছি?
নতুন এয়ারপোর্ট পার হচ্ছি।
মোহাম্মদপুরে যাবে আগে।
আচ্ছা।
আবার গাড়ির ভেতরে যান্ত্রিক শব্দ, পুরোনো দিনের গানের সুর ছাড়া কিছু নেই। হাত দুটি জায়গা বদল করে না। হাতের উপর হাত রাখতে রাখতে গাড়িটা থামে কিশওয়ার আলির বাড়ির সামনে। ড্রাইভার দরজা খুলে দেয়। পরাগের মনে হলো তার একটি হাত নেই। হারিয়ে গেছে। সে চোখ মেলে তাকায় কামরুলের চোখে।
কামরুল হাতটা তুলে নেয়। পরাগ মৃদু হেসে নিজের হাতটা তুলে নেয়। গাড়ি থেকে নামে।
নামে বাচ্চা দুটো।
প্রশান্ত, গাড়ি ছাড়ো।
ড্রাইভার গাড়ি ছাড়ে। পরাগ দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। একটি কথাও বলে না। কেবল নির্নিমেষ তাকিয়েই থাকে। গাড়ি ছুটে চলে বাড়ির পথে। কামরুল সারাটা পথে কেবল একজোড়া চোখ দেখে। যে চোখের তারায় খেলা করছে শিকারী মাছরাঙা পাখির ক্ষিপ্ততা, যে চোখে আকুল আন্তরিক আমন্ত্রণ, নিবিড় পর্যালোচনা, যে চোখে ঘাই মারছে মাছেদের নিপুণ জলকেলি কসরৎ, যে চোখে ভরতনাট্যম নাচের উৎসব- সে চোখ, চোখের মালিককে অস্বীকার করা অসম্ভব কামরুলের পক্ষে।
আপনার ভাবনাটাই সত্যি!
কে?
গোলাপ, কালো গোলাপগুলো আবার হেসে ওঠে- আমরা। আপনার ভাবনা সত্যি। আপনি কিশওয়ার আলির স্ত্রী, পরাগকে এড়াতে পারবেন না।
আমার সংসার?
আপনার সংসার থাকবে- সংসারের জায়গায়। পরাগ থাকবে পরাগের সংসারে। তারপরও আপনাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক, যাকে বলে নিবিড় নিষিদ্ধ সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
অসম্ভব-অস্বীকার করার চেষ্টা করে কামরুল।
আবার হাসে গোলাপগুলো- মোটেই সম্ভব নয়। এই যে দেখুন আপনি কামরুল ইসলাম, একদমই রাত জাগতে পারেন না। রাত বারোটা বাজলেই ঘুমিয়ে পড়েন, সেই আপনি শেষ রাতে জেগে বসে আছেন বারান্দায়, কথা বলছেন আমাদের সঙ্গে, পরাগকে নিয়ে।
তাতে কী? আমার ঘুম আসছিল না-
ঘুম কেন আসছিল না?
সারাদিন পিকনিকে ছিলাম। শরীরের উপর অনেক ধকল গেছে। তার উপর এক্সিডেন্টে অনেক রক্ত ঝরেছে।
তাহলে তো আরো বেশি গভীর ঘুমে আপনার তলিয়ে যাওয়ার কথা।
কামরুল চুপচাপ বসে থাকে।
স্বীকার করছেন?
কী?
পরাগের জন্য আপনার চোখে ঘুম নেই?
কামরুলের উত্তর দেবার আগেই দূরে মসজিদে ফজরের আজান শোনা যায়। সে চমকে পূর্বাকাশে তাকায়। আকাশ ফর্সা হয়ে আসছে। কামরুল বারান্দা থেকে বিছানায় যায়। শামীমা ঘুমে। নিজের বালিশের উপর শামীমার মাথা। মাথা সরিয়ে ঘুমোতে যাবার আগে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে শামীমা জিজ্ঞেস করে- কোথায় গিয়েছিলে?
বাথরুমে- শুয়ে পড়ে কামরুল।
ঘুম জড়ানো কণ্ঠেই বলে শামীমা- তুমি তো রাতে বাথরুমে যাও না!
দরজা খুলে দরজা জুড়ে দাঁড়ায় পরাগ।
মুখে আকাশ রাঙা অপার্থিব হাসির মায়াবাণ। সে হাসিতে আমন্ত্রণ, তিরস্কার, কৌতুক, লোভ- বৈশাখের মেঘের মতো খেলা করে। কামরুল মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। তার এখন ইচ্ছে হচ্ছে- কোনো জাদুমন্ত্র বলে- সে নিজেকে ভ্যানিক করে দেয় পরাগের চোখের সামনে থেকে। যেহেতু সে কোনো জাদু জানে না, কখনো করেনি জাদুর সাধনা- অক্ষমতার বিষ নিয়ে কেবল রাস্তার এক পরিত্যক্ত ল্যাম্পপোস্টের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
ঠোঁটের কোণায় হাসিটা ধরে রেখেই জিজ্ঞেস করে- দরজায় দাঁড়িয়েই- কী বন্ধুর স্ত্রীর খবর নিতে এলেন?
কামরুল স্থির দাঁড়িয়েই থাকে। আপন মনে দু’হাতে নিজের দুই গালে থাপ্পড়ের পর থাপ্পড় মেরে এই স্ব-আয়োজিত অপমানের প্রতিশোধ নেয়। কিন্তু কিছুই করার থাকে না কামরুলের। অনেকটা কৈফিয়তের সুরে সে বলে- না, এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম। যাবার সময় ভাবলাম-
বন্ধুর অরক্ষিত স্ত্রীকে দেখে যাই। যদি আবার সুযোগ পাওয়া যায়- পরাগ হাসে। হাসতে হাসতে সে হাত বাড়ায়- ধরে কামরুলের হাত- আসুন, দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি?
মৃদু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে কামরুল- না থাক। অফিসে আমার কাজ আছে।
কাজ সারা জীবনই করলেন, ভবিষ্যতেও করবেন। আজকে না হয় আমার সঙ্গে অকাজ করলেন- টানে পরাগ।
দরজা অতিক্রম করে ভেতরে ঢোকে কামরুল। দরজা বন্ধ করে পরাগ। ড্রয়িংরুমে বসে কামরুল এবং পরাগ।
আমি জানতাম- আপনি আসবেন।
জানতেন?
হ্যাঁ।
কীভাবে?
কীভাবে জানতাম- সে রহস্যের বাক্স আমি খুলব না। আমার কাছেই থাক আমার জানার রহস্য। আপনার বন্ধু গতরাতে আংকারা থেকে ফোন করেছিল।
কখন?
রাত এগারোটায়।
ও কেমন আছে?
চমৎকার আছে। আর বিদেশে গেলে আপনার বন্ধু কখনোই খারাপ থাকে না। বরং খুবই ভালো থাকে। আর ভালো থাকার জন্যই তো যাওয়া-
পরাগের এই কথার উত্তরে কামরুলের কি কিছু বলা উচিত? বললে কী বলবে? সে বুঝতে পেরেছে পরাগের এই কথার মধ্যে একটা বেদনার সুর লুকিয়ে আছে।
আপনি বোধহয় আমার কথাটা বুঝতে পারেননি? বোঝার কোথাও নয়। কারণ আপনার বন্ধু জানে কখন কোথায় কীভাবে মুখোশ খুলতে হয়- আপনার বন্ধু বিদেশে ব্যবসা এবং নতুন মাংস দুটোই উপভোগ করেন আর কী! আমি পুরোনো, একঘেয়ে একটি বোতল মাত্র। আর রুচিশীল মাত্রই নিত্য নতুন রুচির পরিবর্তন অনিবার্য।
কামরুল তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকে পরাগের দিকে। চব্বিশ ঘণ্টার ব্যবধানে এক একজন মানুষ কতভাবে পরিবর্তন হতে পারে- সামনে বসা এই অসম্ভব সুন্দর পরাগকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। কাউকে বোঝানো আরো কঠিন, কঠিনতরো।
চা খাবেন?
চা পেলে ভালো লাগত।
আপনি বসুন। আমি আসছি- উঠে দাঁড়ায় পরাগ।
রেনুকা আর অর্নব কোথায়?
ওরা স্কুলে গেছে।
পরাগ চলে যায় ড্রয়িংরুম ছেড়ে। কামরুলের মনে হলো সে মুক্তি পেয়েছে। এতক্ষণ, পরাগের সামনে সে কেমন মিইয়ে গিয়েছিল। একটি বিড়াল ছানায় রূপান্তরিত হয়েছিল। যে বিড়াল একটু আদর, এক বাটি বাসি দুধের জন্য পরাগের পেছনে ঘোরে আর মিউমিউ ডাকে। কক্ষের আলো বাতাস আপন হাতের মুঠোয় বন্দি করেছে পরাগ। এক দুর্নিবার আকর্ষণে মতিঝিলের সুসজ্জিত অফিস, অফিসের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে চলে এসেছে কিশওয়ার আলির বাসায়। শুরুতেই একটা অস্বস্তি ছিল- পরাগ যদি জিজ্ঞেস করে- কেন এসেছেন?
কামরুলের এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। কেবল আছে অন্ধ কূল-কিনারহীন অমোঘ এক আকর্ষণ। সেই আকর্ষণের টানে এখানে নির্লজ্জের মতো বসে আছে। আসলে তার এখন চলে যাওয়া উচিত। পরাগকে বোঝানো দরকার কামরুল ইসলাম এত সস্তা নয়। সহজ নয়। সরল নয়ই। তারও আত্মসম্মানবোধ আছে। আছে অহংকার।
হঠাৎ কক্ষটার মধ্যে, ড্রয়িংরুমে অভাবনীয় খিলখিল হাসির ঢেউ উঠে। ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে কামরুল। তাকায় দরজায়- না পরাগ এখনো আসেনি। কিন্তু হাসিটা সারা কণ্ঠে দ্রিম দ্রিম বাজছে। হতভম্ব কামরুল পাগলের মতো চারিদিকে তাকায়। আতিপাতি করে সে হাসির উৎস খুঁজছে। হাসির উৎসমুখ সে খুঁজে পায় না। কিন্তু হাসি সারাটা ড্রয়িংরুমে বিরাজমান। নাচছে। হাসিরা কোকিলের কণ্ঠে হাসছে বর্ষায় ভেজা দুপুরে।
কী খুঁজছেন। হাসতে হাসতে হাসি জানতে চায়।
হাসি খুঁজছি।
পাবেন না।
কেন?
আমরা অধরা।
তোমরা কে?
আমরা কালো গোলাপ।
আবার এখানে কেন?
দেখতে এসেছি আপনাকে।
কেন?
কাল রাতে আপনাকে আমরা বলেছিলাম- আপনি পরাগের কাছে আসবেন।
রেগে যায় কামরুল- তাতে তোমাদের কী?
আসলে আমাদের খুব কষ্ট হয়।
কেন?
শামীমা আমাদের অনেক যত্নে ফুটিয়েছেন তো!
অসহ্য! মাথাটার মধ্যে হঠাৎ একটা শিরশিরে ব্যথা অনুভব করে কামরুল। তার বমি আসছে। বমি আসছে নাক চোখ মুখ কান ভরে। সারাটা শরীর কাঁপিয়ে অসহ্য জ্বর এসেছে এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একটি আসমানী জ্বরের চাদর তাকে ঢেকে ফেলল। সে সোফায় বসে কাঁপছে। বমি আসছে। কামরুল দ্রুত উঠে বাথরুমে ঢোকে। মনে হচ্ছে বেসিনে- শরীরের যাবতীয় মাংস গলে গলে বমির উদ্গিরণে বেরিয়ে আসছে। জিহ্বা বের করে সে বেসিনে হাপায়। কিন্তু শরীর থেকে এক ফোঁটা কসও বের হয় না। অসহ্য কষ্টে শরীর মন মগজ পুড়ে যাচ্ছে। সে পানির কল ছাড়ে। কামরুল অবাক চোখে দেখে- বেসিনের কল থেকে কলকল শব্দে নাচতে নাচতে টাটকা রক্ত নামছে, পানি নয়। সে চিৎকার করতে যাবে- দেখে পানি নামছে। পানিতে হাত ডুবায়। অদ্ভুত ঠাণ্ডা শীতল পানি। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে সে কিছুটা শান্ত হয়। বাথরুমের দরজা খুলে কামরুল বাইরে আসে।
বেডরুমে টেলিফোনে আলাপ করছে পরাগ। পরাগের কণ্ঠে হাসির ফোয়ারা। কামরুল ড্রয়িংরুমে এসে সোফায় শরীর এলিয়ে বসে। চারদিকে তাকায় ভয়ার্ত চোখে। কান রাখে সজাগে- যদি শামীমার হাতে তৈরি কালো গোলাপেরা আবার ফিরে আসে? শামীমা কি কালো গোলাপদের পাহারাদার হিসেবে নিযুক্তি দিয়েছে?
সকাল দশটার দিকে তার ঘুম ভেঙেছিল।
ঘুম থেকে উঠে বাথরুম সেরে প্রস্তুত হয়ে অফিসে যায়। অফিসে পৌঁছেই তার, কামরুলের মনে হচ্ছে কী যেন একটা মূল্যবান নক্ষত্র হারিয়ে গেছে বা হারিয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতর অসীম শূন্যতা বাজপাখির মতো ঘুরতে থাকে চক্রাকারে। অফিসে আসার সময় শামীমা বাসায় ছিল না। তামীমকে নিয়ে স্কুলে গেছে। কামরুলের মনে হচ্ছে- শামীমা আসার আগেই অফিসে চলে আসলে ভালো। সে কি শামীমাকে ভয় পাচ্ছে? না- আপন মনে হাসে, শামীমা খুব ভালো মেয়ে। নরম মনের মানুষ। সরল। ওর মাথায় শয়তানী বুদ্ধি খেলে না। কিন্তু একটি রাতের ব্যবধানে- দু’জনার মধ্যে ছোট্ট পার্থক্যের একটি সরলরেখা তৈরি হয়েছে বুঝতে পারে- কামরুল।
অফিসে পৌঁছে দু’একটি কাজ করতে করতে কামরুলের মাথায় সব হারানোর তীব্র হাহাকারটি লাটিমের মতো ঘুরতে থাকে, কখনো মাটিতে, কখনো আপন হতের তারায়, কখনো মোহাম্মদপুরের রাস্তায়, কখনো শালবনে, পুকুর পাড়ে শানবাঁধানো ঘাটে- তার মনে হচ্ছে- কে যেন তাকে ডাকছে গাজীপুরের গভীর ঘন শালবনের লাল ইট বিছানো পথে, পুকুরঘাটে, শানবাঁধানো চত্বর, মাছেদের জলকেলিতে, চোখের ইশারায়, হাসির আমন্ত্রণে।
উঠে দাঁড়ায় কামরুল। সে একটু বাইরে বেরিয়ে আসবে। ফোন বাজে।
হ্যালো?
আমি। শামীমা ফোন ধরলে কখনো নাম বলে না। বলে- আমি। তুমি আমাকে না বলে অফিসে গেলে যে!
এমনিতে আজ উঠতে দেরি হয়েছে। অফিসে জরুরি কাজ আছে। তাই এসেছি। প্লিজ তুমি কিছু মনে করো না।
আচ্ছা। কিছু মনে করব না। দুপুরে বাসায় আসছো তো?
বাসায়।
হ্যাঁ। আজ তোমার প্রিয় চিংড়ি মাছ রান্না করব।
আসব।
রাখি। শামীমা টেলিফোন রাখে। কামরুল কানের কাছে ফোনটা ধরেই রাখে। রাখতে রাখতে তার মনে হয়- টেলিফোন আর একজন এসে কানেকশনে ঢুকে গেছে। সে ডাকছে কামরুলকে।
আসছি- কামরুল টেলিফোন রেখে অফিস থেকে বের হয়। ড্রাইভারকে অফিসে রেখে নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে। রাস্তায় যানজট পার হয়ে গাড়ি কখন যে কিশওয়ার আলির মোহাম্মদপুরের বাড়ির সামনে এসেছে, ব্রেক কষে থামিয়েছে, দরজা বন্ধ করে পায়ে পায়ে সিঁড়ি বেয়ে এসে কলিংবেল টিপেছে বুঝতে পারেনি।
পরাগ ঢোকে নাস্তার ট্রলি নিয়ে।
দু’জনে মুখোমুখি চা খায়। চা খেতে খেতে পরাগ গ্রীবা বাকিয়ে, রহস্যময় হাসি আনে ঠোঁটে- খেলাটা বোধহয় জমে উঠেছে!
খেলা?
হ্যাঁ- খেলা। হাসিটা ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে পরাগের রহস্যময় কমনীয় ঠোঁটে
কীসের খেলা-
আপনার স্ত্রী, আমার শামীমা ভাবী কিছুক্ষণ আগে ফোন করেছিলেন।
মানে? চমকে ওঠে কামরুল। শরীরের ধাক্কায় চায়ের কাপ থেকে কিছটা তরল চা শার্টে পড়ে।
দিলেন তো শার্টটা নষ্ট করে- মৃদু কিন্তু আকর্ষণীয় ভর্ৎসনা করে পরাগ। উঠে আসে কাছে- দেখি, দেখি- না জামাটাই নষ্ট করে ফেলেছেন।
পাশের সোফায় বসে সোফার কার্নিসে হাত রাখে পরাগ। কামরুল তার নাকে একটা সুগন্ধ পায়।
মুখটা হাতের উপর রেখে পরাগ প্রশ্ন করে- বৌকে খুব ভয় পান বুঝি?
বৌকে সবাই একটু ভয় পায়।
তারপর আসছেন পরের বৌয়ের কাছে। আসলে বাল্যকালে- না যৌবনে, না সবকালেই শুনেছি- পরের বৌয়ের স্বাদই নাকি আলাদা।
ভাবী?
মাইন্ড করলেন?
কামরুল নিরুত্তর।
আরে ভাই- টক চাখবেন কিন্তু মুখ বাঁকাবেন না- তা তো হয় না।
শামীমা কেন ফোন করেছিল?
আমার খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য।
এর আগে তো কখনো করেনি।
প্রয়োজন মনে করেনি। আপনার মতো, আপনার স্ত্রীও জানে- আমার হাজব্যান্ড বাসায় নেই। বিদেশে গেছে। একটা দায়িত্ব আছে না- আপনার কিন্তু দারুণ বুদ্ধি- হাসে পরাগ-
কোথায় দেখলেন আমার দারুণ বুদ্ধি?
মাথায় নাকি আপনার ডাংগুলির গুটি পড়েছিল?
হাসে কামরুল- হঠাৎ মাথায় বুদ্ধিটা এসেছিল। রক্ষা পাওয়া গেছে। নইলে কী যে বলতাম! আপনাকে কী জিজ্ঞেস করেছে?
আমাকে প্রথম ইনিয়ে বিনিয়ে জিজ্ঞেস করেছে- পিকনিক কেমন হলো? তার কিশওয়ার ভাই কবে আসবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ শেষে জিজ্ঞেস করল- কামরুলের মাথায় আঘাতটা কীভাবে হলো- জানেন ভাবী?
আমি উল্টো জিজ্ঞেস করলাম- আপনাকে বলেনি?
আটকে গেলেন শামীমা ভাবী। এতবড়ো একটা দুর্ঘটনা- তার স্বামী তাকে বলেনি এক কথা, তো মিথ্যে হলেও সে স্বীকার করতে পারে না। আমতা-আমতা করে বলে- মাথায় নাকি বাচ্চাদের খেলার সময় ডাংগুলির ছোটো গুটিটা এসে পড়েছিল। আমি বললাম- আমি তো দূরে অন্য মহিলাদের সঙ্গে ছিলাম। পরে এরকমই শুনেছি।
তারপর?
তারপর শামীমা ভাবী বুঝল- আপনার এবং আমার কথায় একটি মিল যখন আছে, মেনে না নিয়ে উপায় নেই।
বাঁচালেন আমাকে- কামরুলের কণ্ঠে নিরাপত্তার সুর।
কিন্তু আমার যতটুকু ধারণা-
থামলেন কেন?
আপনার স্ত্রী, আমার শামীমা ভাবী আপনাকে সহজে ছাড়বে না।
কেন?
মেয়েদের মন বড়ো সজাগ। তীব্র আর ভয়ংকর। আপনাকে উদাহরণসহ বুঝিয়ে দেই?
কামরুল এই মুহূর্তে একজন অনুগত, বাধ্যগত ছাত্র পরাগের। সে গভীরভাবে পরাগের বিশ্লেষণ শোনে- আপনার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা গতকালই, হঠাৎ। আমার নিজের ধারণা- আপনি কোনোদিন আমাকে দূরের জানালায়ও কল্পনা করেননি। কিন্তু তারপরও আমরা নানা কারণে সবসময় ব্যাখ্যার অতীত- কাছে এসেছি। আমি পরাগ-আপনার কাছে বসে, শরীরের ঘ্রাণ নিতে দেবো- ভাবিনি। কিন্তু ঘটনা ঘটছে। ঘটনা এখনো চলমান। সেই একদিনের ঘটনাটা কিন্তু আপনার স্ত্রী ধরে ফেলেছে।
পুরো ছবিটা আত্মস্থ করার জন্য পরাগ কিছু সময় দেয় কামরুলকে। কামরুল ছবির ভেতরে অসংখ্য ছবির টুকরো টুকরো কম্পোজিশনে বিরাট একটি বিমূর্ত ক্যানভাস দেখে বিমূঢ়। ঘটনার মাত্র তিনজন চরিত্র এখন পর্যন্ত। কিশওয়ার আলি আংকারায়। সে কিছুই জানে না। শামীমা ফোন করল যখন, তখন সে পরাগের ড্রয়িংরুমে। কোনো সুতোয় বাঁধা পড়ছে জীবনের জটিলতা?
আজ আমার সঙ্গে খাবেন- পরাগ জানায়।
ক’টা বাজে।
দুটো বাজতে দশ মিনিট বাকি।
কামরুলের মনে পড়ে- ঘণ্টা দু’য়েক আগে স্ত্রীকে বলেছে বাসায় খাবে। শামীমা ওর প্রিয় চিংড়ি মাছ রান্না করবে। হয়তো এতক্ষণে, রান্না শেষ অপেক্ষায় আছে। অফিসে দু’একবার ফোনও করেছে। অফিসের পিওন জানিয়েছে কামরুল স্যার বাইরে গেছে। যা হয় হোক- পরাগের আমন্ত্রণ সে ফেলতে পারবে না।
কী রান্না করেছেন?
চিংড়ি মাছে চচ্চড়ি। মুরগির মাংস। আর ইলিশ মাছ ভাজা-
চিংড়ি মাছ?
পছন্দ নয়- আপনার?
খুবই পছন্দের।
চলুন।
কোথায়।
আমার বাড়ি এসেছেন- আমার ঘর দেখবেন না?
কামরুল পোষা বিড়ালের মতো পরাগের সঙ্গে পায়ে পায়ে পেছনে পেছনে যায়।
আকাশে মেঘ জমছিল। শ্রাবণের উষ্ণ মেঘলা দিন। বাইরের বাতাসে একটু গুমোট- ভ্যাপসা ভাব। কামরুল নিজেকে আবিষ্কার করেÑ পরাগের সঙ্গে দাঁড়িয়ে বেডরুমে নয় পশ্চিমে- নিটোল এক টুকরো বারান্দায়। মনোরমভাবে সাজানো বারান্দাটার গ্রিলে পাতাবাহারের রঙিন মানিপ্লান্ট। মাছের ছোটো দুটি অ্যাকুরিয়াম। একটা ঝুলন্ত দোলনা। দোলনার পাশে একটি চেয়ার।
এটা আমার একান্ত পৃথিবী- পরাগ বলে কামরুলকে।
সুন্দর।
সত্যি বলছেন?
হ্যাঁ। সত্যি বলছি। আমার খুব ভালো লাগছে। বিশাল পৃথিবীর মধ্যে ছোটো আর একটি পৃথিবী- কথা বলতে বলতে আকাশ আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে। চারপাশে বৃষ্টির তুমুল কোলাহাল। বিষণ্ন কিন্তু আনন্দে উদ্বেগে ছোটো বারান্দাটা কেমন অপরূপ হেসে ওঠে।
দাঁড়িয়ে কেন- বসুন- দোলনা দেখিয়ে কামরুলকে বলে পরাগ।
আমি চেয়ারে বসি- আপনি দোলনায় বসুন।
কেন?
দোলনায় মেয়েরা বসলে দৃশ্যটি খুব উপভোগ্য হয়-
পরাগ দোলনায় বসে শরীর এলিয়ে- কোথায় দেখেছেন এর আগে?
সিনেমায়।
ওÑ পরাগ হাসে। নীরব কিন্তু বহমান হাসি স্পর্শ করে সামান্য দূরে বসা কামরুলকে। কামরুলের বুকের কাছাকাছি মোহন পা জোড়া দুলছে। পায়ের আঙুলগুলো পাকা আমলকির মতো টসটসে পাকা। হাত লাগলেই ফেটে যাবে জমাটবাঁধা রসে।
কী দেখছেন?
ভাবনার ভুবন থেকে ফিরত হয়- কামরুলকে- দেখছি আপনার পা জোড়া।
কী আছে আমার পায়ে? নাচতে জানি না। নূপুর নেই।
আপনার পা জোড়া পদ্মপাতার মতো- অপরূপ-
পরাগ হঠাৎ উদাস হয়ে যায়। সে তাকায় বৃষ্টি ভেতর দিয়ে দূরের কোনো দেশে। কামরুলও এই সময়টুকু চুরি করে নির্লজের মতো নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে, দেখে পরাগকে। পরাগ-পরাগের মধ্যে নেই। বৃষ্টির ধূসর একটানা শব্দ, পাতাবাহারের গন্ধ, অ্যাকুরিয়ামে বন্দি মাছেদের মুক্তির জন্য ছুটোছুটি- সব মিলিয়ে কিশওয়ার আলির অনুপস্থিতিতে, তারই বাসার বারান্দায় বর্ণনাতীত একটি অমরলোকের দৃশ্য তৈরি হয়েছে।
জানেন-দীর্ঘক্ষণ পর হারিয়ে পাওয়া দৃশ্যলোক থেকে ফিরে আসা- কণ্ঠ বৃষ্টির গন্ধে আঠালো, ভেজা, গভীর দুঃখতাড়িত- আপনার বন্ধু যে রাতে বাসায় ফেরে না, সে রাত আমি এখানে বসে কাটিয়ে দেই-
পরাগের দৃষ্টি দূরে, বৃষ্টির ভেজা শরীরে- কামরুল কুকুরের মতো চাটতে থাকে চোখের পর্দায় থোকা থোকা বিষণ্ন সৌন্দর্য রাশিকে- সারারাত আমি কথা বলি পাতাবাহারের সঙ্গে, নিস্তব্ধ গভীর অন্ধকারের সঙ্গে, রেলিংয়ের বসা অন্ধকারের পোকাদের সঙ্গে, দূরের নক্ষত্রমালার সঙ্গে- ওরা আমার সঙ্গে গান গায়। আমার সঙ্গে নাচে। আমার এলোমেলো চুলে বিনুনি করে দেয়, আমার কান্নায় ওরা সান্ত্বনা দেয়-
পৃথিবীর সব কান্না একযোগে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে আরম্ভ করে- পরাগের চোখের কার্নিস বেয়ে। কামরুল উঠে দাঁড়ায়। নিজেকে সাহসের সিংহে রূপান্তরিত করে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে পরাগকে, পরাগ বাধা দেয় না। দু’হাতে সে ঝাপটে ধরে কামরুলকে। দুটো শরীর একটি শরীরের আকার নেয়। বাইরে বৃষ্টি আগের চেয়ে বেড়েছে- ঝমাঝম ঝমাঝম, একটানা অবিরাম।
কী ব্যাপার?
কামরুলের প্রশ্নে পাল্টা প্রশ্ন রাখে শামীমা- কী ব্যাপার?
তুমি তৈরি হওনি কেন?
কেন তৈরি হব?
তোমাকে না ফোনে বললাম-
কী বললে?
শামীমা তোমার এই মুখোমুখি প্রতিটি কথার পাল্টা কথা আমার একদম ভালো লাগছে না।
শামীমা স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দেয়- সে আমি জানি।
জানো! বেশ করেছ। এখন তৈরি হও- তাড়াতাড়ি। ঘড়ির দিকে তাকায় কামরুল-মাত্র আধঘণ্টা বাকি আছে নাটক শুরু হওয়ার।
বেডরুমে, জানালা লাগোয়া সোফায় বসে কামরুল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মাথা আঁচড়ায় শামীমা, আপন মনে। কামরুল নামে একজন মানুষ যে কক্ষে প্রবেশ করেছে, সে মানুষটি তার স্বামী একদম ভুলে গেছে সে। পুরোনো দিনের একটি গানের কলি আপন মনে ভাজতে ভাজতে সে নিজের গতিতে ধীরে ধীরে চুল আঁচড়াতে থাকে। কামরুল শুরুতে ব্যাপারটা বোঝেনি। সে সোফায় শরীর এলিয়ে শরীরের ক্লান্তি দূর করছে। মুখে সিগারেট। সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে দিচ্ছে জানালায়। এইটা ওর খুব মজার খেলা। ধোঁয়া উড়িয়ে দেওয়া- ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে সিগারেট শেষ। তাকায় শামীমার দিকে। শামীমা আগেরই মতো আপন মনে ধীরে সুস্থে মাথা আঁচড়াচ্ছে।
শামীমা! বেশ রাগান্তিত কণ্ঠে ডাকে কামরুল।
কিছু বলছ?
তুমি আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছ কেন?
কী রকম ব্যবহার?
আমি বসে আছি তোমার জন্যে। তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আমার সঙ্গে যাবে-
কোথায় যাব?
একটা কথা কতবার বলব- মহিলা সমিতিতে, নাটক দেখতে।
আমি তো বলিনি- নাটক দেখব।
বলনি- তাতে কী হয়েছে! বাসায় বসে কী করবে?
বাসায় বসে আজি সাজব- হাসে শামীমা- আমাকে তো কেউ দেখবে না- আমি দেখব আমাকে। আমার অনেক কাজ আছে- তুমি যাও- নাটক দেখ-
শামীমা, অসহিষ্ণু কামরুল- অস্থিরতার সঙ্গে পেছনে এসে দাঁড়ায় শামীমার- বোঝার চেষ্টা করো, আমি অফিসে অনেক জটিল আর জরুরি কাজ রেখে এসেছি।
কাজের চেয়ে নাটক দেখাটা কি খুবই জরুরি?
অতো ব্যাখ্যা আমি দিতে পারব না।
আমি ব্যাখ্যা চাইনি। কেবল তোমার দায়িত্বের বিষয়টি মনে করে দিলাম। আফটার অল তোমার বিবাহিত স্ত্রী আমি, অন্তত এখন পর্যন্ত।
শামীমা চুল আঁচড়ানো শেষে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগায়। ঠোঁটে ঠোঁটে ঘসে লিপস্টিকের রঙ বিন্যাস করতে থাকে। বারে বারে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে।
হঠাৎ শামীমার দুর্জয় সাহস কিংবা অবজ্ঞা দেখে কামরুল ইসলাম হতবাক। তার চারপাশে এসব কী ঘটছে? যে শামীমা সাধারণ আটপৌরে জীবনযাপনে অভ্যস্ত, সাত চড়ে রা করে না, কামরুলের অধিকাংশ দাবি, কথা, ইচ্ছে কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই মেনে নেয়, সেই কামরুলের স্ত্রী শামীমা কীভাবে এমন করে রূপান্তরিত হচ্ছে?
লিপস্টিক চর্চিত উষ্ণ ঠোঁট জোড়া দেখিয়ে শামীমা জিজ্ঞেস করে- রঙটা ঠিকমতো হয়েছে?
ঘাড় নাড়ে কামরুল- হয়েছে। এবার চল।
উঠে দাঁড়ায় শামীমা, হাসে- তোমাকে বলেছি তো- আমি নাটক দেখতে যাব না।
কেন?
সবসময় তোমার ইচ্ছে অনুসারে আমাকে চলতে হবে নাকি? আমার কোনো ইচ্ছে থাকতে নেই? খুব দৃঢ় কণ্ঠে স্বাভাবিক গাম্ভীর্য কথা বলে শামীমা।
কামরুল ফিরে আসে সোফায়। মাথা এলিয়ে দেয় সে। ঘটনাচক্রে কোথায় যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের চেনা জানা সড়কটি কেমন অচেনা আর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। জানালা গলিয়ে আকাশের দিকে তাকায় সে। সন্ধ্যার প্রগাঢ় আকাশ। একটি দুটি করে তারা জ্বলে উঠছে। আকাশের কী মোহন রঙিন রঙ! গাঢ় প্রলেপ নীল রঙের। আরে শামীমার ঠোঁটের রঙও তো নীল! কামরুল জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শামীমার দিকে তাকায়। শামীমা নেই। কিন্তু মেঝেতে দাঁড়িয়ে এক সামান্য নর্তকী। নগ্ন। উদোম। শামীমা আপন মনে আয়নায় নিজেকে দেখে আজ নিজের শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্পর্শ করে দেখছে, টিপছে, হাসছে। মুখের হাসিতে ঘৃণা উপহাস আগুনের ঢেউয়ে উপচে পড়ছে। পলকহীন চোখে কামরুল ইসলাম স্ত্রী শামীমার এই উত্তপ্ত আনন্দ আয়োজন দেখে। কিন্তু ঘরের মধ্যে মাত্র চার হাত ব্যবধানে একজন পুরুষ, তার স্বামী বসে আছে- মনে পড়ে না শামীমার। নিজেকে দেখার অদম্য খেলায় মেতে উঠেছে সে। দেখছে। অবাক চোখে, সন্দিগ্ধ চোখে, মায়াবী চোখে দেখছে নিজেকে। দেখার শেষ নেই। দেখতেই থাকে। মনে হচ্ছে শামীমা নিজেকে দেখতে দেখতে আয়নার ভেতরের প্রতিবিম্বের মায়ায় ঢুকে যাবে। সেও আয়নায় রূপান্তরিত হবে।
কামরুল ইসলাম নিজেকে পুরুষ ভাবতে পারছে না। শামীমার এই নগ্নতা দেখে, স্ত্রীর শারীরিক সৌন্দর্যের নৃত্য দেখেও এক ফোটা উত্তেজনা অনুভব করে না। শরীরটা মানুষের নয়, পাথরের। অথচ এই সপ্তাহ খানিক আগেও শামীমাকে সামান্য আড়ালে পেলেই জড়িয়ে ধরত প্রবল বেগে, উত্তেজনায়। শামীমা কপট রাগ দেখালেও মুখের হাসিতে গর্বের পতাকা উড়াত। মাত্র তো এক সপ্তাহ। মাত্র সাত দিন। সাতদিনের ব্যবধানে কামরুল এবং শামীমার জন্য নদী ভাঙনের সুর ভেসে আসছে।
হঠাৎ শামীমাকে কুৎসিত এক ডাইনি মনে হয় কামরুলের। তার সামনে এখন যে নগ্ন মহিলার শরীর ঘড়ির পেণ্ডুলামের ডায়ালে অনবরত ঝুলছে আর ঘুরছে সে শরীরটা কোনো মানুষের নয়, ডাইনির। মাথার মধ্যে একটি ঘুণপোকার শিরশির আনাগোনা টের পায় কামরুল। জানালাটা হঠাৎ বাতাস ছাড়াই বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্যুৎ চলে গেল। চারদিকে সূচিভেদ্য কালো কদাকার অন্ধকার। কামরুলের মনে হচ্ছে- শামীমা নয়, এক ডাইনি এবং বারান্দার কালো গোলাপগুলো হাসতে হাসতে নাচতে নাচতে তার দিকে এগিয়ে আসছে-
বিদ্যুৎ ফিরে আসে।
না, সবই ঠিক আছে। কেবল শামীমা আয়নার সামনে নত হয়ে নগ্ন শরীরে আকুল হয়ে কাঁদছে।
এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না কামরুল। ঝড়ের বেড়ে বেরিয়ে যায়- বেডরুম থেকে। এসে দাঁড়ায় বারান্দায়। কান্নাটা বিলম্বিত সুরের তালে তালে তালপাখার ঠাণ্ডা বাতাসের মতো তার পিছু পিছু আসছে। বারান্দা থেকে চলে যায় ড্রয়িংরুমে। না, শামীমার কান্না তার পিছু ছাড়ছে না। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে শামীমা, শামীমার খোলা জমিনের মখমলের শরীর, আয়নায় সমর্পিত কান্নায় ভেঙেপড়া এক বিষাদময় ছবির দৃশ্য।
বাবা?
কামরুলের সামনে দাঁড়িয়ে তামীম। হাত বাড়ায় ছেলের দিকে- কোথায় গিয়েছিলে?
তামীম- টিচারের কাছে।
পড়াশুনা কেমন হচ্ছে?
ভালো। বাবা?
কী?
আমাকে একটা ক্রিকেটের ব্যাট কিনে দেওয়ার কথা ছিল-
চল, এখনই দিচ্ছি।
তামীম নেচে ওঠে- চল।
কামরুল আটকা পড়েছিল একটি সুতোবিহীন জালে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার। ছেলে তামীম সেই জাল ছিঁড়ে তাকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। কামরুল হাফ ছেড়ে বাঁচে। পিতা-পুত্র গাড়িতে ওঠে। ড্রাইভার গাড়ি ছাড়ে।
বাবা?
বল।
মাকে নিয়ে আসি?
আজ থাক। কাল তুমি তোমার মাসহ লং ড্রাইভে যাব।
ঠিক আছে।
আঘো ঘুমে আধো জাগরণে অফিসে বসে ছিল কামরুল। শরীরের কোষে কোষে অবসাদ বাসা বেঁধেছে। কোনো কিছু ভালো লাগছে না। মাঝে-মাঝে মনে হয়- আত্মহত্যা করলে কেমন হয়? জাপানিরা নাকি এই আত্মহত্যা শিল্পে দারুণ বিশ্বাসী। যদি আজ আমি এখন মারা যাই- হত্যা করি নিজেকে নিজে- জগৎ সংসার কি থমকে যাবে?
হাসে কামরুল ইসলাম- মোটেই না- আপন মনে সে বলে।
শামীমা প্রকৃত অর্থেই কষ্ট পাবে। তামীম পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু জীবন থেমে থাকবে না। জীবন স্বাভাবিক গতিতেই চলবে। মাঝখানে সেই থাকবে না। সে মারা গেলে এই চেয়ারে কে বসবে? শামীমা? হ্যাঁ শামীমা ইসলাম বসবে। সবকিছু ম্যানেজ করতেও পারবে। শুধু শুধু নিজের উপর অভিমান করে আত্মহত্যার কোনো অর্থ হয় না। ঠিক আছে- করলাম না হয় আত্মহত্যা! গেলাম মানব চরাচরের যাবতীয় সৌন্দর্যকে পায়ে মাড়িয়ে অমরলোকে, অনন্তকালের আঁধারে। পরাগ কি কাঁদবে আমার জন্য কখনো?
পরাগ কি মনে রাখবে আমাকে?
ফোনটা চিৎকার করে ওঠে। বেশ ভালোই ছিল আপন মনে আত্মহত্যার আত্মমগ্ন জগতে। ফোনটা এসে সব নষ্ট করে দেয়।
হ্যালো- বিরক্তির সঙ্গে ফোন তোলে কামরুল।
কী করছিস? এতক্ষণ লাগে ফোন ধরতে? মনে হচ্ছে পাশের রুম থেকে কথা বলছে কিশওয়ার আলি।
চমকে উঠতে উঠতে থমকে যায় কামরুল- কিছুই না। ঝিমুচ্ছিলাম। কোত্থেকে?
কোত্থেকে আবার? আংকারা থেকে বলছি।
আছিস কেমন?
ফাইন। দেশের খবর-টবর কী?
কোন খবর?
এই ব্যবসা-বাণিজ্য-সরকার-রাজনীতি-
সবই আগের মতো।
আসলে দেশের বাইরে আসলেই বোঝা যায় আরা দেশটাকে কত ভালোবাসি। কয়েকদিন হলো দেশের বাইরে এসেছি- কিন্তু দেশটাকে খুব মনে পড়ছে। এজন্য তোকে ফোন করলাম।
বেশ করেছিস। আমারও খুব মনে পড়ছিল তোকে।
কেন?
তুই ছাড়া এই শহরে আমার বন্ধু কে আছে?
অত দূর থেকেও কিশওয়ার আলির হাসির শব্দ ভেসে আসে টেলিফোনে-
আমারও একই কথা। তোর বৌ-বাচ্চারা কেমন আছে?
ভালো। তুই দেশে আসবি কবে?
আমি এখানে একটি পার্টি পেয়েছি। ওরা আমাদের দেশে ইনভেস্ট করতে চায়। কথাবার্তা হচ্ছে। শেষ হলেই চলে আসব। হ্যালো?
হ্যাঁ শুনছি, বল।
তুই আমার বাসায় একটু খোঁজ রাখিস।
আচ্ছা- রাখব। ফেরার আগে আমাকে জানাস- আমি এয়ারপোর্ট থাকব।
জানাব।
হ্যালো? কিশওয়ার?
কী?
আংকারায় কি কেবল ব্যবসা-বাণিজ্য করছিস-
কী বলতে চাস?
শুনেছি- ওখানকার মেয়েরা নাকি দারুণ চার্মিং। মানে-
উপভোগ্য! হ্যাঁ- এ দেশের মেয়েরা আনন্দ দিতেও জানে। নিতেও জানে। মোটকথা শারীরিকভাবে জীবনটাকে তারা উপভোগ করে ষোলো আনা, না তারও বেশি। সে অনেক কথা- অনেক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। টেলিফোনে বললে সাতদিন লাগবে। ঢাকায় ফিরে তোকে সব বলব- কেমন?
একা ফিরবি নাকি একজন নিয়ে ফিরবি?
দুশ্ শালা- জীবনটাকে উপভোগ করি- কিন্তু মৌলিক জায়গাটাকে ঠিক রেখে করি- বুঝলি? আর হ্যাঁ রাখলাম।
আংকারার হোটেল শেরাটনের বারো তলার একটা কক্ষে টেলিফোন রাখার শব্দ পায় কামরুল, ঢাকায় আর একটি অফিস কক্ষে। রিসিভার সেও নামিয়ে রাখে।
রিসিভার নামিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে কামরুল হাসিতে ভেঙে পড়ে। সে হাসতে হাসতে বাথরুমে যায়। প্রস্রাব করতে করতে বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে হাসিটা সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে- ব্যাটা, কিশওয়ার আলি- তোর বলার আগেই আমি তোর বাসার খোঁজ খবর রাখছি। আমার তো একটা দায়িত্ব আছে! প্যান্টের জীপার বন্ধ করা হয় না কামরুলের। খোলা জীপার নিয়ে চেয়ারে বসে। এবার হাসিটা কেবল মুখে নয়- সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে সংক্রামক রোগের মতো। প্রতিটি লোমকূপ থেকে হাসির ঠমক বেরোয়। পুরো কক্ষটা হাসির স্রোতে ভাসে। কী চমৎকার খেলা? এইভাবে নিরুপদ্রবে সিদ কতজনে কাটতে পারে? আমি কামরুল ইসলাম পারছি। কৌশলী খেলোয়াড় না হলে খেলা জমে না। পুরো বিষয়টি কি খেলা? না নেশা? নেশাও এক ধরনের খেলা। খেলাও এক ধরনের নেশা। কিন্তু খেলাটি কি চালিয়ে যাওয়া উচিত?
আবার ফোন বাজে।
হ্যালো? আমি কামরুল বলছি-
খিলখিল হাসির স্রোত ভেসে আসে- প্রতি-উত্তরে। কামরুল যেতে থাকে আগুনের উত্তাপে মোমের মতো, ধীরে এবং লয়ে। কষ্টে এবং সৌরভে। মৌনতার খোলশে উপভোগের আকুল আমন্ত্রণে।
আমি স্বীকার করছি- পরাগ থেমে যায়।
কী?
আমি হেরে গেছি- পরাগের কণ্ঠস্বর কেমন অনুশোচনায় ভরা।
আর আমি?
আপনি তো বিজয়ী মহাপুরুষ।
কামরুল ইসলাম হঠাৎ নিজেকে সত্যি সত্যি মহাপুরুষ ভাবে। এই প্রথম কোনো যুদ্ধে সে জিতল পরাগের বিরুদ্ধে। এবং তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে পরাগ সে কথা নিজের মুখে স্বীকার করেছে, নিজে ফোন করে। পরাগকে পরাগের মতো যতটুকু চিনেছে কামরুল ভেতরে ভেতরে অসম্ভব কঠিন, সিদ্ধান্তে সিদ্ধহস্ত একজন মানুষ, যে ভেঙে যায় কিন্তু মচকায় না, সে-
আচ্ছা- আমাকে এভাবে কষ্ট দেয়া কি ঠিক হচ্ছে?
কীসের কষ্ট?
এই যে গতকাল থেকে আমি বিছানায় পড়ে আছি। আমার জন্যে যার সারাটা জগৎ সংসার উচ্ছন্নে যাবার জোগাড়- একবার এসে পাশে দাঁড়াল না তো!
কী হচ্ছে আপনার!
জ্বর!
আসছি আমি।
রিসিভার রাখে কামরুল। সমস্ত অন্তরটা অপরাধের বধ্যভূমিতে রূপ নেয়। হায় পরাগ অসুস্থ! অথচ সে একবার খবর নেয়নি! অফিস থেকে বেরিয়ে সে গাড়িতে ওঠে। মতিঝিলের ভিড় বাট্টা এড়িয়ে গাড়ি চলতে থাকে, মোহাম্মদপুরে, অসুস্থ এক গন্ধবণিক, সুরক্ষিত, সুরভিত পরাগের দিকে।
সেই বৃষ্টিস্নাত দুপুরে কিশওয়ার আলির বাসায় ডাইনিং টেবিলে খেতে খেতে কামরুল প্রশ্ন করেছিল- একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই!
করুন!
এই যে আমরা- থেমে যায় কামরুল।
হাসে পরাগ- আমরা মানে আমি আর আপনি তো?
হ্যাঁ।
তারপর?
আমি জড়িয়ে পড়েছি নিষিদ্ধ কিন্তু এক অমোঘ সম্পর্কের মোহন মায়াজালে অথবা সম্পর্কের মধ্যে- যাই বলি না- কেন- প্রশ্ন হচ্ছে, এর জন্য দায়ী কে?
কে আবার? আপনি?
পানি পান করছিল কামরুল। পরাগের সুনির্দিষ্ট ভাবনাহীন অভিযুক্ত উত্তরে তার কণ্ঠনালীতে পানি পাথরের মতো আটকে যায়- কষ্টে পাথর পানি গিলে, শব্দে টেবিলের উপর শূন্য গ্লাস রেখে প্রশ্ন রাখে পরাগের চোখে চোখ রেখে- আমি?
অবশ্যই। পরাগের তীর্যক উত্তর। কেন আপনার সন্দেহ আছে নাকি?
আমার তো ধারণা- কামরুল কিছুটা সময় নেয়- সম্পর্কটা দু’জনার ইচ্ছে, সম্মতি এবং পরিবেশের কারণে গড়ে উঠেছে। কিন্তু আমার চেয়ে আপনার দিক থেকে অংশগ্রহণ ছিল অনেক বেশি।
জগতের সব পুরুষ মানুষ- রাজহাঁস।
কামরুল মাংস চিবোয়। পরাগ থালার ভাত আঙুলে নাড়াচাড়া করতে করতে বলে- সব পুরুষেরা পুকুরে নামবে। শরীরের সবকটা পালক ডুবিয়ে আকণ্ঠ জল পান করবে, পানি ঘোলা করবে, সাঁতার কাটার প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে, মেডেল জিতবে, মেডেল গলায়ও পরবে, তারপরও তীরে উঠে শরীরে দুটো ঝাড়া দিয়ে বলবে- আমি তো পুকুরে নামিনি। সাঁতার কাটিনি! আমি তুলসীপাতা পুত-পবিত্র-পবিত্রময়-
কামরুলে সারা শরীরে, মুখে, চোখে, দৃষ্টিতে, সামনের ভাতের থালায়, ভাতে, মাংসে, তরকারি, তরকারির ঝোলে ড াইনিং টেবিলে কর্কশ আগুনের দাহ পায়। মুখ পুড়ে যায়। একি করাতের কলে সে আটকা পড়েছে! যখন ইচ্ছে হবে- পরাগ তাকে কাটবে, ভাজবে অথচ দায়িত্ব নেবে না!
গম্ভীর মুখে ভাত খাওয়া শেষ করে সে। পরাগ তেমন কিছু খায় না। কেবল কামরুলের সঙ্গে বসেছে সৌজন্যের খাতিরে, সঙ্গ দেয়ার জন্য। খাওয়া শেষে সে মুখ মোছে।
আমি এখন যাব।
খুব ঘনিষ্ঠভাবে, কামরুলকে ঘেঁষে দাঁড়ায় পরাগ, ঠোঁটে সেই আদি অকৃত্রিম হাসি-রাগ হয়েছে খুব? গ্রীবা দোলায় সে ঝরা পাতার শব্দে।
কথা বলে না কামরুল। হাত ধরে পরাগ- আমি জানি, আমি মানুষ খুব ভালো না। সারাটা জীবন মুখের কথার কারণে আমাকে অনেক কিছু হারাতে হয়েছে। কিন্তু আমি তো একা! আর পারি না। কখন আসবে? পরাগ সচেতনভাবে আকুল হয়ে, আন্তরিক অভিজ্ঞানে জিজ্ঞেস করছে- আসবে?
দেখি।
নির্দিষ্ট করে না বললে আমি কষ্ট পাব তো।
কষ্ট কারো একার নয়। অন্যরাও কষ্ট পায়-কামরুল বেরিয়ে আসে।
সেই থেকে তিনদিন কোনো যোগাযোগ করেনি সে। কিন্তু আজ আংকারা থেকে কিশওয়ার আর মোহাম্মদপুর থেকে পরাগ কয়েক মিনিট পরপর যে যোগাযোগটা তার সঙ্গে করেছে সেটা কি পূর্ব পরিকল্পিত? কোনো গোপন ষড়যন্ত্র? যা সে জানে না গভীর সঙ্গোপনে সুই সুতোর সংগমে এগিয়ে আসছে তার দিকে?
কামরুল ইসলাম এই মুহূর্তে সার্কাসের তারকাটার উপর এক পায়ে দাঁড়িয়ে টলটলায়মান একজন মানুষ। সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। সার্কাসের মানুষের হাতে হয় একটা লম্বা লাঠি নয়তো ছাতা থাকে- তার হাতে দৃশ্যমান কিছুই নেই। সে ছুটে চলেছে গন্ধ বিলাসী বিড়ালের মতো টানটান উত্তেজনায়। সামনে কি আছে জানা নেই। আসলে এখন আর না গিয়ে নিস্তার নেই তার। নিষিদ্ধ কিন্তু লোভে আর লালসায় টইটম্বুর সমুদ্রে শরীর ডুবিয়ে স্নান করার সুখই আলাদা। নিশি পাওয়া মানুষের মতো মানুষ ছুটে যায় সেদিকে।
গভীর প্রতিক্ষায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিল পরাগ।
গাড়ি থেকে নামতেই পরাগ হাসি ছুঁড়ে মারে। কামরুল গাড়ির দরজা বন্ধ করে সিঁড়িতে ওঠে। পরাগ বারান্দা থেকে সিঁড়ি বেয়ে ঘুড়ির মতো বাঁক খেতে খেতে নিচে নামে। দরজা খুলে দাঁড়ায়। মুখে হাসির ঢেউ। কামরুল ভেতর ঢোকে। দরজা বন্ধ করে পা- হাত ধরে কামরুলের। কামরুল অনুভব করে একটু একটু কাঁপছে পরাগ। শরীরে সামান্য উত্তাপ। দু’জনে একই সমতলে পা রেখে সিঁিড় বেয়ে উপরে ওঠে। ড্রয়িংরুম বেডরুম পার হয়ে বসে বারান্দায়। পরাগ দোলনায়। চেয়াসে বসে গা এলিয়ে কামরুল। দু’জনের অবস্থান এত কাছাকাছি দু’জনে দু’জনের হাত ধরাধরি করে আছে। কোনো কথা নেই কারো মুখে। দুপুরের মৌন রোদ চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
আমি দুঃখিত পরাগ- কামরুলের কণ্ঠে আবেদন।
কেন?
আমি সত্যিই দুঃখিত। আপনার চোখে মুখে বিকেলের ম্লান ছায়া। ঠোঁট জোড়া বেদনাতুর, পাণ্ডুর। এই সময়ে আপনার কাছে থাকা আমার উচিত ছিল।
আপনার তো সংসার আছে।
তা আছে। কখনো কখনো সংসারের চেয়েও অন্যকিছু মূল্যবান হতে পারে।
চোখের তারা নাচায় পরাগ, পাণ্ডুর মুখে হাসির রেখা- শুনে খুব ভালো লাগল।
কী?
এই যে আপনি আমাকে আপনার এতদিনের সাজানো সংসার- তার উপরও আমাকে জায়গা দিয়েছেন। এর চেয়ে অনেক কমও যদি পেতাম আমার নিজের সংসারে- কথা শেষ করে না পরাগ। দুপুরের কাঠালীচাঁপা রোদের দিকে সে আনমনে চেয়ে থাকে।
কামরুল হাতের মধ্যে লুকিয়ে রাখা পরাগের ডান হাত খানা নিয়ে লুকোচুরি খেলে-জানেন পরাগ, জীবনে কখনো বুঝিনি, মানুষের সঙ্গে মানুষের এই যে সম্পর্ক, নিঃশব্দ ভালোবাসা, কত তীব্র-
সেই সঙ্গে কত ভয়ংকরও- প্রশ্ন পরাগের।
ভয়ংকর কেন?
আমি জানি, আপনিও জানেন- আমাদের এই সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ, যত গভীর হোক না কেন শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটা সামাজিকভাবে অবৈধ। কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
যেকোনো শাস্তির জন্য আমি তৈরি- কামরুল ফাঁসির আগে নিজেই নিজের রায় ঘোষণা করে পরাক্রমশালী সম্রাটের মতো।
পারবেন স্ত্রী শামীমা ভাবী, সন্তান তামীমকে অস্বীকার করে আমাকে নতুন করে জীবন সাজাতে? পারবেন আমাকে আপনার বন্ধুর গ্রাস থেকে বের করে নিতে? ভেবে দেখেছেন ঘটনা কোথায় গিয়ে গড়াবে?
কামরুল কথা বলতে পারে না, কেবল পরাগের হাত নিয়ে আপন মনে খেলে, খেলা করে। ওষ্ঠ ছোঁয়ায়। হাত নিয়ে নিজের গালে, কপালে স্পর্শ লাগায়। এই মুহূর্তে সে একটি বাচ্চা বানর। যার কোনোকিছু করার বা ভাবনার নেই। পরাগের হাতের সঙ্গে খুনসুটি করাই তার একমাত্র আরাদ্ধ কাজ।
কথা বলছেনা না কেন?
আমার কোনো কথা নেই।
কোনো কথা নেই?
না।
তাহলে?
পরাগ, আমি আমাকে আপনার হাতে সমর্পণ করছি। যা ভালো মনে করবেন- সেইভাবে আমি রাজি।
খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে পরাগ। দোলনাটা দোলায় সে রেলিংয়ের কার্নিসে পায়ের ধাক্কায়। কামরুলের হাত থেকে ছুটে যায় পরাগের হাত। আবার ফিরে আসে হাতের মধ্যে পরাগের মাধবী হাত।
হাসছেন কেন? কামরুল জানতে চায়।
হাসছি! হাসছি আমি যা করতে চাই আপনি তাই করবেন?
করবÑ কামরুলের দ্বিধাহীন উত্তর।
যদি বলি আপনার স্ত্রী, শামীমা ভাবীকে ডিভোর্স করুন- করবেন?
আপনি বললে অবশ্যই করবো।
সবকিছু আমার উপর চাপাচ্ছেন কেন কামরুল? আপনার নিজের সাহস নেই? সিদ্ধান্ত নেই?
পরাগ?
বলুন।
আমি আগেও বলেছি- আমাদের এই নিষিদ্ধ কিন্তু উপায়হীন সম্পর্কটা তৈরির পেছনে আপনার ভূমিকা আমার চেয়ে অনেক বেশি- আপনার উষ্ণ বাসনার বাঁশিতে আমি নিশি পাওয়া মানুষের মতো ছুটে এসেছি বারবার।
স্বীকার করি।
আমি এখন ঘটনার শিকার। আমি দাঁড়িয়ে আছি কূল-কিনারহীন এক অজানা নদীর প্রান্তে। আমাকে চালাবার দায়িত্বটা তাই আপনাকে নিতে হবে। সত্যি আমি অসহায়। আমি ভাবতে পারছি না দীর্ঘদিনের তিলে তিলে গড়া আমার তিলোতমা সংসার, স্ত্রী, পুত্র তামীমÑ যে আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না- সেসব আর আমার থাকবে না। কামরুল থামে কয়েক মুহূর্ত- আর আপনার এই হাত, যে হাত আমার এখন দুই হাতের মধ্যে জড়াজড়ি করে আছে-
কামরুল?
কী?
আসলে দোষ আপনার নয়- আমারই। আমার উচিত হয়নি খেলাটায় অংশ নেওয়া অথবা কিশওয়ার আলির এমন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আপনি, আপনার সঙ্গে ভর দুপুরে এই বৌ-চি খেলায় নামা আমার ঠিক হয়নি।
পরাগ!
হ্যাঁ! সত্যি বলছি আমি। মানুষের মধ্যে রক্তমাংসের আড়ালে জৈবিক অনুভূতির যে সম্পর্ক, উচিত হয়নি আমাদের সে সম্পর্কটাকে এত তাড়াতাড়ি তৈরি করা। পাপ-পুণ্যের দিকে আমি যাব না। কিন্তু একটা গ্লানি, শ্লেষ, অপরাধবোধ- ঠিক কী বলব জানি না, আমাকে খাচ্ছে কুরে কুরে। মাত্র কয়েকটা দিন, অথচ আমার শরীরে, মনে, কল্পনায় কী আমূল একটা পরিবর্তন। আমি কী করে দাঁড়াব কিশওয়ারের সামনে?
এই প্রশ্নটা তো আমারও।
তাকায় পরাগ। দুই জোড়া বিষণ্ন চোখ কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে একে অপরের দিকে। চোখ নামায় কামরুল- কিশওয়ার আমার বন্ধু। তার স্ত্রী আপনি। যদি কখনো জানতে পারে-
পারলে?
যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন- তোর সঙ্গে লাখ লাখ টাকার ব্যবসা আমার। কখনো একটা টাকা মারিসনি। অথচ আমার স্ত্রী-
শামীমা ভাবী যদি আমাকে প্রশ্ন করে?
কী প্রশ্ন?
আমার মতো ভালো স্বামীটাকে আপনি কেড়ে নিলেন কেন? কামরুল কী উত্তর দেবো?
পরাগ? উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায় কামরুল ইসলাম।
কী?
চলুন আমরা পালিয়ে যাই?
কোথায়?
কামরুল বসতে বসতে জবাব দেয়- জানি না।
হাসে পরাগ-
কামরুল?
বলুন।
আসুন, এক কাজ করি-
কি কাজ?
আপনি আর আমি আগের মতো হয়ে যাই।
যেমন?
যেমন আমি পরাগ, আপনার পরকীয়া সম্পর্কের মানুষ নই। আমি আপনার বন্ধু, বিজনেস পার্টনার কিশওয়ার আলির স্ত্রী। রেনুকা আর অর্নবের মা। আর আপনি আমার স্বামীর বন্ধু। আগের মতো-
কামরুলের কণ্ঠে সাত-সাগরের করুণ হাহাকার- পারবেন আমাকে ভুলে যেতে?
ঠিক বলতে পারব না। চেষ্টা করতে দোষ কোথায়? আমাদের মানসিক কষ্টের বিনিময়ে যদি দুটো সংসার টিকে যায়? কম কী? গাঢ় হয়ে আসে পরাগের কণ্ঠ।
আমি রাজি।
সত্যি বলছেন? পরাগ নিশ্চিত হতে চায়।
সত্যিই বলছি।
চলুন, খেয়ে যাবেন- পরাগ দোলনা থেকে নামার চেষ্টা করে। হাত বাড়িয়ে ধরে কামরুল। নামা এবং ধরার মাঝখানে মাত্র কয়েক মুহূর্তের পাললিক স্পর্শে দুটো শরীর কিছুক্ষণ আগের প্রতিশ্রুতি ভুলে এক হয়ে মিশে যায় অখণ্ড শারীরিক ঝংকারে। গভীর গোপন সৌরভের খোঁজে ব্যাকুল হয়ে ওঠে দুজন।
কালো রঙের নিশান মাইক্রোবাস।
ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছে কামরুল। পেছনের সিটে কিশওয়ার আর তার স্ত্রী পরাগ। একেবারে পেছনের সিটে বসেছে রেনুকা আর অর্নব। গাড়ি ছুটে চলেছে বাসার দিকে। খলবল হাসছে পরাগ। অনর্গল কথা বলছে কিশওয়ারের সঙ্গে।
কখন উঠেছো বিমানে?
কাল সকাল দশটায়।
নরম হাতে বাঁধা কালো ফিতায় মোড়ানো তুলতুলে হাত ঘড়ির দিকে তাকায় পরাগ- কাল সকাল দশটা আর এখন দুপুর বারোটা- মানে চৌদ্দ ঘণ্টা বিমানে বসে ছিলে?
নারে পাগল। সিঙ্গাপুরে বিমান থেমেছিল। রাতে সিঙ্গাপুরের হোটেলে ছিলাম। আবার আজ সকাল দশটায় বিমানে উঠেছি-
তাই বল। পরাগ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
কামরুল? ডাক দেয় কিশওয়ার।
সামনে দ্রুত হারিয়ে যাওয়ার পথের দিকে তাকাতে তাকাতে সাড়া দেয়- কী?
কথা বলছিস না যে!
হাসে কামরুল- আমার কথা পরে বলা যাবে। ভাবীর সঙ্গে এখন বল।
কেন? তোর ভাবী কি হারিয়ে যাবে? নাকি আমার চেয়েও কোনো বড়ো রুই কাতলা এই ক’দিনে জোগাড় করে ফেলেছে?
কী সব ফাজলামো করছ? পেছনে বাচ্চারা- পরাগের মুখে কপট গাম্ভীর্য।
ঠাট্টা হাসিতে ফেটে পড়ে কিশওয়ার- কীরে কামরুল- কথা বলছিস না কেন?
বুকের কলিজা খামচে ধরে কামরুল- তোর এইসব ইতর মার্কা কথা শুনতে আমার ভালো লাগে না।
ধুশ শালা! পনেরো বিশদিন পর দেশে এলাম- একটু ঠাট্টাও করতে পারব না!
ইয়ার্কির আর কোনো মাল-মশল্লা খুঁজে পাস না? আগে বল- কেমন দেখলি আংকারা?
এককথায় প্রকাশ করব?
কর।
চমৎকার। আংকারা তুরস্কের আধুনিক নগর সভ্যতার কেন্দ্রভূমি। আধুনিক সব ইমারত আর সবুজ বৃক্ষে সাজানো। সবচেয়ে আমার ভালো লেগেছে-
থামলি কেন?
ভালো লেগেছে তুরস্কের মেয়েদের।
ঘাড় বাঁকা করে পেছনে তাকায় কামরুলÑ কেন?
প্রশ্নটা করে তেরছা দৃষ্টিতে তাকায় পরাগের দিকে। পরাগ পাথর দৃষ্টি সামনের দিকে তাকানো। যেন সে গাড়িতে নেই। শোনেনি কিশওয়ার আলির এই মন্তব্য।
ওদের সৌন্দর্যে কোনো তুলনা হয় না। কবি সাহিত্যিকেরা কি সব তুলনা উপমা দেয় তাদের লেখায়, সেইসব উপমার সঙ্গে মিলে যায় ওদেশের মেয়েরা।
যেমন?
গায়ের রঙ সাদা ফর্সা নয়, টকটকে লাল ফর্সা। চুল ঈষৎ বাদামি লাল। অধিকাংশের চোখ ধূসর কিন্তু গভীর। হাসি খুশি প্রাণবন্ত। রাস্তাঘাটে পার্কে পানশালায় অবাধ আমন্ত্রণে তারা পরীদের সৌন্দর্যে ঘুরে বেড়ায়। আড্ডা দেয়Ñ পান করে। দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়, বুঝলি?
প্রাণ জুড়ানো দু’একটা সঙ্গে নিয়ে আসলেই পারতে? পরাগের কণ্ঠে সাপের সুর হিস হিস করে ওঠে।
কী আশ্চর্য- দু’চোখে যা দেখেছি, আমি একজন নির্ভেজাল সাংবাদিকের দৃষ্টিতে তারই বর্ণনা দিলাম মাত্র। আর নিয়ে আসা? তুমিও ভালো করে জানো লোভ যতই লাগুক- নিয়ে আসা সম্ভব নয়।
পরাগ জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়Ñ তোমার জন্য অসম্ভব বলে কিছু আছে?
মেয়েদের আমি মানুষ মনে করি না এই জন্যে- চাপা উত্তেজনায় ঠাসা কিশওয়ারের গলা- তারা স্বামীর মুখে ইট কাঠ পাথরের প্রশংসা শুনতেও পারে- কিন্তু অন্য মেয়ের প্রশংসা যদি নিজের মায়ের প্রশংসাও হয়- নাগ-নাগিনীর রূপ ধারণ করে।
কিশওয়ার? গার্জিয়ানের ভূমিকায় নামে কামরুল।
কী? চেচাচ্ছিস কেন?
চেচাব না? কী সব বলছিস?
আচ্ছা কামরুল, তুই বল- আমি একজন পর্যটক হিসেবে যা দেখেছি, তাই বলছি মাত্র। বলা পর্যন্তই শেষ। আর কি কখনো যাওয়া হবে তুরস্কে? কোনো মেয়েকে কি আমি নিয়ে এসেছি?
না, তারপরও সবসময় সব কথা, সত্য হলেও বলা উচিত নয়।
ভান করব কেন?
সুন্দর সহাবস্থানের জন্য।
ভান করে সুন্দর স্থিতিশীল সহাবস্থানকে আমি ঘৃণা করি। যা সত্য তা প্রকাশে কুণ্ঠিত হবো কেন?
সত্যের মহান পূজারী- পরাগের কণ্ঠে শ্লেষের বাউরি বাতাস। কঠোর হয়ে ওঠে কিশওয়ার আলির চোয়াল। চোখের পাতা ঘন ঘন কাঁপে। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রেখে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে।
এই ঘটনার দু’দিন আগে, দুপুরে পরাগের সঙ্গে নিজের অফিসে চলে যায় কামরুল। অনেক দিনের জমে থাকা কিছু কাজ সেরে রাত দশটার দিকে বাসায় ফেরে সে। কাজের বুয়া জানায়- খালাম্মা আর ভাইয়া বাসায় নেই।
কোথায় গেছে?
বাপের বাড়ি।
কীভাবে গেল?
বড়ো গাড়িতে গেছে। সঙ্গে ড্রাইভার আছে।
ও আচ্ছা।
কামরুল উপরে চলে আসে- বেডরুমে। হঠাৎ নিজেকে নির্ভার মনে হয় কামরুলের। জগৎ সংসারে সে একা। একদম একা। কেউ নেই তার। নিঃসঙ্গ হিম শীতল দেশের একমাত্র যাত্রী সে। জামা-কাপড় খুলে দরজা বন্ধ করে বিছানায় একা নগ্ন কামরুল ইসলাম শুয়ে থাকে। চোখের উপর নিয়ন সাইনের উজ্জ্বল আলোর ফোয়ারায় তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সংসারের যাবতীয় অবসাদ তার ঘাড়ে, শরীরে ভূতের মতো চেপে বসেছে। খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে লাইট অফ করে দেয়। পৃথিবীর সব অন্ধকার বাঘের ডোরাকাটা ছাপ নিয়ে পুরো ঘরটাকে দখলে নেয়, নিমিষে। অন্ধকার ঘরটার মধ্যে বিড়ালের নিঃশব্দ পদক্ষেপে জীবন্ত সাপের মতো হামাগুড়ি দিচ্ছে। অপার্থিব এক ভালো লাগার টানে কামরুলের মনে হয়- এখন এই পাঁচতলা বাড়ির চারতলা ফ্লাটের কার্নিশে দাঁড়ালে চাঁদ স্পর্শ করা যাবে। শামীমাহীন রাত সে চাঁদের চরকা কাটা বুড়ির সঙ্গে কথায় কথায় কাটিয়ে দেবে।
আচ্ছা- উঠে বসে নগ্ন কামরুল। পরাগকে ডাকলে কেমন হয়?
সঙ্গে সঙ্গে অজস্র হাসির স্রোতে সারাটা কক্ষে গোলাপের স্পর্শহীন গন্ধের বিলাশ ছড়িয়ে পড়ে। সহস্র হাসির অজস্র রূপ। কোনো হাসি কান্নায় আনন্দাপ্লুত। কোনো হাসি রাজ্যপাট হারা নবাব সিরাজউদ্দৌলার হাহাকারে ভরা। কুৎসিত কোনো ডাইনির হাসি পলে পলে সারাটা ঘর চেটেপুটে খেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে আসছে কামরুলকে চাটার জন্য।
তোমরা কারা? কামরুলের কণ্ঠে ভয়, শীতলতা।
আমরা- আমরাই। হাসিরা কোরাসে কথা কয়।
ঠিকানা কোথায়?
ঠিকানা?
হ্যাঁ।
বারান্দায়। এই বাড়ির বারান্দায়।
নাম কি তোমাদের?
কালো গোলাপ।
ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত কামরুলকে আপাদমস্তক গিলে খাওয়ার জন্য অন্ধকারে এগিয়ে আসে, টের পায় সে। দ্রুত উঠে সে লাইট জ¦ালায়। জানালা, খাটের নিচে, বালিশ, তোষক সব খোঁজে। কোথায় পালানো রাক্ষুসী অন্ধকার এবং আগ্রাসী কালো গোলাপ?
অন্ধকার এবং কালো গোলাপ দু’জন হাত ধরাধরি করে চলে?
খুব ক্ষুধা অনুভব করে কামরুল। ফ্রিজের দরজা খোলে। মুরগির মাংস পেঁপে দিয়ে তরকারি রান্না করা। আলু ভর্তা বাটিতে। ছোটো মাছের পোড়া পোড়া ভাজি সাজানো একটি প্লেটে। ভাত টেবিলে, পাতিলে।
খেতে বসার আগে কামরুল বিছানায় লম্বালম্বি শুয়ে টেলিফোনের নম্বর টেপে। ওপাশে রিং বাদ্য বাজায়। সময় কাটছে। ফোন তুলছে না কেউ। ফোন তো পরাগের বেডরুমে। কেন ধরছে না?
হ্যালো? পরাগের ঘুম জড়ানো কণ্ঠ।
পরাগ?
কে?
আমি।
আমিটা কে? পরাগের কণ্ঠে ঝাঁঝ।
কী হয়েছে আপনার?
কে আপনি? পাল্টা প্রশ্ন পরাগের।
পরাগ? আমি। আমি কামরুল। মরিয়া কামরুল নিজের নাম ঘোষণা করে টেলিফোনে।
কিছুটা বিরক্তির সঙ্গে পরাগ জিজ্ঞেস করে- এত রাতে আবার ফোন কেন?
এত রাতে কোথায়? মাত্র তো এগারোটা বাজে।
আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। শরীর ক্লান্ত লাগছে। ফোনটা রাখুনÑ আমি ঘুমাবো।
পরাগ?
কী হল?
শামীমা বাসায় নেই।
কোন শামীমা?
কামরুল একটা সময় নেয়- আমার স্ত্রী, তামীমের মা।
কোথায় ভাবী?
গ্রামে, বাপের বাড়ি চলে গেছে।
কেন?
জানি না। কামরুলের দীর্ঘশ্বাস টের পায় পরাগ। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম জড়ানো মুখে হাসিতে ফেটে পড়ে পরাগ। রাতের নাচ ঘরে সহস্র নাগিনীর নাচের শব্দও সে হাসির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারবে না। কামরুল নগ্ন শরীরে শোয়া থেকে উঠে বসে, কানে রিসিভার। কেন হাসছে পরাগ? পরাগ কি অন্ধকার আর কালো গোলাপের প্রেতাত্মা?
পরাগ?
কী গো নাগর আমার?
কী বলছেন এসব?
আমার সঙ্গে দিনরাত্রির লেনদেন সেরে বাসায় গিয়ে জানাচ্ছেন- আমার স্ত্রী, তামীমের মা বাসায় নেই। আমার স্ত্রী! রিসিভারে পরাগ তরল বিষ ঢেলে একের পর এক উচ্চারণ করে যাচ্ছে আমার স্ত্রী! আমার স্ত্রী! আমার স্ত্রী!
কামরুলের কান চিলে নিয়ে যাচ্ছে। প্রবাদ গল্পের সেই চিল, দিনে নয়, রাতের অন্ধকারে, শামীমার রেখে যাওয়া গোলাপের আমন্ত্রণে, সাত সাগর পার হয়ে ভুবন চিল এসে তার কান নিয়ে যাচ্ছে। কানের সঙ্গে সেও উড়ছে। ঘর দরজা জানালা বারান্দা ছড়িয়ে সে আকাশে, ঢাকা শহরের শূন্যতার বিশাল বিহ্বল কেন্দ্র বিন্দুতে চিলের ঠোঁটে ঝুলছে। কানের লতি ছিঁড়ে রক্তপাতের অবিরাম স্রোতে তলিয়ে যাচ্ছে সুসজ্জিত রাজউক ভবন, অযোগ্য মেয়রের সুরম্য মেয়র ভবন, ঘুষখোর পুলিশদের হেডকোয়ার্টার, কৃষক শ্রমিকের ঘামে পালিত অকৃতজ্ঞ সচিবকুলের সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রী বাসভবন, বিরোধীদলীয় নেতার সেনানিবাসের সংরক্ষিত সেনাভবনও এই রক্তপাতের ধারাপাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ওদিকে পরাগ ছিনাল মাগীদের মতো কথাটাকে গানে রূপান্তর করে একই তালে সুরে গেয়ে যাচ্ছে- আমার স্ত্রী! আমার স্ত্রী!!! হায়- আমার স্ত্রী!
অস্থির যন্ত্রণাকাতর নগ্ন কামরুল রিসিভার নামিয়ে রাখে। সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্র্রিসিটি চলে যায়। কামরুল নগ্ন অবতার সেজে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। পুরো শহর ঝিমিয়ে পড়েছে। দূরে আলোর উৎসব। সে তাকায় চারপাশে। পরিষ্কার মনে হচ্ছে। বারান্দার মেঝেতে নিজের নগ্ন ছায়াকে দেখতে পায়। ছায়া অনুসরণ করে তাকায় আকাশের গায়ে। চাঁদ ঝুলছে পাকা আমের হলুদ রঙে মাঝ আকাশে। আর চাঁদের বুড়ি এক মনে কাটছে চরকা। চরকার খণ্ডিত সুতো উড়ে উড়ে আসছে কামরুলের কাছে, ছড়িয়ে পড়ছে পায়ের কাছে। জড়িয়ে ধরছে তার প্রশ্ন।
ফোন বাজে। দৌড়ে ফোন তোলে কামরুল- হ্যালো?
আমার সঙ্গে রাগ করেছ? পরাগ ওপাশে। কিন্তু আমার সঙ্গে রাগ করে আপনি পার পাবেন না।
কামরুল লক্ষ করেছে- পরাগ শুরু করেছে তুমিতে, শেষ করেছে আপনিতে। দ্বিধার কলাপাতা দু’জনার মাঝখানে অনড় দাঁড়িয়ে।
কেন পার পাব না?
সে কথা পরে বলব আপনার বন্ধু আংকারার হোটেল থেকে এইমাত্র ফোন করেছেন। তিনি জানিয়েছেন আগামী পরশু, রবিবার ঢাকা এয়ারপোর্টে নামবেন। আপনাকে এয়ারপোর্টে থাকতে বলেছেন- কথাগুলোয় তীক্ষè বিষের হলাহল ছড়িয়ে দেয় কামরুলের কানে পরাগ।
তারপরও সে জিজ্ঞেস করে- শুধু আমাকে? আপনাকে বলেনি?
আমি তার স্ত্রী- কেন বলবে না? একটু থেমে- আপনার কী মনে হয়েছে? চিড়িয়াখানায় কামরুল এক ধরনের সামুদ্রিক মাছ, মাছ না প্রাণী দেখেছে। বিষাক্ত মাছ। অদ্ভুত আকার। ক্ষণে ক্ষণে জায়গা এবং রঙ পাল্টায় সেই বিষাক্ত মাছ। রঙ পাল্টাবার সঙ্গে সঙ্গে পানিতে, নিজের চারপাশে ছড়িয়ে দেয় বিষ। এক ফোঁটার কয়েকশত ভাগের এক ভাগই একজন মানুষকে খুন করার জন্য যথেষ্ট- জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কামরুল- ভাবছে পরাগ কি মানুষ নামের আড়ালে তেমন কোনো বিরল প্রজাতির বিষাক্ত সামুদ্রিক মাছ?
কিশওয়ার আলি আংকারা থেকে এসেই অসুস্থ।
অফিসে যায় না। বিছানায় শোয়া। সুযোগটা নেয় কামরুল। সকাল বিকাল সন্ধ্যা রাতে যখনই সময় পায়- কিশওয়ার আলিকে দেখতে যায়। পাশে বসে। কপালে হাত রাখে। ডাক্তারের খোঁজ খবর নেয়। কিশওয়ারের অসুখ তেমন কিছু নয়। সামান্য জ¦র। সেই সঙ্গে বিরতিহীন কাশি। ডাক্তার ওষুধপত্র দিয়েছে। খাওয়ার পর কাশিটা কমেছে। কিন্তু জ¦রটা যাচ্ছে না। অসুস্থ শরীরে নিজের পাশে একজন বন্ধু থাকলে ভালোই লাগে। কিশওয়ার দারুণ খুশি কামরুলের বদান্যতায়। এক সময় জিজ্ঞেস করে কিশওয়ার- কামরুল?
কী?
তুই দেখি সারাদিন আমার কাছে পড়ে আছিস- তোর ব্যবসা, অফিস কে দেখছে?
ওসব নিয়ে তুই ভাবিস না।
কেন?
ব্যবসা- অফিস- কোনোকালে আমার কি কিছু ছিল?
কী বলছিস? শ্লেষ্মা জড়ানো কণ্ঠ কিশওয়ারের।
আজ আমার যা কিছু সবই তোর বদৌলতে, পরামর্শে, বুদ্ধিতে। তোর পরামর্শ ছিল বলেই ব্যবসায় নেমেছি। না হলে একজন সরকারি চাকরিজীবী হতাম। জীবনকে পেয়ালায় ভরে পান করতে পারতাম না। ছাপোষা কেরানির জীবনযাপন করতে হতো আমাকে! তোর ঋণ জীবনে কি শোধ করা সম্ভব? কিশওয়ারের হাতে হাত রাখে কামরুল।
কামরুলের আর্দ্র কথায় ক্লান্তিময় শরীরের দু’চোখে কৃতজ্ঞতার পানি জমে- কিশওয়ারের- তোর মতো বন্ধু পাওয়া সৌভাগ্যের সমান।
হাসে কামরুল- কী যা তা বলছিস!
সত্যি বলছি। এ জীবনে আমি কম মানুষের উপকার করিনি। অনেক মানুষের উপকার আমি করেছি। না, কখনো বিনিময়ে কিছু পাব- এই আশায় করিনি। কিন্তু সবাই ভুলে গেছে। একমাত্র তুই-ই ব্যতিক্রম কামরুল।
হয়েছে, থাকÑ কামরুল একটু ধমক দেয়- বেশি কথা বললে কাশিটা বাড়বে।
বাড়ুক শালার কাশি। আজ আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে-
আজ থাক। সুস্থ হয়ে বলিস।
কী এমন অসুখ আমার! সামান্য জ¦র কাশি। এ নিয়ে ভাবলে চলে না। শোন কামরুল-
বল।
কয়েকদিন আগে আংকারায় ব্যস্ত দিন কাটিয়ে, রাতে হোটেলে একটু পান টান করে রুমে এসে ঘুমিয়েছি। ক্লান্ত শরীর। অঘোরে ঘুমোচ্ছি। সকালের দিকে একটি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমার ঘুম ভাঙল- এবং ঘুম থেকে জেগে আমি ভয়ে প্রায় দিশেহারা।
দু’জন মানুষ, দু’জন বন্ধুর বাক্চাতুর্য কিংবা অভিনয়ের নৈপুণ্য দেখছিল পরাগ, তার সাজানো বারান্দায় দাঁড়িয়ে, জানালায় চোখ রেখে। কামরুলের কাতর বন্ধুত্বের অভিনয় দেখে হাসল সে কুমিরের মতো গভীর জলে সাঁতার কাটতে কাটতে। কিন্তু কিশওয়ার স্বপ্নের বর্ণনা দিতে আরম্ভ করলে পরাগ বারান্দা ছেড়ে ভেতরে বেডরুমে আসে। বসে বিছানায়। কামরুল তাকায় পরাগের ওদিকে। পরাগের চোখ কখনো এই চোখ দেখেছে- বোঝা যায় না।
কেন- ভয়ে দিশেহারা কেন হলি?- কামরুল জিজ্ঞেস করে।
স্বপ্নে দেখতে পেলাম একটি চিল, যদিও চিল, উড়ছে আকাশে কিন্তু তার মুখটা মানুষের।
মানুষের? কামরুল এবং পরাগ অবিশ্বাস্য এবং মিলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
হ্যাঁ। মানুষের।
পরিচিত মানুষের মুখ?
পরিচিত। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না।
বলিস কী?
কখনো মনে হয়েছে তোর মুখ।
আমার? কামরুল নিজের অজান্তেই তীব্র গতিতে উঠে দাঁড়ায়।
অভয় দেয় কিশওয়ার আলি- ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিছুক্ষণ পর দেখি ভয়ংকর সেই চিলটার মুখ পরাগের।
পরাগ শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে কিশওয়ারের মুখের দিকে। কোনো ভাবান্তর বা প্রতিক্রিয়া হয় না তার। মনে হয় সে জানত- কামরুলের পর কিশওয়ার দেখতে পাবে চিলের মুখে পরাগের মুখ। পুরো কক্ষটার মধ্যে শান্ত ভয়াবহ নিস্তব্ধতা। নীরবতা ভাঙে কিশওয়ার-তারপর আমি দেখলাম আমার মুখ।
তোরও মুখ দেখেছিস?
হ্যাঁ। কিন্তু রঙটা আলাদা।
যেমন?
তোদের দু’জনের রঙ লাল, টাটকা লাল। আমার মুখের রঙটা ছিল এক্কেবারে নীল। ঘাড় পাথরে মতো নীল।
ঐ রাতে সম্ভবত মাল বেশি টেনেছিস- মন্তব্য জুড়ে দেয় কামরুল।
ক্লান্ত প্রসন্ন মুখে হাসি ফোটে কিশওয়ারের- আরে শালা, মালতো প্রতিরাতেই টানি। কিন্তু এই অদ্ভুত স্বপ্নতো কখনো দেখিনি। এরপরে আমি আরো একটা মুখ দেখেছি, ক্ষিপ্ত চিলের ধারালো মুখে।
কার মুখ?
একদমই চিনতে পারিনি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। কামরুলের কাঁধ খামছে ধরে কিশওয়ার- দোস্ত, আমার মনে হচ্ছে এটা স্বপ্ন নয়, এটা কোনো ইঙ্গিত। আমি যদি মরে যাই- আমার পরাগ, রেনুকা আর অর্নবকে দেখিস।
কী যা তা বলছিস? থাম তো কিশওয়ার- কামরুল উঠে বারান্দায় যায়। রেলিংয়ের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। বিকেলের মরা রোদ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। গাছের ছায়ারা দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হচ্ছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য ডুবে যাবে। কামরুল রীতিমতো কাঁপছে। স্থির দাঁড়াতে পারছে না। সে তো কাঁপতে চায় না। কে তাকে কাঁপাচ্ছে? দুই হাতে শক্ত করে রেলিং চেপে ধরে কামরুল। শরীরের কাঁপুনিটা থামাতে চায় সে। কিন্তু শরীরের কাঁপুনি থামছে না। এই তো, এই বারান্দায় প্রথম পরাগ আর সে মিলেছিল শরীর শিৎকারে। আংকারায় বসে তার একটা সিগন্যাল পেয়ে গেছে কিশওয়ার? কীভাবে? কে পাঠাল? আল্লা-খোদা, ঈশ্বর, ভগবান কোনো কিছুই বিশ্বাস করে না কামরুল। তাহলে? কীভাবে জেনে যায় শামীমা? কালো গোলাপেরা কি কোনো সিগন্যাল আংকারায় পাঠিয়েছিল কিশোয়ার আলির কাছে? হোটেলে?
কামরুল বুঝতে পারে- ফেরা দরকার। পরাগের পরাগায়ণ থেকে তার এখনই ফেরা প্রয়োজন। নইলে সবকিছু তাসের ঘরের মতো নিমিষে সর্বনাশের অট্টহাসিতে ভেঙে পড়বে। চারপাশের ইট কাঠ গাছ-পালা পত্র-পল্লব বারান্দা দোলনা আকাশ নক্ষত্র অন্ধকার আলো- সবাই তাদের কীর্তিকলাপ দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু পরাগের অমোঘ শরীরের কস্তুরী ঘ্রাণ তাকে নিশি পাওয়ার নিষিদ্ধ অথচ আশ্চর্য রমণীয় নেশায় ডাকছে। এই ডাক, আহ্বান বা আমন্ত্রণ উপেক্ষা করার শক্তি, সাহস বা ব্যক্তিত্ব কোনোটাই এখন কামরুলের মধ্যে অবশিষ্ট নেই। সে পুতুল- পরাগ তার নিয়তি। ছোটোবেলায়, গ্রামে একবার পুতুল নাচ দেখেছিল কামরুল। মঞ্চে সে দেখতে পায় হরেক রকম পুতুল আসছে, নাচছে, গান গাইছে, যুদ্ধ করছে- কিন্তু কে যে আড়ালে বসে পুতুলদের নাচাচ্ছিল- বুঝতে পারছিল না। কেবল চোখে আশ মিটিয়ে পুতুলদের নাচ দেখছিল। আজ, জীবনের বাস্তবতার দুয়ারে সে নিজেই এখন একজন অবিমৃশ্যকারী পুতুল। তার আকার আছে, রঙ আছে, ভোগের বুভুক্ষু আকাক্সক্ষা আছে, রক্ত মাংসের শরীর আছে। কিন্তু ইচ্ছে শক্তিটা নেই। সেই শক্তির সুদৃশ্য সুতোটা পরাগের হাতে সাপ-লুডু খেলছে।
এয়ারপোর্টে দু’জন পৃথকভাবে গিয়েছিল। ইচ্ছে করেই কামরুল এড়িয়ে যায় পরাগকে। এয়ারপোর্টে গিয়ে কিন্তু এড়াতে পারল না। পরাগ ঠিকই অজস্র মানুষের সামনে একান্ত অনুগত মানুষের মতো তার হাত ধরে নির্বিকার হাসি মুখে হাঁটতে লাগল। কামরুল ভেতরে ভেতের সংকুচিত হতে চাইলেও পরাগের কথা, হাসি আর স্পর্শের মায়ার কাঠিতে সে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে।
পাশাপাশি বসে দু’জনে চা খায়। বিমান আসতে আরো আধা ঘণ্টা বাকি।
চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে কামরুল তাকায় পরাগের দিকে- একটা কথা বলতে চাই।
বলুন।
যা হবার হয়েছে, আমার মনে হয়- এবার ক্ষান্ত দেওয়া দরকার।
কী?
বলছি তো অনেকবার আমাদের সম্পর্কটার ইতি টানা দরকার- কোনো দুর্ঘটনা না ঘটার আগেই।
চাইলেই পারা যায় না সবকিছু।
কেন?
আমি একজন মানুষ। আমার ক্রোধ, লোভ আছে। আছে দুঃখ-বেদনা এবং প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকার। আমি যে পথে এসেছি- জেনে শুনেই এসেছি। যা হবার হবে। আপনার ভয় পাবার কিছু নেই। আমি সব সামলাব।
কীভাবে?
পরাগের ঠোঁটে দুর্বোধ্য এক রহস্যময় হাসি ডানা মেলে- মেয়েমানুষ সব পারে।
সব মেয়ে মানুষ সব পারে?
সবাই পারে কি-না জানি না। আমি পারি এবং পারবো। তার প্রমাণ তো অনেক দেখলেন-
প্রমাণ?
পরাগের চিবুকে রথ উথলে ওঠে- নয়? আপনি অনেকবার আমার কাছ থেকে আপনাকে সরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। চাননি?
কামরুল নির্বাক।
কিন্তু আপনি পারেননি। আমি ডাকিনি কিন্তু আপনি নিজে এসেছেন, পরাগ সম্রাজ্ঞীর গর্বে নিজের বুকে অঙুলি নির্দেশ করে- আমার কাছে। কী আসেননি? পরাগের ঠোঁটে নাট্যমঞ্চের পর্দার মতো গর্বিত হাসির পর্দা দোলে।
পরাগ?
বলুন।
ঘড়ির দিকে তাকায় কামরুল- আর পনেরো মিনিট পর বিমান নামবে টারমাকে। এক ঘণ্টার মধ্যে আমাদের সঙ্গে দেখা হবে কিশওয়ার আলির। সে বন্ধু আমার। কিন্তু আপনার স্বামী। আপনি তার স্ত্রী। এখনো সময় আছে- আপনি আমাকে রেহাই দিন। আমি ফিরে যাই-
কোথায়?
আমার সংসারে। শামীমা আর তামীমের কাছে।
না গেলে ক্ষতি কী? আমরা-আমি আর আপনি এই যে জীবনের স্বাদ উপভোগ করছি- কম উপভোগ্য নয়তো?
আসলে আমি এসব কথা বলছি শুধুমাত্র আপনার জন্য।
আমার জন্য?
হ্যাঁ। ধরুন আজ না হোক কাল আমাদের নিষিদ্ধ অথচ লোভনীয় সম্পর্কটা জানাজানি হয়ে যাবে। আমি নিজেকে গুটিয়ে নেব কিশওয়ারের কাছ থেকে। হয়তো বন্ধুদের কাছে বদনাম হবে। কয়েকদিন খুব মুখরোচক আলোচনার প্রসঙ্গ হবে। তারপর একদিন- অতীতের ঘটনাবলীর মতো সবাই ভুলে যাবে। কিন্তু কিশওয়ার কি আপনাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে? আপনার জীবনে নেমে আসবে দুঃখ এবং নির্যাতনের স্টিম রোলার। আপনিই বলেছেন- কিশওয়ারের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর দানব-
হাসতে হাসতে জবাব দেয়, পরাগ- ওমা! আপনি দেখছি প্রকৃত অর্থে- ভোগ্য অর্থে নয়- একজন দামি ওয়েলউইসারও আমার! খুব ভালো লাগল- আমাকে নিয়ে আপনার এই চিন্তা- চলুন বিমান এখনই নামবে।
পরাগ আন্তরিক স্পর্শে কামরুলের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়ায়। দু’জনে পাশাপাশি হেঁটে বিমানবন্দরের বারান্দায় আসে। আকাশের বুক চিরে পাখির ডানায় ভর দিয়ে বিমানটি মাটিতে নামে। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সেরে কিশওয়ার ব্যাগ-বাক্স পোটরা নিয়ে হাসি মুখে বেরিয়ে আসে। ওঠে মাইক্রোবাসে। গাড়িতে বসে খুচরো আলাপ, ব্যবসা, পিকনিক অনেক কথা হয় দু’জনের মধ্যে। কিশওয়ার আর পরাগ ড্রাইভারের পেছনের সিটে। পেছনের সিটে একা কামরুল। হঠাৎ এক সময় আবিষ্কার করে পরাগ সিটের নিচে থেকে পা গলিয়ে ওর পায়ে পা দিয়ে আঘাত করছে। কামরুলের ইচ্ছে হলো- গাড়ির জানালা ভেঙে পাখি হয়ে আকাশে উড়ে যায়। কিছুক্ষণ আগের চিন্তাধারা মাথা থেকে উধাও।
শরীর কাঁপার সঙ্গে ঘাম দেখা দিয়েছে কামরুলের শরীরে। অসম্ভব নার্ভাস ফিল করছে সে। বাতাসটাকে আগুনের ভেল্কিবাজী মনে হচ্ছে। কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে কামরুলের। পরাগ, কিশওয়ার, মিলনের প্রথম তীর্থ এই বারান্দা, দোলনা, বারান্দার অর্কিড কোনোকিছুই ভালো লাগছে না। অসহ্য যন্ত্রণায় সে কাঁপছে, ঘামছে।
আসুন- মোলায়েম কণ্ঠে ডাকছে পরাগ। পরাগ তার অবিমৃশ্যকারী সেই দুর্বোধ্য অচেনা অজানা ডাকিনী হাসিতে ঠোঁট মুচড়িয়ে চোখের ইশারায় নাচে কামরুলের সামনে দাঁড়িয়ে।
কপালের ঘাম রুমালে মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করে কামরুল- কোথায় যাব?
আপনার বন্ধু ডাকছে- পরাগ কাছে আসে কামরুলেরর ঠোঁট উঁচু করে উপস্থাপন করে কামরুলের মুখের সামনে। কামরুল দেখতে পায়- পরাগের কোমল নরম নিবিড় ঠোঁট থেকে দুর্গন্ধের রক্ত পড়ছে ফোঁটায় ফোঁটায়। সে পরাগের ঠোঁট ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বাথরুমে ঢোকে। মুখ মাথা চোখ ভালো করে ধুয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে ঢেকে কিশওয়ার আর পরাগের বেডরুমে। পরাগ পাশে বসে কিশওয়ার আলির মাথায় হাত বুলায়।
কামরুলকে দেখতে উঠে বসে কিশওয়ার- কোথায় গিয়েছিলি?
বারান্দায়।
আমার স্বপ্ন বলা তো শেষ হয়নি।
শেষ হয়নি?
না।
কামরুল চেয়ারে বসে পড়ে। পরাগ উঠে পাখার বাতাসটা বাড়িয়ে দেয়। কামরুল আবার ভালো লাগে- অন্তর প্রদেশ পরাগের জন্যে কুসুমে কুসুমে ভরে ওঠে। পরাগ বুঝতে পারে- কামরুলের ভালোলাগা, মন্দলাগা। সত্যিকারের অনুভব অনুরোগ থাকলেই সম্ভব-
শোন- ক্লান্ত কণ্ঠে আবার শুরু করে কিশওয়ার- স্বপ্নে আমি দেখলাম চিলটির মুখের ভেতর বড়ো বড়ো দাঁতাল দাঁত। দাঁত থেকে রক্ত পড়ছে আর আমাকে তাড়াচ্ছে।
কোথায়?
আমাকে তাড়াচ্ছে, আমার মাথার উপর চিলটি উড়ছে, পায়ের সুঁচালো রক্তাক্ত নখ উড়তে উড়তে আমার মাথায়, কাঁধে, শরীরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আমি দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। কোথাও কোনো গাছপালা নেই। কেবল বালি আর বালি। বালুর সাদা স্তূপে আমার পা কাটছে যাচ্ছে। আমি দৌড়াতে পারছি না। এই ফাঁকে চিলটি আমার বুকে আমূল তার নগ্ন পা ঢুকিয়ে দিয়ে কই মাছের মতো লাফানো কলজেটা টেনে আনে, বুক চিরে-
প্লিজ, থাম, ককিয়ে ওঠে কামরুল- আর শুনতে পারছি না।
তখনই আমার ঘুম ভেঙেছে।
কামরুল শ্বশুরবাড়ি যায় শামীমাকে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু সেখানে তার জন্যে অন্যরকম এক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। শ্বশুর বাড়ির লোকজন জানায়- শামীমা আর তামীম গত পরশুই ঢাকা ফিরে গেছে।
ঢাকায়? বাসায় তো যায়নি?
তাহলে? প্রশ্নটা শ্বশুরের।
কী করে বলব?
শ্বশুর গ্রামের হলেও শিক্ষিত মানুষ। স্থানীয় স্কুলে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। রাশেদ আহমদ জামাতাকে বসান। নাস্তার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কামরুল টেনশনে টগবগ করে ফুটতে থাকে। রাশেদ আহমদ পাশে বসে বলেন-শামীমা যেদিন এসেছে, আমি ওর মুখ দেখেই অনুমান করেছিলাম- একটা কিছু ঘটেছে তোমাদের মধ্যে। কিন্তু আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি। আমি বাবা। তোমার শাশুড়ি বেঁচে থাকলে- বৃদ্ধ একটু থামলেন। তার কণ্ঠস্বর আর্দ্র হয়ে উঠল। বিগত স্ত্রীর জন্য ভেতরে ভেতরে এখনো ভালোবাসা, শোক বা টান অনুভব করছেন।
দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে আবার আরম্ভ করেন- বাসায় যাও। হয়তো শামীমা তোমার অপেক্ষায় আছে।
জী আচ্ছা- উঠে দাঁড়ায় কামরুল ইসলাম।
কী হলো- আমাকে জানিয়ো। আমি হাঁটতে পারি না। হাঁটুর ব্যথাটা খুব কাবু করেছে আমাকে, নইলে তোমার সঙ্গে যেতাম।
না, আপনার কষ্ট করার দরকার নেই। কামরুল পা বাড়ায়। ঢাকায় এসে দেখে শামীমা বাসায়ও আসেনি।
কোথায় গেল শামীমা? তামীম? বাড়িঘর গাড়ি বিছানা বালিশ ড্রেসিং টেবিল সবই ঠিক আছে, নেই কেবল শামীমা, কামরুলের স্ত্রী, যে একনিষ্ঠ নিকষিত ভালোবাসায় স্থির ছিল। নেই সন্তান-তামীম। কোথায় যেতে পারে? কয়েক দিনের পত্র-পত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করে কামরুল- কোথাও আত্মহত্যা বা এক্সিডেন্টের খবার পাওয়া যায় কি-না। বাসায় এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ক্লান্তি, অস্থিরতা, সিদ্ধান্তহীনতা, পরাগের আকর্ষণ, কিশওয়ার আলির ফিরে আসা- সবকিছু মিলিয়ে কামরুল ইসলাম হতাশা চর্চায় মগ্ন।
কিশওয়ার এখন অনেকটা সুস্থ।
কাশি কমেছে। জ¦র এখনো আসে। কখনো থাকে না। শারীরিকভাবে অবশ্য খুবই দুর্বল। ডাক্তার সকাল এবং সন্ধ্যায় এসে দেখে যায়। অফিসের কাজ বাসায় সারে। সে অবাক- গতকাল এবং আজ বিকেল পর্যন্ত কামরুলের কোনো খবর নেই। কিশওয়ার বিছানায় শুয়ে ফোন করে কামরুলের অফিসে। অফিসের পিওন জানায় দু’দিন অফিসে আসে না। বিস্মিত কিশওয়ার ফোন করে কামরুলের বাসায়। রিং বাজে কিন্তু কেউ রিসিভ করে না। অনেকক্ষণ বাজার পর রিসিভার নামিয়ে রাখে।
তোমার ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে- পরাগ ঢোকে রুমে।
বলতো কামরুলের হলো কী? জিজ্ঞেস করে কিশওয়ার।
কী হয়েছে?
ও দু’দিন অফিসে যায় না। আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। বাসায় ফোন করেছি কেউ ফোন রিসিভ করছে না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। শামীমা ভাবী, তামিম- ওরা তো অধিকাংশ সময় বাসায়ই থাকে।
হয়তো এখন নেই। বাইরে গেছে। পরে আসবে-
আর একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ?
কী? ওষুধ ঢালতে ঢালতে প্রশ্ন করে পরাগ।
ভাবী মানে কামরুলের বৌ আমার অসুস্থতার খবর শুনে একবারও দেখতে আসেনি। বিষয়টা কেমন অস্বাভাবিক লাগছে।
কেন অস্বাভাবিক লাগছে? কিশওয়ারের মুখে ওষুধ ঢালে পরাগ।
ওষুধ খেয়ে মুখটাকে বিকৃত করে জবাব দেয় কিশওয়ার- এর আগে আমার কিংবা আমাদের বাসার কারো সামান্য অসুখ হলে ভাবী কিন্তু দেখতে আসতেন। তোমার কী মনে হয়?
হাসে পরাগ- আমার কী মনে হবে?
না- ওদের মধ্যে কোনো ঝগড়া হয়েছে নাকি?
আমি কী করে বলব?
পরাগ আর কিশওয়ারের কথার মাঝখানো ঢোকে ঝড়ো কাকের শরীরে কামরুল ইসলাম।
কামরুলকে দেখে পরাগ এবং কিশওয়ার দু’জনেই হতবাক!
কী হচ্ছে তোর? জিজ্ঞেস করে অবাক কণ্ঠে কিশওয়ার।
সোফায় বসতে বসতে ভগ্ন কণ্ঠে জবাব দেয় কামরুল- কিছু না।
বললেই হলো? তোর চেহারা কেমন শুষ্ক। বিধ্বস্ত। শার্ট-প্যান্ট অবিন্যস্ত-দাড়ি কাটিসনি ক’দিন? কী হয়েছে বল- ক্লান্ত শরীরে বিছানা ছেড়ে কিশওয়ার বসে কামরুলের পাশে, সোফায়।
পরাগ নিষ্পলক তাকিয়ে দেখে কামরুলকে। কামরুলের বিধ্বস্ত অসহায় মুখ দেখে বুকের ভেতরে কষ্টের পায়রা ডাকে। তাহলে কি শামীমা এবং তামীমকে নিয়ে কোনো খারাপ খবর নিয়ে এসেছে কামরুল? শুধুমাত্র তার খেলার শিকার হয়ে একটি পরিবার, কয়েকটি মানুষ এভাবে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাচ্ছে?
কোথায় ছিলি দু’দিন? কামরুলের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে কিশওয়ার।
বাসায়।
বাসায় ছিলি?
হ্যাঁ।
তুই কি অসুস্থ?
না।
হয়েছে কী- বল আমাকে- আবেগ কণ্ঠ ভেঙে যায় কিশওয়ারের।
কিশওয়ার?
হ্যাঁ, বল-
শামীমাকে খুঁজে পাচ্ছি না।
বলিস কী?
হ্যাঁ। সঙ্গে তামীমও।
বাসা থেকে চলে গেছে।
হ্যাঁ।
কোথায়।
জানি না।
খোঁজখবর করিসনি?
গতকাল গিয়েছিলাম শামীমার বাপের বাড়ি। সেখানে ওরা গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু আমার যাবার আগের দিন ওরা চলে এসেছে। বাসায় এসে দেখি ওরা বাসায় আসেনি। ঢাকা শহরে ওদের যাবার তেমন জায়গাও নেই। সম্ভব-অসম্ভব সব জায়গায় খবর নিয়েছি, হাসপাতাল, থানা সব জায়গায় লোক পাঠিয়েছি-
কোনো খবর পাসনি?
না।
কী হয়েছিল তোদের মধ্যে?
একটু সময় নেয় কামরুল। তাকায় আগে থেকে তাকিয়ে থাকা পরাগের দিকে। পরাগ নিমিষে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। কামরুল আরম্ভ করে- মাসখানেক ধরেই আমার আর শামীমার মধ্যে একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে।
কী সমস্যা?
ঠিক জানি না।
জানিস না?
হঠাৎ ও আমাকে কেন জানি মারাত্মক সন্দেহ করা আরম্ভ করেছে।
কীসের সন্দেহ?
অন্য নারীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে- তুই তো জানিস কিশওয়ার আমার স্বভাবে এসব নেই। কোনোকালে ছিলও না।
জানি তো। তাছাড়া আমি যতদূর জানি ভাবীও তোকে অসম্ভব ভালোবাসে।
হ্যাঁ।
তারপর?
ওর সন্দেহটা প্রথম দিকে পাত্তা দিতাম না। গত সপ্তাহে বাসায় গিয়ে দেখি শামীমা বাসায় নেই, সঙ্গে নিয়ে গেছে তামীমকে। আমি ভাবলাম কোথায় আর যাবে? বড়োজোর বাপের বাড়ি।
অথচ সেখানে গিয়ে জানলি- আগেই চলে এসেছে।
হ্যাঁ।
ব্যাপারটা যত সহজ আর সরলভাবে বললি কামরুল- আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা অত সরল আর সহজ নয়। কোথাও মস্তবড়ো একটা শূন্য রয়েছে।
কী সেই শূন্য।
সেটা তো তোর জানার কথা- আচ্ছা বস, ভেবে-চিন্তে ঠিকই একটা সমাধান বের করে ফেলব, আমি একটু বাথরুমে যাই- কিশওয়ার উঠে ধীরে ধীরে বাথরুমে যায়।
কিশওয়ার বাথরুমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কামরুল ঝঁপিয়ে পড়ে পরাগের বুকে। অসহায় মুমূর্ষ আহত বালকের মতো দু’হাতে আঁকড়ে ধরে পরাগকে। মৃত্যু পথযাত্রী অসুস্থ বালক একটি মাধবীলতার আশ্রয়ের জন্য কান্নায় ভেঙে পড়ে- পরাগ, পরাগ, আমাকে বাঁচাও। তুমি ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই।
পরাগও আঁকড়ে ধরে কামরুলকে। দু’জন দু’জনার কাছে স্থান কাল মহাকাল বাস্তবতার দেওয়ালে আবেগের পেরেক ঠুকে আশ্রয় খোঁজে। এক সময়ে পরাগ নিজেকে সামলিয়ে কামরুলকে সরিয়ে দিতে দিতে বলে- আমার ধারণা ভাবী ফিরে আসবেন। আর আমাদের এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। সমাধান একটা কিছু হবে।
আমার জীবনে তুমি ছাড়া আর কোনো সমাধান নেই- কামরুলের শেষ কথা।
হাসে পরাগ- আগে আমাকে ছেড়ে সুবোধ বালকের মতো বসুন সোফায়। আপনার বন্ধু বের হয়ে এই অবস্থায় দেখলে-
কামরুলও নিজের ভেতর ফিরে আসে। সে পরাগকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু বাথরুম থেকে বের হয়ে মাত্র কয়েক সেকেন্ড দু’জনার আত্মসমর্পণের দৃশ্যটি দেখে ফেলেছে কিশওয়ার। দেখে বিস্মিত হয়েছে। অবাক হয়েছে এবং অবাক হতে হতে সারা শরীর ঝাঁপিয়ে অজস্র হাসির ফোয়ারা ফুটেছে। বাহ্ চমৎকার! পুরো দৃশ্যটি দেখে তার বিন্দু পরিমাণ খারাপ লাগেনি। বেশ ভালো জমজমাট একটি পরকীয়া প্যাকেজ নাটকের গন্ধ পাচ্ছে। হাসে আপন মনে কিশওয়ার আলি- শেষ পর্যন্ত আমার স্ত্রী, সংসার, বন্ধু মিলে সার্থক এক পরকীয়া নাটক? হাসতে হাসতে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে কিশওয়ার আলি সামনের বারান্দায় যায়। বারান্দায় গ্রিল বেয়ে ওঠা পরাগের লতানো অর্কিডের পাতার ফাঁক দিয়ে তাকায় বাইরে। কী চমৎকার এক চলমান পৃথিবী। পৃথিবীতে, সংসারে, ঘরে-ঘরে কত প্যাকেজ নাটকের জন্ম হচ্ছে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। কতজন খবর রাখতে পারে?
কিশওয়ার আলির অবাক লাগছে নিজেকে। দৃশ্যটি দেখার পর- তার তো অসম্ভব রাগ হওয়ার কথা। রাগে ছিঁড়ে খুড়ে সবকিছু ধ্বংস করে দেয়া উচিত অথচ রাগ হচ্ছে না। খারাপও লাগছে না। সমস্ত বিষয়টা একটা বাস্তব জীবন্ত নাটকের মহড়া মনে হচ্ছে। তাহলে কামরুল? তুমিই শেষ পর্যন্ত আমার জীবনে, সংসারে, ঘাতক হয়ে প্রবেশ করলে? কবে থেকে কামরুল? কবে থেকে? খুব আস্তে, ধীরে নিজেকে শুনিয়ে প্রশ্নটা করে যাচ্ছে কিশওয়ার। কিন্তু বারান্দা, গ্রিল কিংবা পরাগের লাগানো অর্কিডের পাতা- কেউ কোনো উত্তর দেয় না। উত্তর পাবার আশায় কিশওয়ার বারান্দা থেকে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে ওঠে। ছাদে হাঁটে, হাসে! কথা বলে ছাদের ফোটানো ফুল এবং অর্কিডের সঙ্গে। চক্ষের পলকে, বলতে গেলে আমার চোখের ওপর ওরা এইভাবে মিলিত হওয়ার সাহস রাখে? আমি কিশওয়ার কি ওদের কাছে মিথ্যা? মৃত? পরাগের জীবনের কোন দিকটি আমি অপূর্ণ রেখেছি? পরাগ- আমি জানি তুমি মেধাবী, গভীর চিন্তার মানুষ। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলে। কিন্তু তোমার দুটি গুণ ছিল। একটি ক্লাসে ভালো রেজাল্ট আর বিস্ময়কর রকম পিপাসার্ত সৌন্দর্য ছিল তোমার। তোমার রূপ দেখেই আমি প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। আজ থেকে বারো বছর আগে, ঘন বর্ষায় এক সন্ধ্যায় আমি তোমাকে দেখে প্রশ্ন করেছিলাম- আপনি শরৎচন্দ্রের বই পড়েন?
পড়ি।
কেমন লাগে?
ভালো লাগে। তবে তার লেখায় পৃথিবীর মেয়েদের জন্য একটা ছিঁচ কাঁদুনে ভাব থাকে যা পছন্দ করি না। রবীন্দ্রনাথ তার চেয়ে অনেক বেশি সাহসী।
আমাদের দেশের ক্রেজ হুমায়ূন আহমেদ-
তার প্রথম দিকের দুটি উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ আর ‘শঙ্খনীল কারাগার’ই শ্রেষ্ঠ-বাকি সব আবর্জনা-
আবর্জনা? বিস্মিত কিশওয়ার!
হ্যাঁ। তবে তার কিছু অসাধারণ ছোটো গল্প আছে। আমাদের দেশের একজন শক্তিমান লেখক আছেন, লেখেন কম কিন্তু চিন্তা উদ্রেককারী, সাহসী মানুষ।
কে তিনি?
আহমদ ছফা।
আপনি তাকে চেনেন?
না। তার লেখা পড়েছি- তার ‘ওঙ্কার’ আমাদের সমাজ বাস্তবতার নিরিখে এক অসাধারণ উপন্যাস। আহমদ ছফার কিছু রাজনৈতিক লেখাও আমি পড়েছি- পড়ে মনে হয়েছে, তিনি প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে একজন সাহসী মানুষ।
আমি কিশওয়ার আলি- মুগ্ধ। না, তুমি পরাগ কেবল রূপে নও, গুণে, চৈতন্যেও খাঁজ ভাঙা, এক তীব্র তরোবারি। পরিবারের সব বাধা উপেক্ষা করে তোমার হাতে আংটি পরালাম। আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল- না- তুমি অল্পদিনেই আমাদের পরিবারকে নিজের হাতের মধ্যে গুটিয়ে নিলে। কী তরতাজা সংসার আমাদের! তুমি আর আমি। আমি আর তুমি। তুমি ছাড়া আমি আমাকে চিন্তা করতে পারতাম না। বিয়ের আগেই থেকেই পারিবারিক ব্যবসায় নামিয়ে দিলেন বাবা। ব্যবসা করতে করতে অবশ্য মানুষের সঙ্গে মিশতে মিশতে আমার স্বাদ ও রুচির টেবিলে খুব স্লোভাবে হলেও আসতে লাগল কিছু পরিবর্তন। তুমি পরাগ, প্রথম দিকেই টের পেয়েছিলে। ইতোমধ্যে সংসারে- এসেছে দুটি ছেলেমেয়ে। রেনুকা আর অর্নব। পরাগ তুমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলে আমাকে স্বর্গের লালসার জগৎ থেকে ফেরানোর- কিন্তু আমি মানুষটা অন্য ধাতুতে গড়া। স্বাদ পেয়েছি বুনো ফুলের, রক্তে জেগেছে বর্ণিল নেশা- তোমাকে আমি উপেক্ষার পাপড়ি উপহার দিয়ে শ্যাওলা জমানো পুকুরে ডুব দিলাম। ঘটনাগুলো আমার জীবনে ঘটছিল নাটকের মতো। যার কোনো নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে ছিল না। অদৃশ্যের কোনো নির্দেশকের নির্দেশে আমি চলছিলাম।
চলতে চলতে অনেক ঘাট প্রান্তর ঘুরেছি। ঘুরে ঘুরে জীবনকে উপভোগ্য, সম্ভোগে, রমণে রমণীয় করে আজ একি দেখালে আমাকে পরাগ? হ্যাঁ, আমি কিশওয়ার আলি কথাশিল্পী মনি হায়দারের এই জঘন্য উপন্যাসের ক্যারেকটার কিশওয়ার আলিÑ স্বীকার করছি- আমি তোমাকে শেষের কয়েকটি বছর চরমভাবে উপেক্ষা করেছি।
কিশওয়ার আলি দাঁড়ায় ছাদের রেলিং ঘেঁষে। তাকায় চারদিকে কিন্তু কোথাও কোনো স্থাপনা নেই। নেই আকাশ, শূন্য। নেই মাটি, শূন্য। নেই ঢাকা শহর ঢাকায়, চারদিকে কেবল ঘন কুয়াশায় ঢাকা গভীর যন্ত্রণার বালিহাঁস উড়ে যায়, উড়ে যাচ্ছে। বালিহাঁসের পালক নেই, ন্যাড়া কুৎসিত বালিহাঁস। কোথায় যাচ্ছে কুৎসিত এইসব বালিহাঁস? কিশওয়ার আলি আবিষ্কার করে-ওর বাড়ির চারতলার ছাদে আসলে কোনো বালিহাঁস নেই- সে ছাড়া। সে নিজেই কুৎসিত বীভৎস এক জবাই করা বালিহাঁস। যার থাকার কথা- মানবিক সমুদ্রে, বালিহাঁসের ঝাঁকে। অথচ সে কেন জনৈক কিশওয়ার আলির ছাদে।
উপেক্ষার প্রতিশোধ নিলে পরাগ? পরাগ- কে আগে কার দিকে ঝুঁকেছিলে তোমরা? তোমার দিকে আগেই কি হাত বাড়িয়েছে কামরুল? নাকি তুমি? কামরুলকে তুমি আহ্বান জানিয়েছ? পরাগ আমাকে তুমি চিনতে পারোনি- আমার ভেতরে ঘুমিয়ে আছে আমার চেয়ে ভয়াবহ আর এক কিশওয়ার আলি। সেই কিশওয়ার আলিকে তুমি কিংবা কামরুল কেউ দেখোনি। এবার দেখাব- তবে খেলার ছলে। খেলতে খেলতে জীবনের জায়নামাজে আমি তোমাকে বমি করাব। সেই বমি আবার সোনার থালায় পরিবেশিত পানতোয়ার মতো পান করাব তোমাকে। তার আগে আমাকে জানতে হবেÑ কে কতটা অপরাধী? কে কতটা ডুবেছো জলে? কে কতটা পুড়েছো শারীরিক শীৎকার মাখা অতুলনীয় অনলে?
কিশওয়ার? ফিরে তাকায় সে।
ছাদে উঠে এসেছে কামরুল। পেছনে পরাগ। দু’জনের উদ্বিগ্ন মুখ। দু’জনকে পাশাপাশি দেখে কেন জানি দৃশ্যটা অসম্ভব ভালো লাগে কিশওয়ারের। বাহ্- দু’জনকে মানিয়েছে তো দারুণ!
ছাদে কখন এসেছিস? কাছে আসে- কামরুল।
বাথরুম থেকে বেরিয়েই এলাম। ভালো লাগছে না। কয়েকটা দিন ঘরের মধ্যে আটকা-
হ্যাঁ, তুই কি ঘরে বসে থাকার মানুষ? সমর্থন করে কামরুল- আয় নিচে চল। আর ছাদের মতো কিনারে দাঁড়িয়েছিস কেন? পড়ে যাবি।
পড়ে? শব্দটা কবুতরের ডিম পাড়ার মতো মুখ থেকে বেড়োয় কিশওয়ারের- পড়ে গেলে?
হাসে কামরুল।
হ্যাঁ, পড়ে গেলে?
হয়েছে আর দুষ্টমী করতে হবে না- কিশওয়ারের হাত ধরে নিয়ে আসে কামরুল। পড়ে গেলে মরে যাবি।
মরে গেলে?
অতসব জানি না। চল, নাম। আমি আবার এখনই যাব।
কোথায় যাবি?
শামীমাকে খুঁজতে হবে না?
আমার মনে হয় ভাবীকে খুঁজতে হবে না। সময় হলেই চলে আসবেন। অথবা ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পেয়ে যাবি।
সামনে সামনে হাঁটছিল কিশওয়ার। দুই পাশে পরাগ আর কামরুল। কিশওয়ারের কথায় তিনজনেই থমকে দাঁড়ায়। চকিতে নুয়ে পরাগ আর কামরুল দৃষ্টি বিনিময় করে। কিশওয়ার না দেখার ভান করে। হাসে, আপন মনে, মেশিনে তাতানো লোহার মতো।
তোর কথাটা বুঝলাম না রে কিশওয়ার-
কোন কথাটা?
শামীমাকে খুঁজতে হবে না- সময় হলেই চলে আসবে-
আংকারার হোটেলে ঐ ভয়ংকর স্বপ্নটা দেখার পর থেকে আমি কেমন যেন হয়ে গেছি। আগাম কিছু ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারি, মনে হয়। আবার সবটা সত্যিও নাও হতে পারে-
সিঁড়ি বেয়ে নামছে তিনজন। প্রথমে কিশওয়ার। কিশওয়ারের পেছনে পরাগ। পরাগের পেছনে কামরুল।
নামতে নামতে কিশওয়ার ভাবছে- শামীমা ভাবী তাহলে সব বুঝতে পেরেছে? আর বুঝতে পেরেছে বলেই নিজে থেকে হারিয়ে গেছে, ছেলেকে নিয়ে? কামরুল, যতদূর জানি ওর স্ত্রীকে অসম্ভব ভালোবাসে। শামীমাও তাই। দু’জনের চমৎকার মানানসই নিটোল সংসার। সহ্য করতে পারেনি এই অপূর্ব কীর্তন- আগে থাকতেই কেটে পড়েছে। কিন্তু গেল কোথায়? আর কামরুল যে খুব উদ্বিগ্ন তাও মনে হচ্ছে না। মুখে একটা মুখোশ এটে আছে ঢেউ খেলানো শোকের। ওটুকু শোক প্রকাশ না করলে মনুষ্য সমাজে বাস করা যায় না। পালিত কুকুরের জন্যও একটা শোক থাকেÑ আর শামীমা তো ওর স্ত্রী। অনেক দিন ঘর সংসার করেছে। একটা ছেলেও আছে সংসারে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও এক ধরনের শ্লেষের শোক অবচেতনে প্রকাশ পাবেই। আসলে কামরুলের সমস্ত মনোযোগ, আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এখন পরাগ। একমাত্র পরাগ। নিষিদ্ধ সম্পর্কের লোবানে একবার জড়িয়ে পড়লে মানুষ- তার স্বাভাবিক জ্ঞানবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে চশমখোর কুকুরে রূপান্তরিত হয়। যেমন পরাগ আর কামরুল। কিশওয়ার দু’জনের জন্য গভীর করুণা অনুভব করে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই- কেননা- সমাজ সংসার সবাই জানে, পরাগ তার স্ত্রী। বিবাহিত স্ত্রী। পরাগকে বিদায় দিতে হতে পারে, হয়তো দেবেও কিন্তু রহস্যের জালটা উদ্ঘাটন করতে হবে আগে। তারপর সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে ছেলেমেয়েকে নিয়ে গ্রামে থাকবে।
পরাগ দীর্ঘদিনের সাহচর্যে যতটুকু চেনে, তার স্বামী কিশওয়ার আলিকে, তাতে বুঝতে পেরেছে- তার ও কামরুলের মধ্যে নিষিদ্ধ অথচ তীব্র মায়ামৃগ সম্পর্কটি যেকোনোভাবেই হোক বুঝে গেছে কিশওয়ার। কিশওয়ার কূল-কিনারাহীন গভীর জলের মাছ। অত্যন্ত কৌশলী খেলোয়াড় সে। বিষয়টা নিয়ে খেলবে। একটু একটু কাটবে চামড়া, আবার আদর করবে, আবার হাসতে হাসতে চামড়ার নিচে, প্রবাহিত রক্তের নালায় লবণ ছাড়বে, হাসতেই থাকবে, হাসতে হাসতে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রাখা দাঁত বের করে মৃত্যুকামড় বসাবে। কিন্তু মৃতুগুহা পর্যন্ত নেবে না। পরিচর্যা করবে, বাঁচিয়ে তুলবে। তারপর ভিন্ন কৌশলে আবার অস্ত্র শানাবে, হয়তো চোখ উৎপাটন করবে, নয়তো রক্তপাত না হওয়া পর্যন্ত নাচতে বলবেÑ নাচবে পরাগ, নাচতে নাচতে পাগল হয়ে যাবে, মরে যাবে, কিন্তু পশুশক্তির কাছে পরাজিত হবে না। কখনো না। নিজেকে নিয়ে খেলতে পারো। অন্যরাও সে খেলার অধিকার রাখে। স্ত্রী হলেই সব নির্বিকার মেনে নিতে হবে? অন্যরা মানলেও আমি পরাগ, মানব না- কখনই না-
তিনজনের পেছনের জন কামরুল ইসলাম নিজেকে নিয়ে পড়েছে মুশকিলে। কোথায় যাবে, কার সঙ্গে যাবে- বুঝতে পারে না। ঘরবাড়ি আছে, মান-সম্মান আছে- কিন্তু সংসার নেই। নিজেকে কেমন ন্যাংটো লাগছে নিজের কাছে। কিশওয়ার- ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে- সন্দেহ নেই কামরুলের। কিন্তু নিজের স্ত্রীকে কীভাবে সামলাবে সে? পরাগকে তালাক দেবে কিশওয়ার! দিক তালাক। দিলেই ভালো। পরাগকে ডিভোর্স দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে করবে সে। কিন্তু পরাগ কি তাকে বিয়ে করবে? নাকি এইরকম- অধরা অস্পষ্ট আসামাজিক সরলরেখার সম্পর্কের সেতুতে সাঁতার কাটবে? মুশকিল হচ্ছে সে পতঙ্গের মতো পরাগের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আছে- কিন্তু পরাগ নির্বিকার। যখন প্রয়োজন ডানা মেলে দেয়। প্রয়োজন শেষে পরাগকে চেনা যায় না। অচেনা পরাগই তাকে টানছে ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে জীবনের যাবতীয় সুষমা, সুকুমার সৌন্দর্য, মহত্ত্ব- সবকিছু কাঙালের মতো সে বিলিয়ে দিতে চায়। পরাগের পরাগায়ণের নাভিতে। কিন্তু পরাগ মর্মর পাথরে নিজস্ব শোষণের অভিলাষে তৈরি গোপন তাজমহল। আবেগে উত্তেজনায় ভাঙে, ভেঙে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়- আবার জমাট বাঁধে পারদের মতো স্পর্শহীন শোকে। কামরুলের বুকের ভেতর শকুন বাসা বেঁধেছে। কামরুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে না- সে কী করবে? কিশওয়ারের সঙ্গে কী কথা বলবে? অথবা কোনো কথা বলা কি উচিত?
কিশওয়ার ক্যায়সা ঘুঘু? ব্যাটা বুঝতে পেরেছে। আমি, ওর বন্ধু, কামরুল ইসলাম ওরই বৌয়ের সঙ্গে সৌরভের মোহন গন্ধে পদ্মপুকুরে ডুব সাঁতার খেলা খেলছি- অথচ কিছু বলছে না। রাগ করছে না। আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করছে না। ব্যাটা জগতের সৌম্য দর্শন নির্লোভ সিদ্ধার্থ পুরুষ। সুযোগের অপেক্ষায় আছে- সুযোগ পেলেই আমার মাথাটা ঘাড় থেকে দিব্যি নামিয়ে দেবে। তারপর কাটা মুণ্ডু পরাগকে, বিরিয়ানির প্লেটে উপহার দিয়ে শোকের মিছিল করবে, মাথায় বাঁধবে কালো কাপড়। শালা ঘুঘু-
তিনজনের তিন কৌণিক ভাবনার শেষে নিচে নামে।
কিশওয়ার? ডাকে কামরুল।
কী?
যাই?
দুপুরে খেয়ে যা।
না। আসি ভাবী- কামরুল প্রয়োজনের চেয়ে অনেক উঁচুতে ডান হাত তুলে সালাম জানায় পরাগকে। হাসে কিশওয়ার আলি।
তিনদিন পর।
কামরুলের অফিসে, দুপুরে অনেক টেলিফোনের মতো ফোন বাজে। বিষণ্ন, খরায় আক্রান্ত, দুর্ভিক্ষপীড়িত কামরুল মরা মানুষের মতো রিসিভার তোলে- হ্যালো!
আমি পরাগ।
আমি পরাগ- শব্দ দুটি কানের পর্দায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কামরুল তার আদিম ও অকৃত্রিম পৌরুষ ও যৌবন ফিরে পায়। উত্তেজনায় মাদী কুকুরের মতো টগবগ করতে থাকে সে। যাবতীয় ক্লেদ, গ্লানি, হতাশা উবে গিয়ে বর্ণাঢ্য শক্তিতে শরীরে তার আগের শক্তি ফিরে আসে।
পরাগ? কণ্ঠে তার সাত সমুদ্দুরের ঢেউ।
বলুন।
কিশওয়ার কোথায়?
অফিসে।
এতদিন, ফোন করেননি কেন?
কিশওয়ারের ভয়ে।
কী আশ্চর্য- আমিও তো কিশওয়ারের ভয়ে কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি। অথচ আমি আপনার একটু স্পর্শের জন্য, একটি কথা শুনবার জন্যে পাগল হয়ে আছি। জানেন কাল বিকেলে মতিঝিলে আমাদের এসোসিয়েশনের অফিসে ওর সঙ্গে আমার মানে কিশওয়ারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
দেখা হয়েছিল?
হ্যাঁ। আপনাকে বলেনি?
না।
কী আশ্চর্য মানুষ! আমাকে সেই আগের মতো, আংকারায় যাওয়ার আগে দু’জন যেভাবে বসতাম, কথা বলতাম, গল্প করতাম- ও আমার সঙ্গে সে রকমই ব্যবহার করল। বরং মনে হয়েছে কিশওয়ার আগের চেয়ে আমার সঙ্গে আরো আন্তরিক, আরো নিবিড় ব্যবহার করছে। ওর ব্যবহারে, বিকট হা হা হাসিতে আমি কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম-
থাক সে কথা।
পরাগ?
শুনছি।
আমরা নষ্ট হয়েছি। আসুন আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে নষ্ট হই। আমি আপনাকে ছাড়া জগৎ সংসারে কিছুই চাই না। আমার আর কোনোকিছুর প্রয়োজন নেই। কিশওয়ার যদি আপনার উপর অন্যায় অত্যাচার করে আপনি চলে আসবেন। আমি প্রস্তুত। সেদিন দুপুরে আপনাকে শেষ দেখে এসেছি, নিচে সিঁড়ির গোড়ায়, আপনার পাণ্ডুর বিষণ্ন চিন্তামগ্ন মুখ আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। পরাগ আমার কথা, কথা শুনছেন?
টেলিফোনের তারে হাসির মায়াজাল ভেসে আসে- কামরুল?
হ্যাঁ পরাগ?
আপনার বন্ধু-
বলুন, থামবেন না। বলুন পরাগ-
আপনার বন্ধু আমাকে অসম্ভব নির্যাতন করছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
কী রকম?
প্রতি রাতে আমাকে ন্যাংটো করে দাঁড় করিয়ে রাখে। বসতেও দেয় না। শুতেও দেয় না- অন্ধকূপে ডুবে যাওয়া মুমূর্ষু মানুষের আর্তনাদের সুরে পরাগের শোক থৈ থৈ কান্না তীরের নাটাই হয়ে আঘাত করে কামরুলকে। কামরুল- শামীমা নামক এক আপাদমস্তক সুগৃহিণীর স্বামী, নির্দোষ কিশোর তামীমের বাবা, রিসিভার নামিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয়- বিদায় বন্ধু কিশওয়ার আলি, বিদায়। তোমার কাছে আমার অশেষ ঋণ। কিন্তু তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা হলে সেই ঋণ অপরিশোধ্য সুদে পরিণত হবে।
অফিস কক্ষে পায়চারী করতে থাকে কামরুল ইসলাম। উত্তেজনায়, রাগে সে ফুঁসছে জানোয়ারের মতো। আর কতকাল শান্তির সুমহান এক টুকরো বাতাসের জন্য, পরাগের জন্য তাকে রক্তলোলুপ তৃষ্ণায় কাতর থাকতে হবে? পরাগকে তো আস্তে আস্তে এইভাবে মেরে ফেলবে কিশওয়ার আলি। না- কিশওয়ার আলি মেরে ফেলবে কেন পরাগকে?
মাহমুদের রেখে যাওয়া নম্বর খুঁজে সে নম্বর টিপে কানে রিসিভার তুলে অপেক্ষায় থাকে। ওপাশে কেবল বেজেই চলছে।
কামরুলের চলে আসার পর, দুপুরে টেবিলে খেতে বসে কিশওয়ার, পরাগ, অর্নব আর রেনুকা। অনেক, অনেকদিন পর চারজন একসঙ্গে বসে টেবিলে খাচ্ছে। পুরো দৃশ্যটি দেখে কিশওয়ারের ভেতরের দেয়ালে পাশাপাশি দুটো ছবি আঁকা হয়ে যায়। একটি ছবিতে সুখের পায়রাদের আনাগোনা। অন্য ছবিতে খণ্ডিত আপেলের অজস্র টুকরো। দুটো ছবি পাশাপাশি আপন অস্তিত্বের দেওয়ালে দেখতে দেখতে কিশওয়ার ডাকে- পরাগ?
বল- ভাত মাখতে মাখতে তাকায়।
অনেকদিন পর সুস্থ হয়ে উঠেছি, চল কোথাও ঘুরে আসি সবাই মিলে-
সত্যি বলছ আব্বু? পরাগের উত্তরের আগেই রেনুকা উল্লসিত কণ্ঠে বাবাকে জিজ্ঞেস করে কনফার্ম হতে চাইছে।
হ্যাঁ যাব- কিশওয়ার তাকায় পরাগের দিকে- তুমি কিছু বলছ না যে!
হাসে পরাগ, বিলম্বিত হাসি- বলার কী আছে? যাব। একসঙ্গে অনেকদিন পর ভালোই লাগবে।
তোমাকে কেমন যেন চিন্তামগ্ন মনে হচ্ছে?
প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে সাড়া দেয় পরাগ- কই না তো? আমি ঠিকই আছি।
সত্যিই ঠিক আছ?
তুমি দেখতে পাচ্ছো না? অসুখ থেকে তুমি ভালো হয়ে উঠেছ, এখন তো চিন্তা করার কিছু নেই।
কই মাছের মাথা দু’পাটি দাঁতের মাঝে ফেলে পিষতে পিষতে কিশওয়ার বলে- তার মানে আমার অসুস্থতায় তুমি চিন্তিত ছিলে?
থাকব না?
কেন?
কী আজে বাজে কথা বলছ? কী হয়েছে তোমার?
আমার? আমার কিছু হয়নি। আমার মনে হচ্ছে তোমার একটা কিছু হয়েছে?
যতসব পাগলের চিন্তা- পরাগ খাওয়া রেখে টেবিল থেকে উঠে যায়। কিশওয়ার আলি হাসে। হাসির আড়ালে তার জান্তব খেলোয়াড়ি মুখোশ ঢাকা পড়ে যায়।
বাবা?
ফিরে তাকায় অর্নবের দিকে- কী বাবা?
আমরা কোথায় যাব?
তুমি বলো, কোথায় গেলে তোমাদের ভালো লাগবে?
চল আশুলিয়া যাই!
চল। আর হ্যাঁ আসার সময় আমরা অন্য কোথাও খেয়ে আসব।
খুব মজা হবে- রেনুকার উত্তর।
অর্নব জিজ্ঞেস করে- কখন যাব?
এই তো আর একটু পরে, বিকেলের দিকে।
বিকেলে কিশওয়ার আলি, পরাগ, রেনুকা আর অর্নব আশুলিয়ায় যায়। সন্ধ্যার পর তারা ঢাকায় ফিরে আসে। বাসায় আসার আগে একটি রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া করে। পরাগ লক্ষ করে কিশওয়ার আগের মতোই স্বাভাবিক আচরণ করছে। দুপুরে টেবিলে খাবার সময়ে যেভাবে বাঁকা কথার ইট সুরকি তীর ছুড়ে মারছিল- তা থেকে এখন অনেকটা শান্ত। হাসি-খুশি উজ্জ্বল মুখ। ভয়ানক ভাবনার পাথর নামে পরাগের বুক চিরে- যাক বাবা, মানুষটা শান্ত হয়েছে!
বাসায় ফেরার পথে সবাইকে নিয়ে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢোকে কিশওয়ার। রেনুকা আর অর্নবের জন্য কাপড় কেনে। নিজের জন্য নতুন একটা রেজর আর পরাগের জন্য একটা বিদেশি দামি সেন্ট কেনে। পরাগ ভেতরে ভেতরে খুব খুশি হয়। প্রায় পাঁচ-সাত বছর পর আগের সেই কিশওয়ারকে পুনরায় পাওয়া যাচ্ছে। তখন কথাবার্তা থাকত না- বাইরে থেকে এসে পরাগকে জোর করে বাইরে নিয়ে যেত, হোটেলে খেত, সারাক্ষণ বকবক করত কিশওয়ার। পরাগ বাধ্যগত হয়ে সব শুনত। একটা মানুষ বৌয়ের সঙ্গে এত কথা বলতে পারে? বান্ধবীদের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছে- এটা থাকে প্রথম দুটি কি একটি বছর। তারপর সবাই পুরোনো মরচেপড়া জীবনের মতো এক ঘেয়েমিতে ভোগে। কথা খুঁজে পায় না স্বামীরা। উল্টো বৌয়ের কথা বলতে চায়। সময় নেই স্বামীদের যেসব প্যাচাল শোনার। সে ক্ষেত্রে পরাগ ভাগ্যবান।
কিন্তু ভাগ্যটা বেশিদিন তার পক্ষে থাকেনি। সে দেখল বান্ধবীদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার অভিজ্ঞতা মিলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে মানুষটি বদলে যাচ্ছে- দেখতে পাচ্ছে, বুঝতেও পারছে পরাগ। প্রাণপণ চেষ্টায় নিজের দিকে টানার চেষ্টা করেছে- কিন্তু সব চেষ্টাকে ফাঁকি দিয়ে কিশওয়ার নিজেকে গুটিয়ে নেয় পরাগের সঙ্গে কেবল পরাগায়ণ নয়- সংসারের যাবতীয় কর্মকাণ্ড থেকেও। পরাগ বিস্মিত। বেদনাহত। এ কোন জীবন? সে সংসার করছে, ছেলেমেয়েদের আদর করছে, বড়ো করছে, অন্যান্য দায়িত্ব পালন করছে, সবই ঠিক আছে। তারপরও অলিখিত একটি অচেনা বিরাট শূন্য পেছনে পেছনে ঘুরছে আর হাসছে। সে হাসি উপহাসের। অবজ্ঞার। উপহাস এবং অবজ্ঞার মাঝে সাঁতার কাটতে কাটতে যখন সত্যিই ক্লান্ত পরাগ, প্রতিশোধের একটি বিকল্প কাঁথা সে ভেতরে ভেতরে সেলাই করছিল- হঠাৎ সামনে পেয়ে যায় কামরুল ইসলামকে।
রাতে নিজের ঘরে ঘুমুতে যাবার প্রস্তুতি নেয় পরাগ। ঢোকে কিশওয়ার। হঠাৎ জড়িয়ে ধরে পরাগকে। দু’হাতে বলিষ্ঠ বুকের মধ্যে জাপটে ধরে বুনো বাঘের মতো চুমো খায়। শুরুতে ব্যাপারটা কেমন খাপছাড়া, অসহ্য মনে হচ্ছিল পরাগের। ইচ্ছের বিরুদ্ধে এই আবেগকে সে মানতে পারছিল না। বাধাও দিচ্ছিল না- পাথরের মতো চুপচাপ ছিল সে কিশওয়ারের বুকে। শরীরে কোনো প্লাবন নেই। ঝড় নেই। কেমন পাশবিক শীতলতা। কিশওয়ারের কামুক উষ্ণ ওষ্ঠ জোড়া মনে হচ্ছিল ক্ষুধার্ত সাপের ঠোঁট। চুমুতে চুমুতে সে পরাগের শরীরে কালো বিষ ঢালছে। বিষ পান বা গ্রহণ করতে করতে এক সময় পরাগ অনুভব করে, তার শরীর নৌকার কোষে কোষে গরম স্রোত বইছে, কামনার শীর্ষবিন্দু আগ্রাসী আগুনের লেলিহান জিহ্বায় গ্রাস করছে। পরাগ স্বতঃস্ফূর্ত প্রণোদনায় আবেগের কম্পমান সুষুমায় জড়িয়ে ধরে কিশওয়ারকে। কিশওয়ার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দ্রুত খুলে ফেলে শরীরের থেকে শাড়ি, পেটিকোট, ব্রা এবং ইলাট্রেট জাঙ্গিয়া। পরাগ নিজেকে নগ্ন দেখে হাত দেয় কিশওয়ারের প্যান্টের বোতামে।
কিশওয়ারের হঠাৎ এক তীব্র লাথিতে পরাগ বিছানা থেকে ছিটকে পড়ে- মোঝাইকে মেঝেতে টুকরো টুকরো খেলনা পাথরের মতো। মেঝেতে পড়ে পরাগ পাকা, ছোলা খোসানো রসে টসটসে কমলার বিক্ষিপ্ত কোয়ার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় পরাগ। তাকায় বিছানায় আধ শোয়া, মিটমিটে হাসি মুখে কিশওয়ারের দিকে।
কেমন আছ পরাগ?
দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া শরীরটা দু’হাতের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়তে পরাগ বিমূর্ত অসহায় কণ্ঠে জানতে চায়- কী করছ এসব?
কী করছি? কিশওয়ারের মুখে হাসিটি জ¦লছে লকলকে জিহ্বায়।
বুঝতে পারছ না- আমার শরীর ব্যথায় জ¦লছে। মারছো কেন?
পরাগ বিছানার দিকে খুুড়িয়ে বিকৃত মুখে আসতেই দেখতে পায়, কিশওয়ারের ডান পা আবার লাথি সাজিয়ে অপেক্ষায় আছে, পরাগকে নাগালে পাবার জন্য। হতবিহবল পরাগ বিস্ময়ে ভয়ে পিছিয়ে যায়। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। নগ্ন শরীর, স্তন, নাভী- নাভীমূল, কালো রেখায় আবৃত্ত জঙ্গা, সুগঠিত মাংসল থাই কাঁপছে, নিয়ন সাইনের তীব্র আলোয়। পরাগ হাঁপাচ্ছে। কিশওয়ার আলির মুখের হাসিটি আরো দানবিক, আরো পাশবিক হয়ে বাঘের চোখের মতো জ¦লছে- পরাগ?
হতাশ কণ্ঠে ভেঙে পড়া পরাগ জিজ্ঞেস করে- কেন এসব করছ?
আচ্ছা বলত রেনুকা এবং অর্নবের মাÑ কার পীড়ন তোমার ভালো লাগে- আমার না কামরুলের?
দেওয়ালের গায়ে তাকায় পরাগ- কী আবোল-তাবোল বলছ আমি বুঝতে পারছি না।
কার সঙ্গে শরীরের লেনদেন করে আনন্দ বেশি পেয়েছো পরাগ? আমার চেয়ে আমার বন্ধু কামরুল কি খুব ভালো খেলোয়াড়?
বিছানার ওপর লুটিয়ে থাকা শাড়ি, পেটিকোট, ব্লাউজ, ব্রা দেখিয়ে বলে পরাগ- ওগুলো নিতে দাও।
কী করবে?
ন্যাংটো থাকব নাকি?
ন্যাংটো থাকলে অসুবিধা কী? আমি কি বাইরের পুরুষ? স্বামী না তোমার! আচ্ছা বলত কামরুলের সামনে ন্যাংটো হতে তোমার কেমন লাগত?
মেঝেয় বসে পড়ে পরাগ- প্লিজ জামা কাপড়গুলো দাও। আমি আর দাঁড়াতে পারছি না।
চট করে বিছানা ছাড়ে কিশওয়ার। বাঘের ক্ষীপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে পরাগের উপর। মাথার চুল ধরে দাঁড় করায়Ñ পরাগ, আমার বিশ্বাসকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার অপরাধ হিসেবে তোমাকে এই শাস্তি পেতে হবে আমৃত্যু।
কী শাস্তি?
সারারাত আমার সামনে ন্যাংটো থাকবে। বসতে পারবে না। হয় দাঁড়িয়ে থাকবে নয়তো হাঁটবে- আমি তোমাকে দেখব। তোমার শরীরের উত্তাপ উত্তেজনা আমি উপভোগ করব কাছে থেকে, কিন্তু স্পর্শ করব না। আর এই শাস্তির প্রসঙ্গ যদি কামরুলকে জানাও- তোমার পুত্র-কন্যাকে আমি মেরে ফেলব। কামরুল যদি বাসায় আসে, কিংবা কামরুলের সঙ্গে কোথাও তোমার দেখা যায়- আগের মতো ব্যবহার করবে। প্রয়োজনে আড়ালে চুমু খাবে, জড়িয়ে ধরবে- যা ইচ্ছে করবেÑ কিন্তু রাতের তোমার প্রতি আমার এই অপরূপ ভালোবাসার কথা বলবে না।
সব অপরাধ কি আমার? তোমার কোনো অপরাধ নেই?
কিশওয়ার বিছানায় বসে- হ্যাঁ, আমার অপরাধ আছে। বিয়ের কয়েক বছরের পর তোমাকে আমার আর ভালো লাগেনি। আমি অন্য স্রোতে শরীর ভাসিয়েছিলাম।
তাহলে? পরাগ তীব্র হয়ে ওঠে- আমাকে উপেক্ষা, অবজ্ঞা, অপমান করার জন্য আমিও তো তোমাকে শাস্তি দিতে পারি!
পরাগের দিকে কিশওয়ার তাকায় অবাক চোখে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে কিশওয়ার শরীর বিছানা, ঘর, দেওয়ালে টাঙ্গানো নগ্ন ম্যাডোনার ছবি কাঁপিয়ে হাসতে থাকে গেলাসের পর গেলাস। ভাবলেশহীন চোখে পরাগ গভীর রাতের আলেয়ায় নিজের কক্ষে, নিজেকে উপহাসের চাবুক হিসেবে দেখতে দেখতে, কিশওয়ারের হাসির পেয়ালায় শরবৎ পান করতে করতে সিদ্ধান্ত নেয়- জীবনে যাই আসুক, বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেওয়া হবে না।
হাসি থামিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে কিশওয়ার। বিছানায় শুয়ে শুয়ে পা দোলাতে দোলাতে বলে- পরাগ, ঠিকই বলেছ তুমি। আমাকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার তোমারও আছে। বিষয়টা একতরফা নয়। পারলে তুমি শাস্তি দিও- আমি অপেক্ষায় রইলাম- কিশওয়ার আবার কিছুক্ষণ আগের মতো জলপথ আকাশপথ স্থলপথ কাঁপিয়ে হাসতে থাকে।
কিশওয়ার আলি মারা গেছে, না নিহত হয়েছে প্রায় দু’মাস, পুলিশ এখন পর্যন্ত হত্যাকারীর কোনো লেশমাত্র খুঁজে পায়নি। কয়েকদিন আগে পুলিশের এই ব্যর্থতার প্রতিবাদে সাংবাদিক সম্মেলন করেছে পরাগ প্রেসক্লাবে। পত্রিকায় কালারফুল ছবি এসেছে। একটি লম্বা সোফায় বসা পরাগ। শরীর কালো কাপড়ে আবৃত। কালো কাপড়ের মাঝখানে ওর শোকের ছায়ায় ঢাকা গোলাপি মুখমণ্ডল তারাহীন আকাশ একমাত্র চাঁদের আলোয় জ¦লছে। দু’চোখের তারায় তারায় বিদ্যুৎ চমকায়। এই বিষণ্ন সৌন্দর্য সাংবাদিকেরা আর দেখেনি। পরাগের দু’পাশে রেনুকা আর অর্নব। তিনজনার পেছনে পারিবারিক বন্ধু হিসেবে দাঁড়ানো শহরের উঠতি নামি ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম। সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরেÑ কামরুল অশ্রুসজল চোখে তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু বিজনেস পার্টনার কিশওয়ার আলির হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছে। দুটি কিশোর-কিশোরী বাচ্চার প্রতি মানবিকবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছে অপরাধীকে খুঁজে বের করে শাস্তির আয়োজন করতে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে পরাগ জানিয়েছে- এখন পর্যন্ত তার স্বামীর হত্যাকারী কে তাকে চিনতে বা জানতে পারেনি। তবে তাড়াতাড়ি পাবে বলে আশা করেছে। হত্যাকারীরা কেউ তার স্বামীর বন্ধু বা পরিচিতজন বা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছে কি-নাÑ প্রশ্নের উত্তরে পরাগ বলেছে- হতে পারে, নাও হতে পারে।
পরের দিন পত্রিকায় ফলাও প্রচার হয়েছে পরাগের সংবাদ সম্মেলন। চেতনে-অবচেতনে কামরুল এখন ছায়ার মতো লেগে থাকে পরাগের সঙ্গে সঙ্গে। কিশওয়ার হত্যার পর পরাগ অসম্ভব ভেঙে পড়েছে। আগের সেই রোমান্টিক ভীরু চঞ্চলতা একেবারেই নেই ওর মধ্যে। তবে এক ধরনের বুনো সৌন্দর্য পরাগের চেহারায় ডাল-পালা মেলছে শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভেজা তরুণ বৃক্ষের মতো। কামরুল পুড়তে চায়, কামরুল কাঠ কয়লায় পরিণত হতে চায়, কামরুল সন্ন্যাসী হতে চায়- কিন্তু পরাগ স্থির, অবিচল। তিন মাস আগের সঙ্গে বর্তমান পরাগের কোনো মিল নেই। এই পরাগ চেনে না সেই পরাগকে। এই পরাগ প্রশ্রয় দেয় না সেই পরাগকে। আধা ভৌতিক, আধা বাস্তবতার ভেতেরে দিন রাত চলে কামরুলের। যে আশায় যে কামনাপুরের আগুনে পুড়ে পুড়ে, পরাগকে নিজের মতো করে পাওয়ার অন্ধ বিশ্বাসে কামরুল এই কাণ্ডটা ঘটিয়েছে, মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছে- সে বৃক্ষে ফুল-ফল কিছুই হচ্ছে না। মাস খানেক পরাগের মধ্যে একটা আরোপিত খোলস ছিল। কামরুল অনেক সাধনায় সেই খোলসটাকে কিছুটা খুলে ফেলেছে। পরাগকে নিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে লং ড্রাইভে যায়। একসঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেয়। একটু একটু করে, এগুচ্ছে পূর্ণ অধিকার নিয়ে। এরইমধ্যে পরাগের মা বাবার সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে কামরুল। তারা পরাগের সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিয়েছে সবকিছু। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব ব্যবসার লোকজন সবাইকে ম্যানেজ করে ফেলেছে কামরুল। কেবল পরাগ পিছিয়ে যাচ্ছে। পরাগ একটি ফুল নিঃসন্দেহে কিন্তু রাতের কোন প্রহরে ফোটে বুঝতে পারে না কামরুল। কয়েকদিন আগে, কিশওয়ারের বাড়ির ছাদে, জ্যোৎস্নাগলা শুনশান রাতে বসেছিল পরাগ আর কামরুল। কামরুল নিজের হাতের মধ্যে পরাগের ডান হাত নিয়ে লুকোচরি খেলতে খেলতে জানতে চায়- পরাগ যে গেছে, যাক। আসুন, আমরা নতুন করে জীবন সাজাই?
হাসে পরাগ- সাজাবেন?
হ্যাঁ।
সত্যি সাজাবেন?
বলছি তো হাজার বার। লক্ষ বার। আমি আপনার জন্য সব পারি-
আমি জানি।
তাহলে আর দ্বিধা কেন?
আমরা যেভাবে আছি, সেভাবে থাকাটাই তো ভালো। তাছাড়া আমার উপর দুটি বাচ্চা আছে- ওদের ভবিষ্যৎ আমাকে দেখতে হবে।
আপনি একা দেখবেন কেন? আমিও তো দেখতে চাই আপনার সঙ্গে থেকে, মিলেমিশে-
আমাকে আর কয়েকটা দিন সময় দিন। আমি একটু ভাবি।
বিশ্বাস করেন না আমাকে? গলায় অভিমান কামরুলের।
রহস্যময় হাসি খেলে পরাগের ঠোঁটে-বিশ্বাস? খুব কঠিন প্রশ্ন। উত্তর দেওয়া আরো কঠিন বিশেষত আমার জন্য।
আমার কি মনে হচ্ছে জানেন?
বললে জানব।
আমি একটি অন্ধকূপে ঝাঁপ দিয়েছি এবং পড়ছি তো পড়ছিই। কোনো তল পাচ্ছি না। পড়তে পড়তে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাব।
কামরুল?
বলুন।
আমার মনে হয় কি জানেন? আমার মনে হয়Ñ আপনি যখন আমার কাছে আসেন, আমাকে স্পর্শ করেনÑ রেনুকার বাবা এসে আমাদের দু’জনার মাঝখানে দাঁড়ায় বাতাসের মতো। সে খুব বিষণ্ন থাকে, কাঁদে। আপনি টের পান?
নাহ্।
জানি। আপনি টের পান না। চলুন নিচে যাই- রেনুকা অন্যকিছু ভাবতে পারে। ও তো বড়ো হচ্ছে-
চলুন।
দু’জনে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। সিঁড়ির গোড়ায় বিমর্ষ মুখে, প্রশ্নবোধক চোখে দাঁড়িয়ে আছে রেনুকা। রেনুকার চোখের তারায় কিলবিল কিলবিল করছে অজস্র শকুন। হঠাৎ খুব ভয় পায় কামরুল। চলে যায় দ্রুত না খেয়েই অথচ পরাগ অনেক যত্নে রান্না করেছিল কামরুলের জন্য।
অফিসে এসে পত্রিকার পাতায় চোখ দিয়েই বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায় কামরুল। পত্রিকার মাঝ বরাবর আঠারো পয়েন্টে বড়ো টাইপে ছাপা খবর ‘রাজধানীর শীর্ষ খুনি রমেশ ভাণ্ডারী ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে’। রমেশ ভাণ্ডারীর একটি ছবিও ছাপা হয়েছে। রিপোর্টারের নিখুঁত বর্ণনায় রমেশ ভাণ্ডারীর এ পর্যন্ত আটটি খুনের বর্ণনা ছাপা হয়েছে। সর্বশেষ খুন করেছে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কিশওয়ার আলিকে। কামরুল ইসলাম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শীতল কক্ষে ঘামছে, কাঁপছে। জিহ্বা, কণ্ঠ শুকিয়ে জমাটবাঁধা সিমেন্ট হচ্ছে। কী করবে সে? মতিঝিলের পনেরো তলা বিল্ডিং থেকে লাফিয়ে নিচে পড়বে? নাকি রেনুকা আর অর্নবের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবে? নাকি এখনই পালাবে? কোথায় পালাবে? সাগরে? মরুভূমিতে? আসমানে? না কোথাও সে একমুঠো আড়াল খুঁজে পায় না পালানোর জন্য। এতবড়ো একটা গ্রহ কোথাও তার জন্য আড়াল নেই। পুরো পৃথিবীটা ন্যাংটো। উদোম। পৃথিবীটা হাসছে হা হা শব্দে। সে পরপর কয়েক গ্লাস পানি খায়। কিন্তু কণ্ঠের সিমেন্ট বাঁধা শুষ্কতা কমছে না। সে দেখতে পাচ্ছেÑ অজস্র মানুষ, আদালত, পুলিশ, হ্যান্ডকাফ, রশি, পুলিশের গাড়ি, রেনুকা, অর্নব, পরগা, শামীমা, তামীম, কিশওয়ার সবাই সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে তাকে কফিনে ঢোকানোর চেষ্টা করছে জোর করে। কামরুল প্রাণপণ লড়ছে না ঢোকার জন্য। কিশওয়ার লাথি দিয়ে ওকে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয় এবং তাড়াতাড়ি কফিনের তালা আটকে ফেলে।
না, এত সহজে নিজেকে নিজের কফিনে ঢোকাতে চায় না কামরুল। উত্তেজনা কমিয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখা দরকার। নিজেকে নিজে বোঝায় সে। আজকাল দুই একটা খুন কিছু না। ভয় পেলে চলবে না। সে নিজেকে স্থির রাখে। আগে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা প্রয়োজন। আইনজীবী লাগাতে হবে। টাকা পয়সা যত লাগে খরচ করা যাবে। টাকা থাকলে পুলিশ, পুলিশের বাপ-দাদা চৌদ্দগোষ্ঠী কিনে পকেটে রেখে চলাফেরা কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয় এই বাংলাদেশে আজকাল। প্রয়োজনবোধ করলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পর্কটা বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো রমেশ ভাণ্ডারীর মতো মানুষকে পুলিশ ধরল কীভাবে?
ঘটনাটা পরাগকে জানানো দরকার। এইসব দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে পরাগের পরামর্শ খুবই শক্তিদায়ক, প্রেরণাদায়ক। সে ফোনের বাটন চেপে। রিং হচ্ছে। পরাগই রিসিভার তোলে- হ্যালো?
পরাগ, দেখেছেন পত্রিকা- কিশওয়ারের খুনি রমেশ ভাণ্ডারী ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে।
আমি তো ধরিয়ে দিয়েছি- পরাগ স্বাভাবিক উচ্ছলতায় কথা বলে।
কী বললেন? উত্তেজনায় টকবগ করতে করতে দাঁড়িয়ে যায় কামরুল। আপনি ধরিয়ে দিয়েছেন?
হ্যাঁ। আমি।
ঠিকানা পেলেন কোথায়?
হাসে পরাগ- হাসিতে চাঁদমারি ছিদ্র হয়ে যায়Ñ ঠিকানা?
হ্যাঁ।
আপনিই তো আমাকে দিয়েছিলেন! মনে নেই আপনার! আশ্চর্য!
আমি দিয়েছিলাম?
বলছি তো।
আমি দিয়েছিলাম? আপনাকে? রমেশ ভাণ্ডারীর ঠিকানা?
ঠিকানা নয়- টেলিফোন নম্বর দিয়েছিলেন।
কবে? কখন?
ওমা! আপনি দেখি সব ভুলে গুলে খেয়ে বসে আছেন। তিনদিন আগে, আমার পঁয়ত্রিশতম জন্মদিনে, আমার বিছানায় শুয়ে শুয়ে পানীয় পান করতে করতে, হাসতে হাসতে, জন্মদিনের কেক কাটতে কাটতে আমাকে পাবার জন্য কী কী করেছেন- বললেন না? আমি শুধু পুলিশকে রমেশ ভাণ্ডারীর টেলিফোন নম্বরটি দিয়েছি। বাকি কাজ ওরাই করেছে। যাই হোক আপনার বন্ধু, বিজনেস পার্টনার কিশওয়ার আলির খুনি ধরা পড়েছেÑ আপনি সন্তুষ্ট নন? খুশি হননি?
পরাগ?
বলুন।
এ আপনি কী করলেন? আমাকে এইভাবে ধরিয়ে দিলেন?
ভুল বললেন কামরুল- আমি আপনাকে ধরিয়ে দেইনি। একজন ঠাণ্ডা মাথার খুনিকে ধরিয়ে দিয়েছি। যার পেশা হচ্ছে মানুষ খুন করা। নাম রমেশ ভাণ্ডারী।
আমিও তো জড়িয়ে গেলাম রমেশ ভাণ্ডারীর সঙ্গে। কামরুলের কণ্ঠে থ্যাঁতলানো আর্তনাদ।
সে আপনার কর্মফল। কাজ করবেন তার ফল ভোগ করবেন না তা কী করে হয়?
পরাগ!
বলুন।
আমি কী ক্ষতি করেছি আপনার? আমি তো আপনার হাতের পুতুল ছিলাম। যেভাবে আমাকে নাচাচ্ছিলেন আমি সেভাবেই নেচেছি। যতদিন বেঁচে থাকতে চাই- আপনার দাস হয়েই থাকতাম-
বকের ডানার মতো উথাল-পাতাল হাসির তরঙ্গ শোনে কামরুল- তাই নাকি?
আপনিই বলুন। তাই নয়?
না কামরুল। স্বীকার করি আপনাকে আমি প্রলুব্ধ করেছি- কিন্তু আমার স্বামীকে খুন করতে তো বলিনি।
যদি করে থাকি- সে তো আপনারই জন্য?
আমার জন্য আপনি আমার স্বামীকে খুন করিয়েছেন?
হ্যাঁ।
আমাকে সাদা শাড়ি পরিয়ে আপনার কী লাভ? আমার কি প্রয়োজন ছিল নিষ্পাপ সন্তানদের পিতৃহারা করে?
পরাগ আপনি সব জানেন, এই ঘটনার মূল চক্র আপনি। আর এখন সব নির্ভুলভাবে অস্বীকার করছেন?
কে বলল অস্বীকার করছি? কৌতুক পরাগের কণ্ঠে।
সব দোষ আপনি আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছেন?
চাপালাম কই? নিজেই তো ধারণ করেছেন। দেখুন আমি আপনাকে বলেছি-
কী বলেছেন?
রেনুকার বাবা আমার উপর নির্যাতন চালিয়েছে। কিন্তু তাকে খুন করতে তো বলিনি- বলেছি?
পরাগ, আপনি জানেন, আপনাকে আমি কতটা উপলব্ধি করি? ভালোবাসি? শুধু আপনাকে নিজের করে পাবার জন্য স্ত্রী পুত্র সংসারের খবর পর্যন্ত নিচ্ছি না। আপনি, আপনার শরীর, আপনার আমন্ত্রণ, হাসি, চোখ আমাক চুম্বকের মতো প্রবল পাহারা দিচ্ছে। এখন এই মুমূর্ষুকালে আপনি আমাকে পরামর্শ দিন, আমি কী করব?
শুনুন-
হ্যাঁ বলুন।
আপনার সামনে দুটো পথ খোলা আছে। একটা হচ্ছে নির্বিকারভাবে আত্মহত্যা করা। দ্বিতীয় পথ পালিয়ে যাওয়া। আমি জানি আপনি আত্মহত্যা করতে পারবেন না। কারণ ভীতুরা সাহসী কাজ করতে পারে না। তার চেয়ে আপনি পালিয়ে যানÑ
পালিয়ে যাব।
হ্যাঁ এবং খুব তাড়াতাড়ি। কারণ পুলিশ ইন্টারগেশনে এতক্ষণে নিশ্চয়ই রমেশ ভাণ্ডারী আপনার নাম বলে দিয়েছে।
কামরুল ইসলাম আর কামরুল ইসলাম নেই। একটি বিশাল শূন্যতায় যে হাত পা ছড়িয়ে বেলুনের মতো ভাসছে। কামরুল এখন সাদা একটি রুমাল- ঐ রুমাল তৈরি হয়েছে মাংসে কিন্তু কোনো রক্ত নেই। হৃৎপিণ্ড নেই। পরাগ নেই। কামনা-বাসনা কিছুই নেই। অবিরাম শূন্যতায় উড়ছে কামরুল।
হ্যালো- সাড়া না পেয়ে তাড়া দেয় পরাগ। হ্যালো- কামরুল-
কেন আমার সঙ্গে এমন করলেন?
প্রতিশোধের জন্য।
কীসের প্রতিশোধ?
পৃথিবীর পুরুষেরা মেয়েদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে। নাচায়। কাঁদায়। হাসায়। আমি যার শিকার হয়েছি কিশওয়ার কর্তৃক। আপনার দ্বারা। আপনি, আপনার বন্ধু আমাকে ভোগ করেছেন, সংসারের কাজে ব্যবহার করছেন। কিন্তু ভালোবাসেননি।
মিথ্যা, সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলছেন।
না। কিশওয়ার, যে বন্ধুকে আপনি মেরে ফেলেছেন, যে আমার স্বামী ছিল- সে প্রথম দিকে আমাকে ভালোবেসেছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু কয়েক বছর পার হওয়ার পর তার রুচিতে পরিবর্তন এল- সে ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবে নারী মাংসের স্বাদ নিতে। তার শারীরিক এবং অর্থনৈতিক যোগ্যতা দুই-ই ছিল। আমাকে উপেক্ষার পুকুরে ডুবিয়ে রেখে সে যা ইচ্ছে তাই করবে তাতে অসুবিধা নেই। যেই আমি আপনার মতো úুরুষের সঙ্গে মিলিত হলাম- সে সহ্য করতে পারল না। তারপরের ঘটনা তো আপনিই জানেন।
পরাগ? ক্লান্ত বিধ্বস্ত কণ্ঠ কামরুলের। যা হবার হয়েছে- আমি আপনাকে ছাড়া আমাকে ভাবতে পারছি না। আপনার কথানুযায়ী পালিয়ে যাব। বলুন আপনিও আমার সঙ্গে-
কোথায়?
আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন-
হাসিতে ভেঙে পড়ে পরাগ- এই আধুনিক যুগের মানুষ বলছেন প্রাচীন কালের রূপকথার গল্প। কামরুল দেরি করলেই আপনার বিপদ। বেঁচে থাকলে কথা আরো বলা যাবেÑ তাড়াতাড়ি পালান-
আমি আপনাকে ছাড়া পালাব না। আমি আপনাকে ভালোবাসি পরাগ। জীবন দিয়ে ভালোবাসি।
মিথ্যা কথা।
আমার জন্মের কসম-মিথ্যা বলছি না- মরিয়া হয়ে বলে কামরুল।
কামরুল! আবেগ থাকা ভালো কিন্তু অর্থহীন আবেগ থাকা ভালো নয়। আমরা দু’জন দু’জনের সঙ্গে গভীর আন্তরিক প্রতারণা করেছি। আমরা দু’জন দু’জনকে উপভোগ করেছি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে- যেন কাক-পক্ষিও না জানতে পারে। কিন্তু নিষিদ্ধ সম্পর্ক প্রতিপক্ষেরা তাড়াতাড়ি জেনে যায়। আমরা দু’জনে খুব সচেতনভাবে ‘আপনি সম্বোধন করেছি। ভালোবাসার মানুষরা কি আপনি বলে? কিছুটা সময় নেয় পরাগ। আবার বলে- আর আপনার সঙ্গে আমি কেন যাব? প্রথমত আপনি একজন খুনি, আসামী। দ্বিতীয়ত আপনি যাকে খুন করেছেন আমি তারই স্ত্রী। যদি আমি আপনার সঙ্গে যাই আপনার খুনের দায়ভার কি আমার উপর পড়বে না! আপনি শুনছেন আমার কথা? হ্যালো?
মরা মানুষের কণ্ঠে জবাব দেয় কামরুল- শুনছি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছি।
গুড। আমার স্বামীর বিশাল সম্পত্তি আছে। আগেই বলেছি- বাচ্চা দুটোর কথা। আমিই এখন এইসবের একচ্ছত্র অধিপতি, মালিক। সুতরাং আমি কখনোই যাব না আপনার সঙ্গে। আর একটা কথা আমার অনুরোধ, এতদিনে যে নিবিড় মধুর লোভনীয় সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল- সেই সম্পর্কের নামে বলছি আমার সঙ্গে আর কোনোদিন যোগাযোগ রাখবেন না। আপনার মঙ্গল হোক।
ফোন রেখে দেয় পরাগ।
ভোর হয়ে আসছে।
পূর্বের আকাশে সূর্য ঘোমটা খুলছে। মহাসড়ক ধরে ছুটে চলছে গাড়ি। গাড়ির ড্রাইভার কামরুল ইসলাম। তিনদিন আগের দেখা তরতাজা কামরুলকে এখন হঠাৎ কেউ চিনতে পারবে না। সমসময় ক্লিনসেভ মুখে তিনদিনের না কামানো দাড়ি। চোয়াল ঝুলে পড়েছে। চোখ লাল। সারা শরীরে ক্লান্তির গান বাজছে। মসৃণ কংক্রিটের রাস্তায়, গাড়ি চালাচ্ছে কামরুল সর্বোচ্চ গতিতে। যত দ্রুত সম্ভব সে গাড়ি চালিয়ে এই পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে চলে যেতে চায়।
পরাগÑ পরাগÑ পরাগÑ তিনটি অক্ষরের অসম্ভব রোমান্টিক শব্দ তার কানে, ঠোঁটে, শরীরের অগ্নিকুণ্ডলীতে আছাড় খায়। হায় জীবন! তিন দিন আগে ঢাকা শহরের উঠতি ব্যবসায়ী সুদর্শন সুপুরুষ কামরুল ইসলাম, পালাচ্ছে এখন রাত পোহাবার আগেই। জীবন ধারণ করে যে শরীর, শরীর ধারণ করে যে লোভ-সম্ভোগের সীমাহীন আনন্দ উপভোগের ফলাফল তাকে আজ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কামরুল হিসাব মেলাতে পারে না।
পরাগকে নিয়ে সত্যি নিজস্ব আয়নায় ভুলক্রমে হলেও একটি মিলনাত্মক ছবি এঁকেছিল সে। সমস্ত কাণ্ডজ্ঞান জলাঞ্জলি দিয়ে সে ছুটেছিল এক অসম্ভব অলিক আলেয়ার পেছনে। পরাগ আলেয়ার প্রতিভু-মাত্র। যখন কামরুল বুঝতে পারল, তখন দেরি হয়ে গেছে অনেক। অনেক দেরি। পরাগ কি বর্ণাঢ্য কৌশলে তাকে অস্বীকার করল? কামরুলের হাতে ধরা গাড়ির স্টিয়ারিং ক্রোধে থেমে থেমে যায়। কিন্তু পুলিশের ভয়ে আবার গাড়ি গতি পায়।
পরাগ ফোন রাখার পর ঝিম মেরে প্রায় ঘণ্টাখানেক বসেছিল অফিসে সে। বসে বসে ভাবতে ভাবতে কামরুল আপাতত পালিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। হঠাৎ কোথায় যাওয়া যায়? সে অবাক হলো ঢাকা শহরে তার মতো বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন অনেক অথচ এখন কোথাও আত্মগোপন করার জন্য নিরাপদ আশ্রয় নেই। কার কাছে বিশ্বাস করে বলবে আমি ইচ্ছার বিরুদ্ধে, একজন নারীর আমন্ত্রণে সর্বনাশের পুকুরে পড়েছি। আমাকে আশ্রয় দাও। না- এই কথা বলে আশ্রয় পাবার মতো জায়গা কোথাও নেই। কামরুল নিজস্ব বুদ্ধিতে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বের হয়ে ঢাকার পুরোনো এলাকায় মাঝারি মানের একটি হোটেলে ওঠে। হোটেলে থাকার পর ফোনে গাড়ি আনিয়ে চড়ে বসে আজ সন্ধ্যায়। সারারাত গাড়ি চালিয়ে গ্রামের বাড়ি আসে। দরজায় কশাঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে যায়। সামনে হ্যারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে শামীমা।
খুব শান্তভাবে শামীমা হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসে। বিধ্বস্ত কামরুলকে খেতে দেয়। খাবার দেখে কামরুলের খিদের কথা মনে পড়ে। সে গোগ্রাসে ভাত খায় ছোটো পুঁটি মাছের সঙ্গে লালশাক রান্না দিয়ে, সঙ্গে কাঁচা মরিচ। সামনে বসে যত্নের সঙ্গে খাওয়াচ্ছে শামীমা। বিছানায় তামীম ঘুমিয়ে। পাশের ঘরে মা-বাবা। খাওয়া শেষে মুখ মুছে কামরুল বিছানায় শুয়ে পড়ে। ক্লান্ত অবসন্ন শরীর। বিছানায় শোয়া কামরুলের কপালে গভীর মমতায় হাত রাখে শামীমা- শুয়ে পড়লে কেন?
আমার দু’চোখে গভীর ঘুম।
ঘুমোনোর সময় এখন নয়।
উঠে বসে কামরুলÑ মানে?
সকাল হওয়ার আগেই তোমাকে এখান থেকে পালাতে হবে।
কেন?
পুলিশ সন্ধ্যায় এসে খুঁজে গেছে।
কামরুল ভয়ে একটি শীতল সাপে পরিণত হয়ে যায়। জুজুর বয়ে আক্রান্ত অবুঝ শিশুর মতো আঁকড়ে ধরে শামীমার হাত- আমি এখন কী করব?
বলেছি তো। পালাও।
চট করে বিছানা থেকে নামে কামরুল। শামীমা সামান্য কিছু জামা কাপড় গুছিয়ে একটি ব্যাগে ভরে দেয়। ঘুমন্ত তামীমের মুখে আদর করে কামরুল। দরজা খুলে দাঁড়ায় শামীমা। হাতে হ্যারিকেন। মৃদু আলো, মৃদু অন্ধকার। আকাশে তারা। অবারিত পৃথিবী। কামরুল তাকায় শামীমার মুখে। আলো আঁধারের খেলায় শামীমা অপরূপ হয়ে উঠেছে। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। দু’হাত বাড়িয়ে ধরতে যায়- শামীমা বাধা দেয়- আগে পালাও, এদিকে দেখি আমি কী করতে পারি। যেখানেই থাকো যোগাযোগ রেখো। আমি আজই ঢাকায় যাবো। আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলব। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে-
কামরুলের বুক মুখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে- আমি যে এসেছিলাম, বাবা মা আর তামীমকে বলো না।
বলব না।
আসি?
এসো।
শামীমা দরজায় দাঁড়িয়ে হ্যারিকেন উঁচু করে ধরে রাখে। কামরুল আলোকিত পথের রাস্তায় গিয়ে গাড়িতে ওঠে।
সকাল হয়ে আসছে। চারদিকে গাছপালার ডালে ডালে পাখি ডাকার শব্দ ভেসে আসছে। দূরে মসজিদ থেকে ভেসে আসছে সুমধুর আজানের পবিত্র ধ্বনি। কিন্তু কামরুল অবাক বিস্ময়ে দেখতে পাচ্ছে অনন্তকালের দূরত্বে থাকা নীল গাঢ় বেগুনী রঙের অদ্ভুত এক অমোঘ আকাশ কালো রঙে ঢেকে গেছে এবং সেই বিস্ময়কর কালো আকাশ গোলাকার বৃত্তের পরিসরে ক্রমশ তার দিকে পিঁপড়ার গতিতে এগিয়ে আসছে। ছোটো হয়ে আসছে তার পৃথিবী। রাস্তা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। সারিবদ্ধ শুকুন আকাশে চক্রাকারে উড়ছে, ঘুরছে, ডানা ঝাপটাচ্ছে। সে একটি লাশ। দেখতে পাচ্ছে তামীম, শামীমা, পরাগ, অর্নব, রেনুকা, কিশওয়ারকে। হাতে খোলা তরবারি নিয়ে সবাই সামনে অপেক্ষা করছে। তার দিকে এগিয়ে আসছে গাঢ় পাথরের খোদিত কালো আকাশ- আর মাত্র কয়েক ইঞ্চি ফাঁক- জীবন ও দুঃস্বপ্নের মাঝখানে।
অলংকরণ : রেজাউল হোসেন