দেশের রাজনীতিতে ঈদ ও নববর্ষের প্রত্যাশার প্রতিফলন হবে কি?

প্রকাশ | ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৩২

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

১১ই এপ্রিল বাংলাদেশে মুসলমানদের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতি বছরের মতো এবারও কয়েক কোটি মানুষ গ্রামে ঈদ করতে গেছে। বলা চলে এবারের ঈদযাত্রা অনেক বেশি স্বাচ্ছ্যন্দের হয়েছে। বড়ো ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে সদরঘাটে লঞ্চের দড়ি ছিঁড়ে পাঁচজনের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ছাড়াও সড়কে কিছু কিছু দুর্ঘটনায় কয়েকজনের প্রাণহানি পরিবারগুলোর ঈদের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। ঈদ শেষে এখন যার যার কর্মস্থলে ফিরে আসার পালা সবেমাত্র শুরু হয়েছে, চলবে আরও কয়েকদিন। ঈদের এই ছুটির অপেক্ষায় থাকে দেশের সব মানুষ। নিকটজনদের এভাবে কাছে পাওয়া অন্য সময়ে খুব একটা হয় না। এখন থেকে আবার প্রিয়জনদের প্রতীক্ষার পালা শুরু হবে, আগামী বছরের ঈদে একত্রিত হওয়ার, আনন্দ-উৎসব করার। ঈদে সকলেই পরস্পরের শুভ কামনায় নামাজ শেষে মোনাজাতে দু’হাত তুলে দোয়া করেছেন, ঈদগাহে পরস্পরের সাথে কোলাকুলি করেছেন, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করেছেন। গরিবদের কাপড়, নগদ টাকা বিলিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার চেষ্টা করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোও তা করেছে।
ঈদ উপলক্ষ্যে দেশে সম্প্রীতির কথা বারবার উচ্চারণ করা হয়েছে। বছরটি শুরু হয়েছে জাতীয় নির্বাচন দিয়ে। যদিও নির্বাচন উপলক্ষ্যে দেশের রাজনীতি উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে সরে গিয়েছিল। বাংলাদেশের রাজনীতি বহু আগে থেকেই পরস্পর বিরোধী দুটি মেরুতে অবস্থান করছে। এ নিয়ে দেশের রাজনীতি ভালো নেই, এক দল অন্য দলকে কুপোকাত করার বাক্যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। দুই পক্ষই যদি নির্বাচনে অংশ নিত তাহলে অন্তত পরস্পরের বিরুদ্ধে উথাপিত অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাই করা যেত, প্রমাণিত হতো কার অভিযোগ কতটা সত্য, কতটা সত্য নয়। কিন্তু ২০১৪ এবং এবারের নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো ‘বিশাল’ সরকারবিরোধী জোট করা সত্ত্বেও নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় বোঝা গেল না কাদের অভিযোগ কতটা সত্য। কিন্তু নির্বাচনে অংশ না নিয়েও বিরোধীরা দাবি করে আসছে দেশের জনগণ তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভোট কেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত ছিল। এই দাবির সত্যতা নিয়ে খোদ জনমনেই যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে, কারণ দেশে আওয়ামী লীগ এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অন্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকগণ তো নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, ভোট দিয়েছেন। দেশে তাদের ভোটারের সংখ্যা অভিযোগকারীদের চাইতে কি কম হবে? যে কেউ এই প্রশ্নের উত্তরে যা বলবেন তাতে বিরোধী জোটের দাবি এক কথায় নাকচ হয়ে যায়।
নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি আওয়ামী লীগসহ অংশ নেওয়া বিভিন্ন দল এবং স্বতন্ত্রদের প্রতি সহানুভূতিশীলদের ভোট মিলিয়ে যা হাওয়ার তা-ই হয়েছে, সে রকম ভোটই পড়েছে। কিন্তু বিরোধীরা কিছুতেই ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের ফল মেনে নিতে চায় না, তারা এখন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়ে আবার মাঠে নামতে চাচ্ছে। অথচ বিদেশিরা এই সরকারকে গ্রহণ করে নিয়েছে এবং সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী বলে জানিয়েছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাভাবিক সম্পর্ক অব্যাহত আছে। এমন অবস্থায় সরকার-উৎখাতের আন্দোলন দেশে বা বিদেশে সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা- সেটাই মস্তবড়ো প্রশ্ন। 
ঈদের আমেজের সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে বাংলা নববর্ষবরণের আয়োজন। এ বছর ১৪৩১ নতুন বছরটি অনেক নতুন উদ্যোগে উদ্যাপিত হচ্ছে। ঢাকায় সংযোজন ঘটেছে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে গুলশান সাহাবুদ্দিন পার্কে বিদেশি কূটনীতিবিদসহ বিভিন্ন দেশের মানুষজনের অংশগ্রহণে বর্ণিল নববর্ষের উৎসব এবং মেলা। ঢাকা শহরে এ ধরনের আয়োজন দক্ষিণে, পুবে এবং পশ্চিমে আরও অনেক স্থানে করা যেত। রমনা বটমূলে, চারুকলা ইন্সিটিউট কিংবা শাহবাগ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ না রেখে গোটা ঢাকা শহরেই বাংলা নববর্ষের উৎসব ছড়িয়ে দেওয়ার এখন সময় এসেছে। ১৯৬৭ সালে ছায়ানট যার সূচনা করেছে সেটি দেশের বিভিন্ন শহর এবং বিশেষ বিশেষ যায়গায় এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এবার কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে ১৪ কিলোমিটার ব্যাপী সড়কে ছয়শত পঞ্চান্ন জন শিল্পীর অংশগ্রহণে অঙ্কিত আল্পনা গিনেজ বুকে স্থান পেতে যাচ্ছে। হাওর এলাকার মানুষজন নতুন বছরের উচ্ছ্বাসে এই আল্পনার দৃশ্য উপভোগ করেছে।
বাংলা নতুন বছর তাদের জীবনকে এবার নতুনভাবে আন্দোলিত করেছে। এই সময় পাহাড়ে বৈশাবি উৎসবও চলছে, বাঙালি, পাহাড়ি, সমতলের ছোটো ছোটো নৃ-গোষ্ঠী একসঙ্গে নববর্ষের উৎসবে মেতেছে, এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কামনায় তারা এই উৎসবকে স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছে। এই উৎসবের প্রাক্কালেও প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর দিনব্যাপী কর্মসূচি ছিল মানুষকে উজ্জীবিত করার মতো। মঙ্গল শোভাযাত্রার এবারের মূলভাব ‘আমরা তিমির বিনাশী’ স্লোগানে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং মানুষের জীবন থেকে অপশক্তিকে দূরীভূত করার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে তা কতখানি অর্জিত হবে, সেই লক্ষ্যে সবাই কতটা মিলিতভাবে কাজ করবে তার ওপরই এর সাফল্য নির্ভর করবে। তারপরও নববর্ষে উচ্চারিত লাখো-কোটি মানুষের স্লোগান, আশাবাদ বাস্তবায়ন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে যারা অসাম্প্রদায়িক বিনির্মাণে গুরুত্ব উপলব্ধি করেন তাদেরকে সেই ক্ষেত্রে দৃঢ় ভূমিকা পালন করতেই হবে। কারণ বাংলাদেশের সমাজে এখনও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির ব্যাপক উপস্থিতি জানান দিচ্ছে যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনেক বিরোধী শক্তি ছোবল হানার অপেক্ষায় আছে। 


ঈদ এবং বাংলা নববর্ষের উৎসব শেষে বাংলাদেশের রাজনীতি কীরূপ ধারণ করবে সেটি অনেকের কাছেই নানা সংশয় সৃষ্টি করে রেখেছে। রাজনীতিতে পরস্পর বিরোধী দুই ধারার শক্তির মধ্যে প্রতিদিনই বাক্যুদ্ধ লেগেই আছে। অথচ এই যুদ্ধের তো কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের জাতীয় জীবনে এই মুহূর্তে অতীব প্রয়োজন শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাজনীতিকে যার যার অবস্থান থেকে পরিচালিত করা, জনগণ বর্তমান বৈশি^ক অর্থনৈতিক সংকট এবং যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে এড়িয়ে যেন শান্তিপূর্ণ উপায়ে জীবনযাপন করতে পারে সেই বাতাবরণ বাংলাদেশে নিশ্চিত করা। কিন্তু রাজনীতিতে যে দ্বন্দ্ব অমীমাংসিতভাবে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে তা মোটেও কোনো ইতিবাচক বার্তা বহন করে না। সামনে বেশ কিছু স্থানীয় সরকার নির্বাচনের তপশিল ঘোষিত হয়েছে। এই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কি নেবে না সে বিষয়েই তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। অথচ তৃণমূল নেতা ও কর্মীরা এই নির্বাচনে অংশ নিতে চাচ্ছে কিন্তু দল তাদেরকে কোনো অনুমোদন দিচ্ছে না, আবার প্রকাশ্যে বিরোধিতাও করছে না, এর ফলে দলের নেতা-কর্মীদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব যেমন রয়েছে তেমনি জনগণের পক্ষ থেকেও তারা নানা প্রশ্নের সন্মুখীন হচ্ছেন। রাজনীতিতে বিএনপির নির্বাচন বিরোধিতা, সিদ্ধান্তহীনতা অন্যদিকে গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না সম্পূর্ণরূপেই দ্বিচারিতার লক্ষণ বলেই প্রতিভাত হচ্ছে।
দল কেন সম্পূর্ণরূপে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না সেটি পরিষ্কার করা জরুরি। আবার অন্যদিকে জামায়াতের সঙ্গে এতদিন যে লুকোচুরি ভাব ছিল সেটিকে সরিয়ে সম্প্রতি ইফতার পার্টিতে বিএনপি নেতাদের উপস্থিত হওয়ার রহস্য অনেকের কাছেই বোধগম্য নয়। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের রাজনৈতিক মৈত্রী নিয়ে লুকোচুরি খেলার কিছু নেই। এখন জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তাদের নেতৃবৃন্দ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করবে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি কি করবে? জামায়াত বিএনপিকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আদৌ অবহিত করেছে কি না সেই প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপি কিন্তু দেশ-বিদেশে বলে বেড়াচ্ছে যে, তারা গণতান্ত্রিক দল হিসেবে জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ রাজনীতিতে আর জড়াচ্ছে না। কিন্তু তাদের নানা কর্মকাণ্ডেই জামায়াতের সঙ্গে রাজনৈতিক জোটবদ্ধতা এখনও দৃশ্যমান হচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপির সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চ নামে বাম রাজনৈতিক দলের জোট নিজেদেরকে অসাম্প্রদায়িক আদর্শে বিশ্বাসী বলে দাবি করলেও এখন মনে হচ্ছে দেশে আওয়ামী বিরোধিতার নামে যেকোনো জোটের সঙ্গেই রাজনীতি করতে তাদের কোনো দ্বিধা নেই। এর আরেকটি প্রমাণ পাওয়া যায় জামায়াত থেকে বের হয়ে আসা এবি পার্টি আয়োজিত ইফতার পার্টিতে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের অংশ নেওয়ার দৃশ্যে। এইসব রাজনৈতিক দলের জোট, যুগপৎ আন্দোলন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কেবলই মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। সে কারণেই বাংলা নববর্ষের যে স্লোগান মানুষের মুখে উচ্চারিত হয়েছে সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে দ্বিচারিতায় আক্রান্ত শক্তিসমূহ আগামী দিনের জন্য বড়ো বাধা হয়ে আবির্ভূত হচ্ছে এটি এখন সকলকে বুঝতে হবে। তাহলেই কেবল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের বিরোধী শক্তি চিহ্নিত হবে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: ইতিহাসবিদ, কলাম লেখক। সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়