বিবেক সেতুমন্ত্রী এবং মর্দ স্বাস্থ্যমন্ত্রী
প্রকাশ | ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ২০:০৮ | আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ২০:২৯
আমাদের স্বাস্থ্য খাতের চিত্র কী? এক কথায় ভয়াবহ! এটি হচ্ছে আমজনতার কথা। তবে আমজনতার কথায় গুরুত্ব দেওয়ার ধারা অনেক আগেই গেছে হিমাগারে। এখন আর পাবলিকের কথার কোনো দাম নেই! পাবলিক এখন সাবেকী আমলের আনসারের মতো। এদিকে যাদের কথার কিছু দাম এখনো কিঞ্চিত অবশিষ্ট আছে তাঁরা নীরব। এরা বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। তাদের মুখে কুলুপ। অনেকে আবার ‘বুদ্ধি বিক্রেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তবে প্রকাশ্যে নয়। ফেরিওয়ালা। এখানে-ওখানে দরজা নক করে বুদ্ধি বিক্রি করেন। ফলে কথা বলার এখন রাজেন্যবর্গের দখলে। তা হোক বর্তমান অথবা সাবেক। কেবল মাত্রায় হেরফের। তবে দু তরফের কথামালায়ই জনতা সমান মানদণ্ডে বিচার করে, বিনোদনের খোরাক পায়। হয় বিরক্ত।
এদিকে রাজনীতির কথাশিল্পীরা সমানে বকে যাচ্ছেন। কিন্তু মাঝেমধ্যে যেন কীরকম হয়! অতিকথনের ইনবিল্ড বিপত্তি ঘটে। যেমন মাননীয় সেতু ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘মফস্বলের হাসপাতাল দেখে মনে হয় আস্তাবল।’ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যসেবার সুফল পেতে শুরু করেছেন।’ এদিকে সেতুমন্ত্রী বলেছেন, ‘সব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে গুরুত্ব দিতে হবে।’ কিন্তু প্রশ্ন, কবে দেবেন? এ রকম কথা তো অনেক শুনেছি আমরা। সই আওয়াজ! মনে পড়ে সুনীলের সেই কবিতা, “নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার মাথা এই ঘরের ছাদ/ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়/ তিনপ্রহরের বিল দেখাবে?”
কেবল সুনীলের কবিতা নয়, ধসে পড়া স্বাস্থ্য খাত নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই মন্ত্রীর বয়ানে কারো কারো মনে পড়ে এক সময়ের বাংলার ঐতিহ্য যাত্রাগানের বিবেক চরিত্রের কথা। কারো আবার মনে পড়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবদ মহাকাব্যের কথা। আবার পুরো পুথির কথাও মনে পড়েছে কারো। মানতেই হবে, মন্ত্রীদের বচনে নানান ব্যঞ্জনা আছে। তবে কার্যকারিতা কতটুকু? এটি বিবেচনা ও পর্যালোচনার জোর দাবি রাখে। এ নিয়ে একবাক্যে কোনো কিছু বলা কঠিন। এমনকি বিপদও হতে পারে।
অনেকেই জানেন, সেতু ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ৪ এপ্রিল রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে মফস্বলের হাসপাতালগুলোকে আস্তাবলের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নিকট অতীতের ইতিহাস সুখকর নয়। গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র আমদানি হয়ে প্যাকেটের মধ্যে পড়ে থাকে, কিন্তু ব্যবহার হয় না- এই ইতিহাস আমাদের আছে। আমাদের হাসপাতাল আছে, চিকিৎসকরাও ভালো, তারপরও কোথায় যেন সংকট রয়েছে। এখানে স্বচ্ছভাবে দায়িত্ব পালন খুব চ্যালেঞ্জিং। এই দায়িত্বটা সম্মিলিতভাবে সবাইকে নিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে দগদগে অবস্থা করোনা মহামারিতে দেখেছি। মূল জায়গায় দায়িত্বপ্রাপ্তরা যদি সৎ হন, দায়িত্ববোধ থাকে তাহলে অনেক কিছু করা যায়।’
হাসপাতাল নিয়ে মন্ত্রীর এ বচন একেবারে বাস্তবতা এবং এ বিষয়ে কোনো সংশয় নেই, যোগাযোগমন্ত্রীর উল্লিখিত বক্তব্য মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। যাত্রাগানের বিবেক চরিত্রের সংলাপে যেমন হয়। অথবা শেক্সপিয়রের বিয়োগান্ত নাটকের সংলাপ যেমন হৃদয়ে দাগ কাটে।
কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে যোগাযোগমন্ত্রী কেন এ ধরনের অসহায় ডায়লগ দেবেন? তিনি তো করবেন, করাবেন। তারপর বলবেন। আবার বলারও প্রয়োজন পড়ে না। আকাশের চাঁদ উঠলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হয় না। প্রয়োজন হয় না চাঁদ দেখা কমিটিরও। এরপরও রাজনীতিকরা বলেন এবং দেখান। যেমন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাওরান বাজারের র্যাম্প চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার পর মন্ত্রী ঘটা করে কথা বলেছেন। এ সময় স্বভাবসুলভ ধারায় সাফল্যগাথার গীত গেয়েছেন তিনি। কিন্তু এ ধারার বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে ব্যর্থতার গীতমালায় সেতুমন্ত্রী আসলে কী ম্যাসেজ দিতে চাচ্ছেন? দায়িত্ব পালন ‘খুব চ্যালেঞ্জিং’ হিসেবে আখ্যায়িত করে মন্ত্রীর বয়ান, ‘দায়িত্বটা সম্মিলিতভাবে সবাইকে নিতে হবে’- এটি কোন বার্তা দেয়? ‘খুব চ্যালেঞ্জিং’ বলে তিনি কি কাউকে স্কেপগোট হওয়ার রাস্তা করে দিচ্ছেন নিজের অজান্তেই অতি কথনের প্রবণতায়! আর সবাই জানে, ‘দায়িত্বটা সম্মিলিতভাবে সবাইকে নিতে হবে’- মানে কেউ না নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এসব কথাও কিন্তু আমজনতার। নিশ্চয়ই জনতার ভোটে নির্বাচিত মন্ত্রী-নেতারা বিরক্ত হবেন না জনতার কথায়। কিন্তু বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, মন্ত্রীদের এসব বায়বীয় কথায় জনগণ খুবই বিরক্ত হয়। যেমন বিরক্ত হয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনের কথায়ও। স্বাস্থ্য খাতে চলমান অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে ৯ এপ্রিল বিশাল এক আওয়াজ দিয়ে বসেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি বলেছেন, ‘একজন চিকিৎসক দিনে কতজন রোগী দেখতে পারবেন সে বিধান রেখে স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন চূড়ান্ত করা হবে।’ বরিশাল অঞ্চলে প্রবচনের মতো একটি কথা আছে, ‘মিয়ায় পারুক আর নাই পারুক, আইটগাইট মাশাল্লাহ!’ কারো মনে পড়েছে রাচিতে ইন্দিরা গান্ধীকে ঘিরে এক রসালো কথাও।
হাসপাতাল নিয়ে রাজনীতির দিকপাল ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের দুদিনের মাথায় ৬ এপ্রিল নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক থেকে ক্লিন ইমেজের মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যসেবার সুফল পেতে শুরু করেছেন।’ তার এই কথায় কারো কারো মনে পড়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবদ মহাকাব্যের ‘এক্ষণে অরিন্দাম কহিলা বিষাদে...।’ কারো আবার মনে পড়েছে পুরো এক পুথির পঙক্তি, ‘ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিলো, কিছুদূর গিয়া মর্দ রওয়ানা হইলো...।’ অবশ্য হাঁটিয়া চলিলো নাকি ‘হাঁকিয়া’ চলিলো তা নিয়ে বোদ্ধাদের মধ্যে দ্বিমত আছে। কে বা কারা ‘হাঁকিয়া’ শব্দটিকে বিকৃত করে ‘হাঁটিয়া’ করেছিল বলে কারো অভিমত। ‘হাঁটিয়া’ শব্দকে ‘হাঁকিয়া’ ধরলে অর্থ হয়, ঘোড়ায় চড়ে বীর হেঁকে চলল। মানে আওয়াজ দিয়ে দ্রুত চলা। কিন্তু মূল পুথিতে যাই থাকুক প্রচলিত হচ্ছে, ‘ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিলো, কিছু দূর গিয়া মর্দ রওয়ানা হইলো...।’ মন্ত্রীর বক্তব্য অনুসারে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যসেবার ‘সুফল পেতে শুরু’ করে থাকলে এটি প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছাবে কবে? বিগত ৫২ বছর ধরে কী হয়েছে?
বলে রাখা ভালো, বঙ্গবন্ধু সরকারের আমল থেকে হেভিওয়েট ব্যক্তিত্বরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। এর খুব একটা ব্যত্যয় ঘটেনি। টানা বিগত তিন মেয়াদের আওয়ামী সরকারের আমলেও না। এমনকি ৯৬ সালের শেখ হাসিনার প্রথম সরকারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব খোদ প্রধানমন্ত্রী সপ্তাহখানেক নিজ হাতে রেখেছিলেন। কোনো সরকার আমলেই যদুমধু গোছের কাউকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। তবে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনে কতজন প্রত্যাশিত মাত্রায় সফল হয়েছেন তা নিয়ে কিন্তু বিস্তর তর্ক আছে। এ কারণে স্বাস্থ্যমন্ত্রীদের তালিকা বেশ দীর্ঘ এবং এ তালিকায় বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অবস্থান ৩২তম। মেয়াদ বিবেচনায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীদের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। তবে কর্নেল মালেক-পুত্র জাহিদ মালেক স্বপনকে সাফল্যের বরপুত্র হিসেবে বিবেচনা করা যায়। শুধু তাই নয়, তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী থেকে মন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। অথচ শেখ হাসিনা সরকারের বিগত মেয়াদে একজন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে, পরে নায়িকা-কাণ্ডের অজুহাতে বিদায় হয়েছেন পত্রপাঠ। কিন্তু জাহিদ মালেক স্বপন নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তবে তিনি বর্তমান সরকারে কোনো স্থান পাননি। এ নিয়ে অনেক রহস্যজনক কথাবার্তা প্রচলিত আছে। উল্লেখ্য, মন্ত্রী থাকা অবস্থায়ই তার বিরুদ্ধে নানান দুর্নীতির অভিযোগ ফলাও করে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তাতে তার চেয়ার মোটেই টলেনি। অজ্ঞাত কারণে এবার তার বিধি বাম, সরকারে স্থান পাননি। কে জানে, সাবেক এই মন্ত্রীর অবস্থা সাবেক আইজিপি বেনজীরের মতো হয় কি না।
সামগ্রিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্য খাতের দিকে গভীরভাবে নজর দিলে বুঝা যাবে, এ এক জগদ্দল পাথর। এ অবস্থায় যাত্রাগানের বিবেক থেরাপি অথবা প্রাচীন পুথির ধারায় চললে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হওয়ার আশা সোনার পাথরবাটি। আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। অবশ্য খারাপ হওয়ার আর কিছু অবশিষ্ট আছে কি না, তাও এক বড় প্রশ্ন। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে তা অধিকভাবে কঠোরতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর আছে বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার বিষয়ে বিএনপির মতো ‘পরিসংখ্যানবিদ’ হওয়ার প্রয়োজন নেই। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে গণমাধ্যমে যে ছিটেফোঁটা খবর প্রকাশিত হয় তাই বিবেকবান মানুষের রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট! কিন্তু এরপরও স্বাস্থ্য খাত নিয়ে মন্ত্রীদের মুখে কেন অনাবশ্যক কথার খৈ ফোটে তা বলা মুশকিল!
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক