মৃত সাগর, কাওমে লুতের উপর আসা আজাবের নিদর্শন

প্রকাশ | ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:১২ | আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ১১:১৮

ইসলাম ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

মহান আল্লাহ বিশ্বজগতের সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, লালনকর্তা ও পালনকর্তা। তিনি সমুদয় বস্তুর মালিক ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সত্তা, স্বকীয়তা, গুণ, কর্ম ও ক্ষমতায় তাঁর সমপর্যায়ের কেউই নেই, তিনি লা শরিক। দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতের সব কিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন।

 

মহাবিশ্বের রাজাধিরাজ আল্লাহ। মানুষ, পশুপাখি, মাছ, গাছপালা, প্রকৃতি, পৃথিবী, চাঁদ, গ্রহ, উপগ্রহ, সৌরজগৎ, নীহারিকা নিয়ে এক মহাআশ্চর্য্য এই বিশ্বভ্রম্মান্ডে যা কিছু আছে, সবকিছু এক আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। সেই সৃষ্টিকর্তা সর্বশক্তিমান ও একজন। তাঁকে কেউ সৃষ্টিও করেনি, তার সন্তানাদিও নেই। তাঁর সমকক্ষ বা তাঁর মত কিছুই নেই।

 

মহাকাশ ও পৃথিবীর সর্বত্র আল্লাহর অনুগ্রহ পরিবেষ্টিত সবই মানুষের কল্যাণের নিমিত্তে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহের কথা বলা হয়েছে, ‘পরম করুণাময় আল্লাহ, তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন। তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে ভাব প্রকাশ করতে (ভাষা) শিখিয়েছেন। সূর্য ও চন্দ্র নির্দিষ্ট কক্ষপথে আবর্তিত হয়। তৃণলতা ও বৃক্ষাদি তাঁরই বিধান মেনে চলে। তিনি আকাশকে সমুন্নত করেছেন এবং ভারসাম্য স্থাপন করেছেন, যাতে তোমরা ভারসাম্য বা সীমা লঙ্ঘন না করো।’ (সূরা আর রাহমান, আয়াত: ১-৮)

 

মহান আল্লাহতায়ালা মানবজাতির হেদায়েতের জন্য যুগে যুগে পৃথিবীতে অসংখ্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। নবীদের পাঠানো বা নবুওয়ত শেষ হয়েছে প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে। নবীদের সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা নিজের পক্ষ থেকে আসমানী কিতাবও দিয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনে এই বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, হে আমাদের রব! আর আপনি তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে এক রাসূল পাঠান, যিনি আপনার আয়াতসমূহ তাদের কাছে তিলাওয়াত করবেন; তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন আপনি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’। (সূরা বাকারা, (২), আয়াত, ১২৯)

 

মানুষের মধ্যে যারা কাজেকর্মে সৎ হবে, তাদের জন্য রয়েছে অঢেল পুরস্কার এবং যারা কাজেকর্মে অসৎ হবে, তাদের জন্য থাকছে তিরস্কার। সৎকর্মের পরিচয় ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও সংসারজীবনের সব কাজেকর্মে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাওয়া।

 

আর যারা আল্লাহর কথা মানবে না, নিজের মন মতো চলবে, বিভিন্ন পাপাচারে লিপ্ত থেকে মানুষের উপর অন্যায়, হত্যা, জুলুম করবে তাদের জন্যে রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতে শাস্তি। যাদের সীমা লঙ্ঘনের কারণে দুনিয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক, অশান্তি-বিশৃঙ্খলা, হানাহানি ও অসহায় লোকের মৃত্যুর কারণ হয় এবং দেশ ও জনগণের সম্পদ লুণ্ঠিত হয়, এরা সবাই জালিম, নিরীহ মানুষের প্রতি অত্যাচারী। দেশের জনগণ হলো মজলুম বা অত্যাচারিত। জালিম শাসকের জুলুম আল্লাহ তাআলা সহ্য করেন না। মানুষের বড় ধরনের গুনাহের কারণেই পৃথিবীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে।

 

যে ব্যক্তি কোনো বড় ধরনের অন্যায় বা কবিরা গুনাহ করে, সে সারা বিশ্বের মানুষ, চতুষ্পদ জন্তু ও পশু-পাখিদের প্রতি অবিচার করে। কারণ, তার গুনাহের কারণে শক্তিশালী ভূমিকম্প, সুনামি, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য যে বিপদ-আপদ দুনিয়ায় নেমে আসে, এতে সব প্রাণীই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে কিয়ামতের দিন এরা সবাই গুনাহগার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করবে। তাদের পরিণতি সম্পর্কে ঘোষিত হয়েছে, ‘কেবল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে, যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ আচরণ বা সীমা লঙ্ঘন করে বেড়ায়, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সূরা আল-শুরা, আয়াত: ৪২)

 

 

মহান আল্লাহ যুগে যুগে বহু সীমালঙ্ঘনকারী জাতিকে আজাব দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছেন। এবং সে সব আজাবের নিদর্শন এখনও পৃথিবীতে রয়ে গেছে যেন মানুষ এ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। এমনই এক নিদর্শন হচ্ছে মৃত সাগর বা ডেড সি। আল্লাহ লুত (আ.) এর জাতিকে তাদের ঘৃণ্য অপরাধের কারণে ধ্বংস করে দেন আর আল্লাহর আজাবের কারণে মৃত সাগর আজ পর্যন্ত মৃত! আর এই স্থানকে দ্রুত ত্যাগ করতে বলেছেন মহানবী (স.)। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী সমকামিতার মতো জঘন্য পাপ ও অপরাধে লিপ্ত হওয়ার কারণে সডম ও গোমাররাহ নামের লোকালয় মহান আল্লাহর হুকুমে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। ঘটনাটি আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগের। ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থানটি বর্তমানে মৃত সাগর নামে পরিচিত।

 

‘মৃত সাগর’ বা ‘ডেড সি’  আরবদের কাছে ‘বাহরুল মায়্যিত’ নামে পরিচিত। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রায় ২০ লাখ বছর আগে এ সাগরের উৎপত্তি। জর্দান নদীর সঙ্গে সংযুক্ত হলেও এটি মূলত একটি হ্রদ। ডেড সি বা মৃত সাগরের দৈর্ঘ্য ৬৭ কিলোমিটার, প্রস্থ ১৮ কিলোমিটার আর গভীরতা ১২৪০ ফুট। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪২২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এ সাগরের পশ্চিমে রয়েছে ইসরায়েল ও পূর্বে জর্দান। এখান থেকে পবিত্র জেরুজালেম নগরীর দূরত্ব মাত্র ১৫ মাইল। মৃত সাগরের অবস্থান জর্ডান, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যবর্তী অঞ্চলে।

মৃত সাগর বিচিত্র খনিজ পদার্থে ভরপুর। এতে প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম, সালফার, ব্রোমাইন ও কলগেন রয়েছে। মৃত সাগরের পানিতে ম্যাগনেশিয়াম ক্লোরাইড ও সোডিয়াম ক্লোরাইডের পরিমাণ যথাক্রমে ৫০.৮ ও ৩০.৪ শতাংশ। এ সাগরের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ৩৩.৭ শতাংশ। পৃথিবীর অন্যান্য সাগর ও মহাসাগরের তুলনায় লবণাক্ততা বেশি হওয়ায় মৃত সাগরে কোনো মাছ জন্মায় না। জর্দান নদী থেকে মাছ এই নদীতে আসার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। তবে আশ্চর্যজনকভাবে রয়েছে বিপুল ব্যাকটেরিয়া এবং ক্ষুদ্রকায় ছত্রাক। স্বাভাবিক সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০০ মিটার নিচে অবস্থিত হওয়ায় একে পৃথিবীর সবচেয়ে নিম্নভূমিও বলা হয়।

বহু বছর আগে এই মৃত সাগরের স্থানেই গড়ে উঠেছিলো এক জাতি, যার নাম ছিলো সাদুম। তারা ছিলো একটি ফিতনা সৃষ্টিকারী জাতি। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের বহু অপরাধ ছিলো। যেমন, তারা তাদের এলাকার পাশ দিয়ে যাতায়াতকারী মানুষদের ডাকাতি করতো, তারা ছিলো প্রচন্ড মিথ্যাবাদী। তবে কোরআনে তাদের যে অপরাধটা সবচেয়ে বড় ও ঘৃণ্য বলা হয়েছে, তা হচ্ছে অস্বাভাবিক যৌনাচার, সমকামিতা।

 

মহান আল্লাহ তাদের হেদায়েতের জন্য হযরত ইবরাহীম (আ.) এর ভাতিজা হযরত লুত (আ.) কে পাঠালেন। লুত (আ.) দিনের পর দিন তাদের আল্লাহর পথে ডাকলেন, সব রকমের পাপ থেকে তাদের দূরে থাকতে বললেন, অন্যথায় আল্লাহর ভয়াবহ আজাবের ভয়ও দেখালেন। কিন্তু তারা লুত (আ.) কথা শুনলো না। বরং তার বললো, যদি তুমি সত্যবাদী হও, তবে নিয়ে আসো সেই আজাব।

 

আল্লাহর নবী হজরত লুত (আ.)-এর বারবার সাবধান বাণী সত্ত্বেও সে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী অবৈধ যৌন সম্পর্ক ও সমকামিতার অভ্যাস পরিত্যাগ করেনি। পৃথিবীর বুকে একমাত্র তারাই যৌন ক্ষুধা চরিতার্থের উদ্দেশ্যে মহিলাদের বাদ দিয়ে পুরুষদের ওপর উপগত হতো। কোরআনুল কারিমে অত্যন্ত চমৎকারভাবে এই ঘটনা বিধৃত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি লুতকে পাঠিয়েছিলাম। তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, তোমরা এমন কুকর্ম করছ, যা তোমাদের আগে বিশ্বে কেউ করেনি। তোমরা তো কামতৃপ্তির জন্য নারী ছেড়ে পুরুষের কাছে গমন করো, তোমরা সীমা লঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৮০-৮১)

 

 

এর পর নূহ (আ.) আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলেন। আল্লাহ জিব্রাইল (আ.) কে পাঠালেন সে জাতিকে ধ্বংস করে দিতে। আল্লাহ লুত (আ.) কে নির্দেশ দিলেন রাতে শহর ছেড়ে দিতে এবং চলে যাওয়ার সময় যেন কেউ পেছন ফিরে না তাকায়। কিন্তু লুত (আ.)-এর স্ত্রী পেছন ফিরে তাকায় এবং সেও সেই আজাবের মাঝে পরে।

 

পরদিন সকালে সাদুম জাতি জিব্রাইল (আ.) এর প্রচন্ড চিৎকার শুনলো। এমন ভয়াবহ চিৎকার যে তারা দিকবিদিকশুন্য হয়ে যায়। এর পর জিব্রাইল (আ.) তার পাখার কোনা দিয়ে পুরো শহর তুলে আকাশ পর্যন্ত উঠিয়ে উলটো করে আবার নিচে ফেলে দিলেন। এর পর সেখানে শুরু হয় পাথরের বৃষ্টি। এভাবেই ধ্বংস হয়ে যায় সাদুম জাতি। আল্লাহর আজাবের কারণে এখানে আজ পর্যন্ত কোন প্রাণি বা উদ্ভিদ জন্মায়নি।

 

সহীস মুসলিম ও বুখারি শরীফের হাদিস অনুযায়ী মহানবী (স.) সেসব স্থান এড়িয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছেন যেখানে আল্লাহর গজব নাজিল হয়েছে। এভাবেই আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের শাস্তি দেন আর তাদের নিদর্শন যুগ যুগ ধরে সংরক্ষিত রাখেন যেন মানুষ শিক্ষা নিতে পারে।

 

অবৈধ যৌনমিলন, অনৈতিক যৌন সম্পর্ক ও সমকামিতার মতো অমানবিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার জন্য আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে হুঁশিয়ার করেছেন। মানবগোষ্ঠীকে অশ্লীলতা, ব্যভিচার ও সমকামিতা থেকে বিরত থাকার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কঠোর নির্দেশ প্রদান করেছেন। মহানবী (সা.) কিশোর-বালকদের চেহারার দিকে কুদৃষ্টিতে না দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ তাদের চেহারায় বেহেশতের হুরের দীপ্তি আছে। তিনি বলেন, ‘আমার উম্মতের ব্যাপারে যেটা সবচেয়ে বেশি ভয় করি, তা হলো লুত সম্প্রদায়ের অনুরূপ পাপাচার। আমার উম্মতের কিছু লোক লুত জাতির অপকর্মে লিপ্ত হবে। যখন এরূপ হতে দেখবে তখন তাদের ওপরও অনুরূপ আজাব অবতরণের অপেক্ষা করো।’

 

আল্লাহর শাস্তির হাত থেকে বাঁচার পথ হলো একনিষ্ঠ মনে তাওবা করা, তাকওয়া অর্জন, নামাজ, রোজা পালন করা ও আল্লাহর ওলিদের সান্নিধ্য লাভ করা। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) বলেন, কোনো জাতির মধ্যে যদি অবৈধ ও বিকৃত যৌনাচার, সমকামিতা প্রকোপ বৃদ্ধি পায় তখন আল্লাহ তাআলা লুত সম্প্রদায়ের মতো বা এর চেয়ে আরো ভয়াবহ শাস্তি প্রদান করেন। মানুষ যেন আর সীমা লঙ্ঘন না করে, তাহলে দুষ্কর্মের গজব থেকে আল্লাহর মেহেরবানিতে মুক্তি পেতে পারে।

(ঢাকাটাইমস/১৭ এপ্রিল/আরজেড)