সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা উত্তম কুমার: বিলাসী বাসা ছেড়েছেন, গ্যারেজে পড়ে আছে গাড়ি

রাজধানীর বেইলি রোডের সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডের ১৭-১৮ নম্বরের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট 'অ্যাসোর্ট বেইলি নিস্ট'। ভবনে ঢুকতেই বিলাসিতার ছোঁয়া। জুড়িয়ে যায় চোখ। ভবনে আসছে-যাচ্ছে নামিদামি বিভিন্ন ব্রাণ্ডের গাড়ি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভবনটিতে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। এখানেই সপরিবারে বসবাস সিআইডির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাসের।
বিলাসবহুল বাড়ির গ্যারেজে আছে উত্তমের একাধিক দামি গাড়ি। ক'দিন আগেও এসব গাড়ি হাঁকিয়ে উত্তমের স্ত্রী, সন্তানরা বের হতেন। তবে এখন সেটা কিছুটা স্তিমিত। দুদকের আবেদনের পর আদালত উত্তম কুমার বিশ্বাসের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এরপর আত্মগোপনে সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা। তবে স্ত্রী-সন্তানরা এখানে বসবাস করছেন। কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না উত্তম কুমার এখন কোথায়। তবে কয়েকদিন আগে তিনি বেরিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছেন ভবনের নিরাপত্তারক্ষীরা। এখন প্রশ্ন আসছে তাহলে কি দেশ থেকে সটকে পড়লেন উত্তম?
দীর্ঘদিন এই বাড়িতে বসবাস করা সিআইডির সাবেক এই কর্মকর্তার ঢাকায় আরও তিনটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেই সংখ্যা আরও বেশি কি-না তা নিয়ে কাজ করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
বিপুল পরিমাণ আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠা দুর্নীতিবাজ সিআইডির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাসের হদিস মিলছে না। ঢাকা টাইমস তার বেইলি রোডের বাসায় গিয়েও সন্ধান পায়নি। তবে স্ত্রী এবং দুই সন্তানও ঢাকা থেকে সটকে পড়তে পারেন বলে জানিয়েছেন উত্তম কুমারের এক প্রতিবেশী। সূত্র বলছে, ইতোমধ্যে উত্তম কুমার তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিয়েছেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান কারো সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করছেন না। উত্তম কুমার অ্যাসোর্ট বেইলি নিস্ট ভবনের ফ্ল্যাট বি-৭'-এ দীর্ঘদিন ধরে থাকেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ভবন থেকে বের হচ্ছে নামি-দামি বিভিন্ন ব্রাণ্ডের সব গাড়ি। নিচতলার পুরোটাই গ্যারেজ। প্রধান গেটের সামনে কড়া পাহারায় দাঁড়িয়ে আছেন একাধিক নিরাপত্তারক্ষী।
ভবনে ঢুকতেই প্রথমে জেরার মুখে পড়তে হয়। বাড়িতে যারা বসবাস করেন তারা অনুমতি না দিলে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। গেটেই কথা হয় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক যুবকের সঙ্গে। তিনি জানান, উত্তম কুমার এই বাড়িতে নেই। তার স্ত্রী আছেন।
পরিবার সম্পর্কে নিরাপত্তারক্ষী বলেন, স্যারের এক ছেলে ঢাকার একটি মেডিকেলে পড়াশোনা করেন; আর মেয়ে বরিশাল মেডিকেল কলেজে পড়েন। স্ত্রী এই বাসাতেই থাকেন। তবে স্যার এখন নেই। স্যার বর্তমানে কিছু ঝামেলায় আছেন। দুদক তাকে খুঁজছে। তবে এসব ঠিক হয়ে যাবে। তার কিছুই হবে না বলেও জানান ওই নিরাপত্তারক্ষী। বলেন, এই বিল্ডিংয়ের সব ফ্ল্যাটই অনেক বিলাসবহুল। স্যার নিজের মতো করে নামি-দামি জিনিস দিয়ে মন মতো ফ্ল্যাট সাজিয়েছেন। সৌন্দর্যের কোনো কমতি রাখেননি।
গণমাধ্যমকর্মীর উপস্থিতির কথা জানতে পেরে ভবনের তদারকির দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তি সেখানে হাজির হন। নাম গোপন রাখার শর্তে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এই বাড়িতেই পুলিশ কর্মকর্তা উত্তম কুমার বিশ্বাস তার পরিবার নিয়ে থাকেন। তবে উত্তম কুমার স্যার এখানে নেই। তার বিষয়ে আমরা কোনো তথ্য দিতে পারবো না।’ তিনি বলেন, ‘এই ভবনে ট্যুরিস্ট পুলিশের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, র্যাবের ঢাকার একটি ব্যাটালিয়নের অধিনায়কসহ প্রশাসনের অনেকে থাকেন। তাই এই ভবনের নিরাপত্তা অনেক জোরদার থাকে সবসময়।’
উত্তম কুমারের নির্দেশ আছে তার বিষয়ে কাউকে কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না উল্লেখ করে এই ব্যক্তি বলেন, ‘আমরা জানি স্যার এখনো পুলিশে চাকরি করেন। তিনি যে অবসরে গেছেন সেটা জানতাম না।’
এদিকে একাধিকবার উত্তম কুমারের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
গত ৩০ মে ঢাকার একটি আদালত উত্তম কুমারের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়। ইতোমধ্যে উত্তমের দেশত্যাগ ঠেকাতে বিমানবন্দর ও দেশের ইমিগ্রেশনগুলোতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। দুদক তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়ায় এখন মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরপর কোনো সন্ধান মিলছে না সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তার। এদিকে কয়েকটি ব্যাংক হিসাব থেকে প্রায় ৫৫ কোটি টাকার বেশি নগদ অর্থ তুলে নিয়েছেন উত্তম কুমার।
সূত্র বলছে, বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারির পর থেকেই দেশত্যাগের বিকল্প পথ খুঁজছিলেন উত্তম কুমার। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, দুদকের হাত থেকে বাঁচতে সীমান্ত পথ দিয়ে দেশ ছাড়তে পারেন তিনি। কারণ, পাশ্ববর্তী দেশে উত্তম কুমারের একাধিক বন্ধু ও স্বজন থাকেন। সেখানেই উত্তম কুমার অনেক আগে থেকেই সম্পদ গড়েছেন।
এখন প্রশ্ন আসছে তাহলে কি দেশ থেকে সটকে পড়লেন উত্তম কুমার? কারণ দীর্ঘদিন যে বাড়িতে তার বসবাস ছিল সেখানেও তার সন্ধান মিলছে না।
আর নগদ অর্থ তুলে নিয়ে তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন বা টাকা তুলে নিয়ে দেশত্যাগ করে থাকতে পারেন। প্রশ্ন উঠেছে, তা না হলে কেন এতো টাকা ব্যাংক থেকে তিনি তুলে নেবেন।
মাগুরার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা উত্তম কুমার ১৯৮৯ সালে এসআই পদে পুলিশে যোগদান করেন। এরপর তিনি পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পান। পরে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে পদোন্নতি পেলে তাকে সিআইডিতে পদায়ন করা হয়। এরপর র্যাব-২ তে প্রেষণে বদলি হন। গত বছরের মাঝামাঝি তিনি সিআইডিতে পুনরায় বদলি হন। এরপর গত বছর অক্টোবরে অবসরে যান।
সূত্র বলছে, বেশির ভাগ সময় উত্তম কুমারকে স্বর্ণ চোরাচালানে হওয়া মামলার তদন্ত দেওয়া হতো। এতে অল্পদিনেই ফুলে ফেঁপে উঠেছিলেন তিনি। চতুর উত্তম অল্পসময়ে বিপুল ধনসম্পদের মালিক বনে যান। কর্মজীবনের একটি বড় সময় সিআইডিতে ছিলেন উত্তম কুমার। সেখানে থাকাকালে বিভিন্ন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হয়ে অবৈধ উপায়ে দেশ-বিদেশে করেন অঢেল সম্পদ। উত্তম কুমারকে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা গেলে তার অবৈধ সিন্ডিকেটের আরও সদস্যকে বের করা সম্ভব হবে।
ঢাকাটাইমস জানতে পেরেছে, উত্তম কুমারের নামে বেনামে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় চারটি ফ্ল্যাট এবং বিলাসবহুল গাড়ি, গাজীপুর, সাভার ও আশুলিয়ায় তার বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পত্তির (জমি) সন্ধান পেয়েছে দুদক।
(ঢাকাটাইমস/০৭জুন/এসএস/এইচএম/কেএম)

মন্তব্য করুন