রি-টেন্ডার করিয়ে শতকোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নিতে চায় ‘মিঠু চক্র’

প্রকাশ | ০৮ জুন ২০২৪, ১৮:০৫

​​​​​​​হাসান মেহেদী, ঢাকা টাইমস

আবারও স্বাস্থ্য খাতের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিতর্কিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠু তার সিন্ডিকেট সদস্যরা। এবার তাদের নজর সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের শত কোটি টাকার টেন্ডারে।

টেন্ডারের সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা যখন প্রায় চূড়ান্ত তখন সুপারিশপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে এই চক্রটি রি-টেন্ডারের মাধ্যমে মুনাফা হাতিয়ে নিতে চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

জানা গেছে, সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের উন্নত স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহের জন্য টেন্ডার আহ্বান করে। GD-11-SKHUP শীর্ষক টেন্ডারে আইসিইউ, এনআইসিউ, এইচডিইউ, সিসিইউ, পোস্ট সিসিইউ, ক্যাথ ল্যাব এবং পোস্ট ক্যাথ রিকভারি বিভাগের জন্য ৪৮ কোটি ৪৭ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা এবং 12-SKHUP শীর্ষক টেন্ডারে ওটি, পোস্ট অপারেটিভ রিকভারি, ডেলিভারি এবং লেবার বিভাগের জন্য বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম বাবদ ৩৬ কোটি ৪৫ লক্ষ ১৫ হাজার টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রে এরই মধ্যে অংশ নেয় বিভিন্ন নামিদামি প্রতিষ্ঠান।

পাশাপাশি GD-13-SKHUP শীর্ষক দরপত্রে ডায়ালাইসিস এবং ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের জন্য মোট ১০ কোটি ৫১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা GD-16-SKHUP শীর্ষক দরপত্রে হাসপাতাল, অফিস কম্পিউটারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য ১৪ কোটি ২৩ লক্ষ ৩১ হাজার টাকার কথা বলা হয়। সেখানেও বিভিন্ন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। 

অভিযোগ রয়েছে, সব ধরনের নিয়ম নীতি মেনে এইসব দরপত্রে বিভিন্ন যোগ্য অভিজ্ঞ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। প্রায় সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা যখন শেষ পর্যায়ে তখনই বিতর্কিতমিঠু চক্রের’ সদস্যরা রি-টেন্ডারের মাধ্যমে সব প্যাকেজগুলোকে ভেঙে ছোট প্যাকেজ করে পছন্দের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ পাইয়ে দেয়ার পায়তারা করছে। আর তার থেকেই মোটা অংকের মুনাফা হাতিয়ে নিতে চায় চক্রটি।

ভুক্তভোগী ঠিকাদারদের অভিযোগবেঙ্গল সায়েন্টিফিক’ তামাম কর্পোরেশন’ নামের দুই প্রতিষ্ঠান টেন্ডার প্রক্রিয়ার সাথে জড়িতদের নানাভাবে প্রভাবিত করে যাচ্ছে। যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যবসায়িক স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে।

রি-টেন্ডার হলে মূলত সুপারিশপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো যেন কাজ না পায় আর  মিঠু চক্রের সদস্যদের কাজ পাইয়ে দিয়ে তাদের থেকে মোটা অংকের মুনাফা হাতিয়ে নেওয়াই চক্রের সদস্যদের মূল উদ্দেশ্য।

সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের শতকোটি টাকার টেন্ডার পাওয়াকে এখন তারা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহন করেছে।

আলোচনা রয়েছে মন্ত্রনালয়ের কিছু কর্মকর্তা প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে চক্রের সদস্যরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। তাদের সাথে হাত মিলিয়েই মুনাফা হাতিয়ে নিতে চায় চক্রটি। এতে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ক্ষোভ, শঙ্কা ভীতিও তৈরি হয়েছে।

২০২০ সালে মিঠুর বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থ উপার্জন বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাস্ক-পিপিই কেনায় দুর্নীতির অনুসন্ধানে দুদক তলব করলে দেশ ছাড়েন ঠিকাদার মিঠু।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মিঠু গত অক্টোবরে দেশে ফিরেছিলেন। ওই সময় তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকও করেন।

ঠিক ওই সময়ই যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন তার প্রায় ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করে। খবরটি জানার পর দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা দুদক নড়েচড়ে বসে। মিঠুর সম্পদ জব্দ বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক। কৌশলে আবার দেশ ছাড়েন মিঠু।

দ্বিতীয় দফা দেশ ছাড়ার আগে মিঠু তার অনেক সম্পদ বিক্রির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তবে মিঠু দেশে না থাকলেও তার চক্রের লোকজন আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায়।

সরকারি কর্মচারী হাসপাতালকে পাঁচশ শয্যায় উন্নীতকরণ প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, কোনো দুর্নীতিবাজ এই প্রকল্পে প্রভাব ফেলতে পারবে না। আমি নতুন এসেছি, সব বিষয়েই খোজখবর নিচ্ছি। রি-টেন্ডার করার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত হলে সেটা জানিয়ে দেওয়া হবে।

মিঠু সিন্ডিকেট গঠিত হয় ১৯৯১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন। হাওয়া ভবনের দালাল বলে পরিচিত ছিলেন মিঠু। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসলে মিঠু সিন্ডিকেট আরো বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে।

এরপর ২০০৯ সালে মহাজোট সরকারের প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী মন্ত্রী রুহুল হকের ছেলে জিয়াউল হক ছিলেন মিঠুর বিজনেস পার্টনার।

২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের পর মোহাম্মদ নাসিম স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর কিছুটা বেকায়দায় পড়লেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মিঠু মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে ফেলেন।

কর্মকর্তাদের আর্শীবাদে পুরো স্বাস্থ্য খাতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে আবির্ভূত হন মিঠু। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তিনজন পরিচালকও মিঠু সিন্ডিকেটে যোগ দেন। এরা মিঠুকে শত শত কোটি টাকা লুটপাটে সহযোগিতা করেন।

আর সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং তার ছেলের ওপর মিঠুর নিয়ন্ত্রণের কথা সিএমএসডির বিদায়ী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহিদ উল্লাহর চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর হয়ে আসে।

মিঠুর বিষয়ে দুদকের তদন্ত সংস্লিস্ট এক কর্মকর্তা বলেন, মিঠু দীর্ঘদিন যাবত গা ঢাকা দিয়ে আছে। তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো দুর্নীতির প্রমান দুদকের কাছে আছে।

দুদকের পরিচালক জনসংযোগ আকতার হোসেন ঢাকা টাইমসে বলেন, মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুকে দীর্ঘদিন যাবতই দুদক খুজছে। তার দুর্নীতির বিষয়ে দুদকে মামলা রয়েছে।

মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর গ্রামের কছিরউদ্দীনের ছেলে। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মিঠুর নামে-বেনামে আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবের নামে তার কমপক্ষে ৩০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কমপক্ষে ৬১টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করেন মিঠু চক্র।

২০১৬ সালের মে প্রকাশিত বহুল আলোচিত পানামা পেসার্স কেলেঙ্কারিতে বাংলাদেশ থেকে অন্যতম অর্থ পাচারকারী হিসেবে মিঠুর নাম আসে। এক যুগ ধরে দুদক মিঠুর বিরুদ্ধে কয়েক দফা তদন্তের উদ্যোগ নিলেও কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে দুদক অনেক অনুসন্ধান করলেও মিঠু বরাবরই রয়ে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।

(ঢাকাটাইমস/০৮জুন/এইচএম/ডিএম)