ডেঙ্গুতে ‘ভয়ঙ্কর আরেকটি বছর’ এড়াতে সতর্ক থাকার তাগিদ

প্রকাশ | ১৮ জুন ২০২৪, ১১:১৩

তানিয়া আক্তার, ঢাকা টাইমস

এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। ফলে শহর কিংবা গ্রামের বাসিন্দাদের বাড়তি সতর্কতার বিকল্প নেই। বিশেষ করে শহুরে রোগ হিসেবে পরিচিত ডেঙ্গু গ্রামাঞ্চলে যেন ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে সেজন্য মশা নিধনসহ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাতেই জোর দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষষজ্ঞরা।

এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের স্বীকৃত পদ্ধতি ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ (বিআই) বলে দিচ্ছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর এডিস মশার লার্ভা এবং প্রাপ্তবয়স্ক মশা বেশি।

এছাড়াও চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরগুনা, বরিশাল, চাঁদপুর ও গাজীপুর -এই জেলাগুলোতে এডিস মশার ঘনত্ব বেশি পাওয়া গেছে বলে কীটতত্ত্ববিদদের জরিপে উঠে এসেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার ‘ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি’ দেশের ১৫ জেলার লার্ভা জরিপ করে এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। যেখানে শহরের চেয়েও গ্রামে মশার লার্ভার ঘনত্ব বেশি দেখা যাচ্ছে।

অর্থাৎ, এডিস মশার বিস্তার গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়েছে এবং এর মাত্রা শহরের চেয়ে বেশি হচ্ছে। ঢাকার বাইরের এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে গতবছর থেকেই। এবার গ্রামাঞ্চলেও বিআইয়ের বা লার্ভার ঘনত্ব অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে।

 

কীটতত্ত্ববিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, এডিস মশার ঘনত্ব এবং ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা নিয়ে যে ফোরকাস্টিং মডেলটি তৈরি করি সেখানে দেখতে পাচ্ছি এবারও ৬৪ জেলাতেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়বে। এর মধ্যে ঢাকা তো রয়েছেই, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরগুনা, বরিশাল, চাঁদপুর ও গাজীপুর বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ এই জেলাগুলোতে এডিস মশার ঘনত্ব বেশি পেয়েছি।’

দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় নির্দিষ্ট কয়েকটি জেলায় এডিস মশা বেশি থাকার কারণ ব্যাখা করে এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, ‘যেখানে অপরিকল্পিত নগরায়ন হতে থাকে সেখানেই এডিশ মশা বাড়তে থাকে। কারণ প্রায় সব নির্মাণাধীন ভবনেই মশা থাকে। এছাড়া কোন একটি জায়গায় এডিশ মশা ঢুকলো সেটি যদি সমূলে বিনষ্ট না করা যায় তাহলে এর বিস্তার লাভ হতেই থাকে। এডিশ মশার ঘনত্ত্ব বেশি থাকলে ডেঙ্গু হওয়ার শঙ্কাও বেশি থাকে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, দেশে প্রথম ডেঙ্গুজরে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। পরে ধীরে ধীরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০২৩ সালে দেশের ইতিহাসে সর্বাধিক মানুষ আক্রান্ত ও মারা যায়। চলতি বছর গেল ১৫ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে তিন হাজার ২০৭ জন এবং মারা গেছেন ৪০ জন। বর্ষার মৌসুমের আগেই এমন আক্রান্ত এবং মৃত্যু শঙ্কা জাগাচ্ছে।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার ডেঙ্গুর প্রাক বর্ষা জরিপে গত বছর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় অবস্থিত বাড়িতে যে মাত্রায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে চলতি বছর এর ঘনত্ব হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন গুণ। ফলে ডেঙ্গু জ¦র নিয়ে ঈদে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

জনস্বাস্থ্যবিদ এম এইচ চৌধুরী লেলিন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ডেঙ্গু এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ২০১৯ সালের পর গ্রাম ও শহর সর্বত্রই ডেঙ্গু হচ্ছে। ঈদের ছুটিতে যারা গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছেন তাদের আনন্দ যেন মাটি না হয়ে যায় সেদিকে সবাইকে সাবধান থাকতে হবে।’

 

কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘আমরা গবেষণা করে দেখেছি এডিস মশা নোংরা পানিতেও জন্মায়। রাতের বেলায়ও কামড়ায়। ফলে এসব আচরণগত পরিবর্তন হচ্ছে। এসব নানা কারণে গতবছরের তুলনায় এবছরের ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যু সংখ্যা দুটোই বেশি। তাই এখনই যদি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিতে পারি তাহলে গত বছরের তুলনায় পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।’

ডেঙ্গুর হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে কয়েকটি কাজ করার পরামর্শ দিয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘বাড়ি ঘর ও চারপাশের জায়গাগুলোতে পানি জমে থাকে সেগুলো পরিস্কার রাখতে হবে। এছাড়া দিনে কিংবা রাতে যখনই ঘুমাই না কেন অবশ্যই মশারীর নিচে ঘুমাতে হবে। হাত-পা ঢাকা জামা কাপড় ব্যবহার করবো। কারণ খোলা জায়গা পেলেই মশা কামড়াতে পারে। এছাড়াও প্রতিবেশিদের সচেতন করার দায়িত্বও আমাদের।’

গ্রামের বাড়িতে গিয়ে জ্বরে আক্রান্ত হলে অবহেলার সুযোগ নেই জানিয়ে ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘ঈদে বাড়ি যাওয়ার পর জ¦রে আক্রান্ত হলে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না। কারণ ডেঙ্গুর জন্য বা করোনার জন্য, ভাইরাস কিংবা সংক্রমণজনিত কারণে ডেঙ্গু হতে পারে। তাই জ্বর হওয়ামাত্র নিকটবর্তী ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। যদি ডেঙ্গু হয়ে থাকে তবুও ভয় পাওয়ার কারণ নেই। প্রচুর বিশ্রাম নিতে হবে। পর্যাপ্ত পানি এবং তরল খাবার খেতে হবে। এর পাশাপাশি প্যারাসিট্যামলজাতীয় ওষুধ খেলেই প্রায় ৯৫ রোগী সুস্থ হয়ে যায়। এরপরও যদি কেউ অসুবিধাবোধ করে তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শে নিকটবর্তী হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।’

ডেঙ্গু সবার জন্যই মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। তবে গর্ভবতী নারীর সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে এই জনস্বাস্থ্যবিদ বলেন, ‘গর্ভবতী মায়ের জ্বর হলে দুটো জীবন নিয়ে ভাবতে হবে। ফলে যেকোনো জ্বর হলেই দ্বিগুন গুরুত্ব দিয়ে নিকটবর্তী চিকিৎসক দেখাতে হবে এবং সেই পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে।’

(ঢাকাটাইমস/১৮জুন/টিএ/ডিএম)