বাংলাদেশ মাদকের আন্তর্জাতিক রুট!

প্রকাশ | ১১ জুলাই ২০২৪, ১১:৫২ | আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৪, ১১:৫৬

কাদের গনি চৌধুরী

বাংলাদেশ এখন মাদকের আন্তর্জাতিক নিরাপদ রুট! বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারীরা বাংলাদেশকে ট্রানজিট দেশ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। তবে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশকে মাদকের বড় বাজার হিসেবে দেখছে আন্তর্জাতিক মাদক মাফিয়া চক্র। আফ্রিকা,মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, ভারত, মিয়ানমার, মালাবি থেকে শুরু করে ইউরোপ ও আমেরিকার মাদক ব্যবসায়ীদের নজর এখন বাংলাদেশের দিকে।বাংলাদেশকে কেবল মাদকের বাজার হিসেবেই নয়, নিরাপদ রুট হিসেবে দেখছেন তারা।বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে যেমন মাদক আসছে, তেমনি কয়েকটি দেশ ঘুরে বাংলাদেশ হয়ে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে হেরোইন ও কোকেন। কোকেন ও হেরোইনের অধিকাংশ চালান ঢুকছে আফ্রিকা ও নাইজেরিয়ার নাগরিকদের মাধ্যমে। ইয়াবা আসছে মিয়ানমারের পাচারকারীদের মাধ্যমে। ফেনসিডিল ও গাজা আসছে ভারতের মাধ্যমে।

 গত কয়েক বছরে মাদক জব্দের ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায় ভিআইপি মাদক হেরোইন ও কোকেন পাচারে বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক মাদক মাফিয়া চক্র। কিছু বাংলাদেশীও এর সঙ্গে জড়িত। মাদক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রচুর ইয়াবা ও আইসসেবী থাকলেও কোকেন ও হেরোইনসেবী খুবই কম। কোকেন ও হেরোইনের বড় বড় যে সব চালান আসছে সেগুলো মূলত অন্য দেশে পাচারের জন্য এসেছে। পাচারকারীরাও আটকের পর জানান যে, এসব মাদক বিদেশে পাচারের জন্য আনা হয়েছে।

বাংলাদেশের জন্য বড় দুঃসংবাদ হচ্ছে ডার্ক ওয়েব এর মাধ্যমে (ইন্টারনেটের অন্ধকার জগৎ) থেকে অপপ্রচলিত নানা ধরনের ভয়ংকর মাদক কিনে দেশে নিয়ে আসছে কারবারিরা। এসব মাদকের অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে বিট কয়েনে (ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ডিজিটাল মুদ্রা)। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ডার্ক ওয়েবে পরিচয় গোপন করে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ ও নিষিদ্ধ পণ্য কেনা যায়। এ কারণে সারা বিশ্বেই ডার্ক ওয়েব অপরাধীদের কাছে জনপ্রিয়। পণ্য কেনাবেচায় ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করা হয়। ক্রেতা-বিক্রেতা একে অপরকে চেনে না। আবার ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন করায় এ–সম্পর্কিত কোনো তথ্যও থাকে না। সম্প্রতি ডার্ক ওয়েব ব্যবহার করে মাদক ক্রয়ের কারণে কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ মাদকের ভয়াবহ ঝুঁকিতে রয়েছে। এশিয়ার গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল (মিয়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ড ), গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ( ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান ), গোল্ডেন ওয়েজ( ভারতের হিমাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, নেপাল ও ভুটানের কিছু অংশ) পরিচিত মাদক চোরাচালানের তিনটি প্রধান অঞ্চলের কেন্দ্র বাংলাদেশের অবস্থান।যারফলে আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ী চক্র বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা ট্রানজিট হিসেবে বাংলাদেশকে নিরাপদ মনে করছে। কারণ বাংলাদেশে মাদক শণাক্ত করার উন্নত প্রযুক্তি কম, এয়ারপোর্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা ততটা শক্তিশালী না, দেশের ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালীরা এর সঙ্গে জড়িত, তাছাড়া প্রশাসনের লোকদের সহজে ম্যানেজ করা যায়;যা মাদক পাচারের জন্য সুবিধা বয়ে আনে।

কোকেন ও হেরোইন পাচারে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক:

২০১৩ সালের ১১ জুন কারওয়ান বাজারের একটি অভিজাত হোটেল থেকে তিন কেজি কোকেনসহ গ্রেফতার হন পেরুর নাগরিক হুয়ান পাবলো রাফায়েল জাগাজিটা। এরপর থেকেই মাদকপাচারে বিদেশীরা যে জড়িত সেটি নজরে আসে বাংলাদেশের।

পাবলোকে আটক করার পেছনে একটি মজার গল্প রয়েছে।২০১৫ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় মেক্সিকোয় বাংলাদেশ দূতাবাসে একটি উড়ো ফোন আসে। ওপাশ থেকে দাবি করা হয় তিনি একজন বলিভিয়ান। দূতাবাসকে তিনি জানালেন, দুই বাংলাদেশি এবং একজন পেরুভিয়ান মিলে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে ব্যাপক পরিমাণ কোকেন পাচার করছে। সবশেষ ফুডক্যানে করে বিপুল পরিমান কোকেন বাংলাদেশে চালান করেছে তারা। চক্রটির পরবর্তি আপডেট সময়মতো জানানো হবে উল্লেখ করে ফোন কেটে দেন ব্যক্তিটি। সেটাই শেষ।

উড়োখবর হলেও এটিকে উড়িয়ে দেয়নি বাংলাদেশ দূতাবাস। বার্তাটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেয় দূতাবাস কর্তৃপক্ষ।  তারা বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সকল গোয়েন্দা সংস্থাকে সতর্ক করে। শুরু হয় কোকেন অনুসন্ধান।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা বিভাগ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো থেকে আমদানি করা ভোগ্যপণ্য-দ্রব্যের তালিকা চায়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রথমে তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। তারা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা বিভাগকে তাদের অনুসন্ধানের বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে মন্ত্রণালয়কে জানাতে অনুরোধ জানায়। কথামতো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক উপ-পরিচালক উত্তর আমেরিকা থেকে আমদানি করা ভোগ্যপণ্যের তালিকা চেয়ে চিঠি লেখেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু সে তালিকা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে পৌঁছানোর আগেই খবর আসে চট্টগ্রাম বন্দরে সূর্যমূখী তেলের সাথে কোকেনের বড় একটা চালান এসেছে। ২০১৩ সালের জুনের গোড়ার দিকের ঘটনা এটি। চট্টগ্রাম বন্দরে জব্দ হওয়া তেলের ড্রামে কোকেন ধরা পড়ার চাঞ্চল্যকর খবর দুনিয়া জুড়ে হৈচৈ ফেলে দেয়।এরমধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে প্রথম সারির এই মাদক কোকেন পাচারের রুট হিসেবে বাংলাদেশের নামটি গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

এদিকে ২০১৪ সালের ২ জানুয়ারি আর্ন্তজাতিক মাদক বিরোধী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ঢাকায় অবস্থানকারী দক্ষিণ আমেরিকার এক নাগরিকের খবর পায় দুবাই পুলিশ। ওই নাগরিকের (পাচারকারী) সাথে থাকা একটি কোকেনের চালান সম্পর্কেও জানতে পারে তারা। দুবাই হয়েই ওই ব্যক্তি ঢাকা পৌঁছে বলেও জানায় দুবাই পুলিশ। তাদের দেওয়া তথ্যর ভিত্তিতে অভিযানে নামে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। কয়েক স্থানে হানা দেওয়ার পর হোটেল লা ভিঞ্চি থেকে দুই কেজি কোকেনসহ আটক করা হয় পেরুর নাগরিক হুয়ান পাবলো রাফায়েল জাগাজিটারকে । হুয়ান পাবলো রাফায়েল জাগাজিটার পেরু থেকে ইকুয়েডর, পানামা, ব্রাজিল ও দুবাই হয়ে ঢাকায় কোকেন নিয়ে ঢুকেছিলেন। ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে তিনি জানিয়েছিলেন, সাড়ে চার হাজার ডলারের বিনিময়ে তিনি কোকেনগুলো ইউরোপের একটি দেশে পৌছে দেওয়ার চুক্তি করেছিলেন। পাবলো আদালতে জানান, তিনি লিমার একটি ডিসকোতে কাজ করতেন। এক নারী মাদক পাচারকারী তাকে কোকেন পাচারের এই কন্ট্রাক্ট দিয়েছেন।লোভে পড়ে তিনি এ ফাঁদে পাদে দেন। প্রথমে তিনি লিমা থেকে বাসে করে ইকুয়েডর যান। সেখান থেকে কোপা এয়ারলাইন্সে করে পানামা হয়ে ব্রাজিল পৌঁছান। আর সেখান থেকে এমিরেটস এয়ারলাইনসে করে দুবাই হয়ে ঢাকায় আসেন।

পাবলো জানান, লিমাতে প্রশিক্ষিত কুকুর দিয়ে লাগেজ তল্লাশি করা হয় বলেই ১০ ঘন্টার বাস ভ্রমন করে তিনি ইকুয়েডর গিয়েছিলেন। তার যে ব্যাগটিতে কোকেন প্যাক করা ছিল তা ইকুয়েডর থেকে ঢাকার নামেই বুকিং দেওয়া হয়েছিল। পাবলো আদালতকে আরো জানিয়েছিলেন, তার কাজ ছিল প্যাকেটটি ঢাকায় পৌছে দেওয়া। হোটেল থেকে একজন মোটা তরুণীর তা সংগ্রহ করার কথা।

সাইকোট্রফিক সাবসটেনসেস বা এনপিএস এর একটি বড় চালান ধরা পড়ে ২০১৮ সালে।পাচারকারীদের কৌশলটা ছিল ভিন্ন ধরনের। ঘোষণা দেয়া হয়েছিল চা-পাতা। কিন্তু আসলে তা ছিল নতুন ধরনের মাদক, নিউ সাইকোট্রফিক সাবসটেনসেস বা এনপিএস। বাংলাদেশি পণ্য হিসেবে সুদৃশ্য ও চকচকে ‘গ্রিন টি’র প্যাকেটে ভরা এই মাদকের গন্তব্য ছিল ইউরোপ-আমেরিকায়। ক্যাথিনোন গ্রুপের উদ্ভিদ জাতীয় এই মাদক আফ্রিকায় ‘খাত’ নামে পরিচিত। ইথিওপিয়া থেকে বেশ কয়েকটি দেশ ঘুরে বাংলাদেশে আসে খাত। অনেকটা চা-পাতার গুড়ার মতো দেখতে এ মাদকের দাম প্রতিকেজি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।

বিদেশী মাদক পাচারকারীদের সহযোগিতায় ২০১৮ সালে বেশ কিছু চালান দেশে এনেছেন মাদক পাচারকারী মো. নাজিম। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ৮৬১ কেজি এনপিএসসহ নাজিমকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসেইয়ের সহযোগিতায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম শিকদারের নেতৃত্বে একটি টিম শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৪৬৭ কেজি এনপিএস উদ্ধার করে।পরে শান্তিনগর এলাকা থেকে এই চালানের মালিক নাজিমকে গ্রেপ্তারসহ তার হেফাজত থেকে আরো ৩৯৪ কেজি এনপিএস উদ্ধার করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে নাজিম জানান,এনপিএসগুলো আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া থেকে অন্তত চার-পাঁচটি দেশ ঘুরে বাংলাদেশে আসে। গ্রিন টির মোড়কে এই মাদক আমদানী করে স্থানীয় বাজারে বিক্রির পাশাপাশি নতুন মোড়কে বাংলাদেশী পণ্য হিসেবে বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছিল।’ নাজিমকে আরো জানা্য, সে আগে কাজের সূত্রে দুবাই ছিল। সেখানে ইথিওপিয়ার এক ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেখানে ওই ব্যক্তির সঙ্গে খাত আমদানি করে ইউরোপ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতে পাচারের চুক্তি হয়। এরপর দেশে ফিরে কয়েকমাস ধরে এই ব্যবসা চালিয়ে আসছিল নাজিম।দেশের বাজারে এ নতুন মাদকের বাজার সম্পর্কে নাজিম জানায় এনে এক/দেড় কেজি করে নিজস্ব ব্র্যান্ডের চায়ের প্যাকেটে ভরা হতো। এরপর গ্রীন টি হিসেবে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পাঠাতো সে।

দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সলিড কোকেনের চালানটি এবছরের (২০২৪) শুরুর দিকে জব্দ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। আফ্রিকান দেশ ‘মালউ’র একজন নারী ৮ কেজি ৩০০ গ্রামের এ কোকেনের চালানটি বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। ২৪ জানুয়ারি রাতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মালউ-এর নাগরিক নোমথেনডাজো তাওয়েরা সোকোকে (৩৫) কোকেনের এ চালানসহ গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। ডিএনসি জানায়, কোকেনের এ চালান আফ্রিকার দেশ মালউ অথবা ইথোপিয়া থেকে বাংলাদেশে এসেছে। বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল চালানটি পাচার করার জন্য। কারণ এ পরিমাণ কোকেন চাহিদা বাংলাদেশে নেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, কোকেনের একটি বৃহৎ চালান আফ্রিকা থেকে কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে আফ্রিকান একজন নাগরিকের মাধ্যমে ঢাকায় আসবে এমন অগ্রিম তথ্য ছিল তাদের কাছে। এরপর থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নজরদারি বাড়ানো হয়। এপিবিএনকে সঙ্গে নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি টিম গঠন করে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৮ নম্বর টার্মিনালের বোর্ডিং ব্রিজ এলাকায় অবস্থান নেওয়া হয়। ফ্লাইটিতে নামা সব বিদেশি যাত্রীকে ফলো করা হয়। এর মধ্যে দেখা যায়, নোমথেনডাজো তাওয়েরা সোকো নামের এক বিদেশি নারী বিমানবন্দরের নিচ তলায় ভিসা অন অ্যারাইভাল ডেক্সে দীর্ঘক্ষণ ধরে অবস্থান করছে। তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে সন্দেহজনক হওয়ায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেন লাগেজে অবৈধ মাদকদ্রব্য কোকেন আছে। পরে লাগেজের ভেতরে বিশেষভাবে রক্ষিত ৮ কেজি ৩০০ গ্রাম কোকেন জব্দ করা হয়। মাদক চোরাচালানী নোমথেনডাজো তাওয়েরা সোকো আফ্রিকান দেশ মালউয়ের নাগরিক। তিনি প্রথমে মালউ থেকে ইথোপিয়া যান। পরে তিনি ইথোপিয়া থেকে যান দোহাতে। পরে দোহা থেকে কাতারের এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে বাংলাদেশে আসেন। ৪ ফেব্রুয়ারি তার বাংলাদেশ থেকে আবারও মালউতে যাওয়ার কথা ছিল। কোকেনের চালানটি বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করার কথা ছিল তার। পরে এটি চলে যাওয়ার কথা ছিল অন্য কোনো দেশে। এই মাদক পাচারের আগে ২০২৩ সালে গার্মেন্টস ব্যবসার কথা বলে বাংলাদেশে এসেছিলেন নোমথেনডাজো তাওয়েরা সোকো। সেবার সব কিছু তিনি জেনে শুনে যান।এবারও তিনি বাংলাদেশের একটি গার্মেন্টসের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে আসেন। অন এ্যারাইভাল ভিসা নেওয়ার জন্য তিনি তার পরিচয় লুকিয়ে গার্মেন্টস ব্যবসার নাম করে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন। সোকো মালউতে পেশায় একজন নার্স। তিনি মূলত কোকেনের এ চালানের বহনকারী। বাংলাদেশে তিনি আরেকজন বিদেশি নাগরিকের কাছে এ চালান পৌঁছে দিয়ে নিজ দেশে চলে যাওয়ার কথা ছিল।

২৫ জানুয়ারি রাজধানীর উত্তরার একটি আবাসিক হোটেলে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ডগ স্কোয়াড এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের যৌথ অভিযানে ২০০ গ্রাম কোকেনসহ পূর্ব আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ান নাগরিককে আটক করা হয়েছে। তার নাম মোহাম্মেদি আলি (৫৫)। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ এবং ডিএনসির একটি যৌথদল উত্তরায় হোটেল এফোর্ড ইনে অভিযান চালায়। এ সময় তাদের সঙ্গে এয়ারপোর্ট এপিবিএনের ডগ স্কোয়াডও অংশ নেয়। হোটেলটির দোতলায় ১০২ নম্বর রুম ভাড়া নেন তানজানিয়ার অধিবাসী মোহাম্মেদি আলি। আভিযানিক দল প্রথমেই তাকে আটক করে।আটক ব্যক্তিকে মাদকের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করলে প্রথমে অস্বীকার করেন। পরে অভিযানে সঙ্গে থাকা এপিবিএন ডগ স্কোয়াডের সহায়তায় মোহাম্মেদি আলির কক্ষটিতে তল্লাশি চালানো হয়। তল্লাশি চলাকালে ডগ স্কোয়াডের ডগ ‘অলি’ বিদেশি নাগরিক মোহাম্মেদির সঙ্গে থাকা কালো একটি ব্যাগে মাদক রয়েছে বলে তার হ্যান্ডলার সুনেত্রাকে সতর্ক করে। পরবর্তীতে ম্যানুয়ালি ব্যাগটি সার্চ করলে তার ভেতরে বিশেষ কায়দায় লুকায়িত অবস্থায় ২০০ গ্রাম কোকেন জব্দ করা হয়। যার আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য প্রায় ২৫ লাখ টাকা। আটক মোহাম্মেদি আলি তানজানিয়ান নাগরিক। গত ২০ জানুয়ারি তিনি আদ্দিস আবাবা- দোহা হয়ে ঢাকায় আসেন এবং হোটেল এফোর্ড ইনের ১০২ নম্বর রুমে ওঠেন।

কোকেনের এই দুটি চালান জব্দ ও পাচারকারীদের ধরার পর কোকেন পাচারকারী আন্তর্জাতিক চক্রের বাংলাদেশে সমন্বয়কারী ফাঙ্কির নাম চলে আসে গোয়েন্দাদের কাছে।কোকেন পাচারকারী আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের সদস্য নাইজেরিয়ান নাগরিক ডন ফ্রাঙ্কি ওরফে জ্যাকব ফ্রাঙ্কি দীর্ঘদিন ধরে কোকেন পাচারে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে ব্যবহার করে আসছে । বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।২৪ ও ২৫ জানুয়ারির কোকেন জব্দের ঘটনায় দুই বাংলাদেশিসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করার পরই বেরিয়ে আসে দেশে গার্মেন্টস ব্যবসার আড়ালে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের তথ্য।ক্যামেরুনের নাগরিক কেলভিন ইয়েং, নাইজেরিয়ার নাগরিক ননসো ইজিমা পেটার ওরফে অস্কার (৩০) ও নুডেল ইবুকা স্টানলি ওরফে পডস্কি (৩১) ও বাংলাদেশী নাগরিক সাইফুল ইসলাম রনি (৩৪), মো. আসাদুজ্জামান আপেল (২৭) ব্যাপক জিজ্ঞাসা বাদে জানান বাংলাদেশে কোকেন পাচারকারী মাফিয়া চক্রের সদস্য নাইজেরিয়ান নাগরিক ডন ফ্রাঙ্কি ওরফে জ্যাকব ফ্রাঙ্কিসহ আরো কিছু নাম বেরিয়ে আসে। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে রাজধানীর একটি আবাসিক এলাকায় অভিযান চালিয়ে ক্যামেরুনের নাগরিক কেলভিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কেলভিন এবছরের ২০ জানুয়ারি আরেক বিদেশি নাগরি মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। কেলভিন এই মাদক চক্রের অন্যতম সদস্য। তিনি বাংলাদেশে বসে মাদকের দেশি বিদেশি সদস্যদের সমন্বয় করতেন। গত ২৪ তারিখ কোকেনসহ মালাওয়ের নাগরিক গ্রেপ্তারের খবরে দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন কেলভিন। এই প্রস্তুতিকালেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্র জানায়, মাদক চক্রের প্রধান ডন ফ্রাঙ্কির বাংলাদেশি সহযোগী রনিকে গ্রেপ্তার করার পর চক্রের অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালায় ডিএনসি। রনি এই সিন্ডিকেটের বাংলাদেশি সমন্বয়কারী। সেও গার্মেন্টস শিল্পের বিভিন্ন ব্যবসার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে মাদক পাচারের কাজ করত। তার কাজ ছিল মাদক বহনকারীদের দেশে প্রবেশের প্রয়োজনীয় ইনভাইটেশন, হোটেল বুকিং ও ভিসা পাওয়ার কার্যক্রমে সহযোগিতা করা। ম্যাসপেক্স লিমিটেড নামের কথিত একটি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে এই আমন্ত্রণপত্র ইস্যু করা হতো। রনির মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও অন্যান্য প্রযুক্তির ডিভাইস বিশ্লেষণ করে একাধিক ভুয়া ইনভাইটেশন লেটার পাঠানো ও চক্রের প্রধান ফ্রাঙ্কির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া ফ্রাঙ্কির অফিসে অভিযান চালিয়ে বারিধারার একটি বাসা থেকে কোকেন চোরাচালান সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং কোকেন পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন ল্যাগেজ পাওয়া যায়।

সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও বাড়ির মালিকদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ফ্রাঙ্কি ২০২৩ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ত্যাগ করেছে। তার অবর্তমানে ফ্রাঙ্কির ভাই উইসলি ও তাদের ম্যানেজার আসাদুজ্জামান আপেল এই বাসায় থেকে ব্যবসা দেখাশুনা করত। অভিযান চালিয়ে আপেলকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে আপেল ডিএনসিকে জানিয়েছে, বাংলাদেশে কোকেনের চালান প্রবেশের পরে পুনঃপ্যাকেজিং ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে সহায়তা দায়িত্ব ছিল তার। তার ডিজিটাল ডিভাইস বিশ্লেষণ করে এ সংক্রান্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে। ফ্রাঙ্কির ভাই উইসলি কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ ত্যাগ করে চলে গেছে। পরবর্তীতে আপেলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই আবাসিক এলাকায় অভিযান চালিয়ে অস্কার, পডস্কিকে গ্রেপ্তার করা হয়।

 গত বছরের ১০ জানুয়ারি মরক্কো থেকে আসা ভারতীয় এক নারী যাত্রীর ট্রলি ব্যাগ থেকে পৌনে ২ কেজি কোকেন জব্দ করে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। সালোমি লালরামধারি নামের ৪৮ বছর বয়সী ওই ভারতীয় কাতার এয়ারওয়েজে করে শনিবার প্রথম প্রহরে শাহজালালে নামেন। কথাবার্তায় সন্দেহজনক হওয়ায় তার বহনকৃত ট্রলি ব্যাগটি স্ক্যানিং ও দেহ তল্লাশি করা হয়। স্ক্যানিংয়ে যাত্রীর ট্রলি ব্যাগে মাদকের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। পরে ওই ট্রলিতে বিশেষভাবে লুকিয়ে রাখা প্রায় ১৮০০ গ্রাম সাদা রংয়ের কোকেন সদৃশ মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়। জব্দ করা কোকেনের আনুমানিক দাম ১২ কোটি টাকা। এ চালানটি বাংলাদেশ হয়ে ভারত যাওয়ার কথা।

এর আগে ২০২২ সালের ২৩ জানুয়ারি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ২০ কোটি টাকার হেরোইনসহ গ্রেফতার করা হয় দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানার নাগরিক লেসেডি মোলাপিসিকে। আটকের সময় তার কাছ থেকে ৩ কেজি ১০০ গ্রাম হেরোইন জব্দ করা হয়। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ২০ কোটি টাকা। ওই যাত্রী দোহা থেকে কাতার এয়ারলাইন্সে করে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শাহজালালের সব পয়েন্টে কঠোর নজরদারি রেখে তাকে আটক করা হয়। আটকের পর তার বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা দায়ের করা হয়। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান এই চালান অন্য একজনকে হস্তান্তরের কথা ছিল। এই হেরোইন বাংলাদেশ হয়ে অন্য কোনো দেশে পাঠানোর জন্য আনা হয়েছিল।

আড়াই বছর পর এবছরের ২৮মে দণ্ডিত ওই লেসেডি মোলাপিসিকে বিচার শেষে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। ঢাকার অষ্টম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আমিনুল ইসলাম সোমবার এ মামলার রায় দেন। অবশ্যই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ইতোমধ্যে তাকে মৃত্যুদন্ড না দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে।

২০১৬ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা উত্তর মেট্টোর তৎকালীন উপ-পরিচালক খুরশীদ আলমের নেতৃত্বে অভিযানে ২ কেজি ৭০০ গ্রাম পরিমাণের চালান বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়। সে সময় গ্রেপ্তার হন একজন ড্যানিশ নাগরিক। তখন বিষয়টি বেশ আলোচিত ছিল। ওই চালানটিও অন্য দেশে নেওয়ার টার্গেট নিয়ে বাংলাদেশে আনা হয়েছিল। ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রায় আড়াই কেজি কোকেনসহ গ্রেপ্তার হন পেরুর আরেক নাগরিক জেইম বার্গলে গোমেজ। এ মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজা হয়। একই বছেরের জুনে চট্টগ্রাম বন্দরে সূর্যমুখী তেলের ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা একটি ড্রামে কোকেনের চালান পাওয়া যায়। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়া থেকে আনা একটি কন্টেইনারে ১০৭টি ড্রামের মধ্যে একটি ড্রামে তরল অবস্থায় কোকেনের অস্তিত্ব পাওয়া যাওয়ার কথা জানিয়েছিলো শুল্ক বিভাগের গোয়েন্দারা। সে সময় গোয়েন্দারা জানিয়েছিলেন, ড্রামটিতে ১৮৫ কেজি তরল ছিল এবং তাতে এর এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় ৬০ কেজি কোকেন ছিল।কোকেন পাচারের মধ্যবর্তী রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছিলেন গোয়েন্দারা। শুধু বিদেশীরাই নয় অনেক বাংলাদেশীও হোরাইন ও পাচারে  জড়িয়ে পড়েছেন।

২০১২ সালে ভেনেজুয়েলায় আটক আড়াই কেজি কোকেন চালানের সাথেও জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের নাম। সেদেশের পুলিশের ভাষ্য, বাংলাদেশে পাঠানোর জন্যই জমা করা হয়েছিল চালানটি। ২০১১ সালে স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ার পুলিশ বাংলাদেশ থেকে ডাকযোগে পাঠানো আট’শ গ্রাম কোকেনের প্যাকেট আটক করে। তারও আগে ২০০৯ সালে ব্যাংকক বিমান বন্দরে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সোয়া কেজি কোকেনের চালান আটক করেছিল থাই পুলিশ। বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রের দেওয়া তথ্য মতে, কোকেন চোরাচালানের প্রধান রুট হিসেবে এখন বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হচ্ছে। কলম্বিয়া, বলিভিয়া, পেরু ও মেক্সিকো সহ দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকান দেশগুলো থেকে বর্তমানে ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড হয়ে ফের আমেরিকা-এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কোকেন যাচ্ছে।

জাতিসংঘের মাদক বিরোধী সংস্থা অফিস অন ড্রাগস এন্ড ক্রাইম’র (UNODC) ভাষ্যমতে, মাদক পাচারের মধ্যবর্তী ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশের ব্যবহার দ্রুতই বাড়ছে। অন্য এশিয়ান দেশে ক্রমবর্ধমান হারে কোকেন আটকের যে চিত্র, তাতেই করিডোর হিসেবে মাদকপাচারকারীদের বাংলাদেশকে ব্যবহারের আশঙ্কার কথা জানিয়ে দেয়। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৪১ কেজি কোকেন ধরা পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩ কেজি কোকেন ধরা পড়েছে ২০২৩ সালে। এসব কোকেন পাচারের সাথে প্রধানতম জড়িত ছিল বিদেশী নাগরিকরা।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে বিশেষ অভিযানে ২৭২ কেজি হেরোইন ও ৫ কেজি কোকেনসহ মো. জামাল উদ্দিন ও রাফিউল ইসলাম নামক দুই বাংলাদেশি গ্রেফতার হয়। এটি ছিল শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হেরোইন ও কোকেনের চালান।তার কয়েকদিন পর ৩২ কেজি হেরোইনসহ বাংলাদেশি নাগরিক সূর্যমণি গ্রেফতার হয়। ১ মাসের মধ্যে হেরোইন ও কোকেনসহ বাংলাদেশি গ্রেফতারের ঘটনাটি তদন্তে বাংলাদেশে তখন একটি ট্রাক্সফোর্স গঠন করা হয়। ট্রাক্সফোর্সের অভিযান চালিয়ে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে চয়েজ রহমান নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর তার বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করা হয়।এরই ধারাবাহিকতায় গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর বিমান বন্দরের পাশে কাউলা এলাকা থেকে অভিযান চালিয়ে ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১ হাজার ৯৭০ পিস ইয়াবা, বৈদেশিক মুদ্রা ও পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের সাথে সম্পৃক্ত বলে জানায়। বাংলাদেশে তাদের নিয়ন্ত্রক মো. আরিফ উদ্দিন। আরিফ উদ্দিনের আল-আমিন ফ্যাশন বায়িং হাউস নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেই ব্যবসার অন্তরালে আন্তর্জাতিক মাদক সিন্ডিকেটের সাথে তিনি জড়িত।

গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেল থেকে ডিবি পুলিশ বাত সোয়ানা নামে এক আফ্রিকান নারীকে প্রায় ৫ কেজি কোকেনসহ গ্রেপ্তার করে। তিনি খেয়ে পেটের ভেতরে করে কোকেনগুলো নিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তীতে তার পেটা ব্যথা শুরু হলে হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হোটেল কর্তৃপক্ষ ডিবি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে জীবন বাঁচাতে ওই আফ্রিকান নারী জানান তার পেটে কোকেন রয়েছে। যা তিনি খেয়ে এনেছেন। নির্ধারিত সময়ে একজন ব্যক্তির বিশেষ ট্যাবলেট নিয়ে তার কাছে আসার কথা ছিল। কিন্তু তিনি আসেননি। পরবর্তীতে ডিবি পুলিশ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে পেট ওয়াশ করে কোকেনগুলো বের করে।

 মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে কোকেনের ব্যবহারকারী নেই। তাদের ধারণা, গত ২৪ জানুয়ারি ৮ কেজি ৩০০ গ্রামের যে কোকেন এসেছিল দেশে তা অন্য কোনো দেশে পাচারের চেষ্টা ছিল। এর আগে বাংলাদেশে কোকেনের যে চালান ধরা পড়েছিল তার প্রায় সবই এসেছিল দক্ষিণ আমেরিকা থেকে, গন্তব্য ছিল ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা।

জব্দ মাদকদ্রব্যের তালিকা ও পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিগত ১৫ বছরে সারা দেশে চার হাজার ২৫ কেজি ৪৭৮ গ্রাম হেরোইন জব্দ করা হয়। এর মধ্যে গত বছর ৭০০ কেজি ৯৮০ গ্রাম হেরোইন জব্দ করা হয়েছে। এর আগে ২০২২ সালে ৩৩৮ কেজি ২২১ গ্রাম জব্দ করা হয়। এ ছাড়া ২০২১ সালে ৪৪১ কেজি, ২০২০ সালে ২১০ কেজি, ২০১৯ সালে ৩২৩ কেজি, ২০১৮ সালে (বিশেষ অভিযানের বছর) ৪৫১ কেজি, ২০১৭ সালে ৪০১ কেজি, ২০১৬ সালে ২৬৬ কেজি, ২০১৫ সালে ১০৭ কেজি, ২০১৪ সালে ৭৮ কেজি, ২০১৩ সালে ১২৩ কেজি, ২০১২ সালে ১২৬ কেজি, ২০১১ সালে ১০৭ কেজি, ২০১০ সালে ১৮৮ কেজি ও ২০০৯ সালে ১৫৯ কেজি জব্দ করা হয়। গত বছর কোকেন জব্দ করা হয় ১৩ কেজির বেশি, যা ২০২২ সালে ছিল প্রায় সাড়ে চার কেজি। ২০২৩ সালে চার কোটি ২৯ লাখ ৭৭ হাজার ২১৯ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়, যা ২০২২ সালে ছিল চার কোটি ৫৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫৬৯ পিস। একইভাবে ২০২৩ সালে আগের বছরের তুলনায় গাঁজা, আফিম ও ফেনসিডিল জব্দের পরিমাণ কমেছে।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা মনে করছেন, গত বছর যে পরিমাণ হেরোইন জব্দ করা হয়েছে, তা গত ১৫ বছরের যেকোনো সময়ে চেয়ে দুই থেকে পাঁচ গুণ বেশি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র বলেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বেশি দৃষ্টি ছিল ইয়াবা ও আইসে। এর মধ্যে হঠাৎ হেরোইন ও  কোকেন আসা বেড়ে গেছে। অন্যান্য মাদকদ্রব্যের সঙ্গে হেরোইন,কোকেন জব্দ করতে অভিযান জোরদার করা হচ্ছে।

জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউএনওডিসির (United Nations Office on Drugs and Crime) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে আফগানিস্তানকে পেছনে ফেলে মিয়ানমার বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আফিম উৎপাদনকারী দেশ হয়েছে। ২০২২ সালে নিষেধাজ্ঞার পর আফগানিস্তানে আফিম চাষ ৯৫ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে মিয়ানমারে আফিম উৎপাদন বেড়েছে। সেখান থেকে বিভিন্ন দেশে পাচার করা হচ্ছে। এভাবে নিষিদ্ধ এই মাদকদ্রব্য মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসছে।

শুধু মিয়ানমারই নয় প্রতিবেশি ভারত থেকেও প্রচুর হেরোইন আসছে বাংলাদেশে। গত বছর ভারত থেকে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে প্রবেশের সময় হেরোইনের বেশির ভাগ চালান আটক করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, সিলেটসহ বিভিন্ন সীমান্ত এলাকার মাদক ব্যবসায়ীরা বেশির ভাগ হেরোইন আনছেন। এর মধ্যে মিয়ানমার থেকে হেরোইন আনার ক্ষেত্রে ভারতের ত্রিপুরা হয়ে সিলেটের জকিগঞ্জ নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে।

আট বছরে বিজিবি উদ্ধার করেছে ১০ হাজার কোটি টাকার মাদক ও চোরাচালান:

নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ২০১৬ সাল থেকে এবছরের মে মাস (২০২৪) পর্যন্ত শুধু বিজিবিই উদ্ধার করেছে প্রায় ১০হাজার ৩১১ কোটি ২৫ লাখ ২৪ হাজার টাকা মূল্যের মাদক ও চোরাচালান পণ্য। বিপুল পরিমাণ অস্ত্রও উদ্ধার করা হয় এসময়। শুধু এবছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ৫ মাসে প্রায় ৭৫৯ কোটি ৬২ লাখ ৬২ হাজার টাকার মাদক ও চোরাচালান পণ্য উদ্ধার করা হয়।

বিজিবির দেয়া হিসেব অনুযায়ী এবছরের জানুয়ারি মাসে দেশের সীমান্ত এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ১৪৬ কোটি ৫৯ লাখ ৮২ হাজার টাকা মূল্যের মাদক ও বিভিন্ন চোরাচালান পণ্য জব্দ করা হয় । জব্দকৃত মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে- ১০ লাখ ৪৮ হাজার ১৬৯ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৮কেজি ৩১২ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ আইস, ৩৯ কেজি ৩শ’৭৪ গ্রাম হেরোইন, ১১ হাজার ৯শ’৭৬ বোতল ফেনসিডিল, ১৯ হাজার ৭শ’২৪ বোতল বিদেশী মদ, ১ হাজার ২শ’৯৬ লিটার বাংলা মদ, ১ লাখ ১ হাজার ৭শ’৬০ পিস মদ তৈরীর ট্যাবলেট, ১ হাজার ৩৮ ক্যান বিয়ার, ৬শ’৫৪ কেজি গাঁজা, ১লাখ ৮৪হাজার ৫শ’৪৫টি নেশা জাতীয় ইনজেকশন, ২ হাজার ৪শ’ ৮২ বোতল ইস্কাফ সিরাপ, ৪ কেজি ৮শ ৪৫ গ্রাম কোকেন, ১১ হাজার ৯শ’ ৭৬ বোতল কফিডিল, ৫ লাখ ২১ হাজার , ৩শ ৮ পিস বিভিন্ন প্রকার ঔষধ, ১৬৭ প্যাকেট কীটনাশক ও ১ হাজার ১শ  ৬৪টি অন্যান্য ট্যাবলেট।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫৯ কোটি চার লাখ ৭০ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন প্রকারের মাদক ,অস্ত্র ও চোরাচালান পণ্যসামগ্রী জব্দ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। জব্দ করা মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে সাত লাখ ৭৯ হাজার ৩৪৭টি ইয়াবা ট্যাবলেট, পাঁচ কেজি ১০৩ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ আইস, ৪০ দশমিক ৭৫১ কেজি হেরোইন, ১৩ হাজার ৩৪৬ বোতল ফেনসিডিল, ১৭ হাজার ৩০১ বোতল বিদেশি মদ, এক হাজার ৪০০ লিটার বাংলা মদ, ৮২ হাজার ৫২০টি মদ তৈরির ট্যাবলেট, এক হাজার ৯৫২ ক্যান বিয়ার, এক হাজার ৮২০ কেজি গাঁজা, ৫৪ হাজার ৫৮০টি নেশাজাতীয় ইনজেকশন, তিন হাজার ১১৬ বোতল ইস্কাফ সিরাপ, তিন দশমিক ২০০ কেজি কোকেন, ৮৬৩ বোতল এমকেডিল/কফিডিল, চার লাখ ৯৬ হাজার ৭৩৫টি বিভিন্ন প্রকার ওষুধ, চার হাজার ৬৯৭টি অ্যানেগ্রা/সেনেগ্রা ট্যাবলেট, ৫০০ গ্রাম এলএসডি, ৯৭ প্যাকেট কীটনাশক এবং এক লাখ ৬৭ হাজার ৮৫৯টি অন্যান্য ট্যাবলেট।

মার্চ মাসে ১৬২ কোটি ১৯ লাখ ৫৭ হাজার টাকা মূল্যের মাদক ও চোরাচালান পণ্য জব্দ করে বিজিবি। জব্দ করা মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ১৬২ পিস ইয়াবা, ৫ কেজি ৭২৭ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ (আইস), ৩৮.২১৩ কেজি হেরোইন, ১৩ হাজার ৪৩২ বোতল ফেনসিডিল, ২১ হাজার ৪৭৬ বোতল বিদেশি মদ, ১ হাজার ২৮৭ লিটার বাংলা মদ, ১ হাজার ৩১৯ ক্যান বিয়ার, ১ হাজার ৯২৫ কেজি গাঁজা, ৬২ হাজার ৯০৮টি নেশাজাতীয় ইনজেকশন, ২ হাজার ৩২৩ বোতল ইস্কাফ সিরাপ, ১.৫০০ কেজি কোকেন, ১ হাজার ১৩ বোতল এমকেডিল বা কফিডিল, ৫ লাখ ৪৯ হাজার ১২২ পিস বিভিন্ন ধরনের ওষুধ, ৪ হাজারটি অ্যানেগ্রা বা সেনেগ্রা ট্যাবলেট, ৯০০ গ্রাম এলএসডি।

এপ্রিলে দেশের সীমান্ত এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৩ হাজার টাকা মূল্যের মাদক ও চোরাচালান জব্দ করা হয়। জব্দ করা মাদকের মধ্যে রয়েছে ৯ লাখ ৫ হাজার ৯৬৮ পিস ইয়াবা, ১২ কেজি ৩১১ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ আইস, ৩২ দশমিক ৭৯৩ কেজি হেরোইন, ১১ হাজার ৮৩ বোতল ফেনসিডিল, ২০ হাজার ৯০০ বোতল বিদেশি মদ, ৬০৩ লিটার বাংলা মদ, এক হাজার ৮৮ ক্যান বিয়ার, এক হাজার ১১৬ কেজি গাঁজা, ৫১ হাজার ১৫০টি নেশাজাতীয় ট্যাবলেট/ইনজেকশন, ৬ দশমিক ৮৮০ কেজি কোকেন।

মে মাসে ১৫৭ কোটি ৪২ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের মাদক ও বিভিন্ন প্রকারের চোরাই পণ্য জব্দ করা হয়। জব্দকৃত মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৮২৭ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৯ কেজি ৪২২ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ আইস, ৩৬ কেজি ৩৫২ গ্রাম হেরোইন, ১০ হাজার ৭৬০ বোতল ফেনসিডিল, ২২ হাজার ৬২১ বোতল বিদেশি মদ, ২৯৯ লিটার বাংলা মদ, ৫৯৩ ক্যান বিয়ার, ১ হাজার ৫০৩ কেজি গাঁজা, ২ লাখ ৮০৮টি নেশাজাতীয় ট্যাবলেট/ইনজেকশন, ৮ কেজি ৫৮০ গ্রাম কোকেন, ১ কেজি আফিম, ৮২০ বোতল এমকেডিল/কফিডিল।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ২০২৩ সালে দেশের সীমান্ত এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে দুই হাজার ২৮৮ কোটি ৬৬ লাখ সাত হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য ও চোরাচালান পণ্য জব্দ করেছে।

জব্দ মাদকের মধ্যে রয়েছে এক কোটি ৪৭ লাখ ৩৪ হাজার ৭৭৪ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ১৪২ কেজি ৯৪৭ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ আইস, এক লাখ ৮৫ হাজার ৮৩৩ বোতল ফেনসিডিল, তিন লাখ চার হাজার ৭৪৯ বোতল বিদেশী মদ, নয় হাজার ২৬৩ লিটার বাংলা মদ, ৫৭ হাজার ৮৯৯ ক্যান বিয়ার, ২২ হাজার ২২৯ কেজি গাঁজা, ৩৩০ কেজি ৭৯৩ গ্রাম হেরোইন, ১২ কেজি ৯৯৩ গ্রাম কোকেন, পাঁচ লাখ ৯৮ হাজার ৫৮৯টি নেশা জাতীয় উত্তেজক ইনজেকশন, এক লাখ ৫৩ হাজার ২১০টি এ্যানেগ্রা-সেনেগ্রা ট্যাবলেট।

২০২২ সালে অভিযান চারিয়ে ১ হাজার ৫৬৫ কোটি ৫৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা মূল্যের মাদকদ্রব্য এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ ও চোরাচালান জব্দ করা হয়। জব্দ মাদকের মধ্যে ছিল ১ কোটি ২৭ লাখ ৭৮ হাজার ১০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৭৭ কেজি ৬৯০ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ আইস, ৩ লাখ ১৬ হাজার ১৫৭ বোতল ফেনসিডিল, ১ লাখ ৮২ হাজার ৯৩২ বোতল বিদেশি মদ, ৪ হাজার ৬৪ লিটার বাংলা মদ, ৩৭ হাজার ১২৬ ক্যান বিয়ার, ২৮ হাজার ৬৭২ কেজি গাঁজা, ৭২ কেজি ১৫৯ গ্রাম হেরোইন, ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৭৫৪টি নেশা জাতীয় ও উত্তেজক ইনজেকশন, ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৯৪০টি এ্যানেগ্রা/সেনেগ্রা ট্যাবলেট, ১৩ কেজি ৪২৫ গ্রাম আফিম।

২০২১ সালে দেশের সীমান্ত এলাকাসহ অন্যান্য স্থানে অভিযান চালিয়ে মোট ১ হাজার ৭৩ কোটি ৪৩ লাখ ৫৮ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন প্রকারের মাদক, অস্ত্র ও চোরাচালান পণ্য সামগ্রী জব্দ করে। জব্দ করা মাদকের মধ্যে রয়েছে ২ কোটি ২৪ লাখ ৪০ হাজার ৯ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৩ লাখ ৩১ হাজার ৭৮৫ বোতল ফেনসিডিল, ২ লাখ ১৩ হাজার ৯৮৯ বোতল বিদেশি মদ, ৩ হাজার ২৬৮ লিটার বাংলা মদ, ১ লাখ ৩১ হাজার ৮৯৯ ক্যান বিয়ার, ১৯ হাজার ৪৯২ কেজি গাঁজা, ১৩৯ কেজি হেরোইন, ২ লাখ ২৪ হাজার ৬৫৭টি নেশা জাতীয় ও উত্তেজক ইনজেকশন।

২০২০ সালে ৭৩৭ কোটি ৯৩ লাখ ৬৯ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন প্রকারের মাদকদ্রব্য ও চোরাইপণ্য জব্দ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।জব্দ করা মাদকের মধ্যে রয়েছে- ১ কোটি ৮ লাখ ৮৯ হাজার ৮৪৯ পিস ইয়াবা, ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৮৬৯ বোতল ফেনসিডিল, ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৯৯ বোতল বিদেশি মদ, ৬ হাজার ৩৩৯ লিটার বাংলা মদ, ১০ হাজার ৪১৬ ক্যান বিয়ার, ১৩ হাজার ৮৫৭ কেজি গাঁজা, ২২ কেজি ১৭ গ্রাম হিরোইন, ৪৬ হাজার ৬২১টি উত্তেজক ইনজেকশন, ৬৪ হাজার ১৬৯টি অ্যানেগ্রা/সেনেগ্রা ট্যাবলেট এবং ৩০ লাখ ২৪ হাজার ৯টি অন্যান্য ট্যাবলেট।

২০১৯ সালে ৮০২ কোটি ৯৭ লাখ ৯১ হাজার টাকা মূল্যের চোরাচালান ও মাদকদ্রব্য আটক করেছে। আটক মাদকের মধ্যে রয়েছে ৯২ লাখ ১৭ হাজার ৬৮৭ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৪ লাখ ১৮ হাজার ৩৬৮ বোতল ফেনসিডিল, ৮৫ হাজার ৩৭১ বোতল বিদেশি মদ, ৩ লাখ ৮৭৮.৪৫ লিটার বাংলা মদ, ৪ হাজার ৭৩০ ক্যান বিয়ার, ৭ হাজার ৭৮৯.২৬৫ কেজি গাঁজা, ১৪ কেজি ৮৪৯ গ্রাম হেরোইন, ৪ লাখ ৫৯ হাজার ২৮৮ পিস এনেগ্রা/সেনেগ্রা ট্যাবলেট, ৬ হাজার ১৫৫টি নেশাজাতীয় ইনজেকশন এবং অন্যান্য ট্যাবলেট ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৫৮৬ পিস।

২০১৮ সালে সীমান্ত এলাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থান থেকে ৯০৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা মূল্যের মাদক ও চোরাচালান জব্দ করে।অভিযানে মাদক পাচার ও চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ২ হাজার ৭০৫ জন এবং অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের দায়ে ১ হাজার ৩১৬ জনকে আটক করে সীমান্তরক্ষী বাহিনী। জব্দ মাদকের মধ্যে ছিল ১ কোটি ২৬ লাখ ৫৮ হাজার ৫১৮ পিস ইয়াবা, ৩ লাখ ৫৯ হাজার ১৫০ বোতল ফেনসিডিল। এছাড়া ৭৯ হাজার ২৮৬ বোতল বিদেশি মদ, ৪ হাজার ৬০৮ লিটার বাংলা মদ, ৩৬ হাজার ৪৩৫ ক্যান বিয়ার, ১৩ হাজার ৬৮২ কেজি গাঁজা, ৩৩ কেজি ৩৫১ গ্রাম হেরোইন, ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৫ পিস এনেগ্রা ও সেনেগ্রা ট্যাবলেট, ১৯ হাজার ৪৪৮টি নেশাজাতীয় ইনজেকশন এবং ৪৭ লাখ ৩ হাজার ৮২৪ পিস অন্যান্য ট্যাবলেট।

২০১৭ সালের জানুয়ারি হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের সীমান্ত এলাকাসহ অন্যান্য স্থানে অভিযান চালিয়ে ১ হাজার ২১৭ কোটি ৫৫ লাখ ৭৪ হাজার টাকা মূল্যের মাদকদ্রব্য ও চোরাচালান আটক করেছে। আটককৃত মাদকের মধ্যে রয়েছে ১ কোটি ৫৫ লাখ ৭১ হাজার ১৩ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ১ লাখ ৪০ হাজার ৬০৮ বোতল বিদেশী মদ, ১৪ হাজার ১৪৬ লিটার বাংলা মদ, ৪৯ হাজার ৬৫০ ক্যান বিয়ার, ৩ লাখ ২৮ হাজার ৬৮৯ বোতল ফেনসিডিল, ১৬ হাজার ৩৫৭ কেজি গাঁজা, ৪৪ কেজি ৩২৪ গ্রাম হেরোইন, নেশাজাতীয় ইনজেকশন ২৮ হাজার ২৮০ এবং ১ কোটি ৬৭ লাখ ৪৫ হাজার ২৫১টি অন্যান্য ট্যাবলেট।

২০১৬ সালে অভিযানে ১১৬১ কোটি ৬৭ লাখ ১৭ হাজার মূল্যের বিভিন্ন প্রকারের মাদকদ্রব্য ও চোরাচালান আটক করা হয়েছিল।

ইউরোপ-আমেরিকা থেকেও আসছে মাদক:

শুধু মিয়ানমার ও ভারত থেকে নয় আমেরিকার ও ইউরোপ থেকেও মাদক আসছে বাংলাদেশে।দেশে প্রচলিত মাদকের পাশাপাশি অপ্রচলিত অনেক মাদক ছড়িয়ে পড়ছে দেশ জুড়ে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান যে,সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বিভিন্ন ধরনের অপ্রচলিত মাদক যেমন এলএসডি, ডিওবি, কেটামিন, ম্যাজিক মাশরুম ধরা পড়েছে। এই মাদকগুলো আসছে ইউরোপ–আমেরিকাসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো থেকে।এগুলো দামও অনেক বেশি।ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানেরা এগুলোর সেবনকারি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ধারণা বিদেশে পড়তে যাওয়া বা বিদেশ ব্যবসা/ ট্যুরে যাওয়া কেউ কেউ অপ্রচলিত বিভিন্ন মাদকে আসক্ত হন। তাঁদের অনেকেই মাদকসেবী বন্ধুদের জন্য কুরিয়ার সার্ভিসে পার্সেল করে এসব মাদক বিদেশ থেকে পাঠান। আবার অনেকে এ সব মাদক পাচার করে অর্থ কামিয়ে নিচ্ছেন। ডিএনসির বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে দেশে বিপুল পরিমাণ আইস আসছে। এটি মূলত ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান। এটি ইয়াবার চেয়েও মারাত্মক। ২০২০ সালের পর থেকে আইস মিয়ানমার থেকে দেশে নিয়ে আসছে মাদক পাচারকারী চক্র। যারা মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনছেন, তাঁরাই একই পথে (রুট) আইস নিয়ে আসছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, আইস উদ্ধারের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২১ সালে আইস উদ্ধার হয়েছিল প্রায় ৩৭ কেজি। পরের বছর আইস উদ্ধার হয় ১১৩ কেজি আর সর্বশেষ ২০২৩ সালে আইস উদ্ধার বেড়ে হয় ১৮৭ কেজি। ইয়াবা ও হেরোইন উদ্ধারের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩–এ ইয়াবা উদ্ধারের পরিমাণ কমেছে। ২০২২ সালে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছিল প্রায় ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৬৫ হাজার পিস। আর গত বছর উদ্ধার হয়েছে প্রায় ৪ কোটি ২৯ লাখ ৭৭ হাজার পিস। তবে হেরোইন উদ্ধারের পরিমাণ দ্বিগুণের চেয়ে বেশি বেড়েছে। ২০২২ সালে হেরোইন উদ্ধার হয়েছিল ৩৩৮ কেজি। আর গত বছর হেরোইন উদ্ধার হয়েছে ৭০১ কেজি।

ডার্ক ওয়েবে এখন মাদক কেনা বেচা:

বাংলাদেশেও ডার্ক ওয়েবে এখন মাদক কেনা বেচার ঘটনাও ঘটছে। ডার্ক ওয়েবে সক্রিয় মাদক কারবারিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের যোগাযোগ আছে। এসব কারবারি মাদক কেনাবেচায় অবৈধ ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিট কয়েন ব্যবহার করছে। পরিচয় গোপন করে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ ও নিষিদ্ধ পণ্য কেনা যায় বলে সারাবিশ্বেই ডার্ক ওয়েব অপরাধীদের কাছে জনপ্রিয়। ইন্টারনেটভিত্তিক সংযোগ ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের দ্রুত প্রসারকে মূলত মাদকপাচারকারী ও মাদক ব্যবহারকারীরা হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে। ডার্ক ওয়েবের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে—ক্রেতা-বিক্রেতার পরিচয় গোপন রাখা। এতে অপরাধীদের ধরা পড়ার ঝুঁকিও কম থাকে। সে কারণেই অবৈধ মাদক বাণিজ্য ও অর্থপাচারের জন্য ডার্ক ওয়েব পাচারকারীদের কাছে জনপ্রিয়।

২০১৯ সালের শুরুর দিকে হাসিব মুয়াম্মার রশিদ নামে এক যুবককে গ্রেফতারের পর তার মোহাম্মদপুরের বাসায় একটি ল্যাব পাওয়া যায়। সেখানে দেশে প্রথমবারের মতো নতুন ধরনের মাদক ক্রিস্টাল মেথ পাওয়া যায়। হাসিবকে গ্রেফতারের পরই মূলত জানা গেছে, দেশে ক্রিস্টাল মেথের বাজার তৈরির চেষ্টা করছে মাফিয়ারা। মালয়েশিয়ায় লেখাপড়া করার সময় নাইজেরিয়ানদের মাধ্যমে এই ক্রিস্টাল মেথের বিষয়ে জানতে পারে হাসিব। ডার্ক ওয়েবে মাদকের কেনাবেচার বিষয়েও তাদের কাছ থেকে জানতে পারে সে। ওই ঘটনা তদন্ত শুরুর চার মাস পর ওনিয়ানউসি নামে নাইজেরিয়ান এক নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়। সে জানিয়েছে, ডার্ক ওয়েবে অর্ডার দেয়ার পর উগান্ডা থেকে ডিএইচএল কুরিয়ারে বাংলাদেশে ক্রিস্টাল মেথ আসে। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, নাইজেরীয় ওনিয়ানউসি ২০১৭ সালে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি ফার্মা পাস করেন। তিনি পোশাক ব্যবসার নাম করে বাংলাদেশে থেকে যান। ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, উগান্ডা, কেনিয়া ও সিঙ্গাপুরে তিনি নিয়মিত যাতায়াত করতেন। উগান্ডা থেকে ডিএইচএল কুরিয়ারের মাধ্যমে আইসের চালান আনতেন ওনিয়ানউসি।

২০২২ সালের ৫ জুলাই ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে দশমিক ৭৫ গ্রাম (১৩৮টি রঙিন প্রিন্টেড ব্লট পেপার স্ট্রিপ) এলএসডিসহ (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড) নাজমুল ইসলাম নামে এক মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করেছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তার ব্যবহৃত মুঠোফোন ও ল্যাপটপের ফরেনসিক পরীক্ষার প্রতিবেদনে ডার্ক ওয়েব (ইন্টারনেটের অন্ধকার জগৎ) থেকে মাদক কেনা ও লেনদেনসংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে। সেই প্রতিবেদনটি আদলতে জমা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, সচরাচর ব্যবহৃত গুগল বা বিং কিংবা ইয়াহু নয় এর থেকে একদম আলাদা ও টপ লেভেল ডোমেইন ব্যবহার না করে অন্য বিশেষ কিছু নাম ব্যবহার করে ক্রমশই ভয়ংকর অপরাধ করছে এক ধরনের অপরাধীরা। প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে অপরাধীর ধরনও পাল্টাচ্ছে তারা। অপরাধীরাও দেদারছে প্রযুক্তির সহায়তায় গড়ে তুলছে তাদের নিজস্ব অপরাধ জগত। যার নামকরণ করা হয়েছে ডার্ক ওয়েব নামে।

২০২১ সালের ১৫ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজুর রহমান নিজের গলায় ছুরি চালিয়েছিলেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে দেশে কৃত্রিম মাদক এলএসডির অস্তিত্ব থাকার কথা প্রথমবারের মতো জানতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তদন্তে বেরিয়ে আসে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় হাফিজুরের তিন বন্ধু তাঁকে এলএসডি সেবন করান। এর প্রতিক্রিয়া শুরু হলে তিনি শুধু একটি শর্টস পরে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে এক ডাব বিক্রেতার ভ্যানে রাখা দা নিয়ে তিনি নিজের গলায় আঘাত করেন।

খুলনায় অভিযান চালিয়ে ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর আরেক অপ্রচলিত মাদক ডিওবিসহ আসিফ আহমেদ ও অর্ণব কুমার শর্মা নামে দুই জনকে গ্রেফতার করে ডিএনসি। পরে ঢাকা থেকে তাদের আরেক সহযোগী একটি কুরিয়ার সার্ভিসের সদস্য মামুনুর রশীদকে গ্রেফতার করা হয়। ওই ঘটনার তদন্তেও উঠে আসে ডার্ক ওয়েবের সংশ্লিষ্টতা। গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে যেন ধরা না পড়তে হয়, সেজন্য তারা অনেক ক্ষেত্রেই এসব অবৈধ কাজের জন্য ডার্ক ওয়েবের সহায়তা নিচ্ছে। আর এই মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। মাদক বিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপে জানা যায়, এলএসডি ও ডিওবি কৃত্রিম মাদক, যা পরীক্ষাগারে তৈরি। মাদক দুটি দেশে অপ্রচলিত এবং খুবই ভয়ংকর। এসব মাদকের উৎস ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশ। এ ধরনের মাদক মনের ওপর প্রভাব ফেলে, কখনো কখনো ভীতিকর অনুভূতি তৈরি করে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তা ছাড়া মাদকের পাশাপাশি ডার্ক ওয়েবে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে যুক্ত থাকে অপরাধীরা। গত বছরের নভেম্বরে পুলিশের একটি বিশেষায়িত সংস্থা দেশে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে, যাঁরা ডার্ক ওয়েব থেকে শিশু পর্নোগ্রাফির ভিডিও কিনতেন। সেই ভিডিও তাঁরা অনলাইনে অর্থের বিনিময়ে অন্যদের সরবরাহ করে।

আইস ,ইয়াবা ও অস্ত্র আনতে মাদক কারবারিরা ব্যবহার করছে মিয়ানমারের সিম:

 আইস, ইয়াবা ও অস্ত্র আনতে মাদক কারবারিরা ব্যবহার করছে ‘মিয়ানমারের মোবাইল সিম’। সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ইয়াবার মতো ভয়াবহ মাদক আইস (ক্রিস্টাল মেথ) মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। ব্যয়বহুল এই মাদকের এক গ্রামের দাম বাংলাদেশে প্রায় ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা। কক্সবাজার ও টেকনাফের মাদক কারবারিরা মিয়ানমার থেকে আইস আনতে ব্যবহার করছে সে দেশের সিম কার্ড। টেকনাফে মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি ভালো পাওয়া ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে মাদক কারবারিরা ওই দেশের সিম ব্যবহার করছে। এসব সিম কিনতে লাগছে না কোনো কাগজপত্র কিংবা ছবি। ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যেই পাওয়া যায় এই সিম। এসব সিম দিয়ে চোরাকারবারিরা নিয়মিত মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ও আইস নিয়ে আসছে। জানা যায়, টেকনাফ পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় মোবাইল ফোন ফ্রিকোয়েন্সির বেশ কয়েকটি টাওয়ার স্পষ্ট দেখা যায়। উখিয়া সীমান্তে অবশ্য তেমন দেখা যায় না। তবে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে গাছগাছালি কম হওয়ায় নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি বেশি পাওয়া যায়। মিয়ানমারের মোবাইল নেটওয়ার্ক এতই শক্তিশালী যে, কক্সবাজারের কলাতলী থেকেও তাদের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক সীমান্তের ওপারে যেন না থাকে সেজন্য দেশের নেটওয়ার্ক কন্ট্রোল করা হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার তাদের মোবাইল নেটওয়ার্ক কন্ট্রোল করে না। বরং সীমান্তবর্তী এলাকায় তারা মোবাইল নেটওয়ার্কের টাওয়ার সংখ্যা বাড়িয়েছে।

দেশজুড়ে মাদক পাচারকারীদের নেটওয়ার্ক:

শুধু ঢাকা ও কক্সবাজারই নয়, দেশজুড়ে  মাদক পাচারকারীরা শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। ২০২০ সালে বাগেরহাটের মংলা থেকে ৩০০ বোতল বিদেশি মদসহ চীনের তিন নাগরিককে গ্রেফতার করে কোস্টগার্ড। বিদেশ থেকে অবৈধভাবে আমদানি করা চায়না ব্রান্ডের মদের একটি চালান নিয়ে সুন্দরবন সংলগ্ন মংলা উপজেলার পশুর নদের মোহনায় মাদক পাচারকারীরা অবস্থান করছে এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কোস্টগার্ডের একটি দল সেখানে অভিযানে যায়। সেখানে তাদের কাছ থেকে ৩০০ বোতল মদ ও তিন চীনা নাগরিকসহ পাঁচ ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়। আটককৃতরা হলেন, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার সোনাখালী গ্রামের আবজাল সিকদারের ছেলে মো. রুমন সিকদার (২৮),নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের চট্টগ্রাম সড়কের মুনসুর আহম্মেদের ছেলে হাসনাত (২৮) এবং চীনা নাগরিক জেরী (২৬), জ্যাক জিয়া (৩৩) ও ফু (৩৩)।

একই বছর (২০২০ সাল)চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানার শাহ আমানত ব্রিজে তল্লশির সময় সাত হাজার পিস ইয়াবাসহ দুই বিদেশি ফুটবলারকে আটক করেছিল পুলিশ। পরে তাদের তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা থেকে আরেক বাংলাদেশিকে ফুটবলার গ্রেপ্তার হয়েছেন। গ্রেপ্তার বাংলাদেশি ফুটবলার ছিলেন মো. মাসুদ (২৪) এবং অপর দুইজন ঘানার নাগরিক ফ্রাঙ্ক ও রিচার্ড। এদের মধ্যে ফ্রাঙ্ক ও রিচার্ড বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্লাবে ভাড়ায় ফুটবল খেলতেন।

২০২৩ সালের ২০জুন কক্সবাজারের টেকনাফে ৩ কেজির বেশি ভয়ংকর মাদক ক্রিস্টাল মেথ আইসসহ মিয়ানমারের এক নাগরিককে আটক করছে বিজিবি। আটক মো. নুরুন্নবী (২৭) মিয়ানমারের মংডুর সুধাপাড়ার মৃত জহির আহমেদের ছেলে।

এ বছরের ৪ মে কক্সবাজারের টেকনাফ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বিশেষ জোনের আভিযানিক দল ভাড়াবাসা তল্লাশি করে বালতি ভর্তি ৬০হাজার ইয়াবাসহ এক রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করেছে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড মিঠাপানির ছড়ার অলি মাইজ্যার ভাড়াটিয়া কবির আহমদের ভাড়া করা বসত-ঘরে অভিযান চালিয়ে শয়ন কক্ষে অবস্থিত একটি লাল রঙের ঢাকনাযুক্ত হাতওয়ালা প্লাস্টিকের বালতির ভিতর থেকে ৬০হাজার পিস ইয়াবাসহ থাইংখালী ২নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা কবির আহমদ (৩২) কে আটক করা হয়।

 ২০২২ সালে কক্সবাজারের টেকনাফে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (২ বিজিবির) সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা মূল্যের ৫৪ হাজার পিস ইয়াবা ও এক কেজি ৬৯ গ্রাম ক্রিস্টালমেথসহ দুইজন বৈদেশিক মাদক কারবারিকে আটক করেছে । আটক আসামিরা হলেন, মিয়ানমার মংডু জেলার সিরাজ উদ্দীনের ছেলে মো. জুবায়ের আহমদ (২২) আব্দুল গণির ছেলে মো. রফিক (২৩)। এসময় মাদক পাচারে ব্যহৃত নৌকাটি জব্দ করা হয়। ২০১৮ সালে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার বকনদিয়া নামক স্থান থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকসহ ৪ ভারতীয় নাগরিককে গ্রেফতার করে পুলিশ। কালীগঞ্জ-জীবননগর সড়কের বকনডিয়া নামক স্থান থেকে ভারতীয় নাগরিক পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশপরগুনা জেলার বনগা থানার এড়োপোতা গ্রামের কালীদাস মন্ডলের ছেলে মিন্টু মন্ডল (২৫), আনন্দ মন্ডলের ছেলে অভিজিৎ মন্ডল (২৭), সুরেন্দ্রনাথ কর্মকারের ছেলে পরিমল কর্মকার (২৭) ও সোহরাব উদ্দিন মন্ডলের ছেলে ইমরান মন্ডল (২৮) কে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে মাদক ছাড়াও বিভিন্ন চোরাই পন্য উদ্ধার করে পুলিশ। গত বছরের ১৯ জানুয়ারি কক্সবাজারের টেকনাফের নাফ নদীতে অভিযান চালিয়ে ২টি পিস্তল, দুই রাউন্ড গুলি, ১১৪ ক্যান বিদেশি বিয়ার, চাপাতাসহ মিয়ানমারের এক মাদক পাচারকারীকে আটক করেছে কোস্টগার্ড। ২০২১ সালে কক্সবাজারের টেকনাফ সেন্টমার্টিনে কোস্টগার্ড সদস্যরা অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ বিদেশী মদের বোতল ও বিয়ারসহ ৫ জন মিয়ানমারের নাগরিককে আটক করেছে।

ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন পুলিশ:

কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এরই মধ্যে কনস্টেবল থেকে শুরু করে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ তালিকায় সর্বশেষ নাম আসে বগুড়ার এক ডিবি পুলিশ কর্মকর্তার। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়ে মাদক কারবারিকে ছেড়ে দেন। খবরে জানা যায়, সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরের একটি আবাসিক হোটেলে মাদক কারবারিকে আটকে রেখে ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা আদায় করে ছেড়ে দিয়েছেন বগুড়া জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কয়েকজন সদস্য। গত ১২ মে ঘটনাটি ঘটেছে মিরপুর-২ নম্বরের বড়বাগ এলাকার একটি আবাসিক হোটেলে। বগুড়া জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর ওই মাদক কারবারির কাছ থেকে আদায় করা টাকার পুরোটাই ফেরত দিয়েছেন ডিবি পুলিশের সদস্যরা।

মাদক পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি কক্সবাজার পুলিশের বিরুদ্ধে। কিছুদিন আগে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) এসআই রেজাউল করিমকে আটক করা হয় ইয়াবাসহ। কক্সবাজার শহরের কলাতলী এলাকায় গ্রিন লাইনের কাউন্টার থেকে স্ত্রীসহ তাঁকে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে ২০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করা হয়।  গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি রামুর মরিচ্যা চেকপোস্টে তল্লাশি চালিয়ে ৬ হাজার ইয়াবাসহ চট্টগ্রাম পুলিশের এসআই মো. কামরুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে বিজিবি। তিনি চট্টগ্রাম আদালতে চন্দনাইশ থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) হিসেবে কর্মরত। ২০২১ সালের ২২ এপ্রিল কক্সবাজারের উখিয়ায় তাজনিমারখোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ১ হাজার ৮০০ পিস ইয়াবাসহ বাহিনীর তিন সদস্যকে আটক করে এপিবিএন। তাঁরা হলেন– ৮ এপিবিএনের এসআই মো. সোহাগ, কনস্টেবল মিরাজ আহমদ ও মো. নাজিম। তাঁরা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশে ইয়াবা কারবার করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০১৫ সালের ২০ জুন চট্টগ্রাম র‍্যাব-৭ প্রায় ৬ লাখ ৮০ হাজার পিস ইয়াবাসহ চট্টগ্রাম পুলিশের বিশেষ শাখার এএসআই মাহফুজুর রহমানকে আটক করে। ওই সময় তদন্ত করতে গিয়ে ইয়াবা ব্যবসায় পুলিশি সিন্ডিকেটের সন্ধান পায় র‍্যাব। পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে ইয়াবা পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। শুধু বড় বড় ইয়াবার চালান নির্বিঘ্নে পাচারের মাধ্যমে তাঁরা মাসে কোটি টাকা আয় ক্রেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মাহফুজুর রহমান জানিয়েছিলেন, ২০১১ ও ২০১৩ সালে কক্সবাজার ও টেকনাফে কর্মরত থাকার সময় তিনি ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়েন। কোটিপতি হওয়ার নেশায় কারবারিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে নিজেই সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন।

মাদক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন মাদক পাচার বন্ধে সরকারের উদ্যোগ একেবারেই সীমিত। অভিযান চালিয়ে যে মাদক উদ্ধার হচ্ছে তা একদশমাংশের কম। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ এক সময় মাদকের বাজারে পরিণত হবে। বিশেষ করে ডার্কওয়েব ও বিদেশ মাদক পাচার বন্ধে সরকারকে এখই কাযকর উদ্যোগ নিতে হবে। না হয় এর বড় খেসরাত দিতে হবে বাংলাদেশকে।