সাংবাদিক নাদিম হত্যা মামলা

জেলখানায় একবছরে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করেছেন আসামি

প্রকাশ | ১২ জুলাই ২০২৪, ১৬:৩৫ | আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৪, ১৬:৩৭

জামালপুর প্রতিনিধি, ঢাকা টাইমস

জামিনে কারামুক্ত হওয়ার পর সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম হত্যা মামলার প্রধান আসামি মাহমুদুল আলম বাবু এক সভায় বক্তব্যে বলেছেন, ‘এক বছরের উপরে জেলে ছিলাম। জেলখানায় ৫ লাখ টাকা খরচ হয়ে থাকলে, তার সাড়ে চার লাখ টাকা সাধুর পাড়ার গরীব মানুষ দিয়েছে।’

তিনি আরও বলেন,‘জেলে থাকাবস্থায় জামালপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদের সঙ্গে অনেকবার কথা হয়েছে।

তিনি বলেছেন, ‘বের হয়ে আসো, এ মামলা মীমাংসা করে দেব।’ বাবু চেয়ারম্যানের এই বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

কারাগার থেকে বেরিয়ে গত বুধবার (১০ জুলাই) রাতে বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়নের কেবি মডেল উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এক সভায় এই বক্তব্য দেন বাবু চেয়ারম্যান।

তার এ বক্তব্য নিয়ে সচেতন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এতো টাকা খরচের বিষয়টি জেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে খতিয়ে দেখার দাবি করেছেন তারা।

ভিডিওতে বাবুকে বলতে শোনা যায়, ‘১৭ জুন আমি পঞ্চগড় আমার নানার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হয়েছি।  আপনারা জানেন, এই মামলা নিয়ে অনেকেই অনেক মন্তব্য করেছে।

তিনি আরও বলেন, ‘এ মামলায় আমাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। আপনারা জানেন, আমার ছেলে ঢাকায় লেখাপড়া করে। ঢাকার বারিধারা এলাকায় থাকাবস্থায় আমার ছেলেকেও দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, আপনারা তো জানেন, জেলখানা ভালো জায়গা না। আমি দীর্ঘ এক বছরের উপরে ছিলাম। আমি আসলে অনেক কষ্ট করেছি। অনেক গরীব মানুষ দুইশ, তিনশ টাকা দিয়ে আমাকে দেখে আসছে। আপনাদের এ কথা আমি সারাজীবন মনে রাখবো। জেলাখানায় পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়ে থাকলে, তার সাড়ে চার লাখ টাকা সাধুর পাড়ার গরীব মানুষ দিয়েছে।’

বহিষ্কৃত ইউপি চেয়ারম্যান বাবু আরও বলেন, ‘আমাদের সরকার, বাংলাদেশ সরকার এবং সুপ্রিম কোর্ট ‘স্টে নো অর্ডার’ করে দিয়েছে। এই মামলায় আমার আর কোনো সমস্যা হবে না।’

তবে জামালপুর কারাগারের জেলার বলছেন, ‘এখানে এতো টাকা খরচ করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছেন।’

এর আগে হাইকোর্ট জামিন আবেদন মঞ্জুর করায় মাহমুদুল আলম বাবু চেয়ারম্যান এক বছর ২৩ দিন কারাভোগের পর ১০ জুলাই বিকাল ৫টার দিকে জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পান। তিনি সাংবাদিক নাদিম হত্যা মামলার প্রধান আসামি। কারাগার থেকে বের হয়েই কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে বিশাল শোডাউন করে নিজ গ্রামে ফিরে জনসভায় যোগ দেন তিনি।

মাহমুদুল আলম বাবু সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া চেয়ারম্যান। একই সঙ্গে তিনি সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে তাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একই সঙ্গে দলীয় পদ থেকেও বহিষ্কার করা হয়।

বক্তব্যের বিষয়ে কথা বলতে মাহমুদুল আলম বাবুর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেওত তাকে পাওয়া যায়নি।

নিহত সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জেলা প্রতিনিধি ও একাত্তর টেলিভিশনের বকশীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি ওই উপজেলার নিলক্ষিয়া ইউনিয়নের গোমের চর গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে।

এদিকে প্রধান আসামির জামিনে মুক্ত হওয়ার পর তার বক্তব্যের বিষয়ে নিহত সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিমের মেয়ে রাব্বীলা-তুল-জান্নাত বলেন, ‘তিনি তো জেলখানায় রাজকীয় জীবন যাপন করেছেন। যে ব্যক্তির জেলখানায় একবছরে পাঁচ লাখ টাকা লাগে, তার জেলখানা আর বাইরে একই কথা। তাকে বেআইনিভাবে জেলাখানায় সহযোগিতা করা হয়েছে। বাবা হত্যার এক বছর পার হয়েছে। প্রধান আসামি জামিনে জেল থেকে মুক্ত হয়েই উত্তেজনাকর বক্তব্য দিচ্ছেন। মামলায় নাকি তার (মাহমুদুল) কোনো সমস্যা হবে না। ফলে বিচার পাওয়া নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে।

প্রধান আসামি জেল থেকে বের হওয়ায় তারা আতঙ্কিত বলেও জানান তিনি। তার প্রভাবে মামলার অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। এতে ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় করছেন তারা।

জামালপুর সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, ‘জেলাখানায় বেআইনি সহযোগিতায় তিনি রাজকীয় জীবন-যাপন করেছেন। বক্তব্যে তাই প্রমাণ করে। অপরাধী যদি জেলখানায় বেআইনি সহযোগিতা পায় তাহলে তো অপরাধ দিন দিন বেড়েই যাবে। তিনি জেল থেকে মুক্তি পাওয়ায় মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। তবে রাষ্ট্রের কাছে দাবি নৃশংস হত্যা ঘটনার সঠিক বিচার যেন হয়।’ 

বাবু চেয়ারম্যানের বক্তব্যের বিষয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী মো. ইউসূফ আলী বলেন, ‘বক্তব্যের মাধ্যমে বুঝা যায় তিনি জেলখানায় রাজকীয় জীবন যাপন করছেন। অনৈতিক ও বেআইনিভাবে তাকে সহযোগিতা করা হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, এই মামলায় তিনি প্রভাবিত করতে পারেন। জেল থেকে বের হয়েই এলাকায় গিয়ে যেসব  বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে মামলার ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।’

মাহমুদুল আলম বাবুর বক্তব্যের ব্যাপারে জামালপুর কারাগারের জেলার আবু ফাতাহ বলেন, ‘এখানে এতো টাকা খরচ করার কোনো সুযোগ নেই। আর বাবু চেয়ারম্যান সাধারণ বন্দীদের মতোই ছিলেন। সাধারণ ওয়ার্ডে ফ্লোরে ঘুমিয়েছেন। জেলখানার খাবার খেয়েছেন। তিনি যা বলেছেন সম্পূর্ণ মিথ্যা বলেছেন।’

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গোলাম রব্বানি গত বছরের ১৪ জুন রাতে পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে বাড়ি ফেরার পথে বকশীগঞ্জ পৌর শহরের পাটহাটি এলাকায় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন। হামলার পরদিন দুপুরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। হত্যার তিন দিন পর ১৭ জুন নিহত নাদিমের স্ত্রী মনিরা বেগম বাদী হয়ে থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় মাহমুদুল আলম বাবু, তার ছেলে ফাহিম ফয়সাল রিফাতসহ ২২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি ২০-২৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। ১৭ই জুন মাহমুদুল আলম বাবুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পর থেকে তিনি কারাগারে ছিলেন।

(ঢাকা টাইমস/১২জুলাই/পিএস)