প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার দাবি ২২ পেশাজীবী সংগঠনের
প্রকাশ | ১৭ জুলাই ২০২৪, ১৭:০৩
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ‘নৃশংস হামলা ও হত্যাকাণ্ডের’ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদসহ ২২টি পেশাজীবী সংগঠন।
বুধবার এক যৌথ বিবৃতিতে পেশাজীবী নেতারা চলমান ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হত্যা, তাদের ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি, কোটা বাতিলের ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়া এবং শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার বাচ্চা ও নাতি, পুতি’ বলে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে পেশাজীবী নেতারা বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাবিকে অত্যন্ত যৌক্তিক বলে মনে করি। আমরা মনেকরি, 'কোটা কখনো, মেধার বিকল্প হতে পারে না'। এ কোটার কারণে প্রতিভাবান অনেক চাকরিপ্রার্থী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বঞ্চিত হচ্ছেন।
কোটা ব্যবস্থার বিলোপ হলে, সকল প্রার্থীর মধ্যে যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। এতে করে মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীরা তাদের প্রকৃত প্রতিভার স্বীকৃতি পাবেন এবং যোগ্য প্রার্থীদের মাধ্যমে সরকারি খাতে দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি পাবে।
তাঁরা বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি অত্যন্ত যোক্তিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের দাবি না মেনে বল প্রয়োগের পথ বেছে নিয়েছে সরকার।আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, গত ক'দিন ধরে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের উপর নির্বিচার হামলা চালানো হয়েছে। সরকারি ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর পিস্তল, রড, লাঠি, হকিষ্টিক, ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা করে। নির্বিচার হামলায় নারী শিক্ষার্থীরাও রেহাই পায়নি। বিশেষ করে গতকাল মঙ্গলবার ছাত্রলীগ ও পুলিশ যৌথভাবে দেশের বিভিন্নস্থানে অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলে পড়ে। আমাদের সন্তান সমতূল্য কোমলমতি অসংখ্য শিক্ষার্থীকে রক্তাক্ত করতে দেখেছি। তাদের শরীর বেয়ে ঝরছিল রক্ত। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি রাস্তায়।শিক্ষার্থীদের রক্তে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরের পিচঢালা কালো রাস্তা লালে লাল হয়ে যায়।যা একাত্তরের পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে ৬ জন টকবগে ছাত্র-যুবকে। এই বর্বরোচিত হামলায় আমরা শুধু উদ্বিগ্নই নই, ক্ষুব্ধ ও বেদনার্তও। "জাতির কাঁধে ছাত্রের লাশ" এরচেয়ে বেদনার খবর আর কি হতে পারে?
আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, পুলিশের সামনে সরকারিদলের সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করছে; আর তারা নীরব দর্শকের মতো তাকিয়ে থাকলো। কোথাও কোথাও পুলিশ আর সরকারি দলের ক্যাডারটা যৌথভাবে ছাত্রদের উপর হামলা চালিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আহত ও রক্তাক্ত ছাত্ররা যখন কাতরাচ্ছে তাদের হসপিটালে নেয়ার ব্যবস্থা পর্যন্ত পুলিশ করে নি। এমনকি আহতদের হাসপাতালে নেয়ার পথে বাধা দেয়া হয়। হামলা থেকে শিক্ষকরাও রেহাই পায়নি।হামলায় আহত শিক্ষার্থীরা চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে জরুরি বিভাগে থাকা অবস্থায় তাদের উপর আবারো হামলা চালানো হয়েছে, যা মানবতাবিরোধী অপরাধের সমতুল্য। আমরা এসব হামলার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও উপযুক্ত শাস্তি চাই।
বিবৃতিতে বলা হয়, এই হত্যাকান্ডের দায় সরকার কিছুতেই এড়াতে পারে না। কারণ প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও ছাত্রলীগ নেতাদের উস্কানিমূলক বক্তব্য ছাত্রদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। শিক্ষার্থীরা যখন কোটা বাতিলের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে আসছিল তখন আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ না নিয়ে নানা ধরণের হুমকি দিতে থাকেন তারা। বিশেষ করে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কটাক্ষ করে বলেন, "মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, নাতি,পুতিরা কেউ মেধাবী না; যত রাজাকারের বাচ্চারা, নাতি,পুতি ওরা মেধাবী তা-ই না"? এই মন্তব্যকে ঘিরে ক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। হলে হলে শুরু হয় স্লোগান, বিক্ষোভ।রাতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে উত্তেজনা। হল থেকে দলে দলে বেরিয়ে আসেন ছাত্রীরা। এ মিছিলের যেন শেষ নেই। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেন ছাত্ররাও। অন্যরকম এক রাতের নজির তৈরি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যা ১৯৫২ ও ১৯৬৯ স্মরণ করিয়ে দেয়। ছাত্রদের কন্ঠকে স্তব্দ করে দিতে অন্যদিকে চলতে থাকে ভিন্ন প্রস্তুতি। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্রলীগ এবং ক্ষমতাসীনদের সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। তাদের অনেকের হাতেই ছিল হকিস্টিক, নানা ধরনের অস্ত্র। আতঙ্ক আর উত্তেজনা বাড়তে থাকে। গভীর রাতে ছাত্ররা ফিরে যান হলে। একপর্যায়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন ছাত্রলীগের বহিরাগতরা। উদ্বেগের রাত শেষ হয়। তবে পরের দিন সরকার কিছু একটা করতে যাচ্ছে, সেটা সবাই অনুমান করতে পারছিলেন।
সোমবার দৃশ্যপট পরিষ্কার করে দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি রীতিমতো হুমকি দিয়ে বলেন, ক্যাম্পাসে ঊদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জবাব দিতে ছাত্রলীগ প্রস্তুত। একই ভাবে, ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব কোটা আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করে চরম হুঁশিয়ারি। ছাত্রলীগ সভাপতি "তাদের শেষ দেখে ছাড়বো" বলে হুমকি দেয়।
পেশাজীবী নেতারা বলেন, সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের উস্কানি ও আস্কারা পেয়ে ছাত্রলীগ মঙ্গলবার ছাত্র হত্যার উন্মত্ততায় মেতে উঠে। আমরা বিশ্বাস করি সরকার সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হলে এত প্রাণহানি ঘটতো না। কিন্তু ৭১'র পাকিস্তান স্বৈরাচারী সরকারের মতো আওয়ামী লীগ সরকার আলোচনার পথকে ছুঁড়ে ফেলে 'রক্ত'ই বেছে নিল।
বিবৃতিতে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুধু শিক্ষার্থীদেরই বিক্ষুব্ধ করে নি, তাদের অভিভাবকদেরও ক্ষুব্দ করেছে। তাই আমরা প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর এই বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারিদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের আহ্বায়ক প্রফেসর ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন ও সদস্য সচিব কাদের গণি চৌধুরী, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সভাপতি এডভোকেট জয়নুল আবেদীন ও মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী ,ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ড্যাব- সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আল রশীদ ও মহাসচিব ডা. মোঃ আব্দুস সালাম, ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইউট্যাব সভাপতি প্রফেসর ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম ও মহাসচিব প্রফেসর ড. মোর্শেদ হাসান খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সাদা দলের আহ্বায়ক প্রফেসর ড. লুৎফর রহমান ও যুগ্ম-আহ্বায়ক প্রফেসর ড. ছিদ্দিকুর রহমান খান,এসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ-এ্যাব সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম রিজু ও মহাসচিব আলমগীর হাছিন আহমেদ। এগ্রিকালচারিস্ট এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এ্যাব সভাপতি কৃষিবিদ রাশিদুল হাসান হারুন ও মহাসচিব প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান, শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভূঁইয়া ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মো. জাকির হোসেন, জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার ও সমন্বয়কারী প্রফেসর ডা. শফিকুল হায়দার পারভেজ, জিয়া পরিষদ চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. মো. আব্দুল কুদ্দুস ও মহাসচিব প্রফেসর ড. মো. এমতাজ হোসেন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান ও সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. নুরুল ইসলাম ,জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক জোট সভাপতি আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল ও মহাসচিব মো. রফিকুল ইসলাম, এমবিএ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ম্যাব সভাপতি সৈয়দ আলমগীর ও মহাসচিব শাকিল ওয়াহেদ, জাতীয়তাবাদী টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-জেটেব আহ্বায়ক ইঞ্জিনিয়ার ফখরুল আলম ও সদস্য সচিব ইঞ্জিনিয়ার এ বি এম রুহুল আমীন আকন্দ, ডিপোমা ইঞ্জিনিয়ার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিইএব) সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার সাইফুজ্জামান সান্টু ও মহাসচিব ইঞ্জিনিয়ার সাখাওয়াত হোসেন, নার্সেস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ন্যাব) সভাপতি জাহানারা বেগম ও সাধারণ সম্পাদক সুজন মিয়া, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এম-ট্যাব) সভাপতি এ কে এম মুসা (লিটন) ও মহাসচিব মো. বিপ্লবুজ্জামান বিপ্লব, ইউনানী আয়ুর্বেদিক গ্র্যাজুয়েট ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আগড্যাব) সভাপতি ডা. মির্জা লুৎফর রহমান লিটন ও মহাসচিব ডা. আমিনুল বারী কানন, ডিপ্লোমা এগ্রিকালচারিস্ট এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডি-এ্যাব) সভাপতি মো. জিয়াউল হায়দার পলাশ ও মহাসচিব সৈয়দ জাহিদ হোসেন, ফিজিওথেরাপিস্ট এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (প্যাব) সভাপতি মো. কামরুজ্জামান কল্লোল ও সাধারণ সম্পাদক মো. তানভীরুল আলম।
(ঢাকাটাইমস/১৭জুলাই/কেএম)