শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং আমার কিছু কথা 

ফরিদ আহমেদ
 | প্রকাশিত : ২৭ জুলাই ২০২৪, ১৭:৪৩

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। শিক্ষকদের আন্দোলন ও সাফল্য কোন পর্যায়ে জানতে। দুপুর হয়ে গেছে। আগে ক্যাফেটেরিয়া কিংবা লাইব্রেরির সামনে গিয়ে কিছু খেয়ে নিতাম। ঐদিন কেন জানি মনে হলো হলে গিয়ে দেখি। পুরোনো হল। গেটের ভেতরে বেশ কিছু দোকান। ফলের রস, মিষ্টি, দই আছে। আছে খিচুড়ি, পোলাও, তেহারি। তখন একটু একটু বৃষ্টি হচ্ছে। খাবার প্রায় শেষ। একেবারে তলে পড়ে আছে। পোলাও ও মুরগির গোশত (এক মুরগিকে ২০ টুকরা বানানো হয়েছে) মূল্য ৬০ টাকা। আর ডিম নিলে ৪৫ টাকা। আমি ডিম পোলাও নিলাম। ঠান্ডা। ধীরে ধীরে খেয়ে নিলাম। রেজিস্ট্রার অফিসের পরিচিত একজন আমাকে দেখে ফেললো। মৃদু হেসে বললো স্যার আপনি এখানে। বললাম দেখতে এলাম আমাদের শিক্ষার্থীরা কেমন আছে। জিজ্ঞেস করলো: কেমন দেখলেন? আমি বললাম: ৪০ বছর আগে আমি যেমন ছিলাম তার চেয়ে খারাপ। এখন দই মিষ্টি জুস মেলে। হল গেটে আছে ভেন্ডিং মেশিন। কিন্তু সেগুলো অনেকেরই কাছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। লাইব্রেরির সামনে কাছে উচ্চমানের খাবার। দাম অনেক। সেগুলো চলছেই ভালো। এখানে যে বৈষম্য ও বঞ্চনার চিত্র দেখলাম তাতে মনটা খারাপ হয়ে গেল।

গত বছর রোজার মাসে একটি সংবাদ দেখেছিলাম। এক বেলা খেয়ে রোজা রাখে অনেক ছাত্র। যোগাযোগ করে কিছু ছাত্রের জন্য উন্নত খাবারের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম। নিজের অবস্থা আগের মতো নেই বলে এবার তাদের পাশে দাঁড়াতে পারিনি। বৈষম্যের শিকার আমি কীভাবে সেগুলো বলে শেষ করা যাবে না।

আমি বিদেশে কিচেন হ্যান্ড (OC/DC) দিয়ে শুরু করে দারোয়ান, নাপিত, ঘর পরিষ্কার করা, সুইপার সব কিছু করে যে ডিগ্রি নিয়ে এসেছি ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিংয়ে ৪০-এর মধ্যে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিগত ১৭ বছর আমি সেই জ্ঞান কাজে লাগাবার সুযোগ পাইনি। উপায়ন্তর না দেখে ছোটখাটো অনলাইন পত্রিকাতে লিখি কিংবা পরিচিতজনের কাছে শেয়ার করি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন সারা দেশে অনেক ভাগ্যবান শিক্ষক-ছাত্র আছেন। গত ১৫ বছর ক্ষমতা ও পদের জৌলুস অনেক ভোগদখল করেছেন। আর কিছু ভালো মানুষ বঞ্চিত হয়েছেন। অমুক মন্ত্রীর আত্মীয়, তমুকের বন্ধু ইত্যাদি বিবেচনায় অনেক অনেক সুযোগ তারা পেয়েছেন।

বিগত দুই দফা একসঙ্গে নির্বাচন করে বিরোধী দলের ভূমিকাতে আছেন এমন একজন এমপি অনেক আক্ষেপ করে কিছু কথা বলেছেন তা শুনি নীরব থেকে। অধ্যাপক রেহমান সোবহান প্রায় বলেন— সামাজিক বৈষম্য কমানোর জন্য ব্যবস্থা নেওয়া। আমরা পত্রিকাতে অনেক লিখেছি। সেদিন আইনমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদের মানুষের সামনে কিছু বলবার অনুরোধ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছি। পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে গিয়েছিলাম। এক উপাচার্য নাকি নতুন গাড়ি কেনার টাকা চেয়ে পাগল করে দিচ্ছেন। অথচ তিনি জানেন সরকারি বিধিনিষেধ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা যদি শিক্ষার্থীদের জন্য টাকা চাইতেন, যদি বলতেন আমার ছাত্রদের জন্য বই নেই, তাদের রুম নেই, তাদের ভালো খাবার সুযোগ নেই— টাকা দিন। শুনতে ভালো লাগতো। শুনেছি আগের দিনের শিক্ষকরা বাড়িতে ভালো খাবার হলে হয় শিক্ষার্থীকে ডেকে নিতেন বা পরের দিন নিয়ে আসতেন ভালো ছাত্রটিকে দিতে। আজ সেই শিক্ষক নেই। সকলেই কেবল নিজের উন্নয়ন নিয়ে ব্যস্ত। কেন? কারণ তারা অবহেলিত। গত ২৭ দিন শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন পেনশন স্কিম নিয়ে, বেতন-ভাতার বৈষম্য নিয়ে। সচিবালয় ও সরকারি দপ্তরে চলছে নবায়ন-লাক্সারি বলতে যা বোঝায়। বৈষম্য জিইয়ে রেখে আগানো যায় কি? শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড কথাটা কেবল কথার কথা হয়ে আছে। শিক্ষক-ছাত্র যে বৈষম্যের শিকার সেই বৈষম্য নিরসনে সরকার কি কিছু করবে? আন্দোলনের ক্ষতি ওই শিক্ষক-ছাত্রদের বহন করতে হবে কি? ক্যাম্পাসের পানিটা পর্যন্ত নিরাপদ নয়। যারা সামর্থ্য আছে ২০ টাকা দিয়ে কিনে খায়। ২০০০ সালে অস্ট্রেলিয়ার নিউসাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাল-এর ক্লাসে পানির দাম নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমি সেদিন চিৎকার করে বলেছিলাম— Water should be free। সেই পানি বিক্রি করে ধনকুবের হচ্ছেন আমার দেশের কিছু ব্যবসায়ী। বন্ধু রাজনীতিবিদ রুহিন হোসেন প্রিন্স বলছিল— ১০ টাকার শিঙাড়া খেয়ে ২০ টাকার পানি কিনতে হয়। ওই ২০০০ সালে উন্নয়নের অধ্যাপকের ক্লাসে সাবেক দুদক চেয়ারম্যান ডক্টর ইকবাল মাহমুদ একটি ছবি এঁকেছিলেন। সেটি এরকম— পেটটা মোটা আর সারা শরীরটা লিকলিকে। ওনাদের মতো সফল মানুষের জীবনী শুনেছি। কীভাবে কষ্ট করে পড়াশোনা করেছেন। আজও সেই কষ্টের ও বঞ্চনার জীবন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পার করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবাসন সমস্যা সমাধান করে দিয়েছেন। আপনি কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যা সমাধান করতে একটু বেশি সময় দেবেন? জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ বছর পূর্তি হয়ে গেল। সেখানে ছাত্রদের জন্য কোনো হল নেই। সেখানে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা গাদাগাদি করে থাকে। তারা প্রতিদিন অবর্ণনীয় কষ্ট করে যানজটে পড়ে বাড়ি ফেরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে মেসে থাকতে হয়। সচিবালয়ের জৌলুস, ঢাকার রেস্টুরেন্ট দেখলে মনে হবে আমরা স্বর্গে আছি। কিন্তু অপর দিকে হাহাকার। আরও অনেক অনেক বৈষম্য শিক্ষায় আছে। সেগুলো বললে ব্যক্তিকে আক্রমণ করা হয়ে যাবে। সংকট উত্তরণের পথ শিক্ষায় মনোযোগ দেওয়া। এর বিকল্প নেই। আপনি ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৫৫টি বিশ্ববিদ্যালয় করেছেন। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ৩৩ হাজার; যাদের মধ্যে ১৬ হাজার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেখানে শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারী নিয়োগে কোটা নেই। মেধাবীদের সুযোগ করে দিতে শিক্ষার আনুভূমিক উন্নয়ন অসাধারণ ও অতুলনীয়। কিন্তু এখন উলম্ব উন্নয়ন প্রয়োজন। মেট্রোরেলে করে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যেতে পারে। কিন্তু সেই মেট্রোরেল কিন্তু শিক্ষার্থীরা ভাঙেনি। যারা ভাঙল তাদেরকে খুঁজে বের করে শাস্তি দিন। ছাত্রদের আন্দোলনে যে বৈষম্যের কথা এসেছে তার অবসান কেবল কোটা সংস্কার করে সমাধান সম্ভব নয়। আমার দেশের মানুষ সরকারি পয়সায় ১০০ গজের দূরত্বের মসজিদে কিংবা মুদি দোকানে পাজেরো কিংবা প্যারাডো নিয়ে হাজির হন। এই বৈষম্য দূর না করে মুক্তি মিলবে না।

ফরিদ আহমেদ: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :