ভাতকাণ্ডেই কি ডিবির দায়িত্ব থেকে সরতে হলো হারুনকে?

প্রকাশ | ৩১ জুলাই ২০২৪, ২১:১১ | আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২৪, ২১:৩০

প্রশান্ত সুভাষ চন্দ, ঢাকা টাইমস

পদোন্নতি পেয়ে ২০২২ সালের ১২ জুন ডিএমপির ডিবি প্রধান হিসেবে যোগদান করেন আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ। এ পদে ছিলেন প্রায় দুই বছর এক মাস। এর মধ্যে অনেক সমালোচনারও জন্ম দিয়েছেন তিনি। অবশেষে তার ভাত কাণ্ড নিয়ে আদালতের উষ্মা প্রকাশের পর তাকে সরিয়ে দেওয়া হলো ডিএমপির গুরুত্বপূর্ণ এ পদ থেকে। সংযুক্ত করা হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) হিসেবে। প্রশ্ন উঠেছে ভাতকাণ্ডেই কি বদলি হতে হলো হারুনকে?

দুই বছর ডিবি প্রধান হিসেবে দায়িত্বপালন করতে গিয়ে অনেক রাজনৈতিক নেতা, সেলিব্রেটি ও ছাত্রনেতাদেরকে নিজ অফিসে নিয়ে ভাত খাইয়েছেন হারুন অর রশীদ। আবার সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশও করেছেন। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচিত সমালোচিতও ছিলেন তিনি। অনেকে রসিকতার ছলে ডিবি অফিসের সেই ডাইনিং রুমকে ‘হারুনের ভাতের হোটেল’ বলে মন্তব্য করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি একটি সুপরিচিত নামও ছিল। যদিও এসব মন্তব্যকে ইতিবাচক হিসেবেই নিতেন হারুন।

ডিবি অফিসে খাবার খান বিএনপি নেতা গয়েশ্বর

ভাতের হোটেল নামটি প্রথম আলোচনায় আসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে ভাত খাওয়ানোর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করার পর। গত বছর ২৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদের সঙ্গে খাবার খান গয়েশ্বর। হাসিমুখে ডিবি প্রধানের সঙ্গে তার খাবার খাওয়ার ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়। এতে দেখা যায়, হারুন অর রশীদ নিজে গয়েশ্বরের প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন।

জানা যায়, ওইদিন খাবারের মেন্যুতে ছিল খাসির মাংস, মুরগির মাংস, একাধিক মাছের তরকারি, রোস্ট ও সবজি। এছাড়া আম, মালটা, আঙ্গুর ও ড্রাগন ফলও ছিল খাবারের টেবিলে। মধ্যাহ্নভোজ শেষে ডিবির একটি সাদা গাড়িতে করে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে তার বাসায় পৌঁছে দেন ডিবি সদস্যরা।

ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়াকে ন্যক্কারজনক বলেন গয়েশ্বর

রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আপ্যায়ন করে সেটার ছবিসহ ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ও ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড। যারা কাজটি করেছে- এটি অত্যন্ত নিম্ন রুচির পরিচায়ক, এক ধরনের তামাশাপূর্ণ নাটক। এতে কি সরকার প্রমাণ করতে চায় যে আমরা হাভাতে? ভিক্ষা করে খাই? গ্রামের ভাষায় বলা হয় ‘খাইয়ে খোটা দেওয়া’।

হারুনের সঙ্গে খাবার খেয়েছেন বিএনপি নেতা নিতাই রায়

বিএনপি নেতা নিতাই রায় চৌধুরীকেও মধ্যাহ্নভোজ করিয়েছন ডিবি প্রধান। গত বছর ২৯ আগস্ট ব্যক্তিগত কাজে ডিবি কার্যালয়ে গেলে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরীকে দুপুরের খাবার খাওয়ান ডিবি প্রধান হারুন।

নিতাই রায়ের খাবার মেন্যুতে ফলের পাশাপাশি মাছ, মাংস ও ভাতের ব্যবস্থা ছিল। ওইদিনও ডিবিপ্রধান নিজ হাতে খাবার তুলে দিয়ে বিএনপি নেতাকে আপ্যায়ন করেন।

ডিবি কার্যালয়ে হিরো আলমকে ডাল-ভাত দিয়ে আপ্যায়ন

হত্যার হুমকির অভিযোগ নিয়ে গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের সঙ্গে দেখা করেন আলোচিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর আশরাফুল ইসলাম ওরফে হিরো আলম। ওইদিন দুই সহযোগীসহ ডিবি কার্যালয়ে দুপুরের খাবার খান তিনি। তবে ডিবি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের কাছে পুলিশ কর্মকর্তাদের আপ্যায়ন নিয়ে প্রশ্ন না তুললেও খাবার নিয়ে কিছুটা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন হিরো আলম।

এ সময় হিরো আলম বলেন, ‘আমাদের আলুভর্তা আর ডাল দেওয়া হয়েছে। এটা ঠিক না। দুরকম খাবার দিচ্ছেন, ঠিক নাকি? অপু (অপু বিশ্বাস) আসলে অনেক খাবার দিছেন, নেতা আসলেও অনেক কিছু খেতে দিছেন। আর আমারে খালি আলুভর্তা, ডাল, ভাজি দিছেন।’

সমঝোতার পর ডিবিতে খাবার খান অপু-তাপস

চিত্রনায়ক শাকিব খান ইস্যুতে ঝামেলা নিয়ে সমঝোতার পর ডিবি অফিসে খাবার খেয়েছেন অপু বিশ্বাস ও গানবাংলা টিভির সিইও কৌশিক হোসেন তাপস। গত বছর ১৯ ডিসেম্বর সমঝোতার পর ডিবি অফিসে হারুনের সঙ্গে খাবার খান তারা।

ভাত খেয়েছেন শাহজাহান ওমর

সাবেক বিএনপি নেতা (বর্তমানে আওয়ামী লীগ) শাহজাহান ওমরও ভাত খেয়েছেন সেখানে। গত বছর ৬ ডিসেম্বর হারুনের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন তিনি। খাবারের মেন্যুতে ছিল ভাত, মাংস, মাছ, ডাল, সবজি ও ভর্তা।

ডিবি কার্যালয়ে শামীম ওসমানের মধ্যাহ্নভোজ

ডিবি অফিসে মধ্যাহ্নভোজ করেছেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানও। গত বছর ২৯ নভেম্বর দুপুরে ডিবি কার্যালয়ে মধ্যাহ্নভোজ করেন তিনি। 

‘ভাতের হোটেল’ নামকরণে যা বলতেন হারুন

বিভিন্ন সময়ে খাওয়ানোর ছবি ভাইরালের পর ডিবি কার্যালয়কে ‘ডিবির ভাতের হোটেল’ বলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে মন্তব্য করেছেন। তবে এসব মন্তব্যকে ইতিবাচক হিসেবে নিতেন হারুন। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের বক্তব্য- ‘এটা রসবোধের প্রশ্ন। বাঙালি একটা রসবোধসম্পন্ন জাতি। সাহিত্যে রসবোধের প্রয়োগ আমাদের মনের খোরাক জোগায়। আমি মনে করি, এটা রসবোধপ্রবণ একটি বিষয় যে ডিবি ভাত খাওয়ায়।

তবে সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬ সমন্বয়ককে নিরাপত্তার নামে তুলে নিয়ে ভাত খাইয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন হারুন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয়ে তুলে নিয়ে তাদেরকে খাওয়ানোর ছবি প্রকাশ করাকে জাতির সঙ্গে ‘মশকরা’ বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।

ছয় সমন্বয়কের পরিবারকেও আপ্যায়ন করান হারুন অর রশীদ

এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজত থেকে মুক্তির ব্যাপারে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা।

সোমবার (২৯ জুলাই) রিটের শুনানির সময় রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য শুনে আদালত হারুনকে উদ্দেশ্য করে ওই মন্তব্য করেন।

অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মেহেদী হাসান চৌধুরী আদালতকে বলেন, আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিরাপত্তা দিতে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। টিভিতে দেখানো হয়েছে তাদেরকে লাঞ্চ করানো হচ্ছে। তারা ডিবি কার্যালয়ে কাঁটা-চামচ দিয়ে খাচ্ছেন এই ছবি প্রকাশ হয়েছে।

এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, ‘জাতিকে নিয়ে মশকরা করবেন না।’

জানা গেছে, একই দিন রাতে গণভবনে ১৪ দলের বৈঠকে হারুনের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আনেন এক জোট নেতা। জবাবে বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘হারুন সব সময় উল্টাপাল্টা কাজ করে। তাকে দ্রুতই বদলি করার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশনা দেওয়া হবে।’

এর দুদিন বাদেই পদ হারালেন হারুন। রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিদের মতে ভাতকাণ্ডের কারণেই তার ডিবি প্রধান হিসেবে তার কর্মজীবনের ইতি ঘটল।

(ঢাকাটাইমস/৩১জুলাই/এলএম/পিএস/ইএস)