কোটা আন্দোলন: আগুনই কেড়ে নিলো দুই বন্ধুর প্রাণ
প্রকাশ | ০৩ আগস্ট ২০২৪, ২১:১৮
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে সংগঠিত সহিংস ঘটনায় সালাম ও সেলিম নামে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চর জগন্নাথপুর গ্রামের দুই বন্ধু অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে একটি বহুতল ভবনে বিক্ষোভকারীদের দেওয়া আগুনে তাদের মৃত্যু হয়।
সোমবার (২২ জুলাই) সেখান থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) সন্ধ্যায় সালাম ও সেলিমের মরদেহ গ্রামে পৌঁছালে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। শোক আর কান্নায় এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে স্থানীয় মসজিদ মাঠে তাদের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে স্থানীয় কবরস্থানে পাশাপাশি কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হন সালাম ও সেলিম।
এর আগে শনিবার (২০ জুলাই) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের চিটাগাং রোডের ‘প্রিয়ম নিবাস’ নামক ভবনটিতে আগুন দেন বিক্ষোভকারীরা। সেদিন সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা চেষ্টা করেও সেই আগুন নেভাতে ব্যর্থ হন। পরদিন রোববার (২১ জুলাই) আগুন নেভানো হলেও অশান্ত পরিস্থিতির কারণে উদ্ধার কাজ করা হয়নি।
সোমবার (২২ জুলাই) দুপুরে ভবনটির দ্বিতীয় তলায় ডাচ বাংলা ব্যাংকের শাখা থেকে তাদের অগ্নিদগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
নিহত সেলিম মন্ডল (২৯) কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের চর জগন্নাথপুর গ্রামের ওহাব মণ্ডলের ছেলে। তার তিন বছর বয়সী একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে। আর আব্দুস সালাম (২৪) একই গ্রামের মৃত সাবের বিশ্বাসের ছেলে। সালামের ১৫ মাস বয়সী একটা ছেলে সন্তান রয়েছে। সেলিম ও সালাম দুই বন্ধু এবং সহকর্মী। তারা একসঙ্গে কাজ করতেন।
নিহত সেলিমের ভাতিজা ফয়সাল মন্ডল বলেন, ডাচ বাংলা ব্যাংকে ইন্টেরিয়রের কাজ করতে এক সপ্তাহ আগে সেখানে গিয়েছিলাম আমরা। তার আগে আমরা নরসিংদী কাজ করেছি। আমরা একসঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে বেড়াতাম।
শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে খাবার খেয়ে আমরা ব্যাংকের মধ্যে বসে ছিলাম। সাড়ে ৩টার দিকে আমাদের ওই ভবনে আন্দোলকারীরা আগুন দেয়। ওই ভবনের ৫ তলায় পুলিশের ক্যাম্প ছিল। ছাদ থেকে পুলিশ গুলি করে। এতে একটা ছাত্রের মাথায় গুলি লাগে এবং মরে যায়। এরপর বিক্ষোভকারীরা প্রাইভেটকারের টায়ার নিয়ে এসে পেট্রোল ঢেলে আমাদের ব্যাংকের সিঁড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ইট ও খোয়া মারতে শুরু করে ওই ভবনের জানালায়। এ সময় আমরা বাঁচার জন্য চিৎকার শুরু করি এবং দৌড়াদৌড়ি করি। পুরো রুম ধোঁয়ায় ভরে যায়, ধোয়ায় অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। এ সময় আমি আর আমার এক মামা আগুনের ভেতর দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে বাইরে বেরিয়ে আসি এবং বালুর ওপরে গড়াগড়ি করতে থাকি। খুব গোলাগুলি হচ্ছিল। একটা বস্তির লোকজন আমাদের উদ্ধার করে। এতে আমার পা, হাতসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গা পুড়ে গেছে। নিহত সেলিম আমার চাচা। সে ও তার বন্ধু সালাম তিনতলায় আটকে গিয়েছিল, তারা নামতে পারিনি। তারা দুজনেই মরে গেছে। সোমবার জানতে পারি ব্যাংকের মধ্যে থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আগুনে পুড়ে ও দম আটকে তারা মারা গেছে।
নিহত সালামের ভাই আলামিন হোসেন বলেন, শনিবার বিকাল ৫টা ১৫মিনিটের দিকে সালাম আমাকে কল দিয়ে বলে, আমাদের এখানে পুলিশ ও আন্দোলকারীদের সংঘর্ষ গোলাগুলি হচ্ছে। আমাদের ভবনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে গেছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি হয়ত বাঁচবো না। আমি ইনকাম করে তোকে পড়াশোনা করাতে চেয়েছিলাম, খাওয়াতে চেয়েছিলাম। তা তো পারলাম না। তুই আমার বউ ও ছেলেকে দেখেশুনে রাখিস। এরপর আর কোনো কথা বলেনি। আমি তার নম্বরে বহুবার কল করলেও সে রিসিভ করেনি। আমার ভাইয়ের উপার্জনে আমাদের সংসার চলত। এখন আমরা অনেক বিপদে পড়ে গেলাম। সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই।
নিহত সালামের স্ত্রী মারিয়া খাতুন বলেন, আমার স্বামী কাজ করতে গিয়েছিল। সেখানে কোটা সংস্কারের আন্দোলকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ গোলাগুলি চলছিল। ওই ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। এতে আমার স্বামী ভবনে আটকে পড়ে মারা গেছে। আমার বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে আমি মহাবিপদে পড়ে গেলাম। আমাদের দেখভাল করবে কে? আমাদের সংসার চলবে কীভাবে? সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই।
একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।
নিহত সেলিমের ছোট ভাই ওয়াজ মন্ডল বলেন, ভবনের নিচে প্রশাসনের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের গোলাগুলি হয়। গোলাগুলি হওয়ার পর প্রশাসন ওখানে টিকতে পারেনি। টিকতে না পারার কারণে চারতলার কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেয় এবং প্রশাসন ১০ তলায় ছাদের ওপর ওঠে যায়। ছাদ থেকে গোলাগুলি হয়। এ সময় আন্দোলনকারীরা ভবনের নিচে আগুন ধরিয়ে দেয়। অতিরিক্ত ধোঁয়ার কারণে রুম অন্ধকার হয়ে যায়। এ সময় আমার ছেলে ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। আমার বিয়াই দোতালা থেকে লাফিয়ে পড়ে। পরে আমার ভাগনে আমার ভাইয়ের হাত ধরে ডাকে, সেসময় আমার ভাইয়ের জ্ঞান ছিল না। পরে আমার ভাগনে চারতলা থেকে লাফিয়ে পাশের ছাদে পড়ে। আমার ভাই বের হতে পারেনি, মরে গেছে।
তিনি আরও বলেন, আমার ভাই ডাচ বাংলা ব্যাংকে কাঠের বোর্ডের আসবাবপত্র তৈরি করছিল ৬ জনকে সঙ্গে নিয়ে। ভাই ছিল কন্ট্রাক্টর, বাকি ৬ জন ভাইয়ের অধীনে কাজ করতো। সবাই বেরিয়ে গেলেও আমার ভাই সেলিম ও তার বন্ধু বের হতে পারেনি। দুজনেই মারা গেছে। দুই পরিবারকে সহযোগিতা করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। নিহত সেলিমের বাবা ওহাব মন্ডল বলেন, গ্রামের বাজারে আমার চায়ের দোকান আছে। আসরের পরে দোকানে গিয়েছি। তার আধাঘণ্টা পর আমার নাতি গিয়ে বলছে, দোকান বন্ধ করো, ছোট কাকা আগুনে পুড়ে মারা গেছে। এরপর আমি আমার ছেলেকে কল দিই। সে আমাকে বলে, আব্বা আমি তো বাঁচবো না। আমার জন্য দোয়া করো। এরপর আর কথা হয়নি। পরে জানতে পারি, আমার ছেলে মারা গেছে। আমরা গরিব মানুষ। ছেলের উপার্জনের অর্থে সংসার চলতো। এখন আমাদের সংসার চলবে কীভাবে? সেটা নিয়ে চিন্তিত। সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই। একই সঙ্গে হত্যাকান্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
নিহত সেলিমের স্ত্রী শোভা খাতুন বলেন, সেদিন দুপুরে মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার পর আমার স্বামী আমাকে কল দিয়েছিল। মেয়ের ও পরিবারের সবার খোঁজ খবর নিয়েছিল। সেদিন কাজ বন্ধ ছিল। তখন স্বামী বলেছিল, উড়োজাহাজ থেকে বোম ফেলছে। আমরা জানালা দিয়ে দেখছি। এসব কথা বলার পর মোবাইল রেখে দেয়। তার কিছুক্ষণ পর কল দিয়ে বলে, আমাদের বিল্ডিংয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আমরা মনে হয় বাঁচবো না। আমাদের জন্য দোয়া করো। এরপর আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। পরে জানতে পারলাম সত্যিই আমার স্বামী মারা গেছে।
তিনি আরও বলেন, আমার স্বামীর উপার্জনের অর্থে আমাদের সংসার চলতো। এখন আমাদের সংসার চলবে কীভাবে? আমার মেয়ে হুমাইরার বয়স তিন বছর আর আমার বয়স ১৮ বছর। এখন আমি এই মাছুম বাচ্চাকে কীভাবে মানুষ করবো? আমি সরকারের সহযোগিতা চাই। আমার স্বামীকে যারা হত্যা করেছে তাদের শাস্তি চাই।
কুমারখালীর ইউএনও এসএম মিকাইল ইসলাম বলেন, একজন ছাত্রসহ চারজন মৃত ব্যক্তির বাড়ি এ উপজেলায়। পরিবার আবেদন করলে সরকারি বরাদ্দ এলে তা দেওয়া হবে।
ঢাকাটাইমস/০৩আগস্ট/পিএস