হানিয়ার মৃত্যু ও মধ্যপ্রাচ্য সংকটের নতুন সমীকরণ
প্রকাশ | ০৪ আগস্ট ২০২৪, ১০:০৩ | আপডেট: ০৪ আগস্ট ২০২৪, ১০:০৯
হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। ঘটনাটি ঘটেছে ইরানে। এখন পর্যন্ত ইসরাইল এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার বা অস্বীকার করছে না। তবে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের সঙ্গে ইসরাইলের বৈরী সম্পর্ক আরো কঠোর হলো বলা যায়। ইসমাইল হানিয়ার হত্যার পর এই হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইসরাইলে সরাসরি হামলার নির্দেশ দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি। হানিয়া হত্যায় ইসরাইল দায়ী বলে মনে করেন ইরান ও হামাস। অন্যদিকে লেবাননের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক অবনতির দিকেই যাচ্ছে। ইসরাইল লেবাননের ইরানপন্থি সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর ওপর আক্রমণ করার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। এদিকে ইরানের প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে ফোনে জানিয়েছেন যে, লেবাননের ওপর যেকোনো ইসরাইলি হামলা দেশটির জন্য গুরুতর পরিণতি বয়ে আনতে পারে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলি প্রেসিডেন্ট বলেছেন, গোলান মালভূমির ফুটবল মাঠে হিজবুল্লাহর রকেট হামলার বিষয়টি ইসরাইল উপেক্ষা করতে পারে না এবং করবে না। আমাদের প্রতিক্রিয়া আসছে আর তা কঠোর হবে। এ বাস্তবতায় ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে বলা যায়। হামাস ও হিজবুল্লাহর পক্ষে ইরান যদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে দীর্ঘদিনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির সুবাতাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট প্রায় সাত দশকের। এই দীর্ঘ সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের এই অঞ্চলটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে বার বার। যুদ্ধ চলাকালে মাঝে মাঝে যুদ্ধবিরতি হয়েছে। কখনো কখনো স্থিতাবস্থায় কেটেছে কিছুদিন। আবার এক সময় যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে দুই পক্ষ। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি হলেও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইসরাইল বিশে^র একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর সারাবিশে^ ছড়িয়ে থাকা ইহুদি শরণার্থীরা জেরুজালেমে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। সে সময় ফিলিস্তিনিরা ইহুদিদের আন্তরিকভাবেই গ্রহণ করেছিল। কিন্তু পরবর্তী ইতিহাস বড়োই নির্মম। প্রায় সাত দশক ধরে সারাবিশ্ব ধারাবাহিকভাবে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট তথা যুদ্ধ দেখে আসছে। সর্বশেষ গত বছরের ৭ই অক্টোবর নতুন করে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। শুরুতে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরাইলি বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। তারপর দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হয় পাল্টাপাল্টি আক্রমণ। হামলা ও পাল্টা হামলায় যুদ্ধক্ষেত্র গাজা মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়। বিশ^ব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠলেও সংকট সমাধানে কোনো পরাশক্তি এখন পর্যন্ত আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসছে না। বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যুদ্ধ বন্ধের দায়সারা দায়িত্ব পালন করলেও কাউকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদও বেশ কয়েকবার বৈঠক করে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো প্রদানের ফলে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসা কঠিন হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র যুক্তরাজ্য স্পষ্টতই ইসরাইলের পক্ষ নিয়েছে। কেন এই পক্ষপাতিত্ব? বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের তালিম দিয়ে বেড়ানো যুক্তরাষ্ট্র কেন গাজা উপত্যকার হত্যাযজ্ঞ বন্ধের ব্যাপারে কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না- তা ভাববার বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে সরকারের ভূমিকাকে সঠিক মনে করছে না। এর প্রতিবাদে তারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমসূত্রে জানা গেছে। বিশ^ব্যাপী প্রতিবাদও কম হচ্ছে না। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত শান্তি অধরাই থেকে যাচ্ছে।
ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধে বর্তমানে গাজা উপত্যকার পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে। উভয় পক্ষের হামলা ও পাল্টা হামলায় প্রতিদিন বেসামরিক মানুষ, নারী ও শিশু মৃত্যুবরণ করছে। আহত হয়ে বিনা চিকিৎসায় কাতরাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। শুধু তাই নয়, বর্তমানে গাজার প্রায় অর্ধেক মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় আছে বলে খবরে প্রকাশ হয়েছে। গাজার ধ্বংসযজ্ঞ ক্রমশ নির্মম ও ভয়াবহ হচ্ছে। অতর্কিত হামলার আশঙ্কায় সেখানে নিরাপদে কোনো মেডিকেল টিম পৌঁছতে পারছে না। ত্রাণবাহী গাড়ি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লোকেরাও আক্রমণের শিকার হচ্ছে। হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয় প্রভৃতি বেসামরিক স্থাপনা অতর্কিত বোমা হামলা করে গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে গাজা উপত্যকার বেশিরভাগ এলাকা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস হলেও বাস্তবে যুদ্ধবিরতিসহ সংকট সমাধানের কোনো পথ খুঁজে বের করতে পারছে না জাতিসংঘ। এদিকে ইসরাইলের পাশে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এ দুই পরাশক্তির সমর্থনের কারণেই জাতিসংঘের কোনো নিরপেক্ষ উদ্যোগ ফলপ্রসূ হচ্ছে না বলে ধারণা করা হয়। আর একটি দুঃখজনক বিষয় হলো একমাত্র ইরান ছাড়া এ পর্যন্ত অন্য কোনো মুসলিম দেশকে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে না। হামাস ও ইসরাইলি বাহিনীর পাল্টাপাল্টি আক্রমণে দিন দিন ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষ হত্যা বেড়েই চলছে। হত্যার শিকার হচ্ছে নিরপরাধ নারী ও শিশু। জীবিতরা ক্ষুধা-তৃষ্ণায়, বিনা চিকিৎসায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। প্রতিপক্ষের কাছে আটকেপড়া লোকেরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কিন্তু সারাবিশ্ব নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
যুদ্ধে প্রাণহানির সঠিক হিসাব কখনোই জানা যায় না। তবে এই লেখা চলাকালে ফিলিস্তিনি পক্ষে মৃতের সংখ্যা প্রায় ৪০,০০০ হাজার বলে খবরে প্রকাশ হয়েছে। সবচেয়ে নির্মম বিষয় হলো এসব মৃতদের অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। মারা গেছেন শতাধিক গণমাধ্যমকর্মী। ইসরাইল বাহিনীতেও মৃতের সংখ্যা দেড় শতাধিক। আহত অবস্থায় আছে অসংখ্য মানুষ। প্রায় দুই লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এ হত্যাযজ্ঞ ও আহতদের আহাজারিতে গাজা উপত্যকায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় নেমে এলেও সংকট সমাধানের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষ বা তৃতীয় পক্ষের কার্যকর ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। অথচ সদিচ্ছা থাকলে পরাশক্তিগুলো নিজেদের সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে বিশ্বের যেকোনো স্থানে যেকোনো সময় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আবার তারা ইচ্ছে করলে যুদ্ধ কিংবা যুদ্ধাবস্থা দীর্ঘস্থায়ী করে রাখতে পারে। সামরিক ও অর্থনৈতিক- উভয় দিক দিয়ে পরাশক্তি হয়ে ওঠার এই এক সুবিধা। তবে এই সুবিধার বলে কেউ যদি মানবাধিকার প্রশ্নে নীরব থাকে তবে তাকে নিন্দা না করে পারা যায় না। এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, চলমান পরিস্থিতি প্রলম্বিত হলে গাজা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে। গণহত্যা ও ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে হামাস ঘোষণা দিয়েছে গাজায় কোনো ইসরাইলি সৈন্যকে তারা জীবিত রাখবে না। তার মানে পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। বর্তমান মানবতাবাদী বিশে^ এ ধরনের মানবিক বিপর্যয় মেনে নেওয়া যায় না।
গাজা উপত্যকার যুদ্ধ তথা ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে কার লাভ? কার ক্ষতি? ক্ষতির বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, যুদ্ধরত দু’পক্ষেরই ক্ষতি। যুদ্ধে দু’পক্ষেই হতাহত হয়। স্থাপনা ও অবকাঠামো ধ্বংস হয়। বাকিদেরও প্রকারান্তরে কোনো লাভ নেই। তবে যারা যুদ্ধের রসদ বিক্রি করে তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়। মধ্যপ্রাচ্যের এই অঞ্চলটিতে অস্ত্র বিক্রি করে যারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে আসছে তারা শান্তির বদলে যুদ্ধকেই চলমান রাখতে চাইবে। এক্ষেত্রে অর্থনীতির সঙ্গে জাতিগত বিষয়টিও বিবেচনায় আনা যেতে পারে। ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী হয়ে ওঠা মানে জাতিগতভাবে ইহুদিরা শক্তিশালী হয়ে ওঠা। ইহুদিরা শক্তিশালী হয়ে উঠলে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমরা দুর্বল হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র এটা চায় বলেই কি অন্ধভাবে ইসরাইলকে সমর্থন করে যাচ্ছে? তাছাড়া আর কি কারণ থাকতে পারে। সারাবিশ^ যেখানে যুদ্ধবিরতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে কথা বলছে সেখানে আমেরিকার ভিন্ন অবস্থান দুঃখজনক। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব বিপুল ভোটে পাস হয়েছিল। ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে যে ১০টি দেশ যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র তাদের মধ্যে অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের এই যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কারণে ইসরাইল পায়ের নিচে শক্ত মাটি পেয়ে গেছে। ইসরাইল এখন বলছে- হামাসকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসকে নিশ্চিহ্ন করতে গিয়ে তারা ফিলিস্তিনি নারী, শিশু ও বেসামরিক লোকদের উপরও নির্বিচারে হামলা চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করছে। ফলে এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের দায় ইসরাইলকে যেমন নিতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেরও নিতে হবে।
ইসরাইল-ফিলিস্তিন চলমান সংকটে বাংলাদেশ সরকার তার নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। ফিলিস্তিনের গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। এ ঘোষণায় রাজনৈতিকভাবে কোনো পক্ষাবলম্বনের বিষয় নেই। এ ব্যাপারে মানবিক দিকটিই প্রাধান্য পেয়েছে। বিশ্বকে প্রকৃত অর্থে মানবতাবাদী বিশ্বে পরিণত করতে হলে সর্বাগ্রে পরাশক্তিগুলোকে জাতি-ধর্ম নয়, মানবিক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটে বর্তমান বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর দিকেই তাকিয়ে আছে। গাজায় আর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে চায় না বিশ্ববাসী। অনেক হয়েছে। একদিকে গণহত্যা ও বেসামরিক স্থাপনা ধ্বংস অন্যদিকে ত্রাণ ও মেডিকেল সামগ্রী পরিবহণে প্রতিবন্ধকতার ফলে গাজায় যে মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে তুলনীয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল বলেছেন, গাজা উপত্যকায় ইসরাইল যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসরাইল, ফিলিস্তিন, ইরান ও লেবানন তাদের অবস্থান পরিবর্তন না করলে কিংবা তৃতীয় পক্ষ কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন না করলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যই মুত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়ে যেতে পারে, যা কোনো মানবতাবাদী বিবেকবান মানুষের কাম্য হতে পারে না।
আলী রেজা: কলাম লেখক, কলেজ শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়