অনিবার্য পরিণতিকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না

প্রকাশ | ০৬ আগস্ট ২০২৪, ১৪:৪৫ | আপডেট: ০৬ আগস্ট ২০২৪, ১৪:৪৯

আলী হাসান

এ কোন ধ্বংসযজ্ঞ ও মৃত্যু উপত্যকা পার হয়ে এলো বাংলাদেশ। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং নব্বুইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষী আছেন অনেকেই। কিন্তু ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান আগের যেকোনো গণঅভ্যুত্থান থেকে অনেকটাই আলাদা। এভাবে গণভবন, জাতীয় সংসদ ভবন, সরকারপ্রধানের কার্যালয়সহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো আন্দোলনকারীরা এর আগে কখনো দখলে নেয়নি। আগের সেসব গণআন্দোলনে পুলিশের ওপর এমন আক্রমণ এবং প্রতিপক্ষের স্থাপনায় এত ব্যাপক হামলা-আক্রমণও হয়নি দুর্বৃত্তদের দ্বারা। আর কোটা-সংস্কার আন্দোলনের মতো এত দীর্ঘ সময় ধরে টানা একক কোনো আন্দোলনও এর আগে হতে দেখা যায়নি। বাংলাদেশের আপামর মানুষের জন্য এই আন্দোলন এমন একটা শিক্ষা দিয়ে গেল যে- সামান্য একটি ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনও কীভাবে জাতীয় আন্দোলনে রূপ নিতে পারে সেটা। সরকারের প্রধান কর্ণধার যিনি রাষ্ট্রের একেবারে শীর্ষে অবস্থান করেন তিনিও যে তাঁর ‘বার্ডস্ আই ভিউ’ দিয়ে কোনোকিছুই দেখতে পান না, কী ঘটতে যাচ্ছে তা বুঝতে পারেন না- এমনই ঘন-অমানিশার অন্ধত্ব তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছিল; এটাও সাধারণ মানুষের জন্য এক দারুণ শিক্ষা। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি বিখ্যাত কবিতা আছে ‘দেশলাই’ শিরোনামে; যেখানে বলা হয়েছে- ‘আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি / এত নগন্য হয়তো চোখেও পড়ি না / তবু জেনো, মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ / বুকে আমার জ¦লে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস / আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি...’। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই কবিতাটিকে সদ্য দেশব্যাপী বয়ে যাওয়া প্রলেতারিয়েতের সঙ্গে তুলনা করা চলে। ছাত্রছাত্রীদের কোটা-সংস্কার আন্দোলনটিকে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা প্রথমে একটি দেশলাইয়ের কাঠির মতোই অতি তুচ্ছ, নগণ্য ও সাধারণ মনে করে অবহেলা করেছিলেন। কোটা-সংস্কার আন্দোলন নিয়ে তিনি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে অনেক কটু কথাও বলেছেন যা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে আরো উসকে দিয়েছিল সেসময়। 
উল্লেখ্য, গত ১৪ই জুলাই রাতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা চীন সফর বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র ধরে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’, ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’ এ ধরনের স্লোগান দেয়। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য অনেকটা সক্রেটিক আয়রনির মতো ছিল। অর্থাৎ প্রাধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে যেমন বলেছিলেন- ‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? আমার প্রশ্ন দেশবাসীর কাছে। তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে, মুক্তিযোদ্ধারা পাবে না।’ এই বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করেই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আয়রনির মতো করে অর্থাৎ বিপরীতধর্মী শ্লেষপূর্ণ বক্তব্যের আদলে নিজেদের রাজাকার হিসেবে উল্লেখ করে এই স্লোগানগুলো দিয়েছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা এই স্লোগান মোটেও নিজেদের ‘রাজাকার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দেয়নি। বরং তাদের বক্তব্যকে আরো জোরালোভাবে প্রকাশ করতেই তারা এই শ্লেষপূর্ণ বিপরীতধর্মী স্লোগানগুলো দিয়েছে। এতে তো দোষের কিছু ছিল না।
মনে রাখতে হবে- শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনটা কোনোভাবেই কোটাবিরোধী ছিল না- ছিল মূলতই কোটা-সংস্কারের। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কখনোই বলেনি না যে- নারী কোটা, জেলা কোটা, পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠী বা আদিবাসী কোটা কিংবা প্রতিবন্ধী কোটা বাদ দেওয়া হোক। তারা বলছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিদের জন্য যে ৩০% কোটা নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে, এটাকে কমানো হোক। যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরা এবং তাঁদের সন্তান-সন্তুতি পর্যন্ত সরকারের দেওয়া যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন কিংবা এখনো পেয়ে আসছেন- এটা নিয়ে তো কারো মধ্যে কোনো প্রশ্ন দেখা দেয়নি। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধার তৃতীয় প্রজন্ম অর্থাৎ তাঁর নাতি-নাতনির জন্যও ঠিক একই রকম সুযোগ-সুবিধা বহাল থাকবে কেন- এখানেই এসে কোটা-সংস্কারের বিষয়টি সামনে চলে আসে। আর দেশের কোনো মুক্তিযোদ্ধাই তো এই দাবি করেনি যে, তাদের নাতিপুতিদেরও সরকারি কোটায় চাকরি দিতে হবে। বরং অনেক মুক্তিযোদ্ধাই কোটা-সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন বলেছেন- ‘আমরা আমাদের নাতিপুতিদের এই কোটা পদ্ধতির সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি।’
বলা হয়ে থাকে- বাতির নিচেও অন্ধকার থাকে। শিক্ষার্থীদের একটি নিরীহ আন্দোলনের ভাষা শেখ হাসিনা বুঝতে অক্ষম হলেন। তাঁর দীর্ঘ জীবনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার নিচেই যে অন্ধকারেরও হাতছানি ছিল তা দেশের মানুষের কাছে প্রমাণিত হয়েছে। আসলে একচেটিয়া ক্ষমতা প্রয়োগের ফলেই তিনি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য রাজনীতিবিদে পরিণত হয়েছিলেন।

তাঁর রাজনৈতিক দম্ভ ও অহংকার তাঁর বক্তব্য ও আচরণে সব সময়ই স্পষ্টতই প্রকাশ পেত। এটা এখন সকলেরই বোধগম্য যে- শিক্ষার্থীদের কোটা-সংস্কার আন্দোলনটি সহজেই সামাল দেওয়া যেত কিন্তু শেখ হাসিনার দম্ভ ও জেদের কারণে তা সম্ভব হয়নি। কী হতো শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে কোটা-সংস্কার করে যদি মুক্তিযোদ্ধা কোটা যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা হতো। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তো সেটা করাই হলো। বরং একটু বেশি করেই করা হলো। তখন ৯৩% পার্সেন্ট কোটা মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য রেখে বাকি মাত্র ৭% কোটা মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যদের জন্য রাখা হলো। শিক্ষার্থীরা তো এত বেশিসংখ্যক মেধাবী কোটা চায়নি, তবুও তাদের সেটা দেওয়া হলো। কিন্তু ততক্ষণে নির্দিষ্ট ও বিপদমুক্ত সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তখন আর সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। এই আন্দোলনে যেমন বিভিন্ন পেশাজীবী ও অভিভাবকরা যুক্ত হয়েছেন, অন্যদিকে আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে দুর্বৃত্তরাও ঢুকে পড়েছে। তারা সরকারি স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপক নাশকতা চালিয়েছে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এই আন্দোলন চলাকালে শত শত মানুষের মৃত্যু দেখতে হয়েছে দেশবাসীকে। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন হওয়ার সময়ও এত বিপুল মানুষের মৃত্যু হয়নি।
তবে ছাত্রদের এই আন্দোলন শুধু কোটা-সংস্কার আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; তার কারণ বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগের সরকার পরিচালনায় অনেক বিষয়েই স্বৈরাচারী মনোভাব ফুটে ওঠেছে।  ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা সরকার। ২০১৪ সাল পর্যন্ত ঠিকই ছিল তাদের শাসনকাল। কিন্তু এরপর শুরু হয় নির্বাচনব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করে রাখার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। নির্বাচন ব্যবস্থাকে পুরোপুরিই দলীয় কাঠামোর মধ্যে নিয়ে ব্যাপক ভোট কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে তারা। ঠিক এভাবে বিভিন্ন কৌশল ও ব্যাপক কারচুপি দ্বারা এর পরে আরো দুটি নির্বাচন অর্থাৎ ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আগের নির্বাচনগুলোরই পুনরাবৃত্তি করেন। এভাবেই গণতান্ত্রিক জনমত আস্তে আস্তে করে আওয়ামী লীগের বাইরে যেতে থাকে। শেষের দিকে এসে শেখ হাসিনার শাসনামলে বিরোধী দল ও মানুষের স্বাধীন কণ্ঠকে এমন নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয় যে এতে গণতন্ত্র অনেকটাই বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে। শেখ হাসিনা সরকার এমনকি স্বাধীন গণমাধ্যমেরও টুঁটি চেপে ধরে এক সময়, অবরুদ্ধ করে ফেলে গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- কোটা-সংস্কার আন্দোলন নিয়ে চূড়ান্ত অবস্থা যখন দাঁড়ায় তখন পুলিশের গুলিতে কোথায় কতজন মারা যাচ্ছে সেটা প্রচারের ক্ষেত্রেও মিডিয়া হাউজগুলোর স্বাধীনতাকে কণ্ঠরোধ করে ফেলেন শেখ হাসিনা সরকার। বলার অপেক্ষা রাখে না যে- বিগত ১৫ বছরে অনেক লোককেই গুম করা হয় যাদের মধ্যে শতাধিক ব্যক্তির কোনো খোঁজই আজ পর্যন্ত মেলেনি। এছাড়া গণমামলায় আটক বা দুর্বিষহ অবস্থায় এখনো জেলে আছেন বিরোধী দলের অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। শেখ হাসিনা সরকারের এই টানা পনেরো বছর সময়ের মধ্যে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আর বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে- যা দেশের অর্থনীতিকে অনেকটাই পর্যুদস্ত করে ফেলেছে। অর্থনীতির মূল্যস্ফীতির প্রবল নিম্নচাপে সাধারণ মানুষের জীবন যে একেবারেই অতিষ্ট হয়ে ওঠেছে তা বলাই বাহুল্য। সবমিলিয়ে কোটা-সংস্কার আন্দোলনের এই গণজাগরণে যে সর্বস্তরের মানুষের নিঃশর্ত অংশগ্রহণ তা উল্লিখিত রাষ্ট্র পরিচালনার নেতিবাচক দিকগুলোর বিকলাঙ্গতাকেই প্রকাশ করে। বলা যায় এই গণঅভ্যুত্থানে সকল শ্রেণির মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের এক মহাবিস্ফোরণ ঘটেছে।
এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটি সুন্দর পরিবেশের জন্য সবাইকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। ইতোমধ্যেই সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধান জাতির উদ্দেশে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে আশ^স্ত হওয়ার মতো শতভাগ কারণ রয়েছে বলে মনে করি। তাঁরা উভয়েই তাদের বক্তব্যে বলেছেন- আন্দোলনকারীদের এখন সম্পূর্ণ শান্ত হতে হবে। আর কোনো ধ্বংসাত্মক কাজ করা যাবে না। খুব কম সময়ের মধ্যেই একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তাঁরা উভয়েই। তাঁরা দেশের সকল শ্রেণির মানুষকেই শান্ত থাকতে বলেছেন। সেনাপ্রধান সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা রাখার অনুরোধও করেছেন সবাইকে। এই আন্দোলনকালীন যত হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার সুষ্ঠু বিচার হবে বলে সেনাপ্রধান নিশ্চয়তা দিয়েছেন। তিনি বারবার বলেছেন যে- তিনি সবকিছুর দায়িত্ব নিচ্ছেন। এখন থেকে সবাইকে শান্ত থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি এও বলেছেন- আর কোনো সহিংসতা নয়; এখন সবকিছু স্বাভাবিক করতে সকলকে সহায়তা করতে হবে। সবকিছু এখন শান্ত পরিস্থিতির দিকেই যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিএনপিপ্রধান বেগম খালেদা জিয়াসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি এবং কোটা-সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত এক মাসে গ্রেপ্তারকৃতদেরও মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা বলেছেন।
রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধানের বক্তব্যের সারমর্ম সবাইকে অনুধাবন করতে হবে। দেশে আর কোনো নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা যেন না হয় সেটা কেবল নিরাপত্তাকর্মীদেরই দায়িত্ব নয়- সে দায়িত্ব রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের। অবিলম্বে দেশজুড়ে প্রতিপক্ষের স্থাপনায় হামলা, অগ্নিসংযোগসহ সকল ধরনের হানাহানি বন্ধে সকলকে মানবিক আচরণ করতে হবে। বিগত এক মাস ধরে দেশজুড়ে যে সহিংসতা ও নৈরাজ্য হয়েছে এবং তাতে দেশের জানমালের যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা আর যেন বৃদ্ধি না পায়- এজন্য সকলকে এই মুহূর্তে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।

আলী হাসান: সাংবাদিক, কলাম লেখক