ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং অতঃপর করণীয় নির্ধারণ
প্রকাশ | ০৯ আগস্ট ২০২৪, ১১:২১
বাংলাদেশে আর একবার ক্ষমতার পালাবদল ঘটলো। না, কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে নয়। মাসাধিককালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং এ আন্দোলনের দ্বিতীয়ার্ধে সর্বস্তরের জনতার সমর্থন ও অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার পতন ঘটে। প্রায় দেড়যুগের আওয়ামী শাসনে বাংলার মানুষ কেন এতটা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল তা রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তকদের অনুসন্ধানের বিষয় হলেও মোটা দাগে দৃশ্যমান কিছু বিষয় সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি। নজিরবিহীন দলীয়করণের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের বিষয়টি সাধারণ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের হতাশ করে তুলেছিল। সামরিক, আধা-সামরিক ও সিভিল প্রশাসনে নজিরবিহীন দলীয়করণের ফলে প্রশাসনের একটি বড়ো অংশের মধ্যে তিলে তিলে ক্ষোভ ও হতাশা দানা বেঁধেছিল। সরকার সমর্থিত আমলা ও দলীয় নেতাকর্মীদের দুর্নীতি ও লুটপাট, দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি, সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনে দলের ভেতরে বিভক্তি, ডামি প্রার্থী দিয়ে বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠান, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ক্ষমতার দম্ভ, বিরোধীপক্ষকে দমনপীড়ন- এসব বিষয় সাধারণ মানুষকে এতটাই হতাশ করে তুলেছিল যে, তারা আর সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকতে পারেনি।
সরকার সমর্থিত ছাত্র-জনতার একটি বড়ো অংশও সরকারের এ সব কর্মকাণ্ডকে সুনজরে দেখেনি। ফলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে খুব সহজেই যুক্ত হয়ে গেছে সাধারণ মানুষ। বরাবরের মতো বৈষম্যবিরোধী এ ছাত্র আন্দোলনকেও সরকার ছাত্রলীগ ও পুলিশ বাহিনী দিয়ে দমন করতে চেয়েছে। কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের ক্ষোভের বিস্ফোরণ এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে, এতে ছাত্রলীগ নামক সরকার সমর্থিত এই সংগঠনটির অতীতের সকল গৌরবগাথা ধূলায় মিশে গেছে। অনেক নেতাকর্মী পালিয়ে জীবন রক্ষা করেছে, অনেকে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের রোষানলে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের চরম পর্যায়ে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও লেজ গুটিয়ে পালিয়েছিল। পুলিশ বাহিনীর প্রতি ছাত্র-জনতার সীমাহীন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে সারা দেশে থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, পুলিশের গাড়ি ও স্থাপনা ভাঙচুর ও জ্বালিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। তবে এসব ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড সমর্থনযোগ্য নয়। শেখ হাসিনার পতনের পর দেশে যে প্রশাসনিক শূন্যতা ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে কিংবা এখনো ঘটছে তা মোকাবিলা করার জন্য ছাত্র-জনতার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকেও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে।
গত ৫ই আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা। পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু পালিয়ে জীবন রক্ষা করতে পারতেন। তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা তাঁকে সে ধরনের অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পালিয়ে যাননি। দুর্বৃত্তদের বুলেটের মুখে বুক পেতে দিয়েছিলেন। শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের মাটিতেই আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। এরশাদও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। বেগম খালেদা জিয়াও যাননি। বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে পাঁচ দশকের ইতিহাসে শেখ হাসিনাই একমাত্র সরকারপ্রধান যিনি তাঁর নেতা-কর্মীদের অরক্ষিত রেখে নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে গেলেন। একটানা প্রায় দেড়যুগ ক্ষমতাসীন থেকে তিনি ক্ষমতার দম্ভ যতটা দেখিয়েছেন ততটা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন যতটা করেছেন তার সমান্তরালে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে পারেননি। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ছিল নজিরবিহীন।
সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট একটি শ্রেণি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে দেশে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের ওপর নানা ধরনের করের বোঝা চাপানো হয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে বার বার। বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ানো হলেও পরবর্তী সময়ে কখনো বিশ্ববাজার অনুসারে দাম কমানো হয়নি। আমদানিকারক সিন্ডিকেট ও নানা ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি ভোক্তাগণ দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। অন্যদিকে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট এক শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, সরকার সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাস বুঝতে পারেনি। মিডিয়াসহ সকল শ্রেণি-পেশার ভেতরে সরকারের স্তাবকের সংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়ে গিয়েছিল। এই স্তাবকেরা সরকারকে জনগণের পাল্স বুঝতে দেয়নি।
সরকারের ভেতরেও ছিল স্তাবক, যারা বিপদ বুঝে কেটে পড়েছে। এতদিন ক্ষমতায় থেকে স্তাবকদের চিনতে না পারা শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড়ো ব্যর্থতা। তিনি তো দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোভাবে চিনতেন বলেই মনে করি। কিন্তু তিনি দেশে পরিবারতন্ত্র কায়েম করে এমন একটি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী গোষ্ঠী তৈরি করতে চেয়েছিলেন যারা তাঁর রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠবে। হয়েও উঠেছিলেন। কিন্তু দেশের মানুষ এই পরিবারতন্ত্র গ্রহণ করেনি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে কোনো নেতার মৃত্যুর পর তাঁর সন্তানকে কিংবা রাজনৈতিকভাবে অনভিজ্ঞ তাঁর স্ত্রীকে মনোনয়ন দিয়ে জনপ্রতিনিধি বানানো হয়েছে। ত্যাগী নেতারা বঞ্চিত হয়েছে। এই মেরুকরণ এক ধরনের রাজনৈতিক অপকৌশল।
রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বদলে অর্থ ও পেশিশক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। জাতির মেধাবী সন্তানরা রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়েছে। সামর্থ্য থাকলে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। দেশে মেধাকে মূল্যহীন করে দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের অব্যবহিত পূর্বে দেশবাসী জেনেছে যে, সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকে শীর্ষ দুর্নীতিবাজ। অধস্তন কর্মচারীরাও দুর্নীতিতে পিছিয়ে নেই। সীমাহীন সম্পদের মালিক বনে গেছে সবাই।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু কোটা নয়, অর্থের লেনদেনের মাধ্যমে নিয়োগবাণিজ্যের অপসংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়েছে। ঘুষ-দুর্নীতির এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছে সাধারণ মানুষ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে হামলা-মামলার অপসংস্কৃতি থেকেও বের হয়ে আসতে চেয়েছে সাধারণ মানুষ। এ কারণেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সকল নিপীড়িত মানুষ রাস্তায় নেমে এসে ছাত্রদের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে। গড়ে উঠেছে ছাত্র-জনতার এক যুগপৎ গণঅভ্যুত্থান।
ছাত্র-জনতার এই গণঅভ্যুত্থানকে লৌহমানব খ্যাত আইয়ুব খান দমাতে পারেনি। ইয়াহিয়া খান দমাতে পারেনি। বস্তুত কোনো স্বৈরশাসকই দমাতে পারে না। কিন্তু শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার স্বতস্ফূর্ত অভ্যুত্থানকে দমন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হলেন। তিনি ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষাগ্রহণ করলেন না। শত শত ছাত্র-জনতার রক্তে রঞ্জিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের সংবাদ প্রকাশ হলে দেশের সিংহভাগ মানুষকে যেভাবে দলে দলে রাস্তায় নেমে এসে উল্লাস করতে দেখা গেছে তা অভাবনীয়। এই ঘটনায় বোঝা গেছে দেশের মানুষ দীর্ঘদিনের আওয়ামী শাসনে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। আওয়ামী লীগ সরকার দেশে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিল এবং সেসবের সুফল দেশের মানুষ আজীবন ভোগ করছে এবং করবে। কিন্তু দেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে, বিরোধীপক্ষকে দমন-পীড়ন করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রক্রিয়াকে সাধারণ মানুষ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি।
শেখ হাসিনার এই পতন দেশের মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই উচ্ছ্বাস এক দিনেই অনেকটা থেমে গেছে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে গণভবন ও সংসদ ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ও সরকারের এমপি-মন্ত্রীদের বাসায় ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হলেও এ তৎপরতা বেশিদূর এগোয়নি। আন্দোলনকারীরাই আবার সবকিছু ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে। সবকিছু পরিষ্কার করার জন্য মাঠে নেমে পড়েছে।
সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর ও উপাসনালয় রক্ষায় নিয়োজিত হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ বাহিনী আত্মগোপনে চলে যাওয়ার প্রেক্ষিতে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকেই থানা রক্ষা ও ট্রাফিক কন্ট্রোলের কাজে লেগে যেতে দেখা গেছে। বিএনপি নেতাদের বক্তব্যেও দায়িত্বশীলতায় পরিচয় পাওয়া গেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফসল হয়তো ভবিষ্যতে বিএনপি-জামাতের ঘরেই উঠবে। ফলে বিএনপি-জামাতের কর্মীদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে সবাইকে ধৈর্যধারণ করার যে আহ্বান সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আগামীদিনেও বিএনপির এই সংযম দেখতে চায় দেশবাসী। দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করলেও সে দলের গোলামি করতে চায় না।
আশা করি ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান থেকে রাজনীবিদগণ শিক্ষাগ্রহণ করবেন। আমাদের গতানুগতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। কারণ, সবার আগে দেশ ও দেশের মানুষ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের ছাত্রসমাজ রাজনীতির এই সুমহান শিক্ষাটাই দিয়েছেন। এখন যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তাঁরা দেশকে নতুন রাজনীতির পথে তুলে দিয়ে যাবেন- এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।
গণঅভ্যুত্থানের পরদিনই রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার রাত নয়টায় বঙ্গভবনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। ১৭ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টাসহ ১৪ জন উপদেষ্টা শপথ নিয়েছেন ইতোমধ্যে। বাকি তিনজন খুব কময়ের মধ্যেই শপথ নেবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। এখন যত দ্রুত সম্ভব অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশে সাধারণ নির্বাচন দিয়ে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন- এমনটাই আশা করছেন দেশের সাধারণ জনগণ। নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া যত তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করা যাবে ততই দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। তবে ছাত্র-জনতার দাবি অনুসারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অনেককিছুই ঢেলে সাজাতে হবে। প্রশাসনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও বিভিন্ন সাংবিধানিক পদে যে সীমাহীন দলীয়করণ করা হয়েছিল সেসব পদে যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের পদায়ন করতে হবে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদদের চেতনাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে এসব করতে যে সময়ের প্রয়োজন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সে সময় দিতে হবে। এজন্য সংবিধান সংশোধন করার প্রয়োজন হতে পারে। আন্দোলনের সমন্বয়কারী ছাত্রনেতারা সে ধরনের ইঙ্গিতও দিয়েছেন। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা হলো ভবিষ্যতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন- তারা যেন নির্লজ্জ দলীয়করণ ও দুর্নীতির ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও গণমানুষের কলাণে কাজ করে।
আলী রেজা: কলাম লেখক, কলেজ শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়