বাকৃবিতে ছাত্ররাজনীতির বলি ১৬ প্রাণ, বিচার হয়নি একটিরও
প্রকাশ | ০৯ আগস্ট ২০২৪, ১৪:১২ | আপডেট: ০৯ আগস্ট ২০২৪, ১৫:০৬
ময়মনসিংহের পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে গড়ে ওঠা দক্ষিণ এশিয়ার কৃষিশিক্ষার অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। দেশের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় ছাত্ররাজনীতিতে সরব ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। এখানে ছাত্ররাজনীতির নামে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত ঝরেছে ১৬টি তাজা প্রাণ। এসব খুনের একটিরও বিচার হয়নি।
লেজুড়বৃত্তিক দলীয় ছাত্ররাজনীতির করাল গ্রাসে হারিয়ে গেছে কত কত পরিবারের স্বপ্ন। এই ধারা আর কত চলবে! ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর দ্বিতীয় দফা স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির নামে অপরাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানাচ্ছেন বাকৃবির শিক্ষার্থীরা। কিছু কিছু শিক্ষকও একই দাবি জানান।
রাজনীতির বলি সন্তানের মায়ের চোখের পানি হয়তো শুকিয়ে গেছে, কিন্তু হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কি কখনো থামে! শেষ সান্ত্বনা ছেলের হত্যাকারীদের বিচার হয়তো পাবেন। সময়ের পরিক্রমায় সে আশার গুড়ে বালি। অনেক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আজও আলোর মুখ দেখেনি।
তাহলে কি বিশ্ববিদ্যালয়ে খুনিদের কোনো বিচার নেই? তারা কি আইনের ঊর্ধ্বে? এমন প্রশ্ন সন্তানহারা পরিবারের ভেতরে গুমরে মরে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ছাত্ররাজনীতির জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ হয়েছে শতাধিকবার। আহত হন সহস্রাধিক এবং নিহত হন ১৬ জন।
প্রথম খুনটি হয় ১৯৭৩ সালে। কর্মচারী-শিক্ষক-ছাত্র সংঘর্ষে সেবার নিহত হন রঞ্জিত। এরপর থেকে শুরু হয় হত্যার রাজনীতি। টানা ১০ বছরের শান্ত ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয় ১৯৮৩ সালে। ওই বছরে ছাত্রদলের নেতা এ টি এম খালেদ নিহত হওয়ার জের ধরে প্রতিপক্ষের বুলেটে নিহত হন ছাত্রলীগ ও বাকসুর নেতা শওকত, ওয়ালী ও মহসিন।
অতঃপর টেন্ডারবাজি, সিট দখল, বাজেট বণ্টন ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ১৯৯৩ সালে খুন হন রেজাউর রহমান সবুজ। ১৯৯৪ সালে কর্মচারীর কলেজ পড়ড়ুয়া ছেলে, ১৯৯৫ সালে বাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আলাউদ্দিন, শওকত, কবির ও হাসান নামে চার শিবিরকর্মী এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুন হন কামাল ও রণজিৎ নামে দুই ছাত্রলীগ কর্মী। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে ছাত্রদল চার গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়, যার ফলে ২০০১ সালে খুন হন ছাত্রদল নেতা হাসু।
২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি নিয়োগবাণিজ্য, অর্থ ভাগবাটোয়ারা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বাকৃবি ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে নিহত হয় পাশের গ্রামের ১০ বছরের ছোট শিশু রাব্বী। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১ এপ্রিল নিজ সংগঠনের নেতাকর্মীদের পিটুনিতে মারা যান মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের শেষ বর্ষের ক্লাস প্রতিনিধি ও আশরাফুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সায়াদ ইবনে মোমতাজ (সাদ)।
বাকৃবি ক্যাম্পাসে আজ পর্যন্ত ছাত্ররাজনীতির জেরে ১৬টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলেও একটিরও বিচার পায়নি কোনো পরিবার। সব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত রিপোর্ট হিমাগারে জমাটবদ্ধ।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে ছাত্ররাজনীতি সাধারণ ছাত্রদের দাবি-দাওয়া নয়, দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে। ফলে ক্যাম্পাসের সবুজ চত্বর সহপাঠীদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির নামে চলমান অপরাজনীতির ফলেই এসব হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন অনেকে। কেউ কেউ বলছেন নিষিদ্ধ নয়, দরকার সংস্কার। শিক্ষক রাজনীতির ফলে শিক্ষকেরাও সরকারদলীয় ছাত্রনেতার অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শামসুন নাহার অয়ন্তী মনে করেন, ছাত্ররাজনীতিতে ছাত্র নয়, ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পায়। গত ক্ষমতাসীন দল সেটা বহুলাংশে প্রমাণ করে গেছে। ঠিক এই কারণে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য কোনো রাজনৈতিক ট্যাগের প্রয়োজনীয়তা নেই, কোটা সংস্কার আন্দোলন তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। আমরা সবাই একটি বৈষম্যহীন ও সাম্যবাদী ভবিষ্যতের আশা রাখি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি ও হিস্টোলজি বিভাগের লেকচারার মোছা. লতিফা আক্তার বলেন, ‘আমি নিজেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি চাই না। আমি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মাঝেও সব সময় সেটা প্রমোট করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে বাধ্য হয়ে অনেক শিক্ষার্থী রাজনীতি করত।’
এই একই বিষয় আবার জুনিয়র শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও আছে বলে জানান লতিফা আক্তার। তিনি বলেন, ‘ইচ্ছে না থাকলেও শিক্ষকদের বিভিন্ন রাজনৈতিক গ্রুপে নাম লেখাতে হয়। শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ এতে ব্যাপকভাবে ক্ষতি হয়। অনেক ছাত্রছাত্রীর ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যায় এই রাজনীতির জন্য এবং শিক্ষকদের মান-মর্যাদা নষ্ট হয়। আমার সব সময় মনে হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী কোনো রাজনীতিই থাকা উচিত না।’
(ঢাকাটাইমস/৯আগস্ট/মোআ)