সরকারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নেই সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে

প্রকাশ | ১০ আগস্ট ২০২৪, ১০:২৫

ইমরুল কায়েস

কোটা-সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ নৈরাজ্য ও সহিংসতা থেকে ক্রমান্বয়ে বের হয়ে আসছে দেশ। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে ১৪ উপদেষ্টা শপথ নিয়ে কাজ শুরু করেছেন ইতোমধ্যে। গত শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টা তাঁর সরকারের অন্য উপদেষ্টাদের মাঝে দপ্তর বণ্টন করে দিয়েছেন। উপদেষ্টাদের মাঝে বণ্টনকৃত দপ্তর বা মন্ত্রণালয়গুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে বলে ইতোমধেই বিভিন্ন মহলও মতামত প্রকাশ করেছে।
সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়- প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অধীনে রয়েছে ২৭ মন্ত্রণালয়। বাকি মন্ত্রণালয়গুলো ১৪ উপদেষ্টার মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। অন্য উপদেষ্টাদের মধ্যে যে মন্ত্রণালয়গুলো ভাগ করে দেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো- সালেহউদ্দিন আহমেদকে অর্থ এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়, আদিলুর রহমান খানকে শিল্প, হাসান আরিফকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, মো. তৌহিদ হোসেনকে পররাষ্ট্র, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন, শারমিন এস মুরশিদকে সমাজকল্যাণ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনকে স্বরাষ্ট্র, আ ফ ম খালিদ হোসেনকে ধর্ম, ফরিদা আখতারকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, নুরজাহান বেগমকে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ, মো. নাহিদ ইসলামকে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি এবং আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গত বৃহস্পতিবার রাতে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়- সেখানে প্রধান উপদেষ্টাসহ এ সরকারের সদস্যসংখ্যা ১৭ জন। সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে- এর মধ্যে তিনজন ঢাকার বাইরে থাকায় তারা এখনো শপথ নিতে পারেননি। সুপ্রদীপ চাকমা, বিধান রঞ্জন রায় ও ফারুকী আজম- এই তিনজন খুব শিগগিরই শপথ নেওয়ার পরে প্রধান উপদেষ্টা তাদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন করে দেবেন বলে জানা গেছে।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রায় দেড় দশকের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনা সরকারের এক করুণ পতন হয়েছে। এই গণঅভ্যুত্থানের পরে দেশের যে সীমাহীন নৈরাজ্য ও সহিংসতা দেখা দিয়েছিল তার রেশ এখনো কিছুটা রয়েছে। চরম নাশকতা ও সহিংসতার পরে দেশের বেশিরভাগ থানাই এক সময় অরক্ষিত হয়ে পড়ে। অন্তর্ববর্তীকালীন সরকারের চেষ্টায় ইতোমধ্যে কিছু কিছু থানায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে শুরু করেছে। অনেক থানায়ই এখন সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। আশা করা যায়- খুব তাড়াতাড়িই হয়তো রাজধানীসহ দেশের থানাগুলোতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে।
দেশে কেন এমন একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো তা এখন আর করোরই অজানা নেই। আমরা যদি একটু পিছনের দিকে ফিরে তাকাই তাহলে দেখতো পাবো- কীভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বধীন সরকার ধীরে ধীরে একটি গণঅভ্যুত্থানের দিকে এগিয়ে আসছিল। গত ১৪ই জুলাই রাতে কোটা-সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা চীন সফর বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র ধরে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’, ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’ এ ধরনের স্লোগান দেয়। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য অনেকটা সক্রেটিক আয়রনির মতো ছিল। অর্থাৎ প্রাধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে যেমন বলেছিলেন- ‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? আমার প্রশ্ন দেশবাসীর কাছে। তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে, মুক্তিযোদ্ধারা পাবে না।’ এই বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করেই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আয়রনির মতো করে অর্থাৎ বিপরীতধর্মী শ্লেষপূর্ণ বক্তব্যের আদলে নিজেদের রাজাকার হিসেবে উল্লেখ করে এই স্লোগানগুলো দিয়েছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা এই স্লোগান মোটেও নিজেদের ‘রাজাকার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দেয়নি। বরং তাদের বক্তব্যকে আরো জোরালোভাবে প্রকাশ করতেই তারা এই শ্লেষপূর্ণ বিপরীতধর্মী স্লোগানগুলো দিয়েছে। এতে তো দোষের কিছু ছিল না।
ক্ষমতাসীনদের মনে রাখা খুবই প্রয়োজন ছিল যে- শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনটা কোনোভাবেই কোটাবিরোধী ছিল না- ছিল মূলতই কোটা-সংস্কারের। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কখনোই বলেনি না যে- নারী কোটা, জেলা কোটা, পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠী বা আদিবাসী কোটা কিংবা প্রতিবন্ধী কোটা বাদ দেওয়া হোক। তারা বলছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিদের জন্য যে ৩০% কোটা নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে, এটাকে কমানো হোক। যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরা এবং তাঁদের সন্তান-সন্তুতি পর্যন্ত সরকারের দেওয়া যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন কিংবা এখনো পেয়ে আসছেন- এটা নিয়ে তো কারো মধ্যে কোনো প্রশ্ন দেখা দেয়নি। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধার তৃতীয় প্রজন্ম অর্থাৎ তাঁর নাতি-নাতনির জন্যও ঠিক একই রকম সুযোগ-সুবিধা বহাল থাকবে কেন- এখানেই এসে কোটা-সংস্কারের বিষয়টি সামনে চলে আসে। আর দেশের কোনো মুক্তিযোদ্ধাই তো এই দাবি করেনি যে, তাদের নাতিপুতিদেরও সরকারি কোটায় চাকরি দিতে হবে। বরং অনেক মুক্তিযোদ্ধাই কোটা-সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন বলেছেনÑ ‘আমরা আমাদের নাতিপুতিদের এই কোটা পদ্ধতির সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি।’


বলা হয়ে থাকে- বাতির নিচেও অন্ধকার থাকে। শিক্ষার্থীদের একটি নিরীহ আন্দোলনের ভাষা শেখ হাসিনা বুঝতে অক্ষম হলেন। তাঁর দীর্ঘ জীবনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার নিচেই যে অন্ধকারেরও হাতছানি ছিল তা দেশের মানুষের কাছে প্রমাণিত হয়েছে। আসলে একচেটিয়া ক্ষমতা প্রয়োগের ফলেই তিনি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য রাজনীতিবিদে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক দম্ভ ও অহংকার তাঁর বক্তব্য ও আচরণে স্পষ্টতই প্রকাশ পেত। এটা এখন সকলেরই বোধগম্য যে- শিক্ষার্থীদের কোটা-সংস্কার আন্দোলনটি সহজেই সামাল দেওয়া যেত কিন্তু শেখ হাসিনার দম্ভ ও জেদের কারণে তা সম্ভব হয়নি। কী হতো শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে কোটা-সংস্কার করে যদি মুক্তিযোদ্ধা কোটা যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা হতো। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তো সেটা করাই হলো। বরং একটু বেশি করেই করা হলো। তখন ৯৩% পার্সেন্ট কোটা মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য রেখে বাকি মাত্র ৭% কোটা মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যদের জন্য রাখা হলো। শিক্ষার্থীরা তো এত বেশিসংখ্যক মেধাবী কোটা চায়নি, তবুও তাদের সেটা দেওয়া হলো। কিন্তু ততক্ষণে নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তখন আর সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। এই আন্দোলনে যেমন বিভিন্ন পেশাজীবী ও অভিভাবকরা যুক্ত হয়েছে, অন্যদিকে আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে দুর্বৃত্তরাও ঢুকে পড়েছে। তারা সরকারি স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপক নাশকতা চালিয়েছে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এই আন্দোলন চলাকালে শত শত মানুষের মৃত্যু দেখতে হয়েছে দেশবাসীকে। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন হওয়ার সময়ও এত বিপুল মানুষের মৃত্যু হয়নি।
তবে ছাত্রদের এই আন্দোলন শুধু কোটা-সংস্কার আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; তার কারণ বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগের সরকার পরিচালনায় অনেক বিষয়েই স্বৈরাচারী মনোভাব ফুটে ওঠেছে।  ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা সরকার। ২০১৪ সাল পর্যন্ত ঠিকই ছিল তাদের শাসনকাল। কিন্তু এরপর শুরু হয় নির্বাচনব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করে রাখার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। নির্বাচন ব্যবস্থাকে পুরোপুরিই দলীয় কাঠামোর মধ্যে নিয়ে ব্যাপক ভোট কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে তারা। ঠিক এভাবে বিভিন্ন কৌশল ও ব্যাপক কারচুপি দ্বারা এর পরে আরো দুটি নির্বাচন অর্থাৎ ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আগের নির্বাচনগুলোর পুনরাবৃত্তি করেন। এভাবেই গণতান্ত্রিক জনমত আস্তে আস্তে করে আওয়ামী লীগের বাইরে যেতে থাকে। শেষের দিকে এসে শেখ হাসিনার শাসনামলে বিরোধী দল ও মানুষের স্বাধীন কণ্ঠকে এমন নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয় যে এতে গণতন্ত্র অনেকটাই বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে। শেখ হাসিনা সরকার এমনকি স্বাধীন গণমাধ্যমেরও টুঁটি চেপে ধরে এক সময়, অবরুদ্ধ করে ফেলে গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- কোটা-সংস্কার আন্দোলন নিয়ে চূড়ান্ত অবস্থা যখন দাঁড়ায় তখন পুলিশের গুলিতে কোথায় কতজন মারা যাচ্ছে সেটা প্রচারের ক্ষেত্রেও মিডিয়া হাউজগুলোর স্বাধীনতাকে কণ্ঠরোধ করে শেখ হাসিনা সরকার। বলার অপেক্ষা রাখে না যে- বিগত ১৫ বছরে অনেক লোককেই গুম করা হয় যাদের মধ্যে শতাধিক ব্যক্তির কোনো খোঁজই আজ পর্যন্ত মেলেনি। এছাড়া গণমামলায় আটক বা দুর্বিষহ অবস্থায় এখনো জেলে আছেন বিরোধী দলের অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী। শেখ হাসিনা সরকারের এই টানা পনেরো বছর সময়ের মধ্যে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আর বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে- যা দেশের অর্থনীতিকে অনেকটাই পর্যুদস্ত করে ফেলেছে। অর্থনীতির মূল্যস্ফীতির প্রবল নিম্নচাপে সাধারণ মানুষের জীবন যে একেবারেই অতিষ্ট হয়ে ওঠেছে তা বলাই বাহুল্য। সবমিলিয়ে কোটা-সংস্কার আন্দোলনের এই গণজাগরণে যে সর্বস্তরের মানুষের নিঃশর্ত অংশগ্রহণ তা উল্লিখিত রাষ্ট্র পরিচালনার নেতিবাচক দিকগুলোর বিকলাঙ্গতাকেই প্রকাশ করে। বলা যায় এই গণঅভ্যুত্থানে সকল শ্রেণির মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের এক মহাবিস্ফোরণ ঘটেছে।
এখন দেশে যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে এটাকে ত্বরিত উদ্ধার করা জরুরি। দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্থানীয় দপ্তরগুলো অর্থাৎ থানাগুলো পুনরায় সচল না করা গেলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোনোভাবেই স্বাভাবিক অবস্থায় আসবে না। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে; উপদেষ্টাদের মাঝে দপ্তরও বণ্টন হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সরকার তার নিজস্ব কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেছে। মনে রাখতে হবে- আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকেই সরকারের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এ লক্ষ্যে দেশের সবগুলো থানাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় সচল করার কোনো বিকল্প নেই।

ইমরুল কায়েস: কলেজ শিক্ষক, লেখক ও গবেষক