স্বাধীন হওয়ার চেয়েও প্রয়োজন সভ্য হওয়া
প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০২৪, ১০:২০
শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত দুর্বার আন্দোলনে যে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয় সেখানে দেশে নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, সরকারি-বেসরকারি সম্পদের বিনষ্টি হতে দেখা যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ পর্যন্ত কখনোই দেশে কোনো একক ঘটনায় এত হত্যাকাণ্ড, এত ধ্বংস ও হানাহানি হতে দেখা যায়নি। গত ৫ই আগস্টের পরে দেশে ঘটেচলা বিভিন্ন ঘটনায় আমি জানি আমার মতো অনেকেই একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। কী হলো দেশে! কী দেখলো ৫৩ বছর বয়সী এই বাংলাদেশ। এই দেশকে ধ্বংস ও বিপুলসংখ্যক মানুষকে হত্যা করলো এই দেশেরই মানুষ। দুর্বৃত্তরা দেশের বেশিরভাগ থানা আক্রমণ করে অনেক পুলিশ সদস্যকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে থানা জ্বালিয়ে দিয়ে থানায় সংরক্ষিত সমস্ত ডকুমেন্টসই ধ্বংস করে দিয়েছে। কোনোভাবেই আমার বিশ্বাস হচ্ছে না- এইসব হত্যাকারী ও লুণ্ঠককারী ব্যক্তিরা এই দেশেরই নাগরিক। আমি আমার এই কলামে আমার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কথা এখানে সবিনয়ে লিপিবদ্ধ করতে চাই।
গত ৬ই আগস্ট সকালে ঘুম ভাঙতেই এক ভদ্রলোক কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কান্নাজড়িত হয়ে মোবাইল ফোনে কল দিয়ে আামকে বলেন, ভাই আমার সব শেষ। ছেলেরা বিদেশ হতে যে কয়টা টাকা পাঠিয়েছে তা দিয়ে কোনোরকমে একটা ঘর বানিয়েছিলাম। সব ভেঙে ফেলেছে। ছেলের বউয়ের স্বর্ণালংকারসহ সবকিছু নিয়ে লুট করে নিয়ে গেছে। ঘরে যা পেয়েছে তার সবই ভেঙে দিয়ে গেছে। এখন বিষ খাওয়ার টাকাও হাতে নাই। একই দিন আরেক ভদ্রলোক গ্রাম থেকে কল দিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমাকে বলেন- ভাই কালরাতে আমার পাশের ঘরের মহিলা ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ঘরে ঢুকে তার বুকের উপর পা দিয়ে সন্ত্রাসীরা দাঁড়িয়েছিল। তার ঘরের সবকিছু আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। এখন হাসপাতালে চিকিৎসা করার একটা টাকাও নাই তার হাতে। গত ৫ই আগস্ট বিকেলে আমার মোবাইল ফোনে কল করে আমার আরো এক আত্মীয় জানায় যে, সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মচারীর বাড়িতে কয়েকশ লোক আগুন লাগিয়ে উল্লাসে মেতে উঠেছে। একই ব্যক্তি আরো জানায়- ঐ ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যানকে কিছুসংখ্যক লোক দেখা মাত্রই চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি মারা শুরু করে। তিনি তাদের হাত-পা ধরে কাকুতি-মিনতি করে বলছেন- দয়া করে আমার বাড়িতে আগুন দিবেন না।
৬ই আগস্ট আরো একজন ভদ্রলোক কল করে আমাকে বলেন যে- কাল সারারাত ঘুমাতে পারিনি। চর্তুদিকে বিকট শব্দ, থমথমে ভাব, হাতে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে লোকজন বিভিন্ন লোকের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ করেছে। চাঁদা দাবি করেছে, বড়ো অংকের চাঁদা না দিলে আওয়ামী লীগের লোকদেরকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে অনবরত। একই দিন বিকেলে আরেক ভদ্রলোক যিনি গ্রামের বাজারের আকেজন ব্যবসায়ী, তিনি কল দিয়ে বললেন- কয়েকশ লোক তার বাজারে হকিষ্টিক, ক্রিজ, গরুজবাই করার চাক্কু, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দোকানে দোকানে চাঁদা আদায় করছেন। তার দোকান থেকে ২ লক্ষ টাকা নিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় তাকে হুমকি দিয়ে বলছে- ‘আগামীকাল ৫ লক্ষ টাকা চাঁদা দিবি, নয়তো জানে মেরে ফেলব।’ একইদিন এক ষাটোর্ধ্ব এক ভদ্রলোক কল দিয়ে বলেছেন- ১৫ বছর পর আবার একই মিছিল, একই অস্ত্র, একই জ্বালাও পোড়াও এবং একই রকম মানুষের বাড়িতে হামলা শুরু হয়েছে। তাকে প্রশ্ন করলাম এগুলো কারা করছে? তিনি উত্তর দিলেন- এদের মুখ ছিল বাঁধা, কিন্তু এরা যে স্থানীয় তা বুঝতে পেরেছি। বাকি লোকগুলো অচেনা, হয়তো অন্য কোনো এলাকা থেকে তাদের ডেকে নিয়ে এসেছে। প্রশ্ন করলাম ওরা কী বলে? উত্তরে বললেন- তারা বলেছে, বিগত ১৬ বছর কিছু পাইনি, এখন টাকা দিবি, না হয় জানে মেরে ফেলবো।
এসব তো গেল গ্রামের কিছু চিত্র; এবার শহরের কথা বলি। আমার অফিস হচ্ছে রাজধানীর কোনো এক বহুতল ভবনে। দেশে গত কয়েকদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত না থাকায় ভবন কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তাহীনতার দরুন অফিস না খুলতে অনুরোধ করেছিলেন আমাকে। এ কারণে অতীব জরুরি প্রয়োজনে পার্শ্ববর্তী মার্কেটে কম্পোজ করার জন্য গেলাম। দোকানে বসতেই শুনলাম- এক লোক পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বলছেন, এখন থেকে যে নিজেকে আওয়ামী লীগ বলবে তাকেই পেটাবো। দোকানদার জানালো এইলোক কয়েকদিন আগেও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেই ছিল, এখন বোল পালটে বড়ো বিএনপি হয়েছে। গত ৭ই আগস্ট এক ভদ্রলোক আমাকে মোবাইল ফোনে কল করে অবহিত করেন যে- এইমাত্র একদল লোক নোয়াখালী ১ আসনের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য এইচ এম ইব্রাহিমের বাসভবনে হামলা করেন। তিনি আরো বলেন- ৩০টি মোটরসাইকেল ও ৩টি মাইক্রোবাসে ৭০-৮০ জন যুবক স্লোগান দিয়ে তার বাড়িতে হামলা করে আগুন ধরিয়ে দেয়। হামলাকারীদের মধ্যে কয়েকজন মুখোশ পরিহিত ছিল।
আমরা সকলেই জানি যে- গণঅভ্যুত্থানের দিন নজিরবিহীনভাবে গণভবন লুটতরাজ হয়েছে। দেশের মানুষ তা টেলিভিশনের পর্দায় স্পষ্ট দেখেছেন। লুণ্ঠনকারীরা নেচে-গেয়ে রিকশা, অটো, ঠেলাগাড়ি ও মোটরসাইকেলসহ হরেক রকম যানবাহনে করে লুটকরা বিভিন্ন মালামাল নিয়ে যাচ্ছেন। এই দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায় দেখেন নাই এমন একজন লোকও এই দেশে পাওয়া যাবে না। কারো হাতে সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরনের শাড়ি, কেউবা হাড়ি-পাতিল ও স্টিলের গ্লাস নিয়ে এসে হরেক রকম বাজনা বাজাচ্ছেন। কেউবা আবার গণভবন হতে মোরগ, ছাগল ও রাজহাঁসসহ বিভিন্ন ধরনের শোপিচ ও গৃহস্থালীয় নানা উপকরণ নিয়ে যাচ্ছেন।
গত কয়েকদিনের আরেকটি লক্ষণীয় চিত্র হলো বাংলাদেশ পুলিশের বিরুদ্ধে সহিংসতা। দেশের অধিকাংশ থানা আক্রান্ত হয়েছে এই আক্রমণে। এটা সত্য যে, বাংলাদেশের পুলিশের শত ত্রুটি বিচ্যুতি রয়েছে। এজন্য তারা এককভাবে দায়ী নয় মোটেও। প্রতিটি সরকার নিজেদের হীনস্বার্থে পুলিশকে ব্যবহার করেছে। ভুল-ভ্রান্তি থাকলেও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ তাদের মাধ্যমেই রাষ্ট্রকে করতে হয়। পুলিশের কাজ অন্য কাউকে দিয়ে করানো সম্ভবপর নয়। বাংলাদেশ পুলিশ রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে দায়িত্ব পালন করেন। এদের নিয়েই আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন। বিদেশ থেকে তো আর পুলিশ আমদানি করা সম্ভব নয়। আমাদের অন্যান্য সেক্টরও তো কোনো ধোয়া তুলসি পাতা নয়। মনে রাখতে হবে- আজ যারা ছাত্র, তারাই তো একদিন পুলিশ হবেন, পুলিশ কর্মকর্তা হবেন। বর্তমান সময়ে চলমান মুর্খদের লুটতরাজ দেখে মনে হয়- কখন জানি রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রও লুট হয়ে যায়। চলমান আগুন সন্ত্রাস, লুটতরাজ, ডাকাতি ও সহিংসতার ঘটনা যতটুকু ঘটেছে তার প্রায় সবই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হয়েছে। এসব নাশকতাপূর্ণ কাজ কোটা-সংস্কার আন্দোলনের সাধারণ ছাত্র-জনতা কখনোই করেনি, তাহলে এসব কার করলো? এটা বুঝতে অনেক বেশি বুদ্ধিমান হওয়ার প্রয়োজন নাই, কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট।
শুধু মরিচ খেলেই ঝাল লাগে না। উচিত কথায়ও ঝাল লাগে। দেখা যাচ্ছে- অতীতের ন্যায় চলমান লুটতরাজের বিষয়ে আমাদের সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দলগুলো আগুনসন্ত্রাসী ও লুটতরাজকারীদের বিরুদ্ধে খুবই সতর্ক ও সমীহ করে কথা বলছেন। আমি বুঝি না, ডাকাতদের এত সমীহ করার কী আছে। কারণ এ দেশে সমীহ করে কথা বলে কখনো চুরি, ডাকাতি, লুটপাট ও অগ্নিসন্ত্রাসীদের কখনো নিবৃত্ত করা যায়নি এর আগে। এদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে আমার মনে হয়েছে হাজার হাজার বাড়ি-ঘরে লুটপাট, ডাকাতি ও অগ্নিসন্ত্রাস করা হয়েছে গতে কয়েকদিনে। এখনই ছাত্র-জনতার উচিত এসব দানবের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। কেননা, এই সীমাহীন লুটতরাজ ও সহিংসতা বন্ধ করা না গেলে দেশের ভয়াবহ ক্ষতি রোধ করা যাবে না। এ সহিংসতা এখনই বন্ধ করতে হবে। নয়তো ব্যর্থ রাষ্ট্রের ক্লাবে আমাদেরকে নাম লেখাতে হবে।
জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- গত ১৬ বছরের সকল মামলা কেন প্রত্যাহার করতে হবে? রাজনৈতিক সব মামলা কেন প্রত্যাহার করতে হবে? এই গণঅভ্যুত্থানের আগে কোনো রাজনীতিবিদই কি কোনো অপরাধ করেনি? সব মামলা নির্বিচারে প্রত্যাহার করার ফল কখনো ভালো হবে না।
গ্রামে-গঞ্জে দেখা যাচ্ছে ১২ বছরের ছেলেরাও অগ্নিসন্ত্রাস ও ভাঙচুর করেছে। এরা নিজেরাও জানে না কেন এমনটি করছে তারা। এদের জিজ্ঞেস করলে বলে, সবাই করছে এজন্য আমিও করছি। পরে যখন এদের বিরুদ্ধে মামলা হবে, তখন তাদের বাবা মা বলবে আমার ছেলে মাসুম নাবালক। আল্লাহর কসম কখনোই সে রাজনীতি করে নাই। পুলিশ অন্যায়ভাবে আমারে ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে। এদের রাজনীতি করার মতো বয়স ও যোগ্যতা কোনোকিছুই হয় নাই, এটা সত্য। কিন্তু এরা অগ্নিসন্ত্রাস ও লুটপাট যে করেছে এটাও তো সত্য।
তবে আমরা এই বাংলাদেশ আর কোনো নৈরাজ্য ও সহিংসতা দেখতে চাই না। ইতোমধ্যে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির নিকট শপথ গ্রহণের পর উপদেষ্টাদের মধ্যে দপ্তর বণ্টনের ভিতর দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন ১৪ উপদেষ্টার সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পথচলা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে সরকার ব্যবস্থায় গত কয়েদিন ধরে চলা অচলাবস্থার নিরসন হবে বলা যায়। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন নতুন সরকারকে ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ স্বাগত জানিয়েছে। এছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও জনগণকে যেকোনো উপায়ে সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত জাতিসংঘও। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে সংস্থার মহাসচিবের উপমুখপাত্র ফারহানা হক এ কথা জানিয়েছেন। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশের সহযোগিতার আশ্বাস নতুনভাবে পথচলা দেশের অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারের জন্য নিশ্চয়ই ইতিবাচক দিক। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ দেশের সার্বিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে স্বাভাবিকতার পথ ধরে এখন হাঁটতে শুরু করলেই দেশের মানুষ হাফ ছেড়ে বাঁচবে। আমি চাই, আর যেন কোনো হত্যা, ধ্বংস ও সহিংসতা না ঘটে বাংলাদেশে। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন থেকে অনেকবেশি সজাগ ও দায়িত্বশীল হবে বলে বিশ্বাস করি।
ড. আনোয়ার হোসেন: আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি এ্যালকোহলের সভাপতি এবং প্রতিভা এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট এন্ড ওয়েলফেয়ার সোসাইটির চেয়ারম্যান