কাজে ফেরার নির্দেশ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার
পুলিশে শৃঙ্খলা ফেরাতে একাধিক প্রচেষ্টা
শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়া দেশের থানাগুলোর কার্যক্রম এখনো চালু হয়নি। সেনাবাহিনী এবং বিজিবির সহযোগিতায় কিছু থানায় কার্যক্রম চালু হলেও কর্মকর্তাদের বেশিক্ষণ থানায় থাকতে দেখা যায়নি। কোনো সেবাগ্রহিতা থানায় গেছেন এমন তথ্যও মেলেনি। এমন প্রেক্ষাপটে পুলিশ সদস্যদের থানায় ফেরাতে সব পর্যায় থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে।
তবে পুলিশকে ‘রাজনীতিমুক্ত’ রেখে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়াসহ ১১ দফা দাবিতে অনড় নন-ক্যাডার পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তারা। দাবি না মানা পর্যন্ত তারা কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন।
এদিকে ভেঙে পড়া পুলিশি ব্যবস্থায় কেউ কাউকে মানতে চাচ্ছেন না। তৈরি হয়েছে নানা গ্রুপ। গত ১৫ বছরে যারা পদোন্নতি পাননি ও চাকরিচ্যুত হয়েছেন, তারাও এখন একজোট হয়েছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ফেরেনি থানাগুলোর কার্যক্রম।
এদিকে বারবার অনুরোধ করার পরও রবিবার পর্যন্ত কাজে যোগ দেয়নি পুলিশের বেশির ভাগ ইউনিট ও থানার সদস্যরা। এরই প্রেক্ষিতে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে পুলিশ সদস্যদের কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ দেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গার্ড অব অনার শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এই নির্দেশ দেন তিনি।
পুলিশদের উদ্দেশে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘যারা বৃহস্পতিবারের মধ্যে যোগদান করবেন না, আমরা বুঝব তারা চাকরিতে যোগদানে আর ইচ্ছুক নন। এ বিষয় র্যাবের মহাপরিচালক, আইজিপি, ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।’
সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনে ঢাকাসহ সারা দেশে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের পর পুলিশের চেইন অব কমান্ড নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। পুলিশ সদস্যরা চাচ্ছেন যারা অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত হয়েছেন, তাদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হোক। আবার যারা মহাজোট সরকারের আমলে পদোন্নতি পাননি, তারাও একজোট হয়েছেন।
শুক্রবার রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ময়নুল ইসলামের সঙ্গে আলোচনার সময় তারা এ কথা জানান। এ সময় আইজিপি তাদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নানামুখী জটিল সমস্যার সম্মুখীন। এই জটিলতা নিরসন করতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। সিনিয়র কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন সরকার এলেই এমন জটিলতা তৈরি হয়। কিন্তু এবার পুলিশের জটিলতা একটু ভিন্ন। তারা মাঠপর্যায়ের পুলিশের দাবি-দাওয়া, দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনছেন। তারা আশা করছেন, দ্রুতই সংকট কেটে যাবে।
সারা দেশের সর্বমোট ৬৩৯টি থানার মধ্যে ৫৯৯টির কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে রবিবার পুলিশ সদরদপ্তর জানিয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন মেট্রোপলিটনের ১১০টি থানার মধ্যে ৯৭টি এবং জেলার ৫২৯টি থানার মধ্যে ৫০২টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, বাকিগুলোর কাজ দ্রুতই শুরু করা সম্ভব হবে। থানা কার্যক্রমে পুলিশকে সেনাবাহিনী ও আনসার সদস্যরা সহযোগিতা করবেন।
পুলিশ সদরদপ্তরের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর সরকারের পক্ষে থাকা পুলিশের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ কারণে সরকার পতনের পর থানাগুলো থেকে জীবন বাঁচাতে তারা নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। আবার কেউ কেউ জনরোষে পড়ার ভয়ে ইউনিফর্ম পরে বের হতে চাচ্ছেন না। তাদের শঙ্কা ও ভয় কাটছে না। যেসব পুলিশ কর্মকর্তার কারণে পুলিশ বাহিনী বিতর্কিত হয়েছে, তাদের অপসারণের দাবিতে ঢাকার রাজারবাগসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করছেন বিক্ষুব্ধ পুলিশ সদস্যরা।
তারা বর্তমান সরকারকে ১১ দফা দাবি দিয়েছেন। ১১ দফা দাবি হচ্ছে, ৮ ঘণ্টার বেশি ডিউটি দেওয়া যাবে না, দ্রুত পদোন্নতির ব্যবস্থা, বছরে ছুটি ২০ দিন থেকে বাড়িয়ে ৬০ দিন করা, কনস্টেবলদের সোর্স মানি দেওয়া, টিএ বিল প্রদান, ঝুঁকিভাতা বৃদ্ধি, পুলিশ সদস্যদের নিজ নিজ রেঞ্জে বদলি করা, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যেসব পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন, সেসব বিচারের আওতায় আনা, পুলিশকে নিরপেক্ষ রাখা, এমপি ও মন্ত্রীদের প্রটোকল না দেওয়া ইত্যাদি। এসব দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আশ্বাস প্রদান করেছে।
মহাজোট সরকারের সময়ে চাকরি হারানো এবং জোরপূর্বক ওএসডি হওয়া পুলিশ সদস্যরা চাকরি ফেরত চান। তাদের দাবি না মানা হলে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। শনিবার দুপুরে রাজধানীর ফুলবাড়ীয়া পুলিশ সদরদপ্তরের সামনে ভুক্তভোগীরা মানববন্ধন করেন। সেখানে তারা এ দাবি জানান।
ভুক্তভোগী পুলিশ সদস্যরা বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন কারণে নানাভাবে তাদের হয়রানি করে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। কেউ ফেসবুকে কোনো পোস্ট দেওয়ার কারণে চাকরিচ্যুত হয়েছেন, কেউবা কোনো পোস্টে কমেন্ট করে চাকরি হারিয়েছেন। কারণ ছাড়াও বিভিন্ন জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ক এসআই তৌহিদ বলেন, অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে মাদক সেবনের অভিযোগ তুলে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আমাদের সঙ্গে বৈষম্য করা হয়েছে। আমরা এই বৈষম্য চাই না। আমরা চাই জনগণের পুলিশ হয়ে কাজ করতে। জনগণের পুলিশ হয়ে কাজ করছিলাম বলেই আমাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।’
শনিবার দুপুর ১টার পর মানববন্ধন কর্মসূচি শুরু হলে তাদেরকে পুলিশ সদরদপ্তরে ডেকে পাঠান নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম। আন্দোলনরতদের ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল পুলিশ সদর দপ্তরে প্রবেশ করেন। এ সময় মানববন্ধন সাময়িক স্থগিত করা হয়। তবে দাবি আদায় না হলে তারা কঠোর আন্দোলন করবেন বলে জানান।
থানার কার্যক্রম পুনরুদ্ধার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রবিবার পুলিশ সদরদপ্তরের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বলা হয়, থানার কার্যক্রম পুনরুদ্ধার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রতিটি থানা এলাকায় নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠনের জন্য পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স হতে সকল জেলা পুলিশ সুপার ও থানার ওসিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কমিটির প্রধান লক্ষ্য হবে আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো। এ লক্ষ্যে কমিটি একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করে মনিটরিং ও মূল্যায়নের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। কমিটির আওতাধীন এলাকার আইনশৃঙ্খলা পুনঃস্থাপনের লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও কমিটির সদস্যদের সমন্বয়ে যৌথ টহল প্রদানের মাধ্যমে হানাহানি, চুরি-ডাকাতি ও ছিনতাই প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এলাকায় বিদ্যমান সামাজিক সংঘাত যথা বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি নিরসনে নিবিড় ব্যক্তিগত যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্থানীয় জনসাধারণের জীবন, সম্পদ, স্থাপনা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাসনালয়সহ এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা নিয়মিত তদারকি করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এলাকার মাদক, ইভটিজিং ইত্যাদি সমস্যা নিরসনে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কমিটি। এ ছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন ধর্মীয় রাজনৈতিক দলসমূহ ও দল-উপদলের মধ্যে বিরাজমান উত্তেজনা নিরসন ও সম্প্রীতি স্থাপনের লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
স্থানীয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কবৃন্দ কমিটির আকার নির্ধারণ করবেন। গ্রহণযোগ্য আইনজীবী-বিচারক, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা, সিনিয়র সিটিজেন, সর্বজন সমাদৃত স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা, স্থানীয় জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনের সভাপতি-সেক্রেটারি, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, মানবাধিকারকর্মী, নারী অধিকারকর্মী এবং এনজিও প্রতিনিধিরা কমিটির সদস্য হবেন।
(ঢাকাটাইমস/১১আগস্ট/কেএ/এসআইএস)