সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক এই বাংলাদেশ
স্মরণকালের সীমাহীন নৈরাজ্য, প্রায় ছয়শ লোকের প্রাণহানি ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পরে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি একটু একটু করে স্বাভাবিকতার পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছে। আত্মরক্ষার্থে পালিয়ে যাওয়া পুলিশ সদস্যরাও সকলে এখন যার যার কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। এজন্য দেশের থানাগুলোতে সীমিত আকারে হলেও থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দেশের থানাগুলোতে স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হওয়াতেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছে সকলে। দুঃখজনক বিষয় যে- যারা দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দায়িত্বে নিয়োজিত তারাই ব্যাপক নৈরাজ্য ও সহিংসতার মুখে একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছিল। এক সময় তাদের জীবন রক্ষার তাগিদে তারা থানা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে সরে যায়। এরপর দেশের ভিতর যে হত্যা, লুটতরাজ ও হানাহানি শুরু হয় তা অকল্পনীয়। দুর্বৃত্তরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছে, বিরোধীপক্ষের লোকজনের ওপর আক্রমণ করেছে, হত্যা করেছে এবং তাদের বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ লুট করেছে। এমন অরাজগতা ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ বাংলাদেশে কখনো এর আগে দেখা যায়নি। গত ৫ই আগস্ট সোমবার শেখ হাসিনা সরকারের ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান ঘটে যাওয়ার পরে ঠিক এক সপ্তাহেরও বেশি সময় পরে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সকল পরিষেবার ক্ষেত্রগুলোতে স্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখা যেতে শুরু করেছে। দেশের সকল থানা সীমিত পরিসরে হলেও চালু হওয়াতে বলা যায় জনমনে এক ধরনের স্বস্তি ফিরে এসেছে। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে পুলিশের মহাপরিদর্শক মইনুল ইসলাম বলেছেন- গত কয়েকদিনের মারাত্মক সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৪২ জন পুলিশ সদস্যের নির্মম মৃত্যু ঘটেছে। এছাড়া আহত হয়েছে কয়েকশত পুলিশ সদস্য।
ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে ফলেই বাংলাদেশে আরো একবার ক্ষমতার পালাবদল ঘটতে দেখলো সবাই। না, কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে নয়। মাসাধিককালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং এ আন্দোলনের দ্বিতীয়ার্ধে সর্বস্তরের জনতার সমর্থন ও অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার পতন ঘটে। প্রায় দেড়যুগের আওয়ামী শাসনে বাংলার মানুষ কেন এতটা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল তা রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তকদের অনুসন্ধানের বিষয় হলেও মোটা দাগে দৃশ্যমান কিছু বিষয় সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি। নজিরবিহীন দলীয়করণের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের বিষয়টি সাধারণ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের হতাশ করে তুলেছিল। সামরিক, আধা-সামরিক ও সিভিল প্রশাসনে নজিরবিহীন দলীয়করণের ফলে প্রশাসনের একটি বড়ো অংশের মধ্যে তিলে তিলে ক্ষোভ ও হতাশা দানা বেঁধেছিল। সরকার সমর্থিত আমলা ও দলীয় নেতাকর্মীদের দুর্নীতি ও লুটপাট, দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি, সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনে দলের ভেতরে বিভক্তি, ডামি প্রার্থী দিয়ে বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠান, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ক্ষমতার দম্ভ, বিরোধীপক্ষকে দমনপীড়ন- এসব বিষয় সাধারণ মানুষকে এতটাই হতাশ করে তুলেছিল যে, তারা আর সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকতে পারেনি।
গত ৫ই আগস্ট হাসিনা সরকারের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতন ঘটে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা। পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু পালিয়ে জীবন রক্ষা করতে পারতেন। তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা তাঁকে সে ধরনের অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পালিয়ে যাননি। দুর্বৃত্তদের বুলেটের মুখে বুক পেতে দিয়েছিলেন। শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের মাটিতেই আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। এরশাদও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। বেগম খালেদা জিয়াও যাননি। বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে পাঁচ দশকের ইতিহাসে শেখ হাসিনাই একমাত্র সরকারপ্রধান যিনি তাঁর নেতা-কর্মীদের অরক্ষিত রেখে নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে গেলেন। একটানা প্রায় দেড়যুগ ক্ষমতাসীন থেকে তিনি ক্ষমতার দম্ভ যতটা দেখিয়েছেন ততটা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন যতটা করেছেন তার সমান্তরালে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে পারেননি। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ছিল নজিরবিহীন।
সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট একটি শ্রেণি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে দেশে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের ওপর নানা ধরনের করের বোঝা চাপানো হয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে বার বার। বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ানো হলেও পরবর্তী সময়ে কখনো বিশ্ববাজার অনুসারে দাম কমানো হয়নি। আমদানিকারক সিন্ডিকেট ও নানা ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি ভোক্তাগণ দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। অন্যদিকে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট এক শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, সরকার সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাস বুঝতে পারেনি। মিডিয়াসহ সকল শ্রেণি-পেশার ভেতরে সরকারের স্তাবকের সংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়ে গিয়েছিল। এই স্তাবকেরা সরকারকে জনগণের পাল্স বুঝতে দেয়নি।
সরকারের ভেতরেও ছিল স্তাবক, যারা বিপদ বুঝে কেটে পড়েছে। এতদিন ক্ষমতায় থেকে স্তাবকদের চিনতে না পারা শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড়ো ব্যর্থতা। তিনি তো দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোভাবে চিনতেন বলেই মনে করি। কিন্তু তিনি দেশে পরিবারতন্ত্র কায়েম করে এমন একটি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী গোষ্ঠী তৈরি করতে চেয়েছিলেন যারা তাঁর রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠবে। হয়েও উঠেছিলেন। কিন্তু দেশের মানুষ এই পরিবারতন্ত্র গ্রহণ করেনি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে কোনো নেতার মৃত্যুর পর তাঁর সন্তানকে কিংবা রাজনৈতিকভাবে অনভিজ্ঞ তাঁর স্ত্রীকে মনোনয়ন দিয়ে জনপ্রতিনিধি বানানো হয়েছে। ত্যাগী নেতারা বঞ্চিত হয়েছে। এই মেরুকরণ এক ধরনের রাজনৈতিক অপকৌশল।
শেখ হসিনা সরকার অনুধাবন করতে মোটেও সক্ষম হয়নি যে- ছাত্র-জনতার এই গণঅভ্যুত্থানকে লৌহমানব খ্যাত আইয়ুব খানও দমাতে পারেনি। ইয়াহিয়া খান দমাতে পারেনি। বস্তুত কোনো স্বৈরশাসকই দমাতে পারে না। কিন্তু শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার স্বতস্ফূর্ত অভ্যুত্থানকে দমন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হলেন। তিনি ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষাগ্রহণ করলেন না। শত শত ছাত্র-জনতার রক্তে রঞ্জিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের সংবাদ প্রকাশ হলে দেশের সিংহভাগ মানুষকে যেভাবে দলে দলে রাস্তায় নেমে এসে উল্লাস করতে দেখা গেছে তা অভাবনীয়। এই ঘটনায় বোঝা গেছে দেশের মানুষ দীর্ঘদিনের আওয়ামী শাসনে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। আওয়ামী লীগ সরকার দেশে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিল এবং সেসবের সুফল দেশের মানুষ আজীবন ভোগ করছে এবং করবে। কিন্তু দেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে, বিরোধীপক্ষকে দমন-পীড়ন করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রক্রিয়াকে সাধারণ মানুষ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি।
শেখ হাসিনার এই পতন দেশের মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই উচ্ছ্বাস এক দিনেই অনেকটা থেমে গেছে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে গণভবন ও সংসদ ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ও সরকারের এমপি-মন্ত্রীদের বাসায় ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হলেও এ তৎপরতা বেশিদূর এগোয়নি। আন্দোলনকারীরাই আবার সবকিছু ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে। সবকিছু পরিষ্কার করার জন্য মাঠে নেমে পড়েছে।
সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর ও উপাসনালয় রক্ষায় নিয়োজিত হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ বাহিনী আত্মগোপনে চলে যাওয়ার প্রেক্ষিতে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকেই থানা রক্ষা ও ট্রাফিক কন্ট্রোলের কাজে লেগে যেতে দেখা গেছে। যদিও এখন সবকিছুই স্বাভাবিকতার পথ ধরেই হাঁটছে। বিএনপি নেতাদের বক্তব্যেও দায়িত্বশীলতায় পরিচয় পাওয়া গেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফসল হয়তো ভবিষ্যতে বিএনপি-জামাতের ঘরেই উঠবে। ফলে বিএনপি-জামাতের কর্মীদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে সবাইকে ধৈর্যধারণ করার যে আহ্বান সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আগামীদিনেও বিএনপির এই সংযম দেখতে চায় দেশবাসী। দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করলেও সে দলের গোলামি করতে চায় না।
বলার অপেক্ষা রাখে না- পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্র পরিচালনাকারী শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার মিলিত গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়ানক অবনতি ঘটেছিল যা পর্যায়ক্রমে এখন মেরামত হচ্ছে। প্রায় এক মাসের ছাত্র ও গণ-আন্দোলনে যে নৈরাজ্য ও সহিংসতাপূর্ণ নাশকতা চলেছে তাতে প্রায় ছয়শ মানুষের মৃত্যু ছাড়াও ৪২ পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা। আক্রমণ হয়েছে আওয়ামী লীগ অফিস ও নেতাদের বাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। এসব জায়গায় অগ্নিসংযোগ করে অনেককে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। লুটতরাজ করে তাদের সহায়-সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এসব পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক করা প্রয়োজন।
এতটা নৈরাজ্য, সহিংসতা ও হানাহানি কখনোই এর আগে দেখেনি আমজনতা। দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সুযোগে এখনো রাজধানীসহ দেশের অনেক জায়গায় সাধারণ নাগরিকদেরই পাহাড়া দিতে হচ্ছে। এখন প্রয়োজন প্রধান উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে যে প্রতিশ্রুতির কথা বলেছেন তা বাস্তবায়ন করে দেশের সার্বিক পরিবেশ সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক করা।মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন: কলাম লেখক ও সাবেক কলেজ শিক্ষক