আন্দোলন দমাতে স্নাইপার নামান জিয়া! আয়নাঘরও তার কাণ্ড!

প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০২৪, ০৮:৩১ | আপডেট: ১৬ আগস্ট ২০২৪, ১৫:২০

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৪২০ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন একটি কিশোর। তার দুই পায়ে দুটি গুলি। মিরপুরে বাসায় ফিরতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয় সে।

মিরপুরেই এক ব্যক্তি বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন একটু ঘোরাফেরা করবেন বলে। রাস্তায় দাঁড়াতেই হঠাৎ কোত্থেকে এসে গুলি লাগে তার পায়ে। আশপাশে তখন কোনো সংঘর্ষ ছিল না।

আবার মিছিলের পেছনে, আশপাশে অবস্থান করা, এমনকি বাসার বারান্দা কিংবা ভেতরে আহত-নিহত হয়েছে কেউ কেউ, এমন ঘটনা অনেক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিশেষ করে ১৭ জুলাই থেকে এ ধরনের ঘটনা আকছার ঘটেছে। আহত-নিহতের তালিকায় আছেন শিশু-কিশোর থেকে মধ্যবয়সী মানুষ।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের সন্দেহ, আন্দোলন দমাতে এবং মানুষের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করতে স্নাইপার ব্যবহার করা হয়েছে। এ জন্য হতাহতের সংখ্যা বেশি। উচ্চ প্রশিক্ষিত এবং নিখুঁত লক্ষ্যভেদী স্নাইপার মাঠে নামানোর বিষয়ে সন্দেহের তীর মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের দিকে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে জিয়ার বিরুদ্ধে। সেনাবাহিনী, র‌্যাব. এনএসআই হয়ে সর্বশেষ তিনি ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালকের (ডিজি) দায়িত্বে ছিলেন। সব জায়গায় তার প্রধান কাজ ছিল সরকারবিরোধীদের নজরদারিতে রাখা এবং ‘শায়েস্তা’ করা।

জিয়ার জন্যই প্রথমবারের মতো এনটিএমসির ‘মহাপরিচালক’পদটি সৃষ্টি করা হয় বলে জানা যায়। এনটিএমসি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ইন্টারসেপশন সহায়তা দিয়ে থাকে। এনটিএমসির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, তদন্তকারী সংস্থাসহ ৩০টি সংস্থা সরাসরি সংযুক্ত। বৈষম্যবিরোধী ছা্ত্র আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তে দেশে ইন্টারনেট বন্ধে এই সংস্থার প্রধান জিয়াউল আহসানের ভূমিকা রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।

সরকারের ভিন্নমতাবলম্বী দমনের সব ধরনের পন্থা ব্যবহার করেন জিয়াউল আহসান। বহুল আলোচিত আয়নাঘরের মূল কারিগরও ধরা হয় তাকে। সরকারবিরোধীদের ধরে এনে এখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো দিনের পর দিন। সিলেটের বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান রহস্যের সঙ্গে তার নাম এসেছে বারবার। এ হেন জিয়াউল আহসান সরকারবিরোধী প্রবল আন্দোলন দমনে স্নাইপার ব্যবহার করবেন, এমনটা অস্বাভাবিক নয়- বলছেন বিশ্লেষকরা।

ফোনে আড়ি পেতে কাউকে সন্দেহজনক মনে হলেই তুলে নিয়ে যেতেন, এমন অভিযোগ এন্তার তার বিরুদ্ধে। র‌্যাবের পরিচালক থাকার সময় নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছিল। পরে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। আইন বহির্ভূত হত্যা ও কর্মকাণ্ডের বহু অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। কিন্তু তার সব কাজ সরকারের আনুকূল্যে হয়েছে বলে নির্বিবাদে তা চালিয়ে গেছেন জিয়া।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের একটি পোস্টে এই জিয়াউল আহসানকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান দেশের জনপ্রিয় নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। কারণ হিসেবে ‘কয়টা কথা নিয়ে বিনীত এই নিবেদন’শিরোনামে স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, ‘কুখ্যাত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে অবিলম্বে তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে গ্রেপ্তার করা হোক। বাংলাদেশে গুম-খুনের আসল কারিগর শুধু না, ফোন ট্যাপিংয়ের নামে মানুষের প্রাইভেসি ধ্বংস করেছে সে। এবং প্রাউডলি সেই সব রেকর্ডিং এই পারভার্ট লোকটা মিডিয়াতে সরবরাহ করতো…।’

সরকারের জন্য গুরুতর বিপদ হতে পারে এমন ব্যক্তি ও কাজ দমনে অন্য কেউ সাহস না দেখালে, সেগুলো অবলীলায় করতেন জিয়াউল আহসান। এ জন্য তার চাহিদামতো সবকিছুর ব্যবস্থা করত সরকার।

গত ১৫ বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার গোয়েন্দা-নজরদারি যন্ত্র, হত্যা-গুম ও নির্যাতনে ব্যবহারের সরঞ্জাম কেনা হয়েছে বলে একটি সূত্র জানায়। বেশির ভাগ কেনা হয়েছে সরাসরি। এমনও বহু ইকুইপমেন্ট কেনা হয়েছে, যা কখনো ব্যবহার করা হয়নি। লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয় যথেচ্ছভাবে, প্রয়োজনের কয়েক গুণ বেশি। এই সব আয়োজনই ছিল বিরোধীদের গুম-খুনের কাজে ব্যবহারের জন্য।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন এবং আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, সব গুম-খুনের বিচার করা হবে। ইতিমধ্যে গুম-খুনের প্রধান হোতা জিয়াউল আহসানকে আটকের তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৭ আগস্ট ভোররাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এমিরেটসের একটি বিমানে পালাচ্ছিলেন জিয়া। বিমানটি রানওয়ে থেকে বোর্ডিং ব্রিজে ফিরিয়ে এনে তাকে নামিয়ে আনেন ডিজিএফআই সদস্যরা। পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা সেনানিবাসে।

এর আগে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরদিন মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করা জিয়াউল আহসান একজন প্রশিক্ষিত কমান্ডো ও প্যারাট্রুপার। ২০০৯ সালের ৫ মার্চ র‌্যাব-২ এর উপ-অধিনায়ক এবং একই বছর লে. কর্নেল র্যািঙ্কে পদোন্নতি পেয়ে র‌্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক হন। 

২০১৩ সালের ডিসেম্বর তিনি কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান। পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ২০১৬ সালের এপ্রিলে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা পরিদপ্তরে (এনএসআই) পরিচালক হন। পরের বছরের মার্চে তাকে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) পরিচালক করে সরকার।

২০২২ সালের জুলাই মাসে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থেকে মেজর জেনারেলে পদোন্নতি পান জিয়াউল আহসান। ২১ জুলাই তাকে এনটিএমসির মহাপরিচালকের দায়িত্ব দিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়।

(ঢাকাটাইমস/১৫আগস্ট/মোআ)