সমাজের উন্নয়নে প্রযুক্তির ব্যবহারে প্রয়োজন পেশাজীবীদের অগ্রণী ভূমিকা

প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০২৪, ১১:০৩ | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ১১:১০

প্রকৌশলী মো. মুশফিকুর রহমান

বাংলাদেশ বর্তমানে ব্লকচেইন, আইওটি, ক্লাউড কম্পিউটিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো উদীয়মান প্রযুক্তিগুলিকে গ্রহণের দিকে মনোনিবেশ করেছে। এই প্রযুক্তিগত অগ্রগতি দেশকে চতুর্থ ও পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের দিকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে। এই নতুন প্রযুক্তিগুলি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি গ্রাহক সেবা উন্নত করে লাভ বৃদ্ধি করতে পারে, আর সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলি নাগরিক সেবা বিস্তার করে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
উদীয়মান প্রযুক্তি শুধু অর্থনীতিই নয়, সমাজের সব ক্ষেত্রেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং জনসুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিকে এই প্রযুক্তি আরও দক্ষ ও নিরাপদ করে তুলতে পারে। বাংলাদেশে অনেক আইটি প্রতিষ্ঠান আছে যারা বিদেশি প্রযুক্তি কোম্পানির সাথে কাজ করে। তারা প্রাক-নির্ধারিত সফ্টওয়্যার এবং হার্ডওয়্যার বিক্রি করে। কিন্তু দেশীয়ভাবে ব্যবসায়িক সফ্টওয়্যার তৈরির ক্ষেত্রে একটি বড়ো ফাঁক রয়ে গেছে। এর ফলে, এই ধরনের সফ্টওয়্যারের জন্য প্রায়ই বিদেশি বিশেষজ্ঞদের উপর নির্ভর করতে হয়।
বিশেষ ধরনের ব্যবসায়িক অ্যাপ্লিকেশন সফ্টওয়্যার বাস্তবায়নের জন্য বহিরাগত বিশেষজ্ঞদের উপর নির্ভরতা বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ এবং অর্থ অপচয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের আইসিটি উদ্যোক্তা ও পেশাদারদের বর্তমান দক্ষতা এবং অঙ্গীকার উদীয়মান প্রযুক্তি গ্রহণের জন্য সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং অপটিমাইজড নাও হতে পারে। এছাড়াও, বিস্তৃত আইসিটি পেশাদার ল্যান্ডস্কেপের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। যদিও এই শিল্পে প্রোগ্রামার, নেটওয়ার্ক অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, ডাটাবেস অ্যাডমিনিস্ট্রেটর এবং সাইবার সিকিউরিটি পেশাদারদের মতো ভূমিকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অভ্যাসকারী রয়েছে, তবে তাদের বেশিরভাগ (সম্ভবত ৯৯% এর বেশি) প্রধানত কনফিগারেশন-এর মতো প্রশাসনিক কাজে মনোনিবেশ করতে পারে। এটি সম্ভাব্যভাবে তাদেরকে স্বাধীন উদ্ভাবকের চেয়ে প্রাক-নির্মিত সমাধানের বাস্তবায়নকারী হিসেবে অবস্থান করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, তাদের ভূমিকা স্থানীয় আইসিটি বিক্রেতাদের ছাতাধারী বহুজাতিক কোম্পানি দ্বারা উন্নত সমাধানগুলি প্রচারকারী বিক্রয় এজেন্টের মতোও হতে পারে।
চাকরির বাজারের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির কারণে শিক্ষা ব্যবস্থায় কৌশলগত পুনর্গঠন প্রয়োজন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) শিক্ষার জন্য বরাদ্দ বাজেট তথ্যভিত্তিক হওয়া উচিত, যা বর্তমান এবং প্রাক্কলিত শিল্পের চাকরির ভূমিকার একটি বিস্তারিত বিশ্লেষণ দ্বারা পরিচালিত হবে। এই বিশ্লেষণ লক্ষ্যবদ্ধ বৃত্তি প্রোগ্রাম এবং নির্দিষ্ট আইসিটি ক্ষেত্রে বিনিয়োগের বিকাশকে গাইড করবে।
এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে দায়বদ্ধতার অনুভূতি তৈরি করে, যারা এই সরকারি বিনিয়োগের বিনিময়ে পেশা এবং শিল্পে অর্থপূর্ণ অবদান রাখার প্রত্যাশা করে। 
আমাদের দেশের তরুণদেরকে তিনটি মূল ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত:
 

১. নতুন উদ্ভাবক / গবেষক:

এমন কিছু শিখানো যাবে যাতে তারা নতুন নতুন আইডিয়া বের করতে পারে এবং সেগুলোকে বাস্তবায়ন করতে পারে। যেমন, নতুন সফটওয়্যার বানানো, নতুন ধরনের অ্যাপ তৈরি করা।
 

২. উদ্যোক্তা:

নিজস্ব ব্যবসা শুরু করার জন্য তাদের প্রস্তুত করা। তারা যাতে নতুন আইডিয়া নিয়ে ব্যবসা করতে পারে এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে।
 

৩. দক্ষ কর্মী:

বড়ো কোম্পানিগুলোতে কাজ করার জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। যেমন, কম্পিউটারের বিভিন্ন কাজ করা, নেটওয়ার্ক ম্যানেজ করা।

এই তিন ধরনের প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশ্য:
 

১) দেশের উন্নয়ন: নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়া।
 

২) বেকারত্ব দূর করা: তরুণদেরকে দক্ষ করে তৈরি করে তাদের চাকরি দেওয়া।
 

৩) দেশের অর্থনীতি মজবুত করা: নতুন ব্যবসা তৈরি করে দেশের আয় বাড়ানো।
এই প্রশিক্ষণের জন্য কিছু শর্তও থাকবে:
 

১) দায়িত্ব: যারা এই প্রশিক্ষণ পাবে, তাদের দেশের জন্য কিছু করার দায়িত্ব নিতে হবে।
 

২) ফলাফল: প্রশিক্ষণের পরে তাদেরকে দেখাতে হবে যে তারা কিছু করেছেন। যেমন, কোনো নতুন সফটওয়্যার বানিয়েছেন, কোনো নতুন ব্যবসা শুরু করেছেন।
 

৩) অর্থের অপচয় রোধ: যারা প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবেন, তাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে যে তারা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন।
আধুনিক প্রযুক্তির কথা বলতে গিয়ে আমরা যখন খুব জটিল শব্দ ব্যবহার করি, তখন সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। তারা ভাবতে পারে যে এই কাজগুলি খুব সহজে করা যাবে এবং অনেক টাকা আয় করা যাবে। কিন্তু আসলে এটি খুব কঠিন কাজ। যখন এই ধরনের প্রকল্প ব্যর্থ হয়, তখন অনেক লোক তাদের টাকা নিয়ে দেশের বাইরে চলে যায়। এতে করে আমাদের দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আমাদের সরকার এই সমস্যা সমাধানের জন্য অনেক চেষ্টা করছে। তারা মানুষকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, নতুন নতুন প্রকল্প শুরু করছে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছু মানুষ এই সুযোগগুলোকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ চালাচ্ছে। তারা এই প্রকল্পগুলোকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করে। 
তাই আমাদের সবাইকে মিলে এই সমস্যা সমাধান করতে হবে। আমাদের দেশের উন্নতির জন্য কাজ করতে হবে।
আমরা যখন কোনো নতুন সফ্টওয়্যার ব্যবহার করতে চাই, তখন অনেক সময় আমরা বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিই। এটা দেখিয়ে দেয় যে আমরা নিজের দেশের মানুষকে এই কাজে দক্ষ করার চেষ্টা করছি না। হয়তো আমরা সহজে টাকা আয় করতে চাই বা সহজে জনপ্রিয় হতে চাই, তাই এই কাজগুলো অন্যকে দিয়ে করাই। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। আমরা যদি ছাত্রছাত্রীদের এই কাজে প্রশিক্ষণ দিই, তাহলে আমাদের দেশের অনেক টাকা বাঁচবে এবং আমরা দীর্ঘকালের জন্য উপকৃত হব।
 

মানবসম্পদের অপচয় এবং উন্নয়নের বাধা:
অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ:

শিক্ষা ও ব্যবসায়িক অবকাঠামোতে সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ যথেষ্ট হলেও, এর ফলে দক্ষ দেশীয় জনশক্তি উন্নয়নে সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। এটি জাতীয় উৎপাদনশীলতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হারানোর সমান।
 

সীমিত উচ্চমূল্যের প্রবাসী আয়: আমাদের দেশে বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় হলেও, এর বেশিরভাগ অংশ কম দক্ষ শ্রমিকদের কাছ থেকে আসে। দক্ষ জনশক্তিকে দেশে রেখে এবং আরও দক্ষ জনশক্তি আকৃষ্ট করে এই প্রবাসী আয়কে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো সম্ভব।
 

প্রস্তাবিত সমাধান:

১) বিনিয়োগের কার্যকারিতা মূল্যায়ন: শিক্ষা ও অবকাঠামোতে বিনিয়োগের ফলে দক্ষ জনশক্তি উন্নয়নে কতটা সফলতা পাওয়া গেছে, তা মূল্যায়ন করা।
 

২) বাজার-উন্মুখ শিক্ষাক্রম: শিক্ষাক্রমকে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সংস্কার করে শিক্ষার্থীদের বাস্তবজীবনের জন্য প্রস্তুত করা।
 

৩) দেশপ্রেম জাগরণ ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ: দক্ষ জনশক্তিকে দেশের জন্য কাজ করতে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রতিযোগিতামূলক বেতন, উদ্ভাবনী পরিবেশ এবং জাতীয়তাবোধ জাগরণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষার সুযোগপ্রাপ্ত ছাত্রছাত্রী ও নাগরিকদের তাদের শিক্ষার জন্য রাষ্ট্র যে ব্যয় করেছে তা তাদের কর্মস্থলে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্র ও জনগণকে ফেরত দেওয়ার এবং রাষ্ট্রের উন্নয়নে কাজ করার মানসিকতার পরিচয় দিতে হবে এবং জবাবদিহিতা থাকতে হবে । 

প্রকৌশলী মো. মুশফিকুর রহমান: প্রধান তথ্যপ্রযুক্তি কর্মকর্তা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি; সদস্য সচিব, সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা বিষয়ক জাতীয় কমিটি (এনসিসিএ)