মানসিক রোগ থেকে মুক্তি পেতে যা করবেন
একজন মানুষ পুরোপুরি তখনই সুস্থ, যখন তার শরীর ও মন দুটোই পরিপূর্ণভাবে সুস্থ থাকে। কিন্তু অনেক সময় আমাদের শরীর সুস্থ থাকলেও পারিপার্শ্বিক অবস্থা, দীর্ঘদিন মানসিক অস্থিরতা এবং সুস্থ, স্বাভাবিক আচার-ব্যবহার পরিপন্থী জীবনযাপন করার ফলে মানসিক সুস্থতা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এ চাপ দীর্ঘসময় বয়ে বেড়ালে বিষণ্নতা, হৃদরোগ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের মতো বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগ সঙ্গী হতে পারে। দেখা দিতে পারে বড় ধরনের মানসিক রোগও।
বিশেষজ্ঞদের মতে মূলত কয়েকটি কারণে মানসিক রোগের সৃষ্টি হতে পারে। সেগুলো হলো জেনেটিক বা বংশগত প্রভাব, পরিবেশগত প্রভাব, শারীরিক ও মানসিক যৌন-নির্যাতন, অস্বাভাবিকভাবে শিশুর লালন-পালন, দীর্ঘমেয়াদী অস্বাভাবিক চাপ, ইন্টারনেটসহ অন্যান্য নেশা দ্রব্যের প্রতি অধিক আগ্রহ, মস্তিষ্কের গঠন জনিত সমস্যা, নিউরো ট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতা, কিডনি, যকৃত, দীর্ঘমেয়াদী ঘুমের অভাব। এছাড়া মৃগীরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিকস্, মাথায় আঘাত, ব্রেইন টিউমার, হৃদপিণ্ডের ফেইলিয়রও মানসিক রোগের কারণ হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যখন কোনো ব্যক্তির আচরণের বড় ধরনের ও লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায়, বিশেষ করে আবেগ প্রকাশে পরিবর্তন আসে এবং সেটা দৈনন্দিন কর্মকান্ডে প্রভাব ফেলে তখন বুঝতে হবে সেই ব্যক্তি মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ। বিশেষজ্ঞরা মানসিক রোগের কিছু লক্ষণ উল্লেখ করেছেন।
হঠাৎ করে কারণ ছাড়াই উত্তেজিত হয়ে ওঠা। অন্যদের সঙ্গ এড়িয়ে চলা। সবার সাথে ঝগড়া বা বাগবিতন্ডায় জড়ানো। অনেকদিন যাবত নিজেকে সবার থেকে গুটিয়ে রাখা। টানা ১৪ দিনের বেশি সময় ধরে বিষন্নতায় ভোগা। বিনা কারণে অন্যদেরকে সন্দেহ করা। গোসল করা, দাঁত ব্রাশ করার মতো নিয়মিত কাজে গাফিলতি করা। নিজের প্রতি উদাসীন থাকা এবং শারীরিক যত্ন না নেওয়া। পূর্বে ভালো লাগতো এমন কর্মকান্ডে আগ্রহ কমে যাওয়া। খাবারে অরুচি তৈরি হওয়া। অতিরিক্ত শুচিবায়ুগ্রস্থ হয়ে ওঠা। সামাজিক সম্পর্ক থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখা। পেশাগত কাজের প্রতি অনীহা তৈরি হওয়া। সময়মতো না ঘুমানো এবং ঘুমের পরিমাণ কমে যাওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া।
শারীরিক ও মানসিক রোগ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য এক ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বলে। এটি মানুষের জৈবিক গঠন, মানসিক গঠন ও সামগ্রিক মনোদৈহিক প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। অন্যান্য রোগের মতো মানসিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর বেশ কতগুলো কার্যকরী উপায় আছে। সেগুলো হলো:
পরিস্থিতি এড়িয়ে না যাওয়া
মানুষের জীবনে কখনো কোনো ধরনের অপ্রীতিকর, কষ্টদায়ক পরিস্থিতি তৈরি হলে আমরা সেটাকে এড়িয়ে যেতে চাই এবং সেখান থেকে মুক্তি পেতে চাই। কিন্তু বেশিরভাগ সময় এই ধরনের সিদ্ধান্ত মানুষের জন্য নেতিবাচক প্রভাব হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়িয়ে না গিয়ে বরং সেটাকে মোকাবিলা করে সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আগামী দিনগুলো অতিবাহিত করা উচিৎ। এতে করে নিজেদের মাঝে একটা আত্মবিশ্বাস ও আত্মতৃপ্তি পাওয়া যাবে।
পর্যাপ্ত ঘুমান
মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য ঘুম খুবই দরকারী। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থে বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই শরীর ও মন সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। এতে করে মানসিক ক্লান্তি ও বিষাদও দূর হবে। নিয়মিত সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানো মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
মানুষকে সঙ্গ দেওয়া
মানসিক চাপের কারণ নিয়ে কাছের বন্ধুর সাথে কথা বলুন। একাকিত্ব মানুষকে মানসিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। মানসিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করুন সবসময় ভালো মানুষদের সাথে থাকতে। সকলের সাথে হাসিখুশি আচরণ করলে এটা আপনাকে মানসিক তৃপ্তি দিবে এবং আপনি বিচলিত হবেন না বরং প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
মদ্যপান, ধূমপান এবং মাদক থেকে দূরে থাকুন
মদ্যপান, ধূমপান এবং মাদক এই তিনটি জিনসই শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। অনেকেই মানসিক চাপ অনুভব করলে ধূমপান করে থাকেন, তবে এই অভ্যাসটি আপনার ভালো তো করেই না বরং অনেক বেশী ক্ষতি করে ফেলে।
নিয়মিত ব্যায়াম করুন
সু-স্বাস্থ্যই সকল সুখের মুল—প্রচলিত এই কথাটি একদমই সত্য। আর শারীরিক ভাবে ভালো ও ফিট থাকার জন্য নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলুন। হতে পারে সেটা প্রতিদিন সকালে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি অথবা কোন জিমে ভর্তি হয়ে নিয়মিত ব্যায়াম করা। আপনার শরীর সব ধরনের পুষ্টি পাচ্ছে কি না সেটা নিশ্চিত করার জন্য সব ধরনের পুষ্টিকর খাবারই পরিমিতভাবে গ্রহণ করুন। যদি জিমে গিয়ে ব্যায়াম করার সময় না হয় তবে অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন। সেটিও মানসিক চাপ কমাতে কাজে দেবে।
সঠিকভাবে খান
মস্তিষ্ক স্বাস্থ্যবান থাকলে মানসিক রোগ দূরে থাকে বলেই বিজ্ঞানীদের মত। এ ক্ষেত্রে আপনাকে সহায়তা করতে পারে মস্তিষ্কের জন্য স্বাস্থ্যকর এবং ভারসাম্যপূর্ণ একটি খাদ্যাভ্যাস। আর মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো থাকলে আপনি মানসিকভাবেও সুস্থ থাকবেন। কোনো মানসিক রোগই আপনার ধারে কাছে ঘেষতে পারবে না। মানসিক চাপে থাকলে খাওয়ার প্রতি অনেকেরই অনীহা হতে পারে। মনে রাখবেন, না খেয়ে থাকা চাপকে বা সমস্যাগুলোকে কমিয়ে দেবে না বরং খাবার আপনার শরীরকে কর্মক্ষম রাখবে এবং চাপ দূর করার পদক্ষেপগুলো নিতে সাহায্য করবে। এ সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করুন। ক্যাফেইন গ্রহণ কমিয়ে দিন। সকালের নাস্তা ভালোভাবে করুন। দিনে অন্তত ছোটবড় মিলিয়ে ছয় বেলা খাবার খান। গমে রুটি, পাস্তা ইত্যাদি খান। ভিটামিন এ এবং ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খান। পাশাপাশি গ্রিন টি এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খান।
মস্তিষ্ককে স্বাস্থ্যবান রাখতে ডিম খাওয়া জরুরি কারণ এতে আছে ফলিক এসিড, বায়োটিন এবং কোলিন। এছাড়া এসব উপাদান মস্তিষ্কের কোষ এবং স্নায়ুর উন্নয়ন ঘটাতেও সহায়ক ভুমিকা পালন করে।
দই হজম প্রক্রিয়াকে স্বাস্থ্যবান রাখে। যার ফলে আমাদের মস্তিষ্কের নানা কর্মকাণ্ড ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয় বা স্বাভাবিক থাকে। বিশেষ করে আমাদের আবেগগত তৎপরতাকে প্রভাবিত করে দই। ফলে দই খেলে মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ দূরে থাকে।
ব্রকলিতে আছে মস্তিষ্কের জন্য উপকারি বেশ কয়েকটি উপাদান। এতে আছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম যা মস্তিষ্কের তৎপরতা বাড়ায় এবং মস্তিষ্কের তারুণ্য ধরে রাখে।
সবুজ শাক-সবজি খেলে স্মৃতিভ্রংশ রোগে দূরে থাকে। যারা প্রতিদিন প্রচুর এই খাবারটি খায় তাদের মানসিক ক্ষয় হয় কম। সবুজ শাক-সবজিতে থাকে ভিটামিন কে যা মস্তিষ্কের জন্য খুবই উপকারী।
বাদাম খেলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ায় এবং মানসিক রোগ দূরে রাখে। বাদামে আছে উচ্চ মাত্রার ম্যাঙ্গানিজ, সেলেনিয়াম এবং কপার।
চিয়া সিড খেলে শরীরের অবসাদ এবং এডিএইচডি এর মতো মানসিক বিশৃঙ্খলা দূরে রাখে। এই উপাদানটি মস্তিষ্ককে ভাইরাস সংক্রমণ থেকেও মুক্ত রাখে এবং কোষগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বাড়ায়। যার পরিণতিতে স্মৃতিশক্তিও বাড়ে।
মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বাড়ায় ডার্ক চকোলেট। কারণ এতে আছে কোকোয়া। যা স্মৃতিশক্তি বাড়াতেও সহায়ক। আর এতে থাকা ফ্ল্যাবোনয়েড মস্তিষ্কের তারুণ্য ধরে রাখে এবং মস্তিষ্কের মৌলিক কোনো ক্ষয় থেকে রক্ষা করে।
(ঢাকাটাইমস/৯ সেপ্টেম্বর/আরজেড)