সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য প্রয়োজন সামাজিক মূল্যবোধ

আলী রেজা
 | প্রকাশিত : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৩৯

সমাজকেন্দ্রিক রাষ্ট্র না কি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাজ- এ বিষয় নিয়ে একাডেমিক বিতর্ক হতে পারে। সামাজিক গবেষণাও করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। সামাজিক ন্যায়বিচারের অতীত ঐতিহ্য তুলে ধরে কেন এখন সামাজিক ন্যায়বিচার দুর্বল হয়ে পড়ছে এই লেখায় শুধু সে বিষয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি সমাজ বিভিন্ন জাতি-বর্ণ ও সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে কখনো কখনো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়েছে বটে; তবে সামাজিক সম্পর্ক ও সামাজিক সহযোগিতার সংস্কৃতি কখনো বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। বাঙালি জাতি এখনো সমাজকে মেনে চলে। সামাজিক সমস্যা বা সংকট নিরসনের জন্য সাধারণত সমাজের দিকেই তাকিয়ে থাকে। সামাজিক অনুমোদন পেলে একটি কাজ যত সহজে করা যায়, সামাজিক অনুমোদন বা সমর্থন না পেলে সে কাজ তত সহজে করা যায় না। সুতরাং সামাজিক বিধি বা শাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে রাষ্ট্রই সর্বেসর্বা। সমাজ সেখানে গৌণ। তাই সেখানে সামাজিক বিধিগুলো শক্তিশালী নয়। শক্তিশালী হওয়ার প্রয়োজনও পড়ে না। কারণ, রাষ্ট্রই সেখানে নাগরিকের সকল সমস্যার দেখভাল করে থাকে। কিন্তু প্রাচ্যের দেশগুলো সমাজকেন্দ্রিক বলে সমাজই রাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে কাজ করে। সমাজ শক্তিশালী বলেই রাষ্ট্র অনেক সময়ে সামাজিক আইন বা সামাজিক শাসনের অনুমোদন দেয়।

আমাদের দেশে সামাজিক শাসনের একটি ঐতিহ্য আছে। সামাজিক শাসন মেনে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা সে ঐতিহ্যেরই অংশ। বর্তমান সময়ে যেসব বিষয় নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হয় এবং মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বাদী-বিবাদী নিঃস্ব হয়ে যায়, এক সময় সেসব বিষয় সামাজিক বিচার বা সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হতো। গ্রামের মাতব্বরগণ প্রয়োজন মনে করলে কয়েক গ্রামের মাতব্বর নিয়ে সালিশে বসতেন। এ সালিশের বিচার বা শাসন মেনে নিয়ে সবাই আবার মিলেমিশে বসবাস করতো। এতে সমাজভুক্ত মানুষ মামলার হয়রানি ও মামলা খরচ থেকে রেহাই পেত। বিচার পেতেও দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হতো না। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক ন্যায়বিচারের সে সংস্কৃতি বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে সামাজিক বিচার না মেনে বেশিরভাগ মানুষ আইনের আশ্রয় নেয়। মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রিতার ফলে আদালতে মামলা-জট লেগে যায়। মামলা শুরু হলেও সহজে শেষ হয় না। এ পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টদের স্বাভাবিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

অনেক সমাজচিন্তক মনে করেন, সামাজিক ন্যায়বিচার নিরপেক্ষ না হওয়ার ফলে সামাজিক অপরাধের নিষ্পত্তির জন্য আইনের আশ্রয় নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সামাজিক শাসন দুর্বল হওয়ার ফলে আজকাল কেউ কাউকে মেনে চলছে না। সমাজপতিদের মানছে না সমাজের সাধারণ মানুষ। নেতাদের মানছে না কর্মী-সমর্থকরা। পরিবারের সদস্যরাও একে অন্যের শাসন মানছে না। শিক্ষকের উপদেশ থোরাই কেয়ার করছে শিক্ষার্থীরা। অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ ভালো মনে করে কখনো কোনো আদেশ বা উপদেশ দিলে সেসবের তোয়াক্কা করছে না কেউ। মানুষ এখন নিজেকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে গেছে যে, সমাজভুক্ত থেকেও এক ধরনের বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করছে। আত্মস্বার্থের বিষয়টি খুব বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এখন সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন শুধু মুখে মুখে। আন্তরিকতার অভাব ঘরে বাইরে- সবখানে। সামাজিক ক্ষেত্রে এখন ছোটোরা বড়োদের শাসন মেনে নেয় না। পারিবারিক ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখতে পাওয় যায়। এক সময় ভাই ভাইয়ের জন্য যেকোনো স্বার্থ ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকতো। এখন ‘আপন থেকে পর ভালো’ নীতিতে চলছে বেশিরভাগ মানুষ। এমন অনেক মানুষ দেখা যায়, যাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই কিন্তু পরিবারের বাইরে অনেক লোকের সঙ্গে সম্পর্ক পারিবারিক সম্পর্কের মতোই। নাড়ির টান এখন এতটাই দুর্বল যে, বাবা-মা এখন সন্তানের কাছে বোঝা হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে কেউ কাউকে কিছু বলেও না। কারণ, কেউ কারো কথা শোনে না।

দিন দিন বড়োরা ছোটোদের শাসন করার অধিকার হারিয়ে ফেলছে। কেউ নিজের সন্তানকে শাসন করার অধিকার অন্য কাউকে দিচ্ছে না। এই সামাজিক শাসনের অভাবে মানুষ, বিশেষ করে যুবসমাজ স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছে। এ পরিস্থিতি কারো জন্য কাম্য নয়। আমরা সমাজকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক। আমরা চাই সমাজ আমাদের সংকট সমাধানে এগিয়ে আসুক। সমাজ আমাদের ভালো-মন্দের দায়িত্ব নিক। আমার সন্তান তো আমার সমাজেরও সন্তান। তাকে শাসন করার অধিকার সমাজের থাকুক। আর এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলেই সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে উঠবে নতুন প্রজন্ম।

সামাজিক শাসন না থাকায় আমরা আসলে কেউ ভালো নেই। আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। দিনে দিনে আমরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ছি। অভিভাবকহীন হওয়া মানে মানসিকভাবে আশ্রয়হীন হওয়া। আমাদের হয়তো অনেক টাকা আছে। কিন্তু আমাদের মানসিক আশ্রয়ের জায়গা কমে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমরা ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছি ‘শাসন করে সে, সোহাগ করে যে’। এখন শাসন করার কেউ নেই। তাই সোহাগ করতেও কেউ এগিয়ে আসে না। আমরা থাকি আমাদের মতো। এ থাকায় আমাদের মানবিকবোধ নষ্ট হয়ে যায়। মানুষ আর মানুষের জন্য থাকে না। ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’- কবি কামিনী রায়ের এ কথাটি আমাদের সামাজিক বন্ধনের মূলমন্ত্র। আর এই সামাজিক বন্ধন দৃঢ় রাখার জন্য সামাজিক শাসনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তাই সামাজিক শাসনের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার জন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এক্ষেত্রে সহনশীলতার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। মেনে নেওয়ার মানসিকতাও থাকতে হবে।

মানুষের আর্থিক সক্ষমতা তৈরি হলে সহনশীলতার মনোভাব কমে যায়। স্বাবলম্বী মানুষ সহজে অন্যের মতামত মেনে নিতে চায় না। কিন্তু পরমতসহিষ্ণু না হলে সামাজিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না। তাই সবারই পরমতসহিষ্ণু হতে হবে। সমাজের কোনো একজন সদস্য দায়িত্ববোধ থেকে কারো সন্তানকে শাসন করলে সন্তানের বাবা-মাকে সেটা মেনে নেওয়া উচিত। এতে সন্তান সহজে বিপথগামী হবে না। বাবা-মার সঙ্গে সমাজও সন্তানের অভিভাবক হয়ে উঠবে। এটাই সন্তানের জন্য সামাজিক শাসনের সবচেয়ে বড়ো উপকারিতা।

সন্তান যদি সামাজিক শাসন না মানে তাহলে এক পর্যায়ে সে পারিবারিক শাসনও মানবে না। এই না মানার প্রবণতা তাকে এক সময় সমাজবিচ্ছিন্ন বা সমাজবিরোধী করে তুলবে। সে তখন নানাবিধ সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়বে। বর্তমান সমাজ সেদিকেই যাচ্ছে। অধিক স্নেহের বশে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে আমরা সন্তানকে মূল্যবোধহীন করে তুলছি। নতুন প্রজন্ম এখন সামাজিক শাসনের মূল্য বোঝে না, পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের মূল্য বোঝে না। বড়োদের আদেশ-নিষেধের মূল্য বোঝে না। নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক আচরণের মূল্য বোঝে না। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের প্রতি সুসম্পর্কের মূল্য বোঝে না। জ্ঞাতি সম্পর্কের মূল্য বোঝে না। এই মূল্যবোধহীন নতুন প্রজন্ম আর্থিক সক্ষমতা অর্জন করতে পারলেও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না।

এ মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করার জন্য সামাজিক শাসনের অতীত ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে হবে। সামাজিক শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। সমাজপতিদের সততা নিয়ে জনমনে সংশয় আছে। নিরপেক্ষ আচরণের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখে জনমনের সে সংশয় দূর করতে হবে।

সামাজিক মূল্যবোধ ও সামাজিক শাসন প্রতিষ্ঠায় শিক্ষক সমাজের দায়িত্ব অপরিসীম। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো বর্তমানে বেশিরভাগ শিক্ষককে সে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় না। অন্য পেশাজীবীদের মতো শিক্ষকগণও এখন নিজেকে নিয়ে যতটা ভাবে, সমাজকে নিয়ে ততটা ভাবে না। এক সময় শিক্ষকের শাসন ছিল আশীর্বাদের মতো। এখন এক শ্রেণির অভিভাবক শিক্ষকের শাসনকে ভালো চোখে দেখেন না। শিক্ষক শুধু পড়াবেন। পড়া শেষ হয়ে গেলে শিক্ষকের প্রয়োজন নেই বলেও মনে করেন অনেকে। ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের নিকট থেকে নীতি-আদর্শ ও মূল্যবোধের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না। সমাজ যদি শিক্ষকের মূল্য না দেয় তাহলে শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকের মূল্য বুঝবে না। শিক্ষকের দায়িত্ব বিষয়ে সামাজিক মনোভাব বদলানো জরুরি। শিক্ষক শুধু পড়াবেন না, শিক্ষার্থীদের নীতি-আদর্শের শিক্ষাও দিবেন। আজকাল অবশ্য নীতি-আদর্শের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। পাঠক্রম রপ্ত করে ভালো রেজাল্ট করে বেশি বেতনের চাকরি নিতে পারলেই সন্তান মানুষ হয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। বর্তমান সময়ে শহরে বাস করা শিক্ষিত সন্তান নয়; গ্রামের অশিক্ষিত সন্তানটিকেই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে দেখা যায়। কারণ সে সমাজ থেকে দায়িত্ববোধের শিক্ষা অর্জন করেছে।

সামাজিক শাসনের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকেও এগিয়ে আসতে হবে। সাধারণ মানুষকে সামাজিক ন্যায়বিচার মানতে উৎসাহী করতে হবে। সামাজিক সালিশের মাধ্যমে ন্যায়সংগতভাবে নিষ্পত্তি হওয়া যেকোনো বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে সর্বাত্মক সমর্থন দিতে হবে। কেউ কোনো বিষয়ে আইনের আশ্রয় নিতে চাইলে সে বিষয়ে সামাজিক অনুমোদন আছে কি না- সেটাও খতিয়ে দেখা যেতে পারে। সমাজে সামাজিক বিধি ও সামাজিক শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকলে অনেক বিষয়ে প্রশাসনিক পদক্ষেপের প্রয়োজন হয় না। এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিগণকেও নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সামাজিক শাসনের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচারের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে যত্নবান হতে হবে।

আলী রেজা: কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :