যৌক্তিক সময় যেন সীমাহীন না হয়: মঈন খান
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেছেন, সরকার যে সংস্কার করতে চায়, তার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ধৈর্য ধারণ করে যৌক্তিক সময় দেয়া উচিত। তবে সরকারকেও ভাবতে হবে সে সময় যেন সীমাহীন না হয়। তা না হলে ছাত্র-জনতার আবারো মাঠে নামতে হতে পারে।
বুধবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘দ্য মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি’ আয়োজিত ‘জনগণের প্রত্যাশা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রোডম্যাপ’শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
সভায় রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কার ও সংস্কার আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর করণীয় কি? এ বিষয়ে সাধারণ জনগণের মতামত নেয়া হয়।
পরে বক্তব্য দেন, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম’র প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, গণফোরামের নেতা অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক, সাংবাদিক মাসুদ কামাল প্রমুখ। সভা সঞ্চালনা করেন দি মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য অ্যাডভোকেট রোকসানা খন্দকার।
আবদুল মঈন খান বলেন, ৫ আগস্টের পর দেশের মানুষের মধ্যে নতুন চেতনা জেগেছে। ফলে বিভিন্ন সংস্কারের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের সংস্কার করা দরকার। একবার-দুইবার নয়। শেখ হাসিনার মতো একজন দুইবার থাকলেই দেশের ১২টা বেজে যাবে।
তিনি বলেন, বর্তমান রাজনীতিবিদদের ওপর ছাত্র-জনতার আস্থা নেই। আস্থা ফেরাতে রাজনীতিবিদদেরই কাজ করতে হবে। আত্ম-সমালোচনার পাশাপাশি নিজেদের আচরণে সংস্কার আনতে হবে।
বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, ভিন্নমত না থাকলে গণতন্ত্র আসে না। গত ১৬ বছর আমরা এই ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারিনি বলেই, দেশে দুর্যোগ নেমে এসেছিল। পরিশেষে স্বৈরাচার সরকারের পলায়নের মাধ্যমে আমরা ফের মত প্রকাশের সুযোগ পেয়েছি, এটা কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, যারাই দেশ শাসন করেন, ভিন্নমতের গুরুত্ব স্বীকার করলে নিলে, রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো সমস্যা হয় না। তবে আজকের পরিস্থিতিতে রয়েছি, সেখানে সরকারের আইনের বাধ্যবাধকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে লাভ নেই। কারণ, এ সরকার ব্যর্থ হলেই দেশে বড় বিপর্যয় নেমে আসবে।
দেশের রাজনৈতিক পরীক্ষায় রাজনীতিবিদদের উত্তীর্ণ হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে মঈন খান বলেন, আমি নিজেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারিনি। তার ভাষ্য- দেশের সাংবিধানিক সংস্কারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। এ সময় দেশের কোটি কোটি বঞ্চিত মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সরকার যদি ভুল করে তাহলে সবাই মিলে বসে ভুলটা ধরিয়ে দিয়ে পরামর্শ দেওয়া উচিত। এমন কিছু করা যাবে না, যেন যে চেতনায় অভ্যুত্থান হয়েছে তা বাধাগ্রস্ত হয়। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের কাঠামো সংস্কারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার সংস্কার এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। একই সঙ্গে সরকারের ভুলগুলো ধরিয়ে দিলে তারা সমালোচনার ঊর্ধ্বে থেকে কাজ সরতে পারবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ৭২ সাল থেকেই এ দেশে দুঃশাসনের একটি চক্র চলছে। একটি দল ক্ষমতা থেকে হটে গেলে আরেকটি দল ক্ষমতায় আসবে, এমন ধারণা কোনো দল করলে তাহলে দেশ আবারো সেই চক্রেই পড়বে। যেই ব্যবস্থার মধ্যে শেখ হাসিনার সরকার ছিল, সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। তার মতে, প্রতিবিপ্লবের শঙ্কা এখনো আছে। তাই অভ্যুত্থানের লক্ষ্য পূরণে সরকারকে জাতীয় ঐক্য তৈরির আহ্বান জানান সাকি।
প্রশাসনে নৈরাজ্য চলছে উল্লেখ করে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এগুলো আর কোনোভাবে দেখতে চাই না। তার মতে, সরকার মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এর অর্থ সরকার এতদিন হোমিওপ্যাথি দিয়েছে, এখন সেনাবাহিনীকে অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে ব্যবহার করছে। তার মতে, সরকারের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি আছে। তিনি বলেন, সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ ক্লিয়ার করুন, সময় নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সরকার যদি কোনো রাজনৈতিক অংশীদারত্বের অংশ হতে চান, তবে বিতর্কিত হবেন। তাদের অধীনে আমরা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি আমরা সব রাজনৈতিক দলগুলো মিলে যে ৩১ দফা দিয়েছি, সেটা বাস্তবায়ন করতে সরকার আমাদের সহায়তা করবে বলে বিশ্বাস করি।
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম’র প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ তাড়াহুড়োর কোনো নির্বাচন চান না বলে জানান। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বচ্ছ নির্বাচন করতে হবে। তবে তারা আসলে কি কি বিষয়ে সংস্কার করতে চায় তা যদি খোলাখুলি করতো তাহলে সবার মাঝেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব কেটে যেতো। তবে সবচেয়ে আগে জরুরি একটা সুন্দর নির্বাচনের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো। এরপরে সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণের ভোটের রায় নিয়ে যারা ক্ষমতায় আসবেন, তারা জনগণের কল্যাণে দেশের বাকি সংস্কারগুলো করবে।
গণফোরামের নেতা অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ৬ টি কমিশন তো হয়েছে, সরকারকে একটু সময় দেন। নির্বাচন কমিশন চলে গেছে, কমিশন এখনো গঠন হয়নি, দুদক পুনর্গঠন হয়নি। এসব বাস্তবায়নে পক্ষে আওয়াজ তুলতে হবে, কেবল সরকারকে প্রেসার দিলে চলবে না। তিনি বলেন, অধৈর্য হলে আমরা ফের বিপদে পড়বো, ফেইল করবো। এমন হলে দেশের জনগণ আমাদের কাউকে ক্ষমা করবে না।
সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বলছে, তবে সেটা কতোদিন জানতে হবে। তবে সবার মনে প্রশ্ন আছে অন্ত:বতীকালীন সরকার কতোদিন সংস্কার করবে সেটাও তাদের ক্লিয়ার করা এই মুহূর্তে জরুরি। তিনি বলেন, এই সরকারের সমালোচনা করতে হবে, তা না হলে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা মতো সব নিজের ভাবতে শুরু করবে।
তিনি বলেন, সরকারের প্রথম ভুল হলো- তিনি এসেই বললেন, আমাদের প্রথম এমপ্লায়ার হলো ছাত্ররা, এটা বলা ঠিক হয়নি। কারণ, এই আন্দোলন দেশবাসীর অনেক দিনের ত্যাগ। তিনি বলেন, গণভবনে শেখ হাসিনা নেই, তবে সচিবালয় সে আছে। একটা স্বৈরাচার সরকারের আমলা দিয়ে একটি আন্দোলনের সফল সরকার চলতে পারেনা। এসব আমলা নিয়ে সরকার চলতে চায়৷ তবে এই সরকারসহ দেশবাসীর কপালে দুর্ভোগ আছে।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক বলেন, স্বৈরাচার মুক্ত স্বাধীন একটি দেশের জন্য বিএনপি ও দেশের মানুষের তিলে তিলে গড়া আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলেছেন, ছাত্র জনতা। আমরা ১৭ বছর ধরে রাজপথে রক্ত দিয়েছি, দলের অনেক নেতাকর্মীরা গুম খুন হয়েছেন। তিনি বলেন, ১৭ বছরের জঞ্জাল একদিনে মুক্ত হবে না। তার জন্য আমরা সরকারকে সময় দিচ্ছি, আমরা মোটের অধৈর্য হইনি।
(ঢাকাটাইমস/১৮সেপ্টেম্বর/জেবি/এমআর)