এই দেশ চারবার স্বাধীন হয়েছে, আর লড়াই-বৈষম্য চাই না: ফয়জুল করীম
অতীতের খুন, গুম, লুটতরাজ, মেগা ডাকাতির সেই বাংলাদেশকে দেখতে চান না বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের (আইএবি) সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম।
আইএবি নেতা বলেন, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে এই দেশ চারবার স্বাধীন হয়েছে। আমরা আর লড়াই চাই না, বৈষম্য চাই না। বৈষম্যমুক্ত, চোর-ডাকাত, ধর্ষক, খুনেরা, লুটেরা, চাঁদাবাজ ও স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চাই।
বৃহস্পতিবার বিকালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন সৌদি-বাংলা মার্কেটের সামনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সিদ্ধিরগঞ্জ শাখার উদ্যোগে আয়োজিত গণসমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।
ফয়জুল করীম বলেন, আমরা দেখেছি ১৯৭১-এর পর থেকে ২০২৪-এর ৫ আগস্ট পর্যন্ত যারা শাসক ছিল, তারা এই দেশকে দুর্নীতিতে পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন করেছে, তারা আবরারকে বুয়েটের মধ্যে হত্যা করেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একশ’ মেয়েকে ধর্ষণ করার পর সেঞ্চুরি পালন করেছে, সেখানে খুন এবং ধর্ষণের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
সদরঘাটের সামনে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করেছে, বাংলাদেশের ১৪ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে, গোটা ব্যাংকগুলো দেউলিয়া করে ফেলেছে, চুরি-ডাকাতির মেগা প্রজেক্ট খোলা হয়েছিল। সেই বাংলাদেশ আর দেখতে চাই না।
আইএবির এই সিনিয়র নেতা আরও বলেন, আমরা এমন এক বাংলাদেশ দেখতে চাই, যেখানে মানুষের অধিকার থাকবে। মেয়েরা ইজ্জত-আবরুর নিয়ে বসবাস করতে পারবে। আমাদের মেয়েরা-ছেলেরা বড় ব্যবসায়ী হবে, আমাদের ভাই-বোনরা বড় শিক্ষিত হবে, চাকরিজীবী হবে। গরীবরা দারিদ্র সীমার উপরে চলে যাবে। বাংলাদেশে যদি ইসলামিক অর্থনীতি প্রয়োগ করা হয়, তাহলে আগামী দশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে একজন গরীবও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনীতি সব ধনীদের জন্য, গরীবদের জন্য নয়। অন্যদিকে ইসলামী অর্থনীতি সবই গরীবদের জন্য। পুঁজিবাদী অর্থনীতি ধনীদের আরও ধনী এবং গরীবদের আরও গরীব বানায়। এদিকে ইসলামী অর্থনীতি গরীবদের ধনী বানায় এবং ধনীদের ভারসাম্য রক্ষা করায়। গোটা বাংলাদেশের টাকা মাত্র ২০ থেকে ২৫টি পরিবারের কাছে জিম্মি। ১৮ কোটি মানুষের টাকা থাকবে মাত্র ২০ জনের কাছে, এটা হতে পারে না। আমরা সুষম বণ্টন চাই। আজকে বাংলাদেশ ১৮ লাখ কোটি টাকা ঋণী। প্রতিটি নাগরিকের মাথার উপরে আজ দেড় লাখ টাকা ঋণ।
সৈয়দ ফয়জুল করীম বলেন, এদেশে আর গুন্ডামী-বদমাইশি চলবে না। সবাইকে সতর্ক এবং ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে যারা লুটতরাজ, চাঁদাবাজ, চোর, খুনি, দুর্নীতিবাজ, জুলুমকারী, আমরা ভোটাররা তাদেরকে ভোট দেবো না। নয়তো আমরা আর কখনো শান্তি পাব না। দলের পরিবর্তন হয়েছে, নেতার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু নীতির পরিবর্তন হয়নি। তাই শুধু নেতা নয়, নীতির পরিবর্তন চাই।
ফয়জুল করীম অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সেনাবাহিনীকে আপনি বিচারিক ক্ষমতা দিয়েছেন। কিন্তু সিটির মধ্যে বিচারিক ক্ষমতা দেন নাই কেন? আমি অনুরোধ করব, বাংলাদেশের অন্যান্য জেলাগুলোর মতো ঢাকা সিটির মধ্যেও সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া দরকার। নয়তো গুণ্ডা-বদমায়েশদের দমন করা যাবে না। শক্ত হাতে দেশকে পরিচালনা করুন, কোনো অবস্থাতেই দুর্বলতা যেন না পায়। আপনি দুর্বল হলে গোটা বাংলাদেশ দুর্বল হয়ে যাবে। যেসব জায়গা সংস্কারের জন্য আপনি প্রতিনিধি নিয়োগ করেছেন, প্রতিটি সংস্কারে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের প্রতিনিধি আলেমদের রাখতে হবে। আর নয়তো বাংলাদেশ আবারও ভুল করবে।
সমাবেশে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির শরিয়াহ উপদেষ্টা মুফতি ওমর ফারুক সন্দ্বীপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান। প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সভাপতি মুফতি মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সৈয়দ ফয়জুল করীম আরও বলেন, এই দেশ চারবার স্বাধীন হয়েছে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেছিলাম বৈষম্য দূর করার জন্য, ভারতের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিলাম বৈষম্য দূর করার জন্য। একাত্তরেও আন্দোলন করেছিলাম বৈষম্য দূর করার জন্য। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অন্দোলন করে স্বাধীন করেছিলাম, ভারতের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে পাকিস্তান নামে ভূখণ্ড পেয়েছিলাম। এরপর পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে বাংলাদেশ নামে একটি দেশ পেয়েছিলাম। আর ২০২৪-এর ৫ আগস্ট আমরা স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট, খুনি শেখ হাসিনার থেকে দেশ স্বাধীন করেছি বৈষম্য দূর করার জন্য।
তিনি বলেন, বারবার বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করি, কিন্তু বৈষম্য দূর হচ্ছে না। যে জুলম, নির্যাতন, হত্যা মামলা, মিথ্যা মামলা, ধর্ষণ থেকে বাঁচার জন্য আন্দোলন করেছি, আবার ৫ আগস্টের পরে দেখেছি সেই একই দখলদারি, চাঁদাবাজি, মিথ্যা মামলা। এর জন্য দেশের মানুষ আন্দোলন-সংগ্রাম করেনি। আমরা আন্দোলন করেছি মুক্তির জন্য। গরীবদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। যেখানে অধিকার থাকবে জেলে, শ্রমিক, মজলুম, তাঁতী, কৃষক, কামার, মেথর, চামারদের। যেখানে থাকবে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধদের অধিকার। সবার অধিকার যেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে, তেমন একটি বাংলাদেশের জন্যই আমরা আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি।
কিন্তু আজও শ্রমিকরা তাদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করে। তাহলে বিগত আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। আজকে যদি আমাদের মা-বোনেদের এসিড দিয়ে চেহারা ঝলসে ফেলা হয়, দগ্ধ করা হয়, যদি আমাদের মা-বোনদের ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়, আজকে যদি ক্ষুধার কারণে মা তার সন্তানকে বিক্রি করে দেয়, আজও যদি বাংলাদেশের মানুষ পেটের ক্ষুধার তাড়নায় ডাস্টবিনে কাক এবং কুকুরের সঙ্গে খাবারের জন্য লড়াই করে, তাহলে আন্দোলন সফল হয় নাই। আজও বাংলাদেশের মানুষ খোলা আকাশের নিচে ঘুমায়। আজও যদি বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুধার্থ থাকে, বস্ত্রহীন থাকে, আজকে বাংলাদেশের মানুষ যদি চিকিৎসাবিহীন মারা যায়, তাহলে আমরা ব্যর্থ হয়েছি, আন্দোলন সফল করতে পারি নাই।
সৈয়দ ফয়জুল করীম বলেন, আমরা এমন একটা দেশ চাই। এমন সরকার আমরা দেখতে চাই। যেখানে চাঁদা, গরীব, বৈষম্য ইত্যাদি থাকবে না। যেখানে ব্যবসায়ীরা বিনা চাঁদায় ব্যবসা করবে, ড্রাইভাররা পুলিশের ঘুষ ব্যতিত রাস্তায় গাড়ি চালাবে, যেখানে হাজারও মানুষ বুক উঁচু করে হাঁটবে, তাদের ওপর আক্রমণ-জুলুম করা হবে না। যেখানে ডাকাত, চোর, দুর্নীতিবাজ, টাকা পাচারকারী, ঘুষখোর, খুনি, ধর্ষক থাকবে না। যেখানে আমাদের ছোট সন্তানরা মাদকে আসক্ত হবে না, গাজার কোনো প্রচলন থাকবে না, থাকবে না ফেনসিডিল-ইয়াবা। আমাদের সবার সন্তান মানবতার শিক্ষায় শিক্ষিত, ভদ্র, আদর্শবান ও চরিত্রবান হবে। যাদের মাধ্যমে গোটা পৃথিবীতে আমরা নেতৃত্ব দেবো, বুক উঁচু করে দাঁড়াব।
(ঢাকাটাইমস/১৯সেপ্টেম্বর/এসআইএস)