হৃদরোগ-স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায় কফি! ক্যানসারেরও যম
সারা বিশ্বে কফি খুবই জনপ্রিয় একটি পানীয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজের ফাঁকে বা সন্ধ্যাবেলা কাজ থেকে ফিরে কফির কাপে চুমুক না দিলে চলে না। প্রতিদিনের ব্যস্ততায় নিজেকে একটুখানি চাঙ্গা করতে কফির জুড়ি মেলা ভার। সারাদিনের ক্লান্তি এবং বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পেতে এটি অতুলনীয়।
কফিতে ক্যাফেইন নামক এক প্রকার উত্তেজক পদার্থ রয়েছে। ৮ আউন্স কফিতে প্রায় ১৩৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে। কফির উপাদান ক্যাফেইনের জন্যে কফি মানুষের উপর উত্তেজক প্রভাব ফেলে ও উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে।
অস্ট্রেলিয়ার স্নায়ু বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রতিদিন কফি পান মানুষের লিভারের স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং ক্যানসার রোধ করে। ডায়াবেটিস ও ওজন কমাতে সাহায্য করে পাশাপাশি কর্মে ও খেলাধূলায় উদ্যমী করে।
নিয়মিত কফি পানের অভ্যাস ব্রেনের জন্যও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। যারা নিয়মিত কফি পান করেন তাদের মধ্যে পার্কিনসন্সের মতো স্নায়ুরোগেও ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় অনেকটাই কম।
একটি গবেষণায় দেখা যায় কফি পানের ফলে দেহের ক্যাপিলারি ব্লাড ফ্লো বেড়ে যায়। এতে করে দেহের রক্ত সঞ্চালন উন্নত হয়, যার ফলে দেহের প্রতিটি কোষেই অক্সিজেন পৌছায় সঠিকভাবে। এতে করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
তবে সব ধরনের কফিই আপনার জন্য কিছু না কিছু উপকার বয়ে আনবে। পুষ্টিবিদরা এমনটাই জানিয়েছেন। এটি আরও নানাভাবে শরীরের জন্য উপকারী হিসেবে প্রমাণিত। চলুন জেনে নেওয়া যাক কফি খেলে কী কী উপকার হয়-
হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়
দীর্ঘদিন বিপাকীয় সমস্যার ফলে রক্তে অতিরিক্ত মাত্রায় খাদ্যে কোলেস্টেরল জমা হতে থাকে। ‘ইনস্টিটিউট ফর সাইন্টিফিক ইনফর্মেশন অন কফি’-এর গবেষকদের দাবি, প্রতিদিন নির্দিষ্ট মাত্রায় কফি পান করার অভ্যাস মেটাবলিক সিনড্রোম বা বিপাকীয় সমস্যার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। মেটাবলিক সিনড্রোম বা বিপাকীয় সমস্যা কার্ডিওভাসকুলার সমস্যা বা হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটা বাড়িয়ে দেয়।
সম্প্রতি ‘ইনস্টিটিউট ফর সাইন্টিফিক ইনফর্মেশন অন কফি’ আয়োজিত আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে অনুষ্ঠিত পুষ্টিবিদ, বিশেষজ্ঞদের একটি সম্মেলনে অধ্যাপক জুসেপি গ্রসো দাবি করেন, সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর কফি পানের অভ্যাস রক্তে কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। ফলে কমে যায় কার্ডিওভাসকুলার সমস্যা বা হৃদরোগের ঝুঁকি। তার মতে, কফি আসলে হজমের ক্ষেত্রে সহায়ক।
প্রতিদিন ২ থেকে ৩ কাপ কফি পান করলে হার্টের স্বাস্থ্য ভালো হতে পারে। আধুনিক গবেষণা বলছে, ক্যাফেইন হৃৎপিণ্ডের উপকারই করে বেশি। প্রতিদিন তিন কাপ কফি পানে রক্তনালীতে ক্যালসিয়াম তৈরি বাধাপ্রাপ্ত হয়। এতে হৃৎপিণ্ডের রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে।
শরীরের ওজন ঝরায়
দিনে দু-বার দু-কাপ কফি খেয়েও যে পেটের থলথলে মেদ ঝরিয়ে ফেলা যায়। কফিতেও কয়েক পাউন্ড ওজন অনায়াসে কমিয়ে ফেলতে পারেন। কিন্তু, আপনি যেভাবে কফি খেতে অভ্যস্ত, তাতে অবশ্য মেদ গলবে না। লাগবে আরও কিছু উপকরণ, যা আপনার ঘরেই পেয়ে যাবেন। এই কফি বানাতে খাটনিও তেমন নেই। ৩/৪ কাপ নারকেল তেল, এক চা-চামচ দারুচিনির গুঁড়ো, ১/২ কাপ খাঁটি মধু। ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে ঢাকনা দেওয়া পাত্রে তুলে রাখুন। মিশ্রণটি এক কাপ কফির মধ্যে ১ থেকে ২ চামচ মিশিয়ে নিন। দিনে দু-বার এই কফি খেতে হবে। ঘরে কোকো থাকলে, কফিতে তা-ও মিশিয়ে নিতে পারেন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দাবি, এভাবে কফি বানিয়ে খেলে বিপাকক্রিয়ার হার বাড়বে শুধু নয়, বাড়তি ক্যালরিও খরচ হবে। ফলে পেটে জমে থাকা মেদ গলবে। তারা জানাচ্ছেন, নারকেল তেলের মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট। রয়েছে মিডিয়াম চেন ফ্যাটি অ্যাসিড। যা বিপাকক্রিয়ার হার ত্বরান্বিত করে। একই সঙ্গে প্রাকৃতিক তাপ উত্পাদক হিসেবেও এটি কাজ করে।
আর দারুচিনির ব্যবহার প্রাচীন আয়ুর্বেদশাস্ত্রেও রয়েছে। এটি রক্তশর্করার বিপাকক্রিয়া বাড়িয়ে তোলায়, শর্করা ভেঙে এনার্জি বা তাপ উৎপাদন হয়। ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা কমতে থাকে। এ ছাড়া দারুচিনিতে রয়েছে ভরপুর অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট। এটি ফ্যাটি অ্যাসিডও জমতে দেয় না। যে কারণে ওজন ঝরে।
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়
টাইপ-২ ডায়াবেটিসের সম্ভাবনাও কমায় কফি। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত কফি খায় তাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কম হয়। এই ঝুঁকি কমানোর পরিমাণটা ২৩ থেকে ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। জটিল এই রোগের ঝুঁকির হাত থেকে বাঁচতে যদি কফি কাজ করে তাহলে কফি খেতে সমস্যা কোথায়?
শরীরে কার্যক্ষমতা বাড়ে
সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা গেল কফি খেলে শরীরে কার্যক্ষমতা বাড়ে এবং মস্তিষ্কের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। একাধিক সমীক্ষায় দেখা যায়, ক্যাফেইন খেলে দেহের অতিরিক্ত মেদ ঝরে। মেটাবলিজমও বাড়ে। ক্যাফেইনে অ্যাড্রিনালিন মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ফলে ফ্যাটি অ্যাসিড নিঃসরণের মাধ্যমে কায়িক পরিশ্রমের ক্ষমতা বাড়ায়। শরীরচর্চার আগে কফি পান করলে তা অনেক বেশি উপকার করে। এর কারণেই শরীরচর্চার পরও আপনি নিজেকে দুর্বল অনুভব করবেন না।
ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়
বিশ্বে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ ক্যানসার। লিভার ও কলোরেক্টাল ক্যানসারের ঝুঁকি কমায় কফি। স্তন ও প্রস্টেট ক্যানসার ঠেকাতে কফি কার্যকর ভূমিকা রাখে। এমনকি ডিম্বাশয় ও পাকস্থলীর ক্যানসার প্রতিরোধ করে থাকে।
চোখের সমস্যায় কার্যকর
সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে কফি শুষ্ক চোখের সমস্যা সমাধানেও বেশ কার্যকর। ক্যাফেইন চোখের অশ্রুগ্রন্থিকে উদ্দীপিত করে সেই সঙ্গে সেটা সালিভা এবং পাচকরস তৈরি বাড়ায়।
অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট
গবেষণায় দেখা গেছে কফিতে ফল ও শাকসবজির তুলনায় বেশি অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট রয়েছে। মানুষের শরীরের কোষের ক্ষতি করে ফ্রি র্যাডিক্যালস। কফির অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ধ্বংস করে। শরীরের গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে কিংবা স্থিতিশীল রাখতেও ভূমিকা রাখে কফি।
বিষণ্নতা কমায়
২ লাখ ৮ হাজার ৪২৪ জনের ওপর একবার একটি গবেষণায় হয়েছিল। দেখা গেছে যারা দিনে ৪ কাপ বা এর বেশি কফি পান করেছে তাদের মধ্যে বিষণ্ণতায় ভুগে আত্মহত্যার প্রবণতা ৫৩ শতাংশ কম দেখা গেছে।
দূর করে পারকিনসন্স ও আলঝেইমারস রোগ
কফি স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। নিয়মিত কফি পানে মস্তিষ্কের রোগ পারকিনসন্স ও আলঝেইমারসের ঝুঁকি কমে। এ রোগে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ নষ্ট হতে থাকে। ক্রমে অসাড় হতে থাকে শরীর। গবেষণা বলছে, পারকিনসন্সের প্রাথমিক উপসর্গ দূর করতে বিশেষ কার্যকর ক্যাফেইন।
কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি কমায়
ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশনের অফিসিয়াল জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, কিডনিতে পাথর হওয়া প্রতিরোধে কফির ভূমিকা রয়েছে। নিয়মিত কফি পান করলে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, দিনে এক থেকে দেড় কাপ কফি পান করলে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি ৪০ শতাংশ কমে যায়। এছাড়াও ক্যাফেইন কিডনি সেলের সাথে ক্যালসিয়াম অক্সালেটের সংশ্লেষ কমাতে সাহায্য করে। কফি গাছে প্রচুর পরিমাণ সাইট্রিক এসিড থাকে এবং ইউরিনারি সাইট্রেট মূত্রাশয়ে পাথর তৈরিতে প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।
(ঢাকাটাইমস/০৮ অক্টোবর/এজে)