ওয়াকফ সংশোধনী আইন
হিন্দু মন্দির বোর্ডে মুসলিমদের রাখবেন?, প্রশ্ন ভারতের সুপ্রিম কোর্টের

ভারতে সদ্য পাস হওয়া ওয়াকফ সংশোধনী আইনকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা অনেকগুলো মামলার একত্রিত শুনানিতে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারকে একাধিক ‘কঠিন’ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে ভারতেরর সুপ্রিম কোর্ট।
বিশেষ করে নতুন আইনে সেন্ট্রাল ওয়াকফ কাউন্সিলে অমুসলিমদের সদস্য করার যে বিধান রাখা হয়েছে, সেই পটভূমিতে সুপ্রিম কোর্ট সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে হিন্দু এনডাওমেন্ট বোর্ডে (মন্দির বা দেবোত্তর সম্পত্তির পরিচালনা করে যারা) মুসলিম সদস্যদের রাখা হবে কি না?
পাশাপাশি ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে ধরনের সহিংসতা দেখা যাচ্ছে, সেটাও 'বিচলিত করার মতো' বলে মন্তব্য করেছেন দেশের প্রধান বিচারপতি।
বুধবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের বেঞ্চ ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে মোট ৭৩টি পিটিশনকে একত্র করে করা শুনানিতে এই মন্তব্য করেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি পিভি সঞ্জয় কুমার ও বিচারপতি কেভি বিশ্বনাথন।
শুনানিতে ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ বা বহুকাল ধরে ব্যবহারের দ্বারা মসজিদ বা কবরস্থানের মতো যে সম্পত্তি ওয়াকফ বলে চিহ্নিত, সরকার কীভাবে তার দখল নিতে পারে সে ব্যাপারেও সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন।
প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ এদিনের শুনানির শেষে জানিয়েছেন, তারা একটি অন্তর্বর্তী রায় দেওয়ার কথা বিবেচনা করছেন যেখানে কয়েকটি বিষয় নিয়ে তারা মতামত দেবেন।
প্রথমত, যে সম্পত্তিগুলোকে আদালত ওয়াকফ বলে ঘোষণা করেছে, সেগুলোকে 'ডিনোটিফাই' করা যাবে কি না, বা 'নন-ওয়াকফ' হিসেবে ঘোষণা করা যাবে কি না। আর এটা 'ওয়াকফ বাই ইউজার' বা সেরকম নয়, দু'ধরনের সম্পত্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।
দ্বিতীয়ত, কালেক্টর (জেলা শাসক) এই ধরনের কেসে তার তদন্ত বা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু তার সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করা যাবে কি না।
তৃতীয়ত, ওয়াকফ বোর্ড ও কাউন্সিলগুলোতে 'এক্স অফিশিও' (পদাধিকারবলে) যারা নিযুক্ত হন তাদের কথা আলাদা (যেমন এমপি, এমএলএ, জেলাশাসক প্রভৃতি) – কিন্তু বাদবাকি সদস্যদের মুসলিম হতেই হবে কি না।
তবে সুপ্রিম কোর্ট এগুলোর বিষয়ে এখনও কোনো রায় ঘোষণা করেনি। এই মামলার শুনানি আগামীকালও চলবে।
এদিনের শুনানিতে ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্যদের রাখার প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও দেশের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতার কাছে আদালত সরাসরি জবাবদিহি তলব করেন।
বিচারপতিরা তার কাছে জানতে চান, ‘আপনি কি বলতে চাইছেন এখন থেকে হিন্দু এনডাওমেন্ট বোর্ডেও আপনারা মুসলিমদের অ্যালাও করবেন? খোলাখুলি বলুন!’
জবাবে সলিসিটর জেনারেল জানান, তিনি হলফনামা দিয়ে এটাই বলতে পারেন যে (কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরের ওয়াকফ বোর্ডগুলোতে) দু'জনের বেশি অমুসলিম সদস্য কখনোই থাকবেন না।
ভারতে নতুন ওয়াকফ আইন নিয়ে যে বিতর্ক
ভারতে মুসলিম ওয়াকফ সম্পত্তি কীভাবে চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে, সেই সব আইনকানুনের আমূল পরিবর্তন করে লোকসভায় একটি বিতর্কিত বিল পাস হয় গত তেসরা এপ্রিল। পরদিন (৪ঠা এপ্রিল) বিলটি পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার অনুমোদন পায়।
এরপর ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ওই বিলটিতে সম্মতি দেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এবং গেজেট প্রকাশের পর তা আইনে পরিণত হয়।
বিলটি নিয়ে পার্লামেন্টে যখন তর্কবিতর্ক চলছে, তখন থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বহু মুসলিম সংগঠন এই আইনটিকে 'কালা কানুন' বলে বর্ণনা করে আসছেন এবং তারা প্রবল বিক্ষোভও দেখাচ্ছেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় ওয়াকফ আইন-বিরোধী প্রতিবাদ রীতিমতো সাম্প্রদায়িক চেহারা নেয়। গত সপ্তাহে ওই সহিংসতায় বেশ কয়েকজন হতাহতও হয়েছেন।
ইতিমধ্যে এই আইনটিকে অসাংবিধানিক বলে দাবি করে সুপ্রিম কোর্টে এটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আলাদা আলাদা পিটিশন দাখিল করেন একাধিক পার্লামেন্টারিয়ান। বেশ কয়েকটি নাগরিক অধিকার গোষ্ঠীও এই আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়।
আবেদনকারী এমপিদের মধ্যে ছিলেন- এআইএমআইএম নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি, তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র, কংগ্রেসের মহম্মদ জাভেদ, রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মনোজ ঝা প্রমুখ।
এই সব মামলারই মূল কথা ছিল একটিই – নতুন এই আইনটিতে দেশের নাগরিক হিসেবে মুসলিমদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে এবং ইসলামের ধর্মীয় বিষয়ে, ওয়াকফ সম্পত্তির পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকার অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ করেছে।
আবেদনকারীরা আরও বলেন, ওয়াকফ আইনটিতে মুসলিম এনডাওমেন্ট বোর্ডগুলোকে (ধর্মস্থান পরিচালনা করে যারা) বেছে বেছে নিশানা করা হয়েছে এবং দেশের সংবিধান প্রত্যেক নাগরিককে স্বাধীনভাবে নিজস্ব ধর্মাচরণ করার যে মৌলিক অধিকার দেয় তা লঙ্ঘিত হয়েছে।
এরকম সব মামলাকে একসঙ্গে গ্রহণ করে সুপ্রিম কোর্ট আজ ১৬ এপ্রিল (বুধবার) তার শুনানির দিন ধার্য করেছিল।
সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস, বিবিসি
(ঢাকাটাইমস/১৬এপ্রিল/এমআর)

মন্তব্য করুন