প্রেম এক অনিঃশেষ অনুভুতির নাম: এম এম মাহবুব হাসান-এর ‘প্রথম প্রেমের স্পর্শ’ নিয়ে এক শিহরিত শিল্প-ভ্রমণ

বাংলা সাহিত্যে 'প্রেম' নিয়ে লেখা হয়েছে অগণিত গল্প, উপন্যাস, কবিতা। কিন্তু এম এম মাহবুব হাসান এর “প্রথম প্রেমের স্পর্শ” কিছুটা যেন ভিন্নধর্মী এবং অনন্য স্বাদের। এটি কেবল একটি তথাকথিত প্রেমের গল্পই নয়—এ এক অনুভবের জার্নি, এক নিঃশব্দ আত্মকথন। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত উপন্যাসটির প্রতিটি পর্বই যেন হৃদয় নিংড়ে লেখা, যার ভাষা গদ্য হলেও শেকড় চলে গেছে ধ্রুপদী কবিতার দিকে।
প্রেম মানেই কি মিলন? নাকি শুধু ব্যর্থতা? প্রেম কি সময়ের অনুকূলে জন্ম নেয়, নাকি সময়ই তাকে গিলে ফেলে? এম এম মাহবুব হাসান এর উপন্যাস ‘প্রথম প্রেমের স্পর্শ’ এইসব প্রশ্নকে সামনে এনে এক গভীর, করুণ ও দার্শনিক প্রেম-অন্বেষা বোৎ জাগিয়ে তোলে, যা বাংলা সাহিত্যপ্রেমী পাঠকের হৃদয়ে এক দীর্ঘস্থায়ী স্পন্দন জাগাতে সক্ষম হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কেননা এটি এমন এক উপন্যাস, যেখানে প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বি সময়, সমাজ, দায়বদ্ধতা এবং অন্তহীন প্রতীক্ষা।
উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দুটি চরিত্র—তমাল ও নীলা। তারা প্রেমে পড়ে, কিন্তু তাদের প্রেমের পথ মসৃণ ও রোমাঞ্চকর নয়, বরং হৃদয়ের নীরব রক্তক্ষরণময়। তমাল এক নিঃসঙ্গ প্রেমিক—কখনো সে কবি, কখনো সরকারি চাকুরে, কখনো সীমান্তের ওপারে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির অন্বেষণকারী। অন্যদিকে, নীলা যেন প্রেম, প্রতীক্ষা, এবং নীরব আত্মত্যাগের জীবন্ত প্রতীক। তার জীবনজুড়ে শুধু নিঃশব্দ অপেক্ষা, চাপা দীর্ঘশ্বাস আর অস্ফূট আর্তনাদ। লেখকের কুশলি কলমে এ দু'টি চরিত্র কেবল মানুষ নয়— হয়ে ওঠে অনুভূতির রূপক। তমালের একাকীত্ব ও ছুটে চলা যেন এক অন্তহীন আকাঙ্ক্ষা; অপর দিকে নীলার নীরবতা ও আত্মগোপন যেন এক অলিখিত ত্যাগের সুমহান মহাকাব্য।
“সময় হয়তো তার দাগ মুছে দেয়, কিন্তু সেই প্রথম স্পর্শ, সেই প্রথম শিহরণ—চিরকাল বেঁচে থাকে প্রেমিকের অন্তরে।”
উপন্যাসের এই লাইনটি গভীর দার্শনিকতার ইঙ্গিতপূর্ণ। প্রেম এখানে চিরকাল জীবিত থাকে—প্রেমিকের অন্তরে। পরিস্থিতির কারণে কখনো বা ক্ষণিকের জন্য প্রেমের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এটি প্রেমের সেই মুহূর্ত, যখন শব্দের চেয়ে বেশি বাঙময় হয়ে ওঠে চোখের জল। এই একটি বাক্যেই ধরা পড়ে লেখকের সংবেদনশীলতা ও প্রেম-দর্শন—যেখানে ভালোবাসা মুখে উচ্চারিত হয় না, বরং নিঃশব্দ অভিব্যক্তিতে নিজেকে ব্যক্ত করে।
উপন্যাসের প্রতিটি পর্ব যেন একেকটি কবিতার করিডোর—একেকটি রূপক চিত্র। “নীল জোনাকির আলো”— প্রেমের প্রথম আলোকরেখা, যা সন্ধ্যার ছায়ায় মিশে যায়। এটি উপন্যাসের প্রবেশমুখ অর্থাৎ প্রথম পর্ব যেখানে আমরা সম্ভাবনাময় একটি সম্পর্কের ইঙ্গিত পাই, তবে তার মধ্যেই সহসা আবার আবিষ্কার করি সময়ের অস্থিরতা—বিচ্ছেদের করুণ সুর। “চিঠির খামে বন্দি হৃদয়ের কবর”—উপন্যাসটির ষষ্ঠ পর্বের শিরোনাম। এ পর্বের শিরোনামই যেন হৃদয় ফালা ফালা করে দেয়। এখানে সম্পর্ক চিঠিতে বন্দি, ঠাঁই পায় না কোন ডাকবাক্সে—পৌঁছে না কোনো কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। কেবল থেকে যায়, মৃত এক স্মৃতির কবর হয়ে। এখানে লেখক সম্পর্কের গভীরতা ও সামাজিক অসংলগ্নতা তুলে ধরেছেন নরম অথচ নির্মমতার আঁচে।
“একটি অসমাপ্ত কবিতার ঘরে ফেরা”— এই পর্বটি অত্যন্ত প্রতীকী ব্যঞ্জনাময়। এখানে 'ফেরা' মানেই কিন্তু মিলনের ইশারা নয়; বরং এটি এক অপূর্ণতার চূড়ান্ত স্বীকৃতি। অসমাপ্ত প্রেমের দিকে ফেরা মানে—ভালোবাসার মৃতদেহের কাছে আরেকবার দাঁড়ানো। এ উপন্যাসের প্রতিটি পর্বের শিরোনাম শুধু চটকদার অলঙ্কার নয়, বরং এগুলো উপন্যাসের আভ্যন্তরীণ চেতনার নির্যাস।
“তোমাকে হারানো মানে নিজেকে হারানো।”
এই লাইনটি কেবল প্রেমের নয়, এটি এক গভীর আত্মোপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ। এখানে মুখে কিছু না বলেও সব বলা হয়। সম্পর্কের সবচেয়ে জটিল অনুভূতি—ভাঙন, ছেড়ে যাওয়া, না-বলা কথা—সবকিছু যেন এই একটি বাক্যে উঠে আসে। একজন পাঠক এই বাক্যের মধ্যেই খুঁজে পাবেন তাঁর নিজের অতীত, নিজের অপূর্ণ প্রেম, এমনকি নিজের ব্যক্তিগত জীবনের নৈঃশব্দ্য।
একটি উপন্যাসের সাফল্যের চাবি তার ভাষাশৈলী। লেখক এম এম মাহবুব হাসান এর ভাষা যেমন সহজ, সাবলীল, তেমনি আবেগঘন। কখনো তা নদীর মতো বয়ে চলে, আবার কখনো তা হঠাৎ বৃষ্টির মতো রোমাঞ্চকর আবেগে ছুঁয়ে যায় পাঠককে। উপন্যাসের সংলাপগুলো অত্যন্ত সংবেদনশীল—কখনো এক পঙক্তিতে, কখনো এক নীরব বিরতিতে বলে দেয় জীবনের অনেক না-বলা গল্প। বর্ণনায় রয়েছে চলচ্চিত্রীয় গুণ—পাঠকের মনে চরিত্রগুলো কেবল শব্দ নয়, বরং সচিত্রে আবির্ভুত হয়— চোখ বন্ধ করলেই যেন দেখা যায় তমাল একটি ট্রেনের জানালার পাশে বসে, কুয়াশার হিমে কাঁপছে—চোখে তার অব্যক্ত বেদনার ছায়া, আর দূরে কোথাও নীলা একা,—বুকের মধ্যে সযত্নে পুষে রেখেছে একটি যন্ত্রণাময় অনুতাপ।
এই উপন্যাসে লেখক প্রেমকে শুধু আবেগ বা আকর্ষণের বিষয় হিসেবে দেখাননি। এখানে প্রেমের সঙ্গে সমান্তরালে দাঁড়িয়ে পড়ে সময়, বাস্তবতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও আত্মসংযম। তমাল-নীলার সম্পর্ক কেবল সস্তা আবেগে পূর্ণ একটি গল্প নয়—তারা জানে, তারা একে অপরকে চায়, কিন্তু সময় তাদের সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। তারা হয়তো প্রেমে ছিল, কিন্তু জীবন তাদের সে শাশ্বত প্রেমের মাঝখানে বিচ্ছেদের কঠিন দেওয়াল তুলে দেয়। এই উপন্যাসে বারবার ফিরে আসে একটি দর্শন— “সব প্রেম মিলনের জন্য নয়; কিছু সম্পর্কের সূত্রপাত হয় শিশিরকণার মতো শুকিয়ে যাওয়ার জন্য।”
উপন্যাসটি পড়ে শেষ করার পর মনে হলো, কই? কিছুই তো শেষ হলো না। বরং একটি ভারী দীর্ঘশ্বাস জমা হলো বুকের ভেতর। ‘প্রথম প্রেমের স্পর্শ’ সেই ধরনের সাহিত্য, যা চরিত্র দিয়ে নয়, অনুভব দিয়ে মননে জায়গা করে নেয়। এটি কেবল প্রেমের গল্প নয়—বরং প্রেম না-পাওয়ার গল্প, প্রেম হয়ে ওঠার গল্প, আর চিরকাল প্রেম হয়ে পরস্পরের কাছাকাছি থেকে যাওয়ার গল্প।
লেখক এম এম মাহবুব হাসান তাঁর সচেতন ও দায়িত্বশীল লেখনী দিয়ে এক অনুপম প্রেম-জগত নির্মাণ করেছেন—যেখানে উচ্চারণ নয়, নীরবতাই মূল ভাষা। চিত্রকল্প ব্যবহারেও তিনি দারুণ পারদর্শী। এক কাপ কফি, শরতের আলো, অশ্রুভেজা চিঠি কিংবা থেমে যাওয়া চুম্বন—এসব ছোট ছোট উপাদান দিয়েই তিনি গড়ে তুলেছেন এক পরিপূর্ণ প্রেমালেখ্য। আমার মনে হয়েছে “প্রথম প্রেমের স্পর্শ” কেবল পড়ার জন্য নয়, অনুভবের জন্য লেখা। পাঠ শেষে মনে হয়, এই গল্পটি হয়তো আমাদেরই কারও জীবনের গল্প। এটি এক অনন্য কাব্যিক উপন্যাস, যা বাংলা সাহিত্যে প্রেম নিয়ে লেখা রচনা সম্ভারের ভেতর নিজস্ব আসন তৈরি করতে সক্ষম হবে। যারা প্রথম প্রেমের অনুভবকে এখনো মুছে ফেলতে পারেননি, কিংবা যারা নিঃশব্দে ত্যাগের মধ্যেই ভালোবাসার সৌন্দর্য খুঁজে পান—তাদের জন্য এই উপন্যাস অবশ্যপাঠ্য। কেননা এই উপন্যাস প্রমাণ করে, প্রেম কেবল জীবনে আসে না—সে থেকে যায় নিভৃতে, হারিয়েও যায় সহসা।
লেখক: শিক্ষক, কবি ও ভয়েস আর্টিস্ট

মন্তব্য করুন