শান্তিপ্রিয় জনপদে এক মাসে ডজন ‘খুন’
শান্তিপ্রিয় জনপদ হিসেবে পরিচিত সিলেটের কানাইঘাট উপজেলা। ইদানীং এখানে খুন, অপহরণসহ ফৌজদারি অপরাধ অস্বাভাবিক বেড়েছে। ঘটছে একের পর এক খুন ও রহস্যজনক মৃত্যু। যেন পান থেকে চুন খসলেই খুনোখুনি ঘটছে কানাইঘাটে। চলতি নভেম্বরে এখন পর্যন্ত চার খুন, কয়েকটি রহস্যজনক মৃত্যু এবং ডজনখানেক আত্মহত্যা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে বহুল আলোচিত মুনতাহা অপহরণ ও খুন।
বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, গত ৩ নভেম্বর মুনতাহা অপহৃত হয়, এক সপ্তাহ পর উদ্ধার হয় তার লাশ। ৭ নভেম্বর রেজওয়ান আহমদ নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয় পুকুর থেকে। ৮ নভেম্বর ফয়জুল হোসেন নামে মসজিদের এক মুতাওয়াল্লির গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়, ১৩ নভেম্বর শ্বশুরবাড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার হয় জুবায়ের আহমদের লাশ, ১৫ নভেম্বর কাঠমিস্ত্রী যুবক আব্দুস শুকুরের লাশ উদ্ধার করা হয় ফার্নিচারের দোকান থেকে এবং ১৮ নভেম্বর প্রকাশ্যে দিবালোকে খুন হন ছাত্রদল নেতা আব্দুল মোমিন।
শান্তিপ্রিয় জনপদ হিসেবে পরিচিত এই উপজেলায় প্রকাশ্য দিবালোকে খুন, অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং অপহরণের ঘটনায় জনমনে ভয় ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।
চলতি নভেম্বরে সংঘটিত খুন ও আত্মহত্যার ঘটনাগুলো বেশ আলোচিত। এসব ঘটনায় অভিযুক্তদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কয়েকজন ইতোমধ্যে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
শিশু মুনতাহা হত্যাকাণ্ড
ছয় বছরের শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিনের প্রতি নৃশংসতা সর্বত্র ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। তার অপরহরণ ও লাশ উদ্ধারের ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়। মায়াবী চেহারার চেহারার মুনতাহার হাসিতে কেঁদেছে পুরো নেট দুনিয়া। গত ৩ নভেম্বর বাড়ির পাশে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয় কানাইঘাট সদর ইউনিয়নের বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীম আহমদের মেয়ে মুনতাহা। সেদিন রাতে শামীম আহমদ কানাইঘাট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
জীবিত ও নিরাপদে যেন মুনতাহা ফিরে আসে- এমন আকুতি ছিল নেটিজনসহ সবার। নিখোঁজের আট দিন পর ১০ নভেম্বর উদ্ধার হয় মুনতাহার লাশ। নিখোঁজ নয়, পরিকল্পিত অপহরণের শিকার হয়েছিল অবুঝ শিশুটি। তাকে হত্যা করে লাশ বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত কর্দমাক্ত ডোবায় পুঁতে রাখা হয়, সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার সময় প্রতিবেশী নারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলে জনতা।
মুনতাহা হত্যা ও অপহরণের ঘটনায় প্রধান আসামি মার্জিয়াসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মার্জিয়া ছিল মুনতাহার প্রতিবেশী ও গৃহশিক্ষক। পড়ানো থেকে মার্জিয়াকে বাদ দেওয়ায় এবং কিছুদিন আগে তাকে চুরির অপবাদ দেওয়ায় ক্ষোভ থেকে মুনতাহাকে অপহরণ ও হত্যা করা হয়।
পুকুর থেকে যুবক রেজোওয়ানের লাশ উদ্ধার
মুনতাহাকে যখন পাওয়া যাচ্ছে না এবং নেট দুনিয়ায় তার বিষয়টি ভাইরাল, সেসময় ৭ নভেম্বর ৩০ বছরের যুবক রেজোওয়ান আহমদের লাশ উদ্ধার করা হয় নিজ বাড়ির পুকুর থেকে। পেশায় অটোরিকশা চালক রেজোয়ান উপজেলার লক্ষ্মীপ্রাসাদ পশ্চিম ইউনিয়নের গোরকপুর (খাইল্লাকোনা) গ্রামের খলিলুর রহমানের ছেলে।
পরিবারের দাবি, রেজোওয়ান হত্যাকাণ্ডের শিকার। তাকে পুকুরে ফেলে হত্যা করা হয়েছে অথবা হত্যার পর পুকুরে তার লাশ ফেলে রাখা হয়েছে।
চাচাতো ভাইকে গলা কেটে হত্যা
জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে ৬৫ বছর বয়সী ফয়জুল হোসেনকে গলা কেটে হত্যা করেন তার আপন চাচাতো সুলতান আহমদ (৪৮)। উপজেলার দক্ষিণ বাণীগ্রাম ইউনিয়নের বাউরভাগ নয়াগাউ গ্রামে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে।
ফয়জুল হোসেন নিজ মহল্লার মসজিদের মুতাওয়াল্লি ছিলেন। ঘটনার পর গ্রামবাসী সুলতানকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। পুলিশ ও জনতার উপস্থিতিতে সুলতান স্বীকার করেন হত্যাকাণ্ডের কথা। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ধারালো দাটি জনতার উপস্থিতিতে উদ্ধার করে পুলিশ।
শ্বশুরবাড়ির গাছে ঝুলছিল জামাইয়ের লাশ
১৩ নভেম্বর বড়চতুল ইউনিয়নের চতুল সরুফৌদ গ্রামের শ্বশুরবাড়ির গাছের ডাল থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় জুবায়ের আহমদ (৫০) নামের এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। জুবায়ের আহমদ পার্শ্ববর্তী জৈন্তাপুর উপজেলার চারিকাটা ইউনিয়নের আমিরাবাদ গ্রামের আব্দুল বারীর ছেলে। এলাকাবাসীর ধারণা দাম্পত্য কলহের জেরে জুবায়ের আত্মহত্যা করতে পারেন।
কাঠমিস্ত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু
১৫ নভেম্বর উপজেলার দক্ষিণ বাণীগ্রাম ইউনিয়নের নয়াগাউ মাছুখাল বাজারে একটি ফার্নিচারের দোকান থেকে আব্দুশ শুক্কুর (২৬) নামের এক কাঠমিস্ত্রীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের ঘটনাটি নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এটা খুন না-কি আত্মহত্যা- এ নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে।
অনেকেই এটাকে আত্মহত্যা বলতে নারাজ। তাদের মতে, হত্যা করে যুবকের লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে দোকানে। নিহত আব্দুশ শুকুর একই ইউনিয়নের কায়স্তগ্রামের আব্দুন নূরের ছেলে।
প্রকাশ্য দিবালোকে ছাত্রদল নেতা খুন
সর্বশেষ ১৮ নভেম্বর বিকেলে কানাইঘাট বাজারে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন ছাত্রদল নেতা আব্দুল মুমিন (২৮)। কানাইঘাট পৌর ছাত্রদলের এই যুগ্ম আহ্বায়ক পৌরসভার ধনপুর গ্রামের তাজ উদ্দিনের ছেলে।
জানা যায়, আব্দুল মুমিনের খুনি রাজুর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল। পূর্ববিরোধের জের ধরে ঘাতক রাজু ক্ষুর দিয়ে মুমিনের তলপেটে আঘাত করে। এই সময় লোকজন এগিয়ে গেলে রাজু পালিয়ে যায়। পরে মুমিনকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
প্রকাশ্য দিবালোকে জনসমাগমস্থলে ছাত্রদল নেতা হত্যার ঘটনাটি জনমনে ভীতি আরো বাড়িয়ে দেয়।
গত দুই মাসে কানাইঘাট উপজেলায় আরও কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এত অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় জনমনে ভয় ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
খুন ও নানা রকম ফৌজদারি অপরাধের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে তিনটি কারণের কথা বলেন কানাইঘাট গণশিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক এহসানুল হক জসীম। নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি এবং সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার অভাবে এসব ঘটনা বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
এ থেকে উত্তরণের বিষয়ে এহসানুল হক জসীম বলেন, 'দোষীদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সব ফৌজদারি অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মানুষের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আলেম সমাজকেও ভূমিকা রাখতে হবে। ধর্মীয় বয়ানে নৈতিকতার শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। কানাইঘাটের স্থানীয় প্রশাসনকে এই নিয়ে ভাবতে হবে। বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিতে থানা পুলিশকে আদালতের আগের কাজগুলো যথাযথভাবে করতে হবে।'
এই প্রতিবেদক কথা বলেন কানাইঘাট উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মো. মহি উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'এসব ঘটনা প্রতিরোধে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে প্রতিটি পরিবারের অভিভাবককে সন্তানের বিষয়ে আরও অনেক বেশি সচেতন হতে হবে।'
অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনার তদন্ত চলছে জানিয়ে কানাইঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল আউয়াল বলেন, 'এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।’ আসামিদের মধ্যে কয়েকজন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
(ঢাকাটাইমস/২৪নভেম্বর/মোআ)
মন্তব্য করুন