জাহাঙ্গীরনগরে সাংস্কৃতিক বিপ্লব, সাত দিনে সাত যুগের কাজ

প্রকাশ | ০২ এপ্রিল ২০১৭, ২২:৫৬

শেখ আদনান ফাহাদ

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে বলা যায়, তাঁর কাজ হল জ্ঞান সৃষ্টি করা। গবেষণা করেই তো এই জ্ঞান সৃষ্টি করতে হয়, তাইনা? জ্ঞান আছে, কিন্তু চেতনা কোথায়? প্রকৃত মানুষ হতে গেলে যে সঠিক চেতনারও খুব দরকার। জ্ঞানের পাশাপাশি চেতনা সৃষ্টিতে কিংবা চেতনাকে জাগিয়ে তুলতেও যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ করার কথা। অন্তত বাংলাদেশের জন্য সঠিক চেতনার গুরুত্ব অপরিসীম। তাহলে কীভাবে এই জ্ঞান ও চেতনার সম্মিলন ঘটানো যায়?

ক্লাসে পড়ানো, পরীক্ষা নেয়া, ফলাফল প্রকাশ এবং চূড়ান্তভাবে সনদ বিতরণ, এগুলোই কি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ? দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ালেখার নামে কী হচ্ছে মর্মে মাঝে মাঝেই দীর্ঘশ্বাস শোনা যায় নানা মহল থেকে। নেতিবাচক ঘটনা ঘটলে আর রেহাই থাকেনা। যে যেভাবে পারে পরামর্শ, এমনকি গালিগালাজ দিতে ছাড়েনা। কিন্তু প্রগতিশীল কাজের স্বীকৃতি কজন দেয়? হতে পারে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে হয়তো এই কাজগুলোই হয়। কিন্তু ব্যতিক্রম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সাংস্কৃতিক রাজধানীর মতই কাজ করছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

২০১৭ সালের মার্চ মাসের সাতদিন, ২৫ তারিখ থেকে ৩১ তারিখ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে শুধু নয়, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসেই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেন সাতদিনে সাতযুগের প্রোগ্রাম করলেন! ২৫শে মার্চকে আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের নিমিত্তে জাতীয় সংসদে গৃহীত হওয়া প্রস্তাবের সাথে সম্পূর্ণভাবে একাত্মতা প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বেছে নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন। ২৫শে মার্চকে জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের আলোকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া হয়। গ্রহণ করা হয় সাতদিনের কর্মসূচী!

একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিমাণ বাজেট দেয়া হয়, তা দিয়ে দৈনন্দিন কার্যাবলী পরিচালনা করতেই সিংহভাগ খরচ হয়ে যায়। সেখানে সাতদিনের কর্মসূচী গ্রহণ অভাবনীয়। কিন্তু টাকা-পয়সাই যে সবকিছু নয়। সদিচ্ছা, বুদ্ধি, আইডিয়া এবং বাস্তবায়নের দক্ষতা থাকলে যে এক টাকায় লাখ টাকার কাজ করা যায়, সেটিই যেন প্রমাণ করল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এমনিতে জাহাঙ্গীরনগরে ছোট-খাট  প্রোগ্রাম হয়েই থাকে। বিশেষ করে মুক্তমঞ্চ বলে যে অনন্য সুন্দর জায়গাটি আছে, সেখানে গেলে যে কারো মন ভালো হয়ে যাবে। এই মুক্তমঞ্চকে কী অসাধারণভাবেই না ব্যবহার করল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়! একটা বিশ্ববিদ্যালয় ইচ্ছে করলে কী করতে পারে, তার নতুন নজির সৃষ্টি করল জাহাঙ্গীরনগর। উদ্বোধন করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি।

কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে জাতীয় সঙ্গীতের সাথে লাল-সবুজের জাতীয় পতাকার উত্তোলন করে তারামন বিবির পাশে দাঁড়িয়ে ২৫ মার্চের বৃষ্টিস্নাত বিকেলে সেদিন মঞ্চ আলোকিত করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম নারী উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম এবং দেশের সিনিয়র রাজনীতিবিদ মহিউদ্দিন খান আলমগীর এমপি প্রমুখ। খানিক বাদে এসে অংশগ্রহণ করেন দেশের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এমপি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এর বিপ্লবী আহ্বানের জাদুকরী শব্দে শুরু হয় ২৫ মার্চের প্রোগ্রাম। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে শুরু হওয়া সেই সেদিনের কর্মসূচী চলে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। এক ছোট লেখায় এই সাতদিনের গুরুত্ব এবং অর্জনকে উপস্থাপন সম্ভব নয়।

তারামন বিবির শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। কিন্তু যখন কথা বলা শুরু করলেন, মনে হল নতুন করে মুক্তিযুদ্ধকালীন শক্তি ফিরে পেয়েছেন তিনি। কথা যেন শেষ হয়না এই বীর মুক্তিযোদ্ধার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে পেয়ে হয়তো মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্ব নতুন প্রজন্মের কাছে দিয়ে যেতে চাইলেন তিনি। বললেন, মুক্তিযুদ্ধের কাজ এখনো শেষ হয়নি। ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের কাজে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সর্বশক্তি নিয়োগের আহবান জানান তিনি। উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামকে এই টানা সাতদিন মুক্তমঞ্চে সশরীরে উপস্থিত থেকে সাংস্কৃতিক উৎসবের সভাপতিত্ব করতে হয়েছে। সহজ কাজ নয়। ঢাকার নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করে, ক্যাম্পাসের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে প্রতিদিন মুক্তমঞ্চে উপস্থিত থাকা সহজ কাজ নয়। কিন্তু তিনি এটি করে দেখিয়েছেন। প্রতিদিন বক্তৃতা করেছেন মুক্তমঞ্চের উপস্থিত শত শত দর্শক-শ্রোতার সামনে। এতবড় একটা প্রোগ্রাম, অথচ দেশের মূলধারার গণমাধ্যমে খুব বেশি প্রচার পায়নি এই সাংস্কৃতিক উৎসব। আমি অবশ্য এতে অবাক হইনি। ভালো কাজের প্রচার দিতে এখনো শেখেনি আমাদের গণমাধ্যম। সাংস্কৃতিক উৎসব না হয়ে যদি টানা সাতদিন মারামারি হত, তাহলে আমরা দেশের গণমাধ্যমগুলোর অন্য আচরণ আমরা লক্ষ্য করতাম। এই প্রবণতা থেকে যত তাড়াতাড়ি আমাদের গণমাধ্যম বের হয়ে আসবে, তত দেশ ও দশের মঙ্গল।   

এই সাতদিনে কারা কারা এসেছেন জাহাঙ্গীরনগরের সবুজ ক্যাম্পাসে? সবার নাম এখানে লেখা সম্ভব নয়। দেশ-বিদেশের অর্ধশতাধিক গুণী ব্যক্তিত্বকে দাওয়াত দিয়ে এনে সম্মাননা দিয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সম্মাননা নিতে এসে, মুক্তমঞ্চের মায়াময় পরিবেশ পেয়ে মুগ্ধ অতিথিরা নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে। মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, সফল ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ সমাজের প্রায় সবক্ষেত্রের গুণী ব্যক্তিবর্গ জাহাঙ্গীরনগরকে আলোকিত করেছেন। ক্লাসরুমে আমরা পড়াতে গিয়ে অনেক কথা বলি। কিন্তু সবসময় কি আমাদের কথায় ছাত্র-ছাত্রীদের মন ভেজে? ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য  এই সাতদিন ছিল বিরল এক সুযোগ। যারা এর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে, তারা ঠিকই বিকেল থেকে রাত অবধি মুক্তমঞ্চে বসে থেকে কথা শুনেছে। কথা শুনে হাততালি দিয়েছে গান শোনার মত। নাটক মঞ্চস্ত হয়েছে পাঁচটি। মজার বিষয় হল,  প্রাকৃতিক কোনো বাধার মুখেও পড়তে হয়নি আয়োজক এবং অংশগ্রহণকারীদের। বৃষ্টি হয়েছে রাতে, অনুষ্ঠানের শেষে। যেন অতিথিদেরকে আরাম দিতেই বিধাতার এই আয়োজন।

অনুষ্ঠানের শেষদিন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারাজানা ইসলাম প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু দারুণ ঘোষণা প্রদান করেন। তিনি জানান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন থেকে প্রতিবছর জাতীয় গণহত্যা দিবস এবং ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে এ জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজন করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনোসাইড স্টাডিজ সেন্টার ও লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ সেন্টার প্রতিষ্ঠাকল্পে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দেন উপাচার্য।

বসন্তের নতুন পাতা, নতুন ফুল, আরামের বৃষ্টি, নানারঙের ব্যানার-ফেস্টুন, সাতদিনে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর পদচারণ, দেশের গুণী ব্যক্তিত্বদের দারুণ মজার তাৎপর্যপূর্ণ বক্তৃতা, নাটক, সব মিলে জাহাঙ্গীরনগরের ইতিহাসে এই সাতদিন অন্যরকম, অনন্য হয়ে থাকবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এমন সাতদিন, ফিরে আসুক প্রতিবছর।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়