কারাগারে বিশেষ বন্দিদের মোবাইল ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই: আইজি প্রিজন্স
কারাগারে নির্ধারিত এলাকায় মোবাইল ফোন জ্যামার এবং সিসি ক্যামেরা থাকায় বিশেষ প্রকৃতির বন্দিদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন।
তবে বিধি মোতাবেক শ্রেণিপ্রাপ্ত বন্দিরা খাট, চেয়ার-টেবিল, পত্রিকার পাশাপাশি কিছু অতিরিক্ত খাদ্যদ্রব্য পেয়ে থাকেন বলে জানান তিনি।
বুধবার সকালে রাজধানীর বকশীবাজারের দেশের কারাগারগুলোর বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন মো. মোতাহার হোসেন।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন পরবর্তী সময়ে দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কারের উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় কারা প্রশাসনেও বেশ কিছু সংস্কার ও পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে শৃঙ্খলা আনয়নসহ বন্দিদের সকল প্রকার প্রাপ্যতা বিধি-বিধানের আলোকে নিশ্চিতের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বন্দিদের খাবারের তালিকায় আমিষের পরিমাণ বৃদ্ধি, কারাগারগুলোকে উৎপাদনমুখী করা, তারা বন্দি ও কর্মচারীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল নির্মাণ এবং প্রতিটি কারাগারে অ্যাম্বুলেন্স সরবরাহের ন্যায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে।’
মোতাহার হোসেন বলেন, ‘পরিবর্তিত সময়ে কারাগারগুলোতে সাময়িকভাবে বন্দির সংখ্যা তুলনামুলকভাবে কমলেও বর্তমানে তা উর্ধ্বমুখী। তাছাড়া বিশেষ প্রকৃতির বন্দির সংখ্যাও কম নয়। তবে সকল সময়ের ন্যায় কারা বিধিসহ অন্যান্য বিধি-বিধানের আলোকে তাদের নিরাপদ আটক ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হচ্ছে। কারাগারে সকল বন্দিকে আগমনের পর শ্রেণি/ঝুঁকি নির্ধারণপূর্বক প্রকৃতি অনুযায়ী নির্ধারিত ওয়ার্ড/সেল এলাকায় পাঠানো হয়। বিশেষ প্রকৃতির বন্দিদের ওয়ার্ড/সেলে মোবাইল ফোন জ্যামার স্থাপন করাসহ সিসি ক্যমেরা দ্বারা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং প্রতিদিন কয়েকবার তল্লাশী করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘কারাবন্দিরা যোগাযোগের ক্ষেত্রে আদালতের আদেশ ছাড়াও সকল প্রকার বিচারাধীন বন্দি প্রতি ১৫ দিনে এবং সাজাপ্রাপ্ত বন্দি ৩০ দিনে আইনজীবীসহ একবারে পরিবারের সর্বোচ্চ পাঁচজন সদস্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন। এছাড়া প্রত্যেক বন্দিই প্রতি ৭ দিনে একবার আইনজীবীসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তিনটি নম্বরে ১০ মিনিটের জন্য কথা বলার সুযোগ পান। শ্রেণিপ্রাপ্ত বন্দিরা দিনে দুইবেলা এবং অন্য সকল বন্দি দিনে একবেলা আমিষ জাতীয় খাবার পান। কারাগারের ভেতরের ক্যান্টিনের পণ্যের দাম ন্যায্যতার সঙ্গে নির্ধারণসহ ক্যান্টিন সুবিধা সকলের জন্যই উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষে মাসিক সর্বোচ্চ ব্যয় নির্ধারণ করে দেওয়ার উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে।’
সম্প্রতি কারাগারে বন্দিদের মোবাইল ফোন ব্যবহারসহ আয়েশী জীবন-যাপন করছে। বেশকিছু গণমাধ্যমে এমন সংবাদ প্রকাশ হয়েছে।
এ বিষয়ে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, ‘বিশেষ প্রকৃতির বন্দিদের নির্ধারিত এলাকায় মোবাইল ফোন জ্যামার এবং সিসি ক্যামেরা থাকায় মোবাইল ফোন ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। বিধি মোতাবেক শ্রেণিপ্রাপ্ত বন্দি খাট, চেয়ার-টেবিল, পত্রিকার পাশাপাশি কিছু অতিরিক্ত খাদ্যদ্রব্য পেয়ে থাকেন, যা দিয়ে আয়েশী জীবন-যাপন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অপরদিকে কোনো বন্দিকে কারাগারের বাইরে পাঠানোর সময় প্রধান ফটক পর্যন্তই কারা কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ ও দায়-দায়িত্ব থাকে। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিধি মোতাবেক নিরাপত্তাসহ হাতকড়া/ডান্ডাবেড়ি পরানো, প্রিজন ভ্যান/মাইক্রোবাসে নেওয়া ইত্যাদি পরিচালিত হয়ে থাকে। তবে কয়েকটি গণমাধ্যমে কারাগার ও কারাবন্দিদের নিয়ে ধারণাগত সংবাদ প্রচার করার ফলে জনমনে কারাগার সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য পৌঁছাচ্ছে বলে কারা কর্তৃপক্ষ মনে করে।
কারাগারগুলোতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ
১। কারা অভ্যন্তরের সকল প্রকার তল্লাশী জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া অবৈধ দ্রব্যাদির প্রবেশ রোধকল্পে প্রবেশপথে বডিস্ক্যানারসহ অন্যান্য আধুনিক সরঞ্জামাদি স্থাপন করা হয়েছে।
২। কারা অভ্যন্তরে মাদক দ্রব্যের প্রবেশ রোধকল্পে ঝুঁকিপূর্ণ কারাগারগুলোতে ডগ স্কোয়াড মোতায়েন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে।
৩। সৎ এবং যোগ্যতাসম্পন্ন অফিসার এবং কারারক্ষীদের পেশাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে কারা সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কারাগারগুলোতে পদায়ন করা হয়েছে।
৪। অসাধু কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে চাকরি হতে অপসারণ, তাৎক্ষণিক বদলিসহ সকল প্রকার বিভাগীয় কার্যক্রম। জোরদার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আইনি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেকে আবার অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িত হচ্ছেন বিধায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রনে আইনি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
৫। সকল সময়ে বন্দিদের সঙ্গে মানবিক আচরণ নিশ্চিতের জন্য বেশ কয়েকটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বন্দিদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী খাবারসহ প্রয়োজনীয় সরাঞ্জামাদির সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য কঠোর তদারকি অব্যাহত রয়েছে। বন্দিদের দেখা সাক্ষাৎ, টেলিফোনে কথোপকথন, চিকিৎসা সেবা যথাযথভাবে নিশ্চিতের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারিসহ তা বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে।
৬। বন্দি ব্যবস্থাপনা অধিকতর স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে কারাগার ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সফটওয়্যারসহ, আর এফ আইডি এবং জিপিএস ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সেবা প্রত্যাশিদের সহায়তার জন্য ২৪ ঘণ্টা হটলাইন চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
৭। কারাগারকে সংশোধনাগার হিসেবে রূপান্তরের লক্ষ্যে বন্দিদের প্রশিক্ষণসহ তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে থাকবে নতুন পণ্যের উৎপাদনের লক্ষ্যে স্থাপনা তৈরি, পুরনো যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন। এছাড়া বিজিএমই-এর সহায়তায় একটি পূর্ণাঙ্গ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং লাইন স্থাপনের লক্ষ্যে তাদের সাথে সমঝোতা স্বাক্ষরসহ কারাগারে কর্মদক্ষতা অর্জনকারী বন্দিদের তাদের মুক্তির পর বিজেএমই আওতাভুক্ত ফ্যাক্টরিসমূহে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাকরি প্রদানের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করণের বিষয়ে আলোচনা চলছে। পরবর্তীতে কারাগারে খাবার পানি বোতলজাতকরণ, মাস্ক তৈরির মত কার্যক্রমও গ্রহণ করা হবে।
৮। অতি পুরাতন কারা আইন ও বিধি-বিধান সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণসহ কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কল্যাণে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জনবল বৃদ্ধি, পদ-পদবির আপগ্রেডেশন, নিয়োগবিধি পরিবর্তনসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিকরণ। এ সকল বিষয়সমূহ সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে।
৯। নানা মহলের দাবির প্রেক্ষিতে কারা অধিদপ্তরের লোগো পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত লোগো যেন কারা অধিদপ্তরের কর্মকান্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখা হবে।
১০। বন্দি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল স্থাপনসহ বেশ কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ কারাগার পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া জ্যামার, বডিক্যমসহ আধুনিক সরঞ্জামাদি ক্রয়ের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে।
১১। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন স্তরে নিয়মিত প্রশিক্ষণের আয়োজনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং এরূপ বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন করা হয়েছে।
১২. কারাগার সমূহের ভবনগুলোর অব্যবহৃত ছাদসমূহ ব্যবহার করে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এতে সরকারের বিপুল রাজস্ব সাশ্রয় হবে এবং বাড়তি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার ব্যবস্থাও রাখা হবে, যা দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
(ঢাকাটাইমস/৪ডিসেম্বর/এলএম/এজে)
মন্তব্য করুন