খরচের ধাক্কায় তছনছ হবে মধ্যবিত্ত

প্রকাশ | ০৩ জুন ২০২৩, ০৮:৩৬ | আপডেট: ০৩ জুন ২০২৩, ১৭:৫৬

রুদ্র রাসেল

মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের অনেকেই আশায় ছিলেন নতুন বাজেট তাদের স্বস্তি দেবে। কিন্তু সদ্য পেশ করা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নতুন এই বাজেট জীবনযাত্রায় যোগ করেছে নতুন নতুন ব্যয়। চাপিয়ে দিয়েছে বাড়তি খরচের বোঝা। ৩৮টি সেবা পেতে দুই হাজার টাকা কর দিয়ে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতকামূলক করা হয়েছে। যার বেশিরভাগ সেবাই মধ্য-নিম্নমধ্যবিত্তসহ সীমিত আয়ের মানুষ গ্রহণ করে থাকেন।

এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বাজেটে বলা হলেও ভোজ্যতেলসহ নিত্যপণ্যের দাম কমানোর উপযুক্ত পদক্ষেপ নেই। উপরন্তু এসব শ্রেণির মানুষের ব্যবহার্য বেশ কিছু গৃহস্থলী সামগ্রির মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। সব মিলিয়ে সামনে মধ্যবিত্তের জন্য আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে বাজেটের প্রভাব পড়তে কিছু দিন সময় লাগবে। চলতি মাসের শেষ দিকে বা জুলাইয়ের প্রথম থেকেই চরম চাপে পড়বেন মধ্যবিত্তরা। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে লক্ষ্য বাজেটে নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জন অনেকটা অসম্ভবই বলা চলে। আর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কোনো উদ্যোগকে নির্দিষ্ট করে বাজেটে অন্তর্র্ভুক্ত করা হয়নি।

এদিকে গত কয়েক মাসের উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সীমিত আয় ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনে ভোগান্তি বেড়েছে। নতুন বাজেটে ভোগান্তি কমাতে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হবে- অনেকে এমন আশায় থাকলেও তা ঘটেনি। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মধ্যবিত্তের ওপর চাপ কমানোর তেমন উদ্যোগ নেই, বরং বাজেটের কিছু প্রস্তাব তাদের বাড়তি চাপে ফেলবে।

শুল্ক-কর বাড়ানোর ফলে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ওভেন, ফ্রিজের মতো দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, যা মধ্যবিত্তের খরচ বাড়াতে বাধ্য করবে। ভোজ্যতেল নিয়ে কয়েক মাস ধরেই তেলেসমাতি চলছে। ইতোমধ্যে প্রতি লটার তেলের দাম ২০০ টাকা ছাড়িয়েছে। গত মার্চ মাসে দাম নিয়ন্ত্রণে আমদানি করা ভোজ্যতেলে ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর মেয়াদ আগামী ৩০ জুন শেষ হচ্ছে। কিন্তু বাজেটে এ নিয়ে কোনো কথা বলেননি অর্থমন্ত্রী। ভ্যাট কমানোর মেয়াদ না বাড়ানো হলে আমদানি খরচ বাড়বে। এ প্রভাব সীমিত আয়ের মানুষ, মধ্যবিত্তসহ ভোক্তাদের ওপরই পড়বে।

প্রস্তাবিত বাজেটে ৩৮ ধরনের সেবা পেতে হলে আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রিটার্ন জমা না নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান এই ৩৮ সেবা দেবে, তাদের ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ওই ৩৮টি সেবার মধ্যে বেশ কিছু মধ্যবিত্তের জীবন ঘনিষ্ঠ। যেমন, ব্যাংকঋণ পাওয়া, সঞ্চয়পত্র কেনা, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার, অনলাইনে বেচাকেনার ব্যবসা। এমনকি সন্তানকে ইংরেজি সংস্করণে (ইংলিশ ভার্সন) পড়াশোনা করালেও রিটার্ন জমা দিতে হবে। এসব সেবা পেতে একবার করজালে ঢুকলে প্রতি বছর নিজের আয়-ব্যয়ের বিবরণী এনবিআরে জমা দিতে হবে।

বর্তমানে ৮৭ লাখ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএনধারী) আছেন। তাদের মধ্যে ২৯ লাখের মতো টিআইএনধারী প্রতি বছর নিজেদের আয়-ব্যয়ের তথ্য জানিয়ে রিটার্ন দেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, মূল্যস্ফীতি কমানোর পদক্ষেপ, খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য স্বস্তির বার্তা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই বাজেটে।

তিনি বলেন, এবার ব্যাংক খাত থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের উপরে। সেখানে সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি কমানো অসম্ভব। মূল্যস্ফীতি প্রক্ষেপিত লক্ষ্য ৬ শতাংশে আসবে কীভাবে আমার জানা নেই।’তিনি বলেন, বাজেটে অতিদরিদ্রদের জন্য সামান্য কিছু থাকলেও খেটে খাওয়া মানুষের জন্য কিছুই নেই। এসব খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ বাড়ালে কর্মসংস্থান বাড়ত। সঙ্গে বৃদ্ধি পেত উৎপাদন। মূল্যস্ফীতিও কমে আসত। ’

এদিকে আইএমএফের শর্ত পূরণে ভর্তুকি কমাতে এরই মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। এর ওপর রাজস্ব আদায় ঠিক রাখতে আগামী অর্থবছর থেকে ১৩ ধরনের জ্বালানি পণ্যের ওপর বিদ্যমান শুল্কের বদলে সুনির্দিষ্ট শুল্ক আরোপ করছে সরকার। প্রতি লিটারে নতুন এই শুল্ক হতে পারে সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট এ প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে ১২ ধরনের জ্বালানির শুল্ক হার ১০ শতাংশ। আসন্ন বাজেটে সুনির্দিষ্ট শুল্ক আরোপ করা হলে তা খুচরা মূল্যে বেশি প্রভাব ফেলবে। পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭ দশমিক ০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯ দশমিক ১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

এদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে গ্যাস সিলিন্ডার তৈরির দুটি কাঁচামাল আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডারের ভ্যাট আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে দেশে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম বাড়বে। যা শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্তের ঘাড়েই পড়বে।

অন্যদিকে অসুখ-বিসুখসহ বিভিন্ন জরুরি প্রয়োজনে ব্যাংক ঋণ নেন মধ্যবিত্তরা। এবার বাজেটে সেই পথকে কঠিন করে তোলা হয়েছে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণের আবেদন করলে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে। রিটার্ন জমার রসিদ বা প্রাপ্তি স্বীকারপত্র জমা না দিলে ঋণ দেবে না ব্যাংক, দিলে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা আরোপ।

ব্যাংকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) বা অন্য কোনো আমানতের সুদের টাকায় সংসারের বড় অংশ খরচ করেন অনেক মধ্যবিত্ত। সুদের টাকা বেশি পেলে তাদের স্বস্তি দেয়। অথচ আগের মতো এবার সেই স্বস্তির জায়গায় শর্ত বলবৎ রাখা হয়েছে। সুদের টাকা উত্তোলন করার সময় টিআইএন দেখালে ১০ শতাংশ এবং টিআইএন দেখাতে না পারলে ১৫ শতাংশ কর কেটে রাখা হয়। এবার থেকে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র না দেখাতে পারলে ১৫ শতাংশ হারেই উৎসে কর কেটে রাখা হবে।

ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ সভাপতি গোলাম রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, এমনিতেই নিত্যপণ্যসহ সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্তরা সংসার চালাতে হিমশিত খাচ্ছেন। বাজারে এমনিতেই বিশৃঙ্খলা। সরকার নির্ধারিত মূল্যে কোনো কিছুই কেনা যায় না। সেগুলো নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ বাজেটে নেই। উপরন্তু করযোগ্য আয় না থাকলেও রিটার্ন জমা দিতে দুই হাজার টাকা কর নির্ধারণের যে প্রস্তাব, তা সীমিত আয়ের মানষকে নতুন করে চিন্তায় ফেলেছে। এছাড়া সীমিত আয়ের মানুষ ব্যবহার করেন, এমন কিছু জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। যা বাজেট পরবর্তী সময়ে মধ্য ও নি¤œবিত্তের গলার কাটা হয়ে দাঁড়াবে। ভীষণ চাপে পড়বেন তারা। সংসার চালানো দায় হয়ে পড়বে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, বাজেটে নি¤œমধ্যবিত্তের ওপর চাপ বাড়বে। তারা জীবনধারণের জন্য যেসব পণ্য ক্রয় করে সেগুলোর মূল্য সাধারণ মূল্যস্ফীতির চেয়ে দুই-তিন গুণ বেড়ে গেছে। এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতার অবনমন হয়েছে। সেটা আগামী এক-দুই বাজেটেও দূর করা যাবে বলে মনে হয় না।

আরও পড়ুন: এবারের বাজেট গরিব-ধনী সবার জন্য: অর্থমন্ত্রী

প্রসঙ্গত, উচ্চবিত্ত বাদ দিয়ে দারিদ্র্যসীমার ওপরে যাদের বসবাস তারাই মধ্যবিত্ত। এ সংখ্যা দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৩০ শতাংশ। আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সব খাতে নিম্নমধ্যবিত্তরা বড় ভ‚মিকা রাখছে। এসএমই খাতের মাধ্যমে আমাদের জিডিপির ২৫ শতাংশ তারাই অবদান রাখে।

(ঢাকাটাইমস/০৩জুন/)