ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-১৭

কোরআনের মোজেজা, কেয়ামত ও পুনরুত্থান

প্রকাশ | ২৭ মার্চ ২০২৪, ২২:৫৭ | আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৯:৫৭

​​​​​​​মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী

প্রিয় পাঠক,

ঢাকা টাইমসের আয়োজনে আজ আমরা পবিত্র কুরআনুল কারীমের ১৭তম পারার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো জানার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।  চলুন তাহলে আমরা শুরু করি...

আগের পর্ব: বাদশা জুলকারনাইন, ঈসা-ইবরাহিম আ. ও ইয়াজুজ-মাজুজের বিস্ময়কর ঘটনা

সুরা আম্বিয়া

 

এটি মক্কি সুরা। আয়াতসংখ্যা: ১১২। রুকুসংখ্যা: ৭

 

নামকরণ

 

সুরা আম্বিয়ার মাধ্যমে সতেরোতম পারা শুরু হয়েছে। এই সুরাতে সতেরোজন নবীর আলোচনা এসেছে। তাই একে সুরা আমবিয়া বলা হয়। বুখারি শরিফে হজরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে, সুরা বনি ইসরাইল, সুরা কাহাফ, সুরা মারিয়াম, সুরা ত-হা ও সুরা আমবিয়া প্রথমদিকে অবতীর্ণ হয়েছে, এবং এগুলো আমার অনেক আগের উপার্জিত সম্পদ।'

 

সুরা আমবিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

 

কেয়ামত অতি নিকটে

 

১. সুরা আমবিয়ার শুরুতে পার্থিব জীবনে ক্রান্তিকালের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, কেয়ামত অতি নিকটে। হিসাবের সময় ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর দিনের ব্যাপারে মানুষ উদাসীনতায় ডুবে আছে। না তারা এজন্য কোনো প্রস্তুতি নিচ্ছে আর না এমন কোনো কাজ করছে, যা তখন কাজে আসবে। তাদের সামনে যখন নতুন কোনো আয়াত আসে, তখন তারা তা নিয়ে ঠাট্টা- বিদ্রুপ করে। তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। তারা জানেই না যে, কতটা বিনয়- নম্রতার সাথে এ মহান কালাম শ্রবণ করা উচিত!

 

সকল নবীই মানুষ ছিলেন

 

২. মুশরিকরা পরস্পরে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে বলত, এই লোক মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদার। সে রাসুল নয়; সে বরং তোমাদের মতোই সাধারণ মানুষ। অন্যান্য নবীর মতো সে চাক্ষুষ মুজিজা প্রদর্শন করতে অক্ষম। কোরআনে এর উত্তরে বলা হয়েছে, পূর্বে যত নবী-রাসুল প্রেরিত হয়েছে, তারা সকলেই মানুষ ছিলেন। তারা পানাহার করতেন। মানবিক প্রয়োজন পুরা করতেন। এমন কোনো নবী ছিলেন না, যার মানবিক প্রয়োজন পূরণ করতে হতো না।

 

 

কোরআনের মুজিজা

 

মুজিজার প্রশ্নে বলা হয়েছে, কোরআনের চেয়ে বড় মুজিজা কী হতে পারে? এটা মুজিজা হওয়ার প্রধান দিক হচ্ছে, বিভিন্ন আকিদা-বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা এবং মত- কবির লোকেরা এতে নিজেদের চেহারা পরিলক্ষ করতে পারে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এতে সকল ধরনের ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের আলোচনা করা হয়েছে। কারাহ তায়ালা বলেন, আমি তোমাদের নিকট এমন এক কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমাদের আলোচনা রয়েছে। তোমরা কি বোঝো না? (১০)

 

প্রসিদ্ধ তাবেয়ি আরব-সরদার হজরত আহনাফ বিন কায়েস রহ. এর ব্যাপারে হরিত আছে, তিনি একদিন বসে ছিলেন। তখন এক ব্যক্তি তার সামনে এই আয়াত তেলাওয়াত করে। তিনি তখন সচকিত হয়ে বলেন, কোরআন শরিফটা একটু নাও তো! আমি এতে আমার আলোচনা খুঁজে দেখবো। দেখার চেষ্টা করব আমি কাদের সাথে আছি? কাদের সাথে আমার সাদৃশ্য রয়েছে?

 

তিনি কোরআনের পাতা উলটাতে থাকেন। বিভিন্ন শ্রেণির লোকের অবস্থা পড়তে থাকেন। প্রথমে তিনি একটি আয়াত তেলাওয়াত করেন, যাতে সেসব সৌভাগ্যশীল ব্যক্তির আলোচনা করা হয়েছে, যাদের কেউ আল্লাহর রাস্তায় জান কোরবান করেছে। কেউ এ রাস্তায় সমস্ত ধনসম্পদ ব্যয় করে দিয়েছে। কেউ রাতে কখনো বিছানায় পিঠ লাগায়নি। কেউ কখনো কোনো খারাপ কাজের কাছেধারেও যায়নি।

 

এরপর তিনি সেই আয়াত তেলাওয়াত করেন, যাতে মুশরিক, কাফের, মুনাফিক ও ফাসেকদের আলোচনা করা হয়েছে। উভয় প্রকার আয়াত পাঠ করার পর তিনি বলে ওঠেন, হে আল্লাহ, আমি এই দু-দলের কোনো দলেরই অন্তর্ভুক্ত নই। এরপর তিনি সুরা তাওবার এক আয়াত অধ্যয়ন করেন, যাতে সেসব লোকের আলোচনা করা হয়েছে, যারা গুনাহও করে আবার নেকআমলও করে। এই আয়াত পড়ে তিনি বলে ওঠেন, হ্যাঁ, এখানে আমার কথা আলোচনা করা হয়েছে। এভাবে তিনি কোরআন থেকে নিজের আলোচনা খুঁজে বের করেন।

 

মুশরিকদের এক হাস্যকর আপত্তি ও বোকামি এটাও ছিল যে, কোরআনের ব্যাপারে তারা বিশেষ কোনো আপত্তির উপর স্থির ছিল না। কখনো বলত এটা জাদু। কখনো বলত এটা কবিতা। কখনো বলত এটা স্বপ্ন। কখনো একে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বানানো কিছু বলত। কখনো বলত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারো থেকে তা শিখেছে।

 

তাদের এই মতভিন্নতার কথা আলোচনা করতে গিয়ে কোরআন বলেছে, এ ছাড়াও তারা বলে যে, তা অলীক স্বপ্ন; বরং সে একে নিজে রচনা করেছে, কিংবা সে একজন কবি। অতএব সে আমাদের কাছে কোনো নিদর্শন নিয়ে আসুক, পূর্ববর্তীগণ যেমন নিদর্শনসহ প্রেরিত হয়েছিলেন। (৫)

 

 

"কোরআন এরপর মুশরিকদের জালেম সম্প্রদায়ের পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, যাদেরকে আল্লাহ তায়ালা চক্ষুষ্মানদের শিক্ষার উপকরণ বানিয়ে দিয়েছেন। এসব ধ্বংসপ্রাপ্ত সম্প্রদায় যখন আল্লাহর আজাব দেখতে পেয়েছিল তখন তারা পলায়নের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আল্লাহ তাদের সে সুযোগ দেননি। তিনি তাদেরকে কর্তিত শস্য ও নির্বাপিত আগুনে পরিণত করেছেন। (১১-১৫)

 

তাদেরকে বলা হয়েছিল, এখন পলায়নের চেষ্টা কোরো না; বরং ফিরে এসো। তোমরা যে ভোগ-বিলাসে মত্ত ছিলে তার দিকে ফিরে এসো। সেসব উঁচু উঁচু দালান- কোঠা ও সমৃদ্ধ জনপদে তোমরা ফিরে এসো, যেখানে তোমরা অত্যন্ত আনন্দের সাথে দম্ভভরে চলাফেরা করতে, যাতে করে এসব ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদের দৃশ্য দেখে আজাব অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে অভিযোগকারীদের উত্তর দিতে পারো। বস্তুত তাদের সেই অবকাশটুকু আর নেই। এজন্য হজরত কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ঠাট্টা-বিদ্রূপবশত তাদেরকে এমনটা বলা হয়েছিল।'

 

একত্ববাদের অসংখ্য প্রমাণ

 

৩. বিশ্বজগতের উন্মুক্ত গ্রন্থে রাব্বুল আলামিনের একত্ববাদের অসংখ্য দলিল- প্রমাণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এ বিশ্বজগতে আসমান-জমিন, চন্দ্র-সূর্য, দিনরাত্রি যা কিছু রয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তা খেল-তামাশার জন্য সৃষ্টি করেননি; বরং এর পেছনে অনেক হেকমত নিহিত রয়েছে। এসব সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য হল, মানুষ যেন এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে যে, বিশ্বজগতের সবকিছু আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করে। তার তাসবিহ জপে। কিন্তু অকৃতজ্ঞ লোকেরা হরহামেশা তার অবাধ্যতা করে। (১৬-২০)

 

৪. মুশরিকরা আল্লাহর পরিবর্তে বিভিন্ন জড়পদার্থের সামনে মাথা নত করত। তাদেরকে তিরস্কার করা হয়েছে, এসব মূর্তি কীভাবে ইবাদতের উপযুক্ত হতে পারে! এ ব্যাপারে তাদের থেকে দলিল চাওয়া হয়েছে। বলাবাহুল্য, তাদের নিকট প্রতিমাপূজার পক্ষে না যুক্তিনির্ভর কোনো দলিল আছে আর না বর্ণনানির্ভর কোনো ঐশী প্রমাণ রয়েছে।

 

ছয়টি দলিল

 

মুশরিকদের ভ্রান্ত দলিল খণ্ডন করার পর একক স্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারে ছয়টি দলিল উপস্থাপন করা হয়েছে। দলিলগুলো তাকবিনি (বিশ্বজগতের নিপুণ ব্যবস্থাপনায় নিহিত দলিল)। উল্লেখ্য, সুরায় উল্লেখকৃত দলিলগুলো চাক্ষুষ পর্যায়ের। দৃষ্টি প্রসারিত করলে যেকারো নজরে পড়বে তা। আলেমগণ বলেছেন, এগুলো মহান স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে থাকে। নিম্নে আমরা সেগুলো তুলে ধরছি:

 

প্রথম দলিল: আসমান-জমিন উভয়টিই মিলিত ছিল। আমি উভয়কে পৃথক করে দিয়েছি।' আকাশকে ফেরেশতাদের ঠিকানা বানিয়েছি। আর জমিনকে মানুষের কামান বানিয়েছি। কোরআন আসমান ও জমিনের মিলিত থাকার যে বিষয়াটি হয়েম করেছে, তা তৎকালীন বিশ্বের কেউ-ই জানত না। আরবরাও জানত না। জুন প্রায় দু-শতাব্দী হল, পদার্থবিজ্ঞানীরা দীর্ঘ গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের পর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, গ্রহ-নক্ষত্র, আসমান-জমিন মিলিত ছিল। এরপর একটি অপরটির থেকে পৃথক হয়ে গেছে। আজ থেকে চোদ্দশ বছর পূর্বে কোরআনের নির্দ্বিধায় এ বাস্তবতা উল্লেখ করা মুজিজা ছাড়া কী হতে পারে?

 

দ্বিতীয় দলিল: আমি প্রত্যেক জীবকে পানি থেকে সৃষ্টি করেছি। বর্তমান বিশ্বের সকল জ্ঞানী-গুণী ও বিজ্ঞানীরা স্বীকার করে যে, সকল জীবের মধ্যে পানির উপাদান রয়েছে। পানি ব্যতীত কখনো জীবন সঞ্চার হতে পারে না। মানুষ, জীবজন্তু, বৃক্ষলতা সবকিছুই পানির মুখাপেক্ষী। বিজ্ঞানীরা আজ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। অথচ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বহু আগেই তা বলে গেছেন। চন্দ্রের দিকে লক্ষ করুন। তা পৃথিবীর মতোই। কিন্তু পানি না থাকায় সেখানে জীবনযাপন করা সম্ভব নয়।

 

তৃতীয় দলিল : জমিনে আমি পাহাড় স্থাপন করেছি, যাতে মানুষদের নিয়ে তা হেলে না পড়ে। যদি এসব পাহাড় না থাকত তা হলে পৃথিবী ক্রমাগত দোল খেতে থাকত। ভূগর্ভের আগুন থেকে আত্মরক্ষা করা যেত না। এখনও যে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আগ্নেয়গিরির পাহাড় পরিলক্ষিত হয়, এর মাধ্যমে যেন পৃথিবী শ্বাস- প্রশ্বাস নিয়ে থাকে।

 

চতুর্থ দলিল : আমি পৃথিবীতে প্রশস্ত রাস্তা বানিয়েছি, যাতে মানুষ তার উপর চলাফেরা করতে পারে। যদি সমতল ভূমি থেকে একটু দৃষ্টি ফিরিয়ে আমরা পাহাড়ের দিকে দৃষ্টিপাত করি, তা হলে দেখতে পাবো যে, এতসব সারি সারি উঁচু ২পাহাড়ের মাঝেও এমন প্রশস্ত চলার পথ ও পানির প্রস্রবণ রয়েছে, যার ফলে সফরের সময় এখানে চলাফেরা করতে মানুষের তেমন কষ্ট পেতে হয় না।

 

পঞ্চম দলিল: আকাশকে আমি সংরক্ষিত ছাদ বানিয়েছি। এ ছাদে চন্দ্র-সূর্য এবং লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র রয়েছে, যা অতি দ্রুততার সাথে স্বীয় কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করছে। এগুলোর মধ্যে কোনো সংঘর্ষ হয় না। এরা কখনো নিজ কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয় না। কোনো নক্ষত্র যদি আপন কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে পড়ে তা হলে

 

বিশ্বজগতের ব্যবস্থাপনাই ভণ্ডুল হয়ে যাবে। তা হলে সেই মহান সত্তা কে, দিনি এসব নিয়ন্ত্রণ করছেন? এগুলোকে তাদের কক্ষপথে পরিচালিত করছেন? এদিক এদিক হতে দিচ্ছেন না? তিনি কি 'লাত-হুবল', 'উজ্জা-মানাত'? কখনোই নয়, বরং তিনি হচ্ছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশ্বজগতের স্রষ্টা।

 

ষষ্ঠ দলিল। এটি তাকবিনি দলিল। এতে বলা হয়েছে, দিনরাত, চন্দ্র-পূর্ব সবকিছু আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন। এগুলো আকাশে সাঁতার কাটে। এগুলো পরস্পর প্রদক্ষিণ করে। এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয় না। এগুলো ধারাবাহিকভাবে ক্রমাগত প্রদক্ষিণ করে আর প্রদক্ষিণ করাই তাদের কাজ। (৩০-৩৩)

 

দিনরাত, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রের ব্যাপারে কোরআন যা বলেছে, তা সম্পূর্ণ নির্ভুল ও সঠিক। কোরআন এমন এক সময় এসব তথ্য উপস্থাপন করেছে যখন তৎকালীন বড় বড় জ্ঞানী-গুণীরাও এ ব্যাপারে কিছু জানত না। আজকের আধুনিক

 

বিজ্ঞান ও কোরআনের এ বক্তব্য সমর্থন করে। পদার্থবিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে বসে বছরের পর বছর অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি

 

দিয়ে গবেষণার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অক্ষরজ্ঞানহীন নবী, যিনি পড়াশোনা করতে জানতেন না, তিনি এসব বিষয় সম্পর্কে কীভাবে অবগত হলেন?! নিঃসন্দেহে তিনি ওহীর মাধ্যমে এ ব্যাপারে অবগত হয়েছিলেন। অক্ষরজ্ঞানহীন নবীর জবানে এ বিষয়ের বর্ণনা ও বক্তব্য কি তার সত্যতার দলিল নয়? তবে সত্যতা স্বীকার করার জন্য অবশ্যই চোখ থেকে হঠকারিতার পট্টি খুলতে হবে।

 

সতেরোজন নবীর আলোচনা

 

তাওহিদ, নবুওয়াত, আখেরাত ও হিসাব-নিকাশের দলিল উল্লেখ করার পর সতেরোজন নবীর আলোচনা করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন হজরত মুসা, হজরত হারুন, হজরত ইবরাহিম, হজরত লুত, হজরত ইসহাক, হজরত ইয়াকুব, হজরত নুহ, হজরত দাউদ, হজরত সুলাইমান, হজরত আইয়ুব, হজরত ইসমাইল, হজরত ইদরিস, হজরত জুলকিফল, হজরত ইউনুস, হজরত জাকারিয়া, হজরত ইয়াহইয়া ও হজরত ঈসা আলাইহিমুস সালাম। (৪৮-৯১)

 

এই সকল নবীর দাওয়াত এক ও অভিন্ন ছিল। তারা বলতেন, 'যে-ব্যক্তি সৎকাজ করবে আর মুমিন হবে, তার প্রচেষ্টা বৃথা যাবে না।' (৯৪) সতেরোজন নবীর মধ্যে ছয়জনের ঘটনা কিছুটা বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে।

 

১. হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে একত্ববাদের দাওয়াত দেওয়ায় এবং শিরক প্রত্যাখ্যান করায় আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাকে রক্ষা করেছেন।

 

২. তার ভাতিজা হজরত লুত আলাইহিস সালামকে এক নিকৃষ্ট সম্প্রদায়ের নিকট নবী বানিয়ে পাঠানো হয়েছিল।

 

* হজরত নূহ আলাইহিস সালাম দীর্ঘ সাড়ে নয়শ বছর আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াত *দিয়েছেন। অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। এ কারণে তাকে শাইখুল আমবিয়া বলা যেতে পারে।

 

৪. হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম এবং তার পুত্র সুলাইমান আলাইহিস সালামের ঘটনা। তারা নবীও ছিলেন আবার বাদশাহও হয়েছিলেন। তাদেরকে বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উভয় ধরনের নেয়ামত দেওয়া হয়েছিল।

 

৫. হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামকে বিপদ-আপদ ও কষ্ট-মুসিবতে ফেলে পরীক্ষা করা হয়েছিল। তিনি দৃষ্টান্তমূলক ধৈর্য প্রদর্শন করেছেন। বিপদ-আপদে সবসময় তিনি আল্লাহর প্রতি নিবিষ্ট ছিলেন। এ নিবিষ্টচিত্ততার ফলে তিনি আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার দোয়া কবুল করা হয়েছে। তার মুসিবত উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে।

 

৬. হজরত ইউনুস আলাইহিস সালামের ঘটনা। মাছ তাকে গিলে ফেলেছিল। মাছের পেটে থেকে তিনি আল্লাহকে ডেকেছেন। আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেছেন। তাকে বিপদ থেকে মুক্ত করেছেন। নিঃসন্দেহে যারা আল্লাহকে ডাকে, তিনি তাদেরকে বিপদমুক্ত করে থাকেন।

 

৭. ইয়াজুজ-মাজুজ। সুরা কাহাফে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এ সুরায় পুনরায় তাদের আলোচনা এসেছে। বলা হয়েছে, কেয়ামতের পূর্বসময়ে ইয়াজুজ-মাজুজকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তারা প্রত্যেক উঁচু স্থান থেকে নেমে আসবে।

 

৮. মুশরিক এবং তাদের মূর্তিগুলোকে কেয়ামতের দিন জাহান্নামের ইন্ধন বানানো হবে। সেদিন কেউ কারও উপকার করতে পারবে না।

 

৯ . পূর্ববর্তী নবীদের ঘটনা বর্ণনা করার পর বলা হয়েছে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহকাল ও পরকালে সকলের জন্য রহমত। সকলের নিকট তিনি আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু যখন যাবতীয় দলিল উল্লেখ করা সত্ত্বেও কাফেররা বোঝেনি তখন তিনি আল্লাহর নিকট দোয়া করেছেন, হে আমার প্রতিপালক, আপনি ন্যায়ানুগ ফয়সালা করে দিন। আমাদের পালনকর্তা তো দয়াময়, তোমরা যা বলছো সে বিষয়ে আমরা তার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি। আল্লাহ তায়ালা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই দোয়া কবুল করেন। বদরযুদ্ধে মুশরিকদের উপর তিনি আজাব অবতীর্ণ করেন।

 

 

এটি মাদানি সুরা।' আয়াতসংখ্যা: ৭৮। রুকুসংখ্যা: ১০

 

নামকরণ ও বিষয়বস্তু

 

কাবাঘর নির্মাণের পর হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের জবানে লোকদেরকে হজ ফরজ হওয়ার ঘোষণার বিষয়টি এ সুরায় উল্লেখ হয়েছে। বিধায় একে সুরা হজ বলা হয়।

 

পাঠকগণ এ বিষয়টি আগেও জেনেছেন যে, মক্কি সুরাগুলোতে সাধারণত আকিদা-বিশ্বাস নিয়ে আলোচনা করা হয়। আর মাদানি সুরায় মাসআলা-মাসায়েল ও বিধিবিধান নিয়ে আলোকপাত করা হয়। তবে এর অর্থ এই নয় যে, মাদানি সুরায় আকিদা বিষয়ে কোনো আলোচনা করা হয় না; বরং তাতে আকিদা নিয়েও আলোচনা করা হয়। তাই এটি আধিক্যের ভিত্তিতে প্রণীত মূলনীতি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যার প্রয়োগ ঘটতে দেখা যায়।

 

সুরাটি যদিও মাদানি; এতে হিজরত, জিহাদ, হজ, কোরবানি প্রভৃতি বিধান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে; কিন্তু এতে মক্কি সুরার বৈশিষ্ট্যও অধিক পরিমাণে রয়েছে। এতে একত্ববাদ, জান্নাত, জাহান্নাম, পরকাল, পুনরুত্থান, বিচার-দিবস এবং কেয়ামতের ভয়ানক দৃশ্য সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। সুরাটি এমনভাবে শুরু হয়েছে যে, এর ফলে অন্তর প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। দেহে কম্পন শুরু হয়ে যায়।

 

বলা হয়েছে, হে লোকসকল, তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় করো। নিশ্চয় কেয়ামতের প্রকম্পন একটি ভয়ংকর ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্যদাত্রী তার দুধের শিশুকে বিস্মৃত হবে। প্রত্যেক গর্ভবতী গর্ভপাত করবে। সেদিন মানুষকে তুমি মাতাল দেখবে অথচ তারা মাতাল নয়। বস্তুত আল্লাহর আজাব অত্যন্ত কঠিন।

 

পুনরুত্থানের দুটি দলিল

 

কেয়ামতের আলোচনা করার পর পুনরুত্থানের ব্যাপারে দুটি দলিল দেওয়া হয়েছে। প্রথম দলিলটি মানব-সৃষ্টির বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ সাতটি স্তর অতিক্রম করে থাকে।

 

১. আমাদের পিতা হজরত আদম আলাইহিস সালামকে সরাসরি মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর সবাইকে পরোক্ষভাবে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

 

 

২. সকলেরই জন্ম হয়েছে বীর্য দ্বারা। এ বীর্য তৈরি হয় রক্ত থেকে। রক্ত তৈরি হয় খাবার থেকে। খাবার মাটি থেকে তৈরি হয়। মাটি ও বীর্যের মাঝে জীবনের রহস্য নিহিত রয়েছে।

 

৫. তৃতীয় ধাপে রক্ত জমাটবদ্ধ হয়।

 

* চতুর্থ ধাপে তা মাংসপিণ্ডের রূপ ধারণ করে, যা কখনো পূর্ণ হয় আবার কখনো অপূর্ণই রয়ে যায়।' ৫. পঞ্চম ধাপে বাচ্চা তৈরি হয়, যার পঞ্চেন্দ্রিয় অত্যন্ত দুর্বল থাকে।

 

* ঘষ্ঠ ধাপে সে যৌবনে উপনীত হয়। তার শক্তি-সামর্থ্য ও জ্ঞানবুদ্ধি পূর্ণতায় পৌঁছায়।

 

৭. সপ্তম ধাপে হয়তো সে যৌবনেই মৃত্যুবরণ করে কিংবা বার্ধক্যে উপনীত হয়। কেউ যখন আপন জীবনের এসব ধাপ পরিলক্ষ করে তখন সে কীভাবে বলতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা দ্বিতীয়বার তাকে সৃষ্টি করতে সক্ষম নন! বিশেষত বর্তমান যুগের মানুষেরা জানে যে, আল্লাহ তায়ালা এক ফোঁটা বীর্যের মধ্যে সকল মানব-বৈশিষ্ট্য রেখে দিয়েছেন। এসব জানা সত্ত্বেও মানুষ কীভাবে পুনরুত্থান অস্বীকার করতে পারে?

 

কিছু কিছু মানুষ সুস্পষ্ট গোমরাহিতে লিপ্ত। আর কিছু মানুষ সত্য-মিথ্যার মাঝে দোদুল্যমান। যদি তাদের পার্থিব স্বার্থ হাসিল হয় তা হলে তারা ইবাদত করে। আর যদি উপকারিতার পরিবর্তে তারা বিভিন্ন পরীক্ষায় নিপতিত হয়, তা হলে তারা ইবাদত ছেড়ে দেয়। এসব লোক সম্ভবত ঈমানকে মুদ্রা মনে করে, যা ভালো বা জাল হওয়ার ফয়সালা তারা নিজেদের দুনিয়াবি স্বার্থের মাধ্যমে করে থাকে।'

 

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষকে ছয় ভাগ করা যায়।

 

১. মুসলমান: তারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও কোরআনের উপর ঈমান রাখে।

 

২. ইহুদি : তারা মুসা আলাইহিস সালামের উম্মত। তাওরাতের অনুসারী।

 

৩. খ্রিষ্টান : তারা ঈসা আলাইহিস সালাম ও ইনজিলের অনুসারী।

 

 

৪. সাবি: ইবরাহিম আলাইহিস সালামের জমানার মুশরিকদের মতো এক

 

তারকাপূজারি গোষ্ঠী। ৫. অগ্নিপুজক: তারা কোনো ধর্মের অনুসরণ করে না। চন্দ্র-সূর্য ও তারকার পূজা করে।

 

৬. মুশরিক: তারা মূর্তির পূজা করে।

 

উল্লিখিত পাঁচটি দলই শয়তানের। কেবল প্রথমটিই রহমানের দল। কেয়ামতের দিন তাদের মাঝে ফয়সালা করা হবে। (১৭)

 

হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম আল্লাহর নির্দেশে বাইতুল্লাহ নির্মাণ করেন। এরপর জাবালে আবি কুবাইসে দাঁড়িয়ে তিনি হজের ঘোষণা দেন। আল্লাহ তায়ালা স্বীয় কুদরতে এই ঘোষণা আকাশ ও পৃথিবীবাসীদের কানে পৌঁছে দেন। সকলেই তা শুনতে পেয়েছিল।'

 

হজ ও তার প্রতীকের আলোচনাপ্রসঙ্গে এটাও বলা হয়েছে, আল্লাহ যেসব বিষয় হারাম করেছেন, তার সম্মান করা ঈমানের আলামত। যেমনিভাবে সৎকর্ম সম্পাদন করা বড় সাওয়াবের কাজ তেমনি হারাম কাজ থেকে বিরত থাকাও বড় পুণ্যের কাজ।

 

প্রকৃত মুমিনের চারটি আলামত

 

প্রকৃত মুমিনের চারটি আলামত রয়েছে। আল্লাহর ভয়, বিপদে ধৈর্যধারণ, নামাজ আদায় এবং ভালো খাতে ব্যয় করা।

 

পশু কোরবান করার নির্দেশের পর বলা হয়েছে, এসব প্রাণীর রক্ত ও গোশত আল্লাহর নিকট পৌঁছে না; বরং তার নিকট কেবল বান্দার তাকওয়া পৌঁছে। যার অন্তরে তাকওয়া থাকবে, সে গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে। সে তখন শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই নেক কাজ করবে।

 

জিহাদের অনুমতি

 

হজের বিধান উল্লেখ করার পর মুসলমানদের জিহাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কেননা কাফেররা মুসলমানদের ধর্মপালন ও মক্কায় প্রবেশ করতে বাধা দেয়। প্রথমে যদিও এক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ ও তাদেরকে ক্ষমার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু মদিনায় হিজরতের পরও যখন মুশরিকদ

 

লেখক: আলেম ও ওয়ায়েজ; খতিব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।