ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-১৬

বাদশা জুলকারনাইন, ঈসা-ইবরাহিম আ. ও ইয়াজুজ-মাজুজের বিস্ময়কর ঘটনা

মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী
| আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৯:৫৯ | প্রকাশিত : ২৬ মার্চ ২০২৪, ২২:১৯

প্রিয় পাঠক,

পবিত্র কোরআনুল কারীম নাজিলের এই মাস দ্রুততার সাথে আমাদের থেকে বিদায় নিচ্ছে। মাগফিরাতের অংশ প্রায় শেষের দিকে। আজ আমরা পবিত্র কোরআনুল কারীমের ১৬ তম পারার গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। আজ আমরা বাদশা জুলকারনাইনের ঘটনা দিয়ে শুরু করছি .....

আগের পর্ব: ইসলামি জীবনের ১৩টি আদেশ-নিষেধ

জুলকারনাইনের ঘটনা

ষোলো পারার শুরুতে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম ও হযরত খিজির আলাইহিস সালামের ঘটনার অবশিষ্টাংশ উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর জুলকারনাইনের ঘটনা বলা হয়েছে। জুলকারনাইনের ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে মতভেদ আছে।

অনেকে সিকান্দারকে জুলকারনাইন বলেছেন। কিন্তু সঠিক কথা হল সিকান্দারকে জুলকারনাইন বলা মুশকিল। কেননা সে মুমিন ছিল না। পক্ষান্তরে কোরআন যে-ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেছে, তিনি শুধু উপায়-উপকরণের অধিকারী বাদশাহই ছিলেন না; বরং তার মধ্যে ঈমানি গুণাবলিও বিদ্যমান ছিল।

অত্যাচারী বাদশাহর মোকাবেলায় ন্যায়নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি আল্লাহপ্রদত্ত উপায়-উপকরণ ব্যবহার করেছিলেন। কেউ কেউ সিকান্দার ছাড়াও কিছু বাদশাহর নাম উল্লেখ করেছেন। তাদেরকে তারা কোরআনে উল্লিখিত জুলকারনাইন বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তার নির্দিষ্ট নাম জানা না গেলেও এই আলোচনা বুঝতে কোনো বেগ পেতে হয় না। কেননা কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া কোরআনের উদ্দেশ্য নয়; বরং কোরআনের উদ্দেশ্য হল ঘটনা থেকে অর্জিত শিক্ষা ও উপদেশ পাঠকদের সামনে পেশ করা।

কোরআন থেকে বোঝা যায়, জুলকারনাইনকে আল্লাহ তায়ালা বাহ্যশক্তি দেওয়ার পাশাপাশি রুহানি ও ঈমানিশক্তিও দিয়েছিলেন। তার বিজয়াভিযানের পরিধি অনেক বিস্তৃত ছিল। তিনি একদিক থেকে পৃথিবীর পূর্বপ্রান্ত অন্যদিক থেকে পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন।

বিজয়াভিযানের একপর্যায়ে তিনি (যখন পৃথিবীর উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যান, তখন) এমন এক সম্প্রদায়ের নিকট উপনীত হন, যারা পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করত। এক বর্বর জাতি-কোরআন যাদের ইয়াজুজ-মাজুজ বলে উল্লেখ

করেছে সর্বদা তাদের উপর আক্রমণ চালাতো। এই নির্যাতিত সম্প্রদায়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জুলকারনাইন এক শক্তিশালী প্রাচীর নির্মাণ করেন, যার মাধ্যমে তারা ইয়াজুজ-মাজুজের আক্রমণ ও নির্যাতন থেকে নিরাপদ হয়ে যান। কেয়ামতের পূর্বে বা তারও আগে এই দেয়াল ধুলোয় মিশে যাবে।' ইয়াজুজ-মাজুজ গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে।

দেয়ালটি কবে ধুলোয় মিশে যাবে? কেয়ামতের পূর্ব সময়ে না তারও আগে? এ বিষয়ে কোরআন-হাদিসের কোথাও স্পষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। কোরআনে শুধু এসেছে (সুরা আমবিয়া ৯৬), ‘তারা প্রত্যেক উঁচু ভূমি থেকে দ্রুত ছুটে আসবে।’

এ কারণে আল্লামা কাশ্মিরিসহ অনেকের মত হল জুলকারনাইন নির্মিত সেই দেয়াল অনেক আগেই ধসে গেছে। ইয়াজুজ-মাজুজ গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। কেয়ামতের পূর্বে তারা হিংস্র রূপ নিয়ে আবির্ভূত হবে।

বস্তুবাদ ও ইসলাম

বস্তুগত দিক থেকে জুলকারনাইন বহু শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও তিনি আল্লাচ তায়ালায় বিশ্বাসী এক মুমিন বান্দা ছিলেন। অথচ বস্তুবাদী অনেক বাদশাহ বাহ্য উপকরণকেই সবকিছু মনে করে থাকে। কারনটেন বস্তুবাদীদের অন্যতম আদর্শ হচ্ছে পশ্চিমা সভ্যতা। এর সামনে তারা মাথা নত করে থাকে। এক সময় এ সভ্যতার এক আদর্শ ব্যক্তিত্ব বেরিয়ে আসবে, হাদিসে যাকে দাজ্জাল বলা হয়েছে। মনে হচ্ছে, তার আত্মপ্রকাশের দিন খুব বেশি দূরে নয়। কেননা ঈমান ওবস্তুবাদের মধ্যকার যুদ্ধ সংঘটিত হতে খুব সামান্য সময়ত বাকি আছে। যারা দাজ্জালি সভ্যতা ও দাজ্জালের আত্মপ্রকাশের সময় ঈমান রক্ষার ক্ষেত্রে সফল হবে তারাই সৌভাগ্যবান।

যারা বস্তু ও উপকরণকেই সবকিছু মনে করে না, সূরা কাহাফের শেষে তাদেরকে যেন হুকুম দেওয়া হয়েছে, ‘যারা স্বীয় প্রতিপালকের সাথে মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা রাখে, তাদের উচিত ভালো কাজ করা এবং ইবাদতের ক্ষেত্রে রবের সাথে কাউকে শরিক না করা।’ (১১০)

সূরা মারয়াম

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৯৮। রুকু সংখ্যা: ৬

অন্যান্য মক্কি সূরার ন্যায় সুরা মারইয়ামেও আল্লাহর অস্তিত্ব, তার একত্ববাদ, পুনরুত্থান ও বিচার দিবস সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।' এই সুরায় আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন নবীর ঘটনা বর্ণনা করেছেন।

প্রথম ঘটনা: জাকারিয়া আলাইহিস সালামের সন্তানলাভ

সর্বপ্রথম জাকারিয়া আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি বার্ধক্যে উপনীত হয়ে গিয়েছিলেন। তার শরীরের হাড়গোড় দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। চুল সাদা হয়ে গিয়েছিল। তার স্ত্রীও বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বন্ধ্যা ছিলেন। জাকারিয়া আলাইহিস সালামের বয়স ছিল তখন ১২০ বছর। তার স্ত্রীর বয়স হয়েছিল ১৮। বাহ্যত তখন তাদের সন্তান হওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু তবু তারা আল্লাহর নিকট সন্তানের জন্য আবেদন করেছেন।=

সন্তান চাওয়ার পূর্বে তারা আল্লাহর নিকট তিনটি বিষয় পেশ করেছেন। প্রথমত, আমি অত্যন্ত দুর্বল।

দ্বিতীয়ত, তবে আমি নিরাশ নই। কেননা আপনি কখনো আমার দোয়া প্রত্যাখ্যান করেননি।

তৃতীয়ত, এ দোয়া দ্বারা দীনের কল্যাণ উদ্দেশ্য।

এরপর তিনি স্বীয় দীনি স্থলাভিষিক্ত হিসেবে এক পুত্রসন্তানের আবেদন কবেন। সাথে সাথে তিনি এ আবেদনও করেন, যাতে এমন সন্তান দান করা হয়, আল্লাহ তায়ালা যার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন আর সে সন্তানও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন। অত্যন্ত ইবাদতগুজার, দুনিয়াবিমুখ এক সন্তান হজরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামকে দান করা হয়। আল্লাহ তায়ালা সেই সন্তানকে নবুওয়াতও দান করেছেন।

হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের ঘটনা

ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামের জন্মের ঘটনা বর্ণনা করার পর এর চেয়েও আশ্চর্যজনক ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। আর তা ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম। নিঃসন্দেহে হজরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামের ঘটনাটি আশ্চর্যজনক ছিল। কেননা তার মাতাপিতা (দুনিয়ার স্বাভাবিক নিয়মে) সন্তান জন্ম হওয়ার বয়স অতিবাহিত করেছিলেন। পক্ষান্তরে হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম হয়েছিল পিতা ছাড়াই। তার মা কুমারী ছিলেন। আলোচ্য সুরা মারিয়ামে আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়টি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন।

কীভাবে তিনি পরিবার-পরিজন ছেড়ে ইবাদতের জন্য বাইতুল মাকদিসের পূর্ব কোণে চলে গিয়েছিলেন? কীভাবে জিবরাইল আলাইহিস সালাম তার নিকট আসে? তার গ্রীবাদেশে ফুঁক দেন আর এতে তিনি গর্ভবতী হয়ে ওঠেন? কীভাবে তিনি বিপদ ও দুশ্চিন্তার সম্মুখীন হয়েছিলেন (এসব বিষয় এ সুরায় উল্লেখ হয়েছে)?

প্রসবের পর সন্তান নিয়ে যখন তিনি নিজ সম্প্রদায়ের নিকট আসেন তখন ইহুদিদের মুখ বেসামাল হয়ে যায়। তারা মারিয়াম আলাইহাস সালামের উপর বিভিন্ন অপবাদ আরোপ করে। হজরত মারিয়াম আলাইহিস সালাম আল্লাহর নির্দেশে ছেলের দিকে ইঙ্গিত করেন। মায়ের কোলে থাকা শিশু তখন কথা বলতে থাকে। তার মুখ থেকে সর্বপ্রথম যে বাক্য বের হয়, তা হচ্ছে, اني عبد الله )নিশ্চয় আমি আল্লাহর বান্দা)।

ঈসা আলাইহিস সালাম দুনিয়ায় মাত্র পা রেখেছেন, এখনও কথা বলার বয়সে উপনীত হননি, মুজিজাস্বরূপ স্বীয় মাতার পবিত্রতা বর্ণনা করার জন্য মুখ খুলেছেন আর তার জবান থেকে সর্বপ্রথম যে বাক্যটি বের হয়েছে, তার মাধ্যমে খ্রিষ্টানদের দাঁড় করানো শিরকি ইমারতের ভিত ধসে পড়ে।

আল্লাহ আমাকে ছয়টি বৈশিষ্ট্য দান করেছেন

তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালা আমাকে ছয়টি বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছেন: আমি আল্লাহর বান্দা। আমি প্রতিপালকও নই, আবার তার ছেলেও নই।

২. আমাকে ওহী ও নবুওয়াত দেওয়া হয়েছে।

১. আল্লাহ তায়ালা আমাকে বরকতময় করেছেন। আমার অস্তিত্ব মানুষের বরকত ও রহমতের কারণ। আমি কল্যাণের প্রশিক্ষক ও উম্মতের হিতাকাঙ্ক্ষী।

৪. অন্যান্য নবীর মতো আমাকে শরিয়তের বিধান মান্য করার এবং ইবাদত করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি বিশেষভাবে নামাজ-রোজার কথা উল্লেখ করেন। এর মাধ্যমে ইবাদতের গুরুত্বের বিষয়টি বুঝে আসে।

৫. আমি স্বীয় মাতার অনুগত। নিকটাত্মীয়দের সেবাকারী। আমি বিনয়ী। আমার স্বভাবে অহংকার ও বড়ত্ব নেই।

৬. দুনিয়া ও আখেরাতে আমাকে শান্তি ও নিরাপত্তার সুসংবাদ শোনানো হয়েছে। (১৬-৩৬)

ঈসা আলাইহিস সালামের মুজিজাময় জন্ম ইহুদি-খ্রিষ্টানদের মতানৈক্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। খ্রিষ্টানরা তাকে আল্লাহর ছেলে বলে আখ্যা দেয়। আর ইহুদিরা (নাউজুবিল্লাহ) তাকে জারজ সন্তান বলে অপবাদ দেয়।

ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ঘটনা

ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম এবং তার ব্যাপারে আহলে কিতাবদের মতানৈক্য বর্ণনা করার পর সূরা মারিয়ামে ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও তার মুশরিক পিতার মাঝে সংঘটিত ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনার মাধ্যমে শিরকের অসারতা, ধোঁকা, প্রতারণা, হঠকারিতা, গোমরাহি ও বোকামির ঝলক পরিলক্ষিত হয়। তেমনিভাবে এর দ্বারা ইবরাহিম আলাইহিস সালামের চরিত্র, তার মহান গুণাবলি, বিশেষত তার ধৈর্য ও হেকমতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা উদ্দেশ্য, যাতে দাওয়াতের ময়দানের কর্মীদের সামনে একজন প্রকৃত দায়ীর চিত্র উঠে আসে। তারা যেন তাকে নিজেদের আদর্শ বানিয়ে নেয়। তেমনিভাবে এ ঘটনা থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে, হকের দাওয়াত এবং হকের উপর দৃঢ় থাকার কারণে হজরত ইবরাহিম খলিল আলাইহিস সালামের উপর আল্লাহর কী রহমত বর্ষিত হয়েছে! তার বংশ থেকে এক বিশাল জাতি তৈরি হয়েছে। তার সন্তানদের মধ্যে নবী-রাসুল, বিশেষত সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্ম নিয়েছেন।

এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে, দুনিয়ার সকল জাতি নিজেদের হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের দিকে সম্বোধিত করাকে গর্বের বিষয় মনে করে।

সুরা মারিয়ামের মাধ্যমে জানা যায়, ইবরাহিম আলাইহিস সালাম যখন তার ভাবনার দৃষ্টি প্রসারিত করেন, পিতাকে তখন মূর্তিপূজা করতে দেখতে পান। নবুওয়াতপ্রাপ্ত হওয়ার পর তিনি নিজ ঘর থেকেই একত্ববাদের দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন। নম্রভাবে পিতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। পিতা মশরিক হওয়া সত্ত্বেও তার সাথে কথা বলার ক্ষেত্রে তিনি আদব রক্ষা করতেন। কিন্তু তার পিতা 'আজর' কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, ‘হে ইবরাহিম, তুমি কি আমার উপাস্যদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? যদি তুমি বিরত না হও তা হলে অবশ্যই আমি প্রস্তরাঘাতে তোমার প্রাণ নাশ করব। তুমি চিরতরে আমার কাছ দূর হয়ে যাও।’ (৪৬)

থেকে যখন ধারাবাহিক দাওয়াত দেওয়া সত্ত্বেও 'আজর' সঠিক পথে আসেনি, আর তার সম্প্রদায়ও দাওয়াত কবুল করেনি, তখন তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইরাক থেকে শামে হিজরত করেন। স্বীয় বংশ ও সম্প্রদায় পরিত্যাগ করার ফল হিসেবে আল্লাহ তায়ালা তাকে এর চেয়ে বহুগুণ উত্তম হজরত ইসমাইল, হজরত ইসহাক এবং তার ঔরসে হযরত ইয়াকুব আলাইহিমুস সালামকে দান করেন। (৪১-৫০)

এরপর সূরা মারিয়ামে হজরত মুসা, হজরত হারুন, হজরত ইসমাইল, হজরত ইদরিস আলাইহিমুস সালামের আলোচনা করা হয়েছে। (৫১-৫৮) এরপর বলা হয়েছে, এমন কিছু লোক এ সমস্ত নবীর স্থলাভিষিক্ত হয়েছে, যারা নামাজ বিনষ্ট করেছে। প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে। আর মুশরিকরা তো পুনরুত্থান ও বিচার দিবসের কথা অস্বীকার করে। তাদেরকে অবশ্যই জাহান্নামে একত্র করা হবে।

মুমিনদের প্রতি মানুষের মনে মহব্বত

সূরার শেষে বলা হয়েছে, মুমিনদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা মানুষের মনে মহব্বত তৈরি করে দেন। আর অপরাধীদের পূর্ববর্তী অপরাধীদের মতোই ধ্বংস করে দেওয়া হবে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রবৃত্তিকে দমিয়ে রাখবে, শুধু তার জন্যই আপন জীবন ব্যয় করবে, মানুষের অন্তরে তার প্রতি ভালোবাসা তৈরি করে দেওয়া হয়।

বুখারি, মুসলিম ও মুসনাদে আহমদের রেওয়ায়েতে এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন তখন জিবরাইলকে ডেকে জানিয়ে দেন, আমি অমুক বান্দাকে ভালোবাসি, তুমিও তাকে ভালোবেসো। জিবরাইল তখন তাকে ভালোবাসতে থাকেন। এরপর আকাশে ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হয়, আল্লাহ অমুককে ভালোবাসেন, তোমরা সবাই তাকে ভালোবেসো। এরপর আকাশবাসী তাকে ভালোবাসতে থাকেন। এরপর পৃথিবীবাসীর অন্তরেও তার গ্রহণযোগ্যতা ও ভালোবাসা তৈরি করে দেওয়া হয়।

পক্ষান্তরে আল্লাহ যখন কারও প্রতি অসন্তুষ্ট হন তখন জিবরাইলকে তা জানিয়ে দেন। জিবরাইল তার প্রতি ঘৃণা পোষণ করতে থাকেন। এরপর আকাশবাসীদের একথা জানিয়ে দেওয়া হয়। তারাও তার প্রতি ঘৃণা পোষণ করতে থাকেন। পৃথিবীর উপরও তাদের এ ঘৃণার প্রভাব পড়ে। পৃথিবীবাসীরাও তাকে ঘৃণা করা শুরু করে।'

সুরা ত-হা

এটি মক্কি সুরা। আয়াত সংখ্যা: ১৩৫। রুকু সংখ্যা: ৮

হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, সুরা ত-হা সূরা মারিয়ামের পর অবতীর্ণ হয়েছে। বিষয়ের দিক থেকে সুরা-দুটোয় স্পষ্ট মিল পাওয়া যায়। সূরা মারিয়ামে মুসা আলাইহিস সালামের ঘটনা সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছিল। সুরা ত হায় তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এ ছাড়াও সূরা মারিয়ামে শুধু আদম আলাইহিস সালামের নাম এসেছিল। কিন্তু এ সূরায় তার ঘটনা কিছুটা বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। এ সুরাতেও দীনের মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

নামকরণ ও প্রেক্ষাপট

তহা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি নাম। এখানে এর মাধ্যমে তাকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, কষ্ট শিকার করার জন্য আমি আপনার উপর কোরআন অবতীর্ণ করিনি। বিষয়টি হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোরআন মাজিদের দাওয়াত ও তেলাওয়াত দুই ক্ষেত্রেই অসম্ভব রকমের কষ্ট করতেন। রাতেরবেলায় যেমনিভাবে দীর্ঘ সময় নিয়ে লম্বা কেরাতের মাধ্যমে নামাজ পড়তেন, তার পা ফুলে যেত, তেমনি আবার দিনেরবেলা নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে কোরআন প্রচারের কাজও করতেন।

যখন কেউ তার দাওয়াত কবুল করত না তখন তিনি ভীষণ কষ্ট পেতেন। এই কারণে আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন স্থানে তাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। তাকে বোঝানো হয়েছে, আপনি নিজেকে অধিক কষ্টে নিপতিত করবেন না। সবাই এই কোরআনের প্রতি ধাবিত হবে না। যার মধ্যে আল্লাহর ভয় আছে, তার জন্য এটা নসিহত।

এরপর আল্লাহ তায়ালা নিজের কিছু গুণ উল্লেখ করেছেন, যাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্তরে সান্ত্বনা ও প্রশান্তি লাভ করেন যে, আল্লাহ তায়ালা তো আমার সাথেই রয়েছেন। তিনি আমার রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। আমাকে কখনো একা ছেড়ে যাবেন না। এটা স্পষ্ট করার জন্য যেন নমুনাস্বরূপ হজরত মুসা আলাইহিস সালামের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বোঝা যায় আল্লাহ তায়ালা নিজ প্রিয় বান্দাদের হেফাজতের একান্ত ব্যবস্থা রেখেছেন।

মুসা আলাইহিস সালামের ঘটনা

অন্যান্য নবীর তুলনায় মুসা আলাইহিস সালামের ঘটনা কোরআনে বিস্তারিতভাবে ও বারবার উল্লেখ হয়েছে। কেননা তার ঘটনাবলিতে বহু আশ্চর্য বিষয় ও ইঙ্গিত রয়েছে, যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতের কথা স্মরণ হয়। মানুষ তার নেয়ামতের ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করতে পারে। সম্ভবত বারবার তার ঘটনা উল্লেখ করার একটা কারণ এটাও যে, প্রত্যেক জমানায় কোনো-না-কোনো ফেরাউনের অস্তিত্ব থাকে, তার মোকাবেলায় মুমিনদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

সূরা ত-হার ৯নং আয়াত থেকে ৯৮নং আয়াত পর্যন্ত মুসা আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। এতে তার জীবনের অধিকাংশ ঘটনাই চলে এসেছে। তবে ঘটনাগুলো ধারাবাহিক নয়; বরং কিছুটা আগপিছ করে বলা হয়েছে। উদাহরণত এখানে আলোচনা শুরু হয়েছে তার মাদয়ান থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় আগুন দেখা, আল্লাহ তায়ালার সাথে কথা বলা এবং নবুওয়াতপ্রাপ্তির ঘটনার মাধ্যমে। কিন্তু জন্মগ্রহণের পর সিন্দুকে বন্দি করে তাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করার ঘটনাটি পরে উল্লেখ হয়েছে। অথচ সময়কালের বিচারে প্রথম উল্লেখকৃত বিষয়টি পরে, আর পরে উল্লেখকৃত বিষয়টি প্রথমে সংঘটিত হয়েছে।

এমনটি করার বড় কারণ হল আলোচনায় বৈচিত্র্য আনা। অর্থাৎ উপস্থাপনাশৈলী পরিবর্তন করে কোরআনে একই ঘটনা বারবার উল্লেখ করা হয়ে থাকে। ফলে পাঠকদের মধ্যে বিরক্তি সৃষ্টি হয় না। ঘটনার ছোটখাটো বিষয়ের পরিবর্তে তা থেকে অর্জিত শিক্ষা ও উপদেশের প্রতি তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়।

সুরা ত্ব-হায় মুসা আলাইহিস সালামের যেসব অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে, বোঝার সুবিধার্থে সেসবের কিছু শিরোনাম দাঁড় করানো যেতে পারে, তা হল:

১. আল্লাহ তায়ালার সাথে কথা বলা।

২. তাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করা।

৩. আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাকে এবং তার ভাই হারুন আলাইহিস সালামকে ফেরাউনের নিকট যাওয়ার নির্দেশ। ফেরাউনের সাথে মাওয়িযায়ে হাসানা তথা সদুপদেশের নীতিতে আলোচনা করা।

৪ . মুসা আলাইহিস সালামের মোকাবেলার জন্য ফেরাউন কর্তৃক জাদুকরদের একত্র করা।

৫. মুসা আলাইহিস সালামের বিজয়।

৬. জাদুকরদের ঈমান গ্রহণ।

রাতারাতি মুসা আলাইহিস সালামের মাধ্যমে বনি ইসরাইলদের মিসর থেকে বের হয়ে যাওয়া।

৭. ফেরাউন কর্তৃক সদলবলে তাদের পশ্চাদ্ধাবন এবং তাদের ধ্বংস।

দয়াময় মেহেরবান আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতের প্রতি বনি ইসরাইলের অস্বীকৃতি ও অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ।

৮. সামেরির গোবৎস বানানো।

১. বনি ইসরাইলের গোবৎসপূজা। মুসা আলাইহিস সালামের তুরপর্বত থেকে প্রত্যাবর্তন।

১০. ভাইয়ের উপর রাগের বহিঃপ্রকাশ।

একইভাবে এসব আয়াত পাঠ করার মাধ্যমে হজরত মুসা আলাইহিস সালামের উপর আল্লাহ তায়ালার বিশেষ নেয়ামতসমূহের কথা জানা যায়। যেমন: ফেরাউনের বাহিনী যখন বনি ইসরাইলের নবজাত শিশুদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করছিল, তখন এই জুলুম থেকে মুসা আলাইহিস সালামকে বাঁচিয়ে দেওয়া।

মানুষের অন্তরে তার প্রতি মহব্বত সৃষ্টি করা। ফলে যেই তাকে দেখত সেই তাকে ভালোবেসে ফেলত।

তার লালনপালনের বিশেষ ব্যবস্থা করা। দুধপানের জন্য পূর্ণ সম্মানের সাথে স্বীয় মায়ের নিকট তাকে ফিরিয়ে দেওয়া।

তার হাতে এক কিবতি নিহত হয়েছিল। তাকে এর কিসাস থেকে বাঁচিয়ে দেওয়া। মাদয়ান থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় তাকে নবুওয়াত প্রদান।

আল্লাহ তায়ালার সাথে কথা বলা। তাকে মহব্বত ও ভালোবাসার পাত্র হিসেবে নির্বাচন করা।

এই ঘটনার শেষে কোরআনে বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করার হেকমত এবং যারা কোরআন থেকে বিমুখ হয়, তাদেরকে কেয়ামতের দিন শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার আলোচনা করা হয়েছে। এরপর এ প্রসঙ্গে ১০৬নং আয়াত থেকে ১১২নং আয়াত পর্যন্ত কেয়ামতের ভয়ংকর অবস্থার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

ভুলত্রুটি মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। এ বিষয়টি বর্ণনা করার জন্য আদম আলাইহিস সালামের ফল খাওয়ার নির্দেশ ভুলে যাওয়ার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এরপর ইবলিসের সাথে যে ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল, তা উল্লেখ করা হয়েছে। (১১৫-১২২)

যারা কোরআন থেকে বিমুখ হয়ে রয়, তাদের জন্য রয়েছে মারাত্মক শাস্তি। তাদের জীবন সংকীর্ণ হয়ে যাবে। কেয়ামতের দিন তাদেরকে অন্ধ করে ওঠানো হবে। যারা কোরআনুল কারিমের মতো মুজিজা দেখা সত্ত্বেও (পূর্বের নবীদের আল্লাহপ্রদত্ত চাক্ষুষ মুজিজা, যেমন) লাঠি ও উটের মতো মুজিজার দাবি করে, তাদের ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। (১৩৩)

শেষ আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ‘আপনি তাদের বলে দিন, সকলে অপেক্ষমাণ, অতএব তোমরাও অপেক্ষায় থাকো। অচিরেই তোমরা জানতে পারবে কে সরল পথের পথিক আর কে হেদায়েতপ্রাপ্ত?’ (১৩৫)

চলবে ইনশাআল্লাহ....

লেখক: আলেম ও ওয়ায়েজ; খতীব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।

(ঢাকাটাইমস/২6মার্চ/এসআইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :