তোফায়েল বনাম শেখ সেলিম: আ.লীগের রাজনীতিতে কে বেশি ক্ষমতাবান ছিলেন?

তোফায়েল আহমেদ ও শেখ সেলিম। দুজনই ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রচণ্ড প্রভাশালী নেতা। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর দুজনই দলের সভাপতির বিরাগভাজন হলেও পারিবারিক কারণে প্রভাব ধরে রাখেন শেখ সেলিম। তোফায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল আওয়ামী লীগ সংস্কারের, আর শেখ সেলিম দেন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জবানবন্দি।
প্রায় একই দলীয় শঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে তোফায়েলকে হারাতে হয় দলীয় সভাপতিমণ্ডলীর পদ। স্থানান্তরিত হন উপদেষ্টামণ্ডলীতে। শেখ সেলিম বহাল থাকেন তার আগের জায়গায়।
এই পারিবারিক প্রভাবেই শেখ সেলিম যুবলীগকে কুক্ষিগত করে রাখেন, রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের নেপথ্য গডফাদারও হয়ে ওঠেন এবং সরকারের কেউ না হয়েও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে হস্তক্ষেপ করে গেছেন প্রতিনিয়ত।
ছাত্ররাজনীতি দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে আসা তোফায়েল আহমেদের প্রভাব ছিল রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সচিব হয়ে সেই সময়কার বিসিএসের প্রায় সব পদ পূর্ণ করেন তার কর্মীদের দিয়ে। তাই সেই বিসিএসের নাম হয়ে যায় ‘তোফায়েল ক্যাডার’। এরপর তো দায়িত্ব নেন রক্ষীবাহিনী প্রধানের।
দুই নেতার দুই রকম প্রভাবের সেসব গল্পের বিস্তারে যাচ্ছি নিচের লেখায়।
সর্বোচ্চ নয়বার করে জাতীয় সংসদের সদস্য হওয়া এই দুই আওয়ামী লীগ নেতা দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন, সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন একাধিকবার।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দুজনের প্রভাব ছিল দুই কারণে। তোফায়েল আহমেদ প্রভাব তৈরি করেছিলেন তার রাজনীতি দিয়ে। আর শেখ সেলিম প্রভাব বিস্তার করেছেন শেখ পরিবারের পরিচয়ে।
ভোলার এক সাধারণ কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা তোফায়েল আহমেদ ছাত্ররাজনীতি শুরু করেন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে। পরে এসে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে হন সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ভিপি, পরে ডাকসুর ভিপি, আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা। সাংগঠনিক দক্ষতায় তৈরি করেন নিজের অনুসারী বলয়।
১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে জয়লাভ করেন ভোলা থেকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বিশেষ বাহিনী বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা মুজিব বাহিনীর চার প্রধানের তিনি ছিলেন একজন।
স্বাধীনতার পর প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সচিব হন তোফায়েল আহমেদ। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিসিএস পরীক্ষায় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই ছিলেন তোফায়েল আহমেদের কর্মী। এ কারণে বিসিএসের সেই ব্যাচের নাম হয় ‘তোফায়েল ক্যাডার’।
স্বাধীনতার পর থেকে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সাথেও যোগাযোগ গড়ে তোলেন তোফায়েল আহমেদ। এসব কিছু মিলিয়েই আওয়ামী লীগ ও দেশের রাজনীতিতে নিজের একটি প্রভাববলয় তৈরি করেন তিনি। দল, প্রশাসন ও ব্যবসায়ীদের মাঝে এই প্রভাবের কারণে আওয়ামী লীগে বরাবরই অপরিহার্য ছিলেন তোফায়েল আহমেদ।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে দুই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। এরশাদ সরকারের আমল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়টায় তোফায়েল আহমেদ যা করতে চেয়েছেন, তা-ই হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমনই প্রভাব ছিল তার।
তবে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাধায়ক সরকারের সময় তোফায়েল আহমেদের প্রভাবে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে। শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ সংস্কারের অন্যতম উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন তিনি। পরে দাবি করেন, সেনা গোয়েন্দাদের চাপে এমন উদ্যোগে তাকে শামিল হতে হয়েছে। দলে প্রভাবের কারণে শেখ হাসিনা তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।
তবে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর তোফায়েল আহমেদকে মন্ত্রিসভায় নেননি শেখ হাসিনা। পরে অবশ্য ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের আগে তাকে মন্ত্রী করা হয়। সেই দায়িত্ব পালন করেন ২০১৮ সাল পর্যন্ত। পরের বারই আবার বাদ পড়েন মন্ত্রিসভা থেকে। একপর্যায়ে বাদ পড়েন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী থেকে। ঠাঁই হয় উপদেষ্টামণ্ডলীতে। এভাবেই আওয়ামী লীগে কমতে থাকে তোফায়েল আহমেদের প্রভাব।
অন্যদিকে ৭৬ বছর বয়সী শেখ সেলিমের রাজনৈতিক যাত্রা ছিল চামচে তুলে দেওয়ার মতো। বড় ভাই যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মণি, মামা শেখ মুজিবুর রহমান, বাড়ি গোপালগঞ্জ। ছাত্রলীগ দিয়ে রাজনীতি শুরু হলেও কখনো কোনো বড় পদে ছিলেন না।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব ও শেখ মণি নিহত হওয়ার বেশ খানিকটা পরে শুরু হয় শেখ সেলিমের আওয়ামী রাজনীতি। ১৯৮০ সালে আওয়ামী লীগের এক সংসদ সদস্যের মৃত্যুতে উপনির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে প্রথম সংসদে প্রবেশ করেন। পারিবারিক উত্তরাধিকারের মতোই যুবলীগের চেয়ারম্যান হন। ১৯৮০ সাল থেকে আওয়ামী লীগ যতবার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, ততবারই গোপালগঞ্জ থেকে সংসদ সদস্য হন শেখ ফজলুল করিম সেলিম।
শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেয়ার পর বাড়তে থাকে শেখ সেলিমের প্রভাব। দীর্ঘদিন যুবলীগকে কুক্ষিগত করে রাখেন তিনি। এমনকি সংগঠনটির চেয়ারম্যানের পদ ছাড়লেও পরবর্তীতে যুবলীগের কমিটি গঠন হয় তার কথায়। যুবলীগে নিজের একান্ত অনুগতদের দিয়ে রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের নেপথ্য গডফাদারও হয়ে ওঠেন শেখ সেলিম। ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হন শেখ সেলিম।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেপ্তার হয়ে যৌথ বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জবানবন্দি দেন শেখ সেলিম। এ কারণে শেখ হাসিনার বিরাগভাজন হয়ে পরে আর মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি তিনি। কিন্তু পারিবারিক কারণে প্রভাব ধরে রেখেছিলেন সরকার ও আওয়ামী লীগে। দলের সভাপতিমণ্ডলীর পদও হাতছাড়া হয়নি কখনো।
মন্ত্রী না হয়েও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বড় বড় কাজের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন শেখ সেলিম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পুলিশের বদলি বাণিজ্যও ছিল তার হাতের মুঠোয়।
একবার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ তার কথামতো কাজ না করায় তাকে চড় মারতে গিয়েছিলেন শেখ সেলিম। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ ঘটনার বিচার না পেয়ে মন্ত্রিসভা ও রাজনীতি ছেড়ে দেন সোহেল তাজ।
এমনকি শেখ হাসিনার বিপরীতে শেখ রেহানাকে আওয়ামী লীগের বিকল্প নেতা তৈরির চেষ্টাও করেছেন শেখ সেলিম। তার খেসারত তাদের দিতে না হলেও তৎকালীন যুবলীগ সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরীকে হারাতে হয় পদ।
২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পতন হলে শেখ সেলিম দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। অন্যদিকে দেশেই অবস্থান করছেন তোফায়েল আহমেদ। অবশ্য বয়সজনিত কারণে গুরুতর অসুস্থ তিনি। এখন তার বয়স ৮২ বছর।
(ঢাকাটাইমস/১২জুলাই/মোআ)

মন্তব্য করুন