কোটায় অস্ত্রের লাইসেন্স আসিফ মাহমুদের?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ‘জুতা আবিস্কার’ কবিতাটি মনে আছে? পুরো কবিতা মনে না থাকলেও নিশ্চয়ই দুটি লাইন মনে আছে? কারণ নানা কাজে, নানা ঘটনায় এই দুটি লাইন আউড়ায় বাঙালি। ‘করিতে ধুলা দূর, জগত হল ধুলায় ভরপুর!’ এবার দু’একটা শব্দ যোগ-বিয়োগ করে লাইন দুটি পড়তে পারেন। ‘করিতে কোটা দূর, দেশ হল কোটায় ভরপুর!’
সেই ২০১৮ সালে একবার সরকারি চাকুরিতে কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেই আন্দোলনের জেরে কোটা বাতিল হয়েছিলো। কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুর হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসুর ভিপি। পরে আবার কোটা ফিরে এলে গত বছর আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু। ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলনের কর্মী ছিলেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া।
২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে তিনি একেবারে সামনের কাতারের শীর্ষ নেতাদের একজন। কোটা সংস্কারেরই পরের নাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া সেই আন্দোলনে কোটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সরকারও ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া হয়ে গেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা।
কিন্তু সরকারের সকল কাজ ও আইন-কানুন থেকে কোটা বাদ যায়নি। বিলুপ্ত হয়নি বৈষম্য। বরং সেই কোটা ব্যবহার করেই নানা রকম সরকারি সুবিধা নিচ্ছেন কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতারা। এখানেও সামনের কাতারে, সবার আগে আছেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। সরকারি আইনে কোটা ব্যবহার করে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নিয়েছেন তিনি।
আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদানে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি নীতিমালা আছে। ব্যক্তি পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদানের সাধারণ যোগ্যতায় বলা আছে পাঁচটি শর্ত। এর প্রধান দুটি শর্তের একটি হচ্ছে লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারীর বয়স সর্বনিম্ন ৩০ ও সর্বোচ্চ ৭০ হতে হবে। অন্যটি হচ্ছে পিস্তল বা রিভলবার বা রাইফেলের জন্য আবেদনকারীকে আবেদনের পূর্ববর্তী টানা তিন বছর কমপক্ষে তিন লাখ টাকা আয়কর দিতে হবে। আয়কর পরিশোধের প্রমাণ হিসাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রত্যয়নপত্র জমা দিতে হবে।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বয়স মাত্র ২৭ বছর। গেলো তিনবছর তিন লাখ টাকা আয়কর দেয়ার মত তার কোন আয়ের উৎসও নেই। তবু তিনি ব্যক্তি পর্যায়ের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন। এজন্য অবশ্য আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদানের নীতিমালা সংশোধন করতে হয়নি। কারণ লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্যতার বেলাও কোটা আছে। স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী ও তাদের সমমর্যাদার ব্যক্তিদের জন্য বয়স এবং আয়করের শর্ত মাফ।
এই শর্ত মাফের তালিকায় আরো কয়েক রকম পদ-পদবী বা বিশেষ ব্যক্তি আছেন। তবে আসিফ মাহমুদ লাইসেন্স পেয়েছেন উপদেষ্টার কোটায়। যাদের আন্দোলন ছিলো কোটার বিরুদ্ধে, তাদেরই নেতা এখন সরকারি কোটা ব্যবহার করছেন।
পিস্তল বা রিভলবারের মত আগ্নেয়াস্ত্রের দাম আহামরি বেশি কিছু না। দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকাতেই পাওয়া যায় এধরণের অস্ত্র। আসিফ মাহমুদ তাঁর কয়েক মাসের উপদেষ্টা পদের বেতন দিয়েই পিস্তল বা রিভলবার কিনতে পারেন।
প্রশ্ন উঠেছে তার আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে। আসিফ মাহমুদ জানিয়েছেন, কোটা আন্দোলনের পর তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তিনি লাইসেন্স নিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র কিনেছেন। কিন্তু উপদেষ্টা হিসাবে তো তিনি ঘরের বাইরে বের হলে সার্বক্ষনিক সরকারি নিরাপত্তা পান। তার সাথে থাকে সাদা পোশাকের গানম্যান বা অস্ত্রধারী পুলিশ সদস্য।
এছাড়াও থাকে পুলিশের নিরাপত্তা বহর। নিজে যিখন যে বাড়িতে অবস্থান করেন, সেই বাড়ির নিরাপত্তাও দেয় পুলিশ। তাহলে কি ঘরের বাইরে সরকারি নিরাপত্তায় আসিফ মাহমুদের আস্থা নেই? নাকি নিজের ঘরের ভেতরে পরিবারের লোকজনের মাঝেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেন তিনি?
সরকারের ঘোষণা অনুসারে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকবে আর সর্বোচ্চ ১১ মাস। সেই হিসাবে আগে পদত্যাগ না করলে আসিফ মাহমুদের উপদেষ্টার মেয়াদও সেই ১১ মাস। তখনও তার বয়স ৩০ পূর্ণ হবে না। তখন তার নিরাপত্তায় পুলিশ থাকবে না, অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার সরকারি কোটার সুযোগও থাকবে না। তখন তার নিরাপত্তা দেবে কে?

মন্তব্য করুন