লংগদুতে সেগুন বনায়নে বিপন্ন  প্রকৃতি

বিপ্লব ইসলাম, লংগদু (রাঙামাটি)
  প্রকাশিত : ২৭ মে ২০২৫, ০৮:২১
অ- অ+

পার্বত্য জেলা রাঙামাটির লংগদু উপজেলা, যার অপরূপ পাহাড়, সবুজ বন, লেক ও নদী মিলে এক স্বপ্নময় প্রকৃতি গড়ে তুলেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে সেগুন গাছের অতিরিক্ত উপস্থিতি ও পরিকল্পনাহীন বনায়নের কারণে শুধু ভারসাম্য নষ্ট নয়, হারাচ্ছে সৌন্দর্য, নষ্ট হচ্ছে উর্বর মাটি ও ন্যাড়া হচ্ছে সবুজ পাহাড়।

সেগুন (বৈজ্ঞানিক নাম: Tectona grandis) মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে বিশেষ করে ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাওসে চাষ বেশি হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই গাছগুলো ব্রিটিশ আমলে আনা হয় এবং পাশাপাশি পার্বত্য অঞ্চলে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করা হয়। পরে টেকসই বৈশিষ্ট্য ও কাঠের উচ্চ মূল্য হওয়ায় গাছগুলোর চাষাবাদ বাণিজ্যিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

তথ্য বলছে, বাংলাদেশ বন বিভাগ ১৯২০-এর দশকে পাহাড়ি জেলাগুলোতে সেগুনের পরিকল্পিত বনায়ন শুরু করে। যদিও শুরুর দিকে তা সীমিত ছিল, বর্তমানে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি ও লিজকৃত বনভূমিতেও সেগুন চাষ ব্যাপক হারে বিস্তার লাভ করেছে।

লংগদু উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে, যেমন মাইনীমুখ, বগাচতর, গুলশাখালী, লংগদু সদর ও কালাপাকুজ্যা, করল্যাছড়ি ইউনিয়নে গত এক দশকে ব্যক্তিমালিকানাধীন সেগুন চাষ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বনজ সম্পদ রক্ষার পরিবর্তে অধিক লাভজনক কাঠ উৎপাদনের উদ্দেশ্যে পাহাড় কেটে এবং দেশীয় গাছপালা সাফ করে সেগুন রোপণ করা হয়েছে।

অন্যদিকে সেগুন গাছের পাতা সহজে পচে না, ফলে মাটির ওপর একটি স্তর তৈরি হয় যা অন্যান্য গাছের বীজ অঙ্কুরোদগমে বাধা সৃষ্টি করে। এ গাছের শিকড় অনেক গভীরে চলে যাওয়ায় জমির আর্দ্রতা শোষিত হয়, যা পাশের কৃষিজমি ও ছোট গাছগুলোর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অনেক জায়গায় দেখা গেছে, সেগুন বাগানের আশপাশে ফসল উৎপাদন কমে গেছে।

লংগদু উপজেলার বহু বনভূমি একসময় দেশীয় গাছপালা, বাঁশঝাড়, পাখি ও বনজ প্রাণীতে পরিপূর্ণ ছিল। কিন্তু এখন সেই বনাঞ্চল একক প্রজাতির সেগুন বাগানে পরিণত হচ্ছে একরের পর একর জায়গা। এতে করে পাখির আবাসস্থল হারিয়ে যাচ্ছে, কীট-পতঙ্গের বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে, সংকট হচ্ছে প্রাণী খাদ্যেরও।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, আগে আমাদের এই টিলায় কলাবাগান করতাম। পাশের টিলায় ছিল আম, কাঁঠাল, জাম, সুরুজ ইত্যাদি অনেক প্রজাতির গাছ।

স্থানীয় বন বিভাগ বা উপজেলা প্রশাসনের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত সেগুনের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে কোনো গবেষণা বা নীতিগত পরিকল্পনা নেই। ফলে জমির মালিকরা লাভের আশায় নির্বিচারে সেগুনের চারা রোপণ করছেন, যার পরিণতি দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশকর্মীরা।

উপজেলার সাংবাদিক ও পরিবেশ কর্মী আরমান খান বলেন, সেগুনের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা থাকলেও পরিবেশের জন্য এটি খুবই ক্ষতিকর একটি বৃক্ষ। সেগুন পানি শোষণ করে বেশি, ফলে পাহাড়ের ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে যাচ্ছে। অচিরেই এই বৃক্ষের বাণিজ্যিক চাষ বন্ধ করতে হবে। না হয় পাহাড় মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।

বৃক্ষরোপণ মানেই পরিবেশ রক্ষা নয়- এই বার্তাটি এখন আরও জোরালোভাবে উঠে আসছে লংগদুর প্রেক্ষাপটে। যদি বনায়ন পরিকল্পনাহীন হয় এবং প্রকৃতির নিজস্ব ভারসাম্যকে উপেক্ষা করে কেবল লাভের আশায় পরিচালিত হয়, তবে তা হবে আত্মঘাতী।

লংগদুর মানুষ এখনো চায় সবুজ পাহাড়, পাখির গান আর ঝরনার জলের শব্দে জেগে উঠতে। পরিবেশ রক্ষায় এখনই যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে শিগগিরই এই স্বপ্নময় জনপদ এক নিষ্প্রাণ কাঠের বাগানে রূপান্তরিত হবে। প্রশাসনের দায়িত্বশীলতা, সচেতন বনায়ন এবং পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনাই পারে লংগদুকে আবার তার প্রকৃত রূপে ফিরিয়ে আনতে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উপজেলা উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ অফিসার রতন চৌধুরী বলেন, সেগুন চাষিদের আমরা নিরুৎসাহিত করি, তার পরও যদি কেউ করে খুব উচু পাহাড়ে করলে সমস্যা নেই। সাধারণত সেখানে ফলজ গাছ হয় না। নিচু অংশে সেগুন চাষের ফলে মাটির উর্বরতা কমে যাওয়ায় কৃষিজমিতে ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে।

এ বিষয়ে জানতে লংগদু বন বিভাগের উল্টাছড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তা মাহাবুব সেন্টুকে একাধিকবার কল দিয়েও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

(ঢাকাটাইমস/২৭মে/মোআ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বিএনপি একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে চায়: আমিনুল হক 
ঢাকা-বেইজিং অংশীদারিত্ব এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে: চীনা রাষ্ট্রদূত
বেইলি রোডে ৩৪ কোটি দামের কষ্টিপাথরের মূর্তি ও বিদেশি মদসহ ৪ জন আটক
দেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে ২৮২০ ডলার, দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা