রাজধানীর নীরব রক্ষাকবজ ডিবি, বেড়েছে জনআস্থা ও নিরাপত্তা

ঘটনা-১

রাত গভীর, পরিবারে ফিরে যাওয়ার পথে ছিলেন প্রাইভেটকার চালক মোহাম্মদ সাজু। হঠাৎ রাজধানীর বিজয়নগরের বটতলায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান তিনি। কোনো ক্লু ছিল না। চোখে জল আর প্রশ্ন নিয়ে অপেক্ষা করছিল তার পরিবার।

ডিএমপির গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের সদস্যরা ধৈর্য ধরে খুঁজে যেতে থাকেন একটি সুতো— অবশেষে এক খুনির মাথার ক্যাপ আর গায়ের পোশাকের সূত্র ধরে উন্মোচন হয় পুরো চিত্র।

গ্রেপ্তার করা হয় খুনি আসিফুজ্জামান লিসানসহ তিনজনকে। সাজু আর ফিরে আসবে না, কিন্তু তার পরিবারের চোখে একটু স্বস্তির ছায়া ফিরে এসেছে— ন্যায়বিচারের আশায়।

ঘটনা-২

ঢাকার সোনার বাজারে অদৃশ্য এক ভয়— সোনার দোকানে গুলি, বোমা আর মুহূর্তের মধ্যে লুটপাট। ২৩ ফেব্রুয়ারি বনশ্রীতে ব্যবসায়ীকে গুলি করে স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা ছিতাই। এরপর ৯ মার্চ, ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় দিনের আলোয় সোনার দোকানে ডাকাতি। তার আগে ডেমরা ও কেরানীগঞ্জে বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে বাজার।

ধারাবাহিক ঘটেছে ঘটনাগুলো। একই ধরনের অস্ত্র, একই রকম হামলার প্যাটার্ন। তদন্তে স্পষ্ট হয়— এসব ঘটনায় সক্রিয় একাধিক চক্র, যাদের শিকড় পুরান ঢাকায়। একটির নাম ‘ইয়াসিন মাল চক্র’।

এই চক্রে রয়েছে ১০-১৫ জন সদস্য। কেউ বিস্ফোরক বহন করে, কেউ থাকে অস্ত্র হাতে, কেউ গাড়ি চালায়। পরিকল্পিতভাবে তারা দোকানে ঢুকে কিংবা রাস্তা আটকে আতঙ্ক তৈরি করে, তারপর লুট করে বিনা বাধায় পালিয়ে যায়।

ধারাবাহিক এসব ঘটনায় ডিবির সাঁড়াশি অভিযানে গ্রেপ্তার হয় ইয়াসিন মালসহ কয়েকজন মূলহোতা। উঠে আসে ভয়াবহ তথ্য— চক্রটি পরিবারকেন্দ্রিক, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অপরাধের চর্চা করে আসছে তারা।

এই প্রথম এত বড় চক্রের এমন কাঠামো উন্মোচিত হলো। ব্যবসায়ীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও, গোয়েন্দারা বলছেন— চক্রটি এখনও পুরোপুরি নিঃশেষ হয়নি।

প্রাইভেটকার চালক মোহাম্মদ সাজু খুন কিংবা স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির ঘটনায় শুধু অপরাধী শনাক্ত নয়, রাজধানীর আনাচে-কানাচে যখন অপরাধের ছায়া ঘনিয়ে আসে, তখন নীরবে, নিঃশব্দে, দৃঢ় পায়ে এগিয়ে আসে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা— ডিবি। এমনই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকাটাইমসকে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম যেমন বলেন, ৫ আগস্ট পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ডিবি পুলিশের ধারাবাহিক সাফল্য শুধু অপরাধ দমনে নয়, বরং নাগরিক আস্থার প্রতীক হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও তার দলের নেতাকর্মীদের নির্বিচারে হামলায় হাজারো ছাত্র-জনতা হতাহত হয়। এসব হামলার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলায় এজাহারনামীয় সাড়ে চার শ রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। তাদের মধ্যে দুর্দণ্ড প্রভাবশালী নেতাও রয়েছেন।

৫ আগস্ট থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত ডিবির অভিযানে আওয়ামী লীগ আমলের ২৫ জন মন্ত্রী, শেখ হাসিনার ২ জন উপদেষ্টা, ৩২ জন সংসদ সদস্য, একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য, তিনজন পৌর মেয়র, ১৩ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ যুবলীগের ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের প্রায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তাছাড়া সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালকে রাজধানীর মগবাজার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। এর বাইরে নানান অপরাধে জড়িত এমন সাড়ে ১১০০ অপরাধীকে আইনের আওতায় এনেছে গোয়েন্দা সংস্থাটি।

গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার গুজব ছড়িয়ে মিছিল করে বেশ কিছু নেতাকর্মী; তাদের মধ্যে সাতজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।

চোরচক্র থেকে সন্ত্রাস— সব দমনে তৎপর ডিবি

ডিবির দেওয়া তথ্য বলছে, চুরি, ডাকাতি, অপহরণ, মানবপাচার, অস্ত্র ও মাদক চোরাকারবারি চক্রের বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে অভিযান পরিচালনা করে আসছে ডিবি পুলিশের দল। গত দশ মাসে ডিবির অভিযানে উদ্ধার হয় ৫১টি চুরি যাওয়া গাড়ি। রিভালবার, শটগানসহ দশটি অবৈধ অস্ত্র, ২৫৬ রাউন্ড গুলি, প্রায় তিন কেজি হেরোইন, সাড়ে তিন লাখ ইয়াবা, ১৭০০ কেজি গাঁজা এবং ৪০ লাখ টাকা সমমূল্যের জাল টাকা জব্দ করে ডিবি।

এর বাইরে জাল সনদ বিক্রি চক্রের হোতাকে আটক, বিদেশি নকল পণ্য জব্দ এবং অপহরণ হওয়া ভুক্তভোগীকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হন গোয়েন্দারা।

গাজীপুর সাফারি পার্ক থেকে বিশ্বব্যাপী বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী তিনটি রিংটেইল লেমুর চুরির ঘটনায় একটি লেমুর উদ্ধার এবং একজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। ১৮ এপ্রিল জামালপুরে অভিযান চালিয়ে লেমুরটি উদ্ধার করা হয়।

সাইবার অপরাধ দমনেও দৃশ্যমান অগ্রগতি

ডিজিটাল যুগের অপরাধ মোকাবিলায় ডিবির আছে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। তাদের তথ্যমতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারণা, নারী নির্যাতন, হয়রানিমূলক কনটেন্ট ছড়ানোসহ নানা অপরাধের বিরুদ্ধে দ্রুত সাড়া দিয়ে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনছে তারা। গত দশ মাসে যেসব অভিযোগ ডিবি পেয়েছে তার মধ্যে শতকরা ৮৫ শতাংশ অপরাধী শনাক্ত হয়েছে।

ডিবির যুগ্ম কমিশনার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাইবার অপরাধ বাড়ছে। বিশেষ করে অনেক নারী সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। আমরাও ভুক্তভোগীদের সেবা দিচ্ছি। তাছাড়া অনলাইনে নানান ধরনের প্রতারণার অভিযোগ আমাদের কাছে আসছে; যা আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি।’ তবে সাইবার অপরাধ কমাতে অধিক সক্ষমতা ও জনবল বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে জানান নাসিরুল ইসলাম।

সাম্য হত্যা ও পল্লবীর জোড়া খুনের রহস্য উদঘাটন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার ঘটনায় যখন কোনো কূল-কিনারা মিলছিল না, তখন এর রহস্য উদঘাটন করে ডিবি পুলিশ। ঘটনায় জড়িত বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। ডিবি জানায়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাদক ব্যবসায়ী মেহেদীর অনুসারীদের কাছে থাকা ‘টেজার গান’ (বৈদ্যুতিক অস্ত্র) দেখতে চাওয়াকে কেন্দ্র করে খুন হন সাম্য। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় একাধিক মাদক ব্যবসা গোষ্ঠীকে শনাক্ত এবং তাদের সিন্ডিকেট ভেঙে দেয় ডিবি।

গত ৯ মে পশ্চিম শেওড়াপাড়ার একটি বাসার দোতলার এক ফ্ল্যাটে বিআইডব্লিউটিএর সাবেক কর্মকর্তা মরিয়ম বেগম ও তার ছোট বোন সুফিয়া বেগমকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। হত্যার ঘটনায় বাসার সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়া অপরিচিত এক ব্যক্তিকে খুঁজতে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মুখে মাস্ক, মাথায় ক্যাপ পরা ওই ব্যক্তিকে কেউ শনাক্ত করতে পারছিল না। পরে গোয়েন্দা জালে ধরা পড়ে দুই নারীকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত গোলাম রব্বানী খান তাজ নামের এক কিশোর।

আটক কিশোরের বরাতে ডিবি জানায়— মূলত সাইকেল কেনার টাকা সংগ্রহে শেওড়াপাড়ায় খালার বাসায় গিয়েছিল ওই কিশোর। সুযোগ বুঝে খালার বেডরুমের আলমারি থেকে টাকা চুরির সময় দেখে ফেলেন খালা। বিষয়টি পরিবারের কাছে জানিয়ে দিতে চাইলে ক্ষিপ্ত হয়ে খালার পেটে ছুরিকাঘাত করে তাজ। এই দৃশ্য দেখে ফেলায় অপর খালাকেও ছুরিকাঘাত করে সে। পরে শিলপাটা দিয়ে মাথা থেঁতলে মৃত্যু নিশ্চিত করে তাজ।

ডিবির ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা বলছেন, ডিবি শুধু তদন্ত করে না, তারা চান প্রতিটি মানুষ পুলিশের সহযোদ্ধা হোক। কারণ, সম্মিলিত প্রয়াসেই অপরাধ দমন সম্ভব।

গত ২৭ মে মিরপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে মানি একচেঞ্জ ব্যবসায়ীকে গুলি করে ২২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। ঘটনার সময়ের একটি সিসিটিভি ফুটেজ ভাইরাল হয়। অপরাধী শনাক্তে মাঠে নামে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। ঘটনার কুড়ি দিন পর (১৭ জুন) লুণ্ঠিত অর্থ, বিদেশি অস্ত্র ও গাড়িসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ।

তাছাড়া ১৯ জুন উত্তরায় র‌্যাবরে পোশাকে ‘নগদ’ প্রতিনিধির কাছ থেকে ১ কোটি ১৮ লাখ ৭১ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় রহস্য উদ্ঘাটন করে ডিবি পুলিশ। টাকা ছিনতাইয়ে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে সংস্থাটি। থানা পুলিশ অপরাধে ব্যবহৃত মাইক্রোবাস ও তার চালক জাফরকে গ্রেপ্তার করে। পরে ডিবি অপরাধ মহলে ক্যাপ্টেন (সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত সার্জেন্ট) হিসেবে পরিচিত জালাল ও পুলিশের বরখাস্ত এএসআই শাহীনকে আটক করে। প্রথমে শাহীনের কাছ থেকে ১৩ লাখ, জালালের কাছ থেকে ১২ লাখ এবং ইমদাদ নামে আরেকজনের কাছ থেকে আরও আট লাখ টাকা উদ্ধার করে।

আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণে ভবিষ্যতের ডিবি

জানা গেছে, বর্তমানে ডিবিকে উন্নত প্রযুক্তি, ড্রোন নজরদারি, জিপিএস ট্র্যাকিং ও এআই বেইসড অ্যানালাইসিস সিস্টেমে প্রশিক্ষণ এবং আধুনিকায়নে কাজ চলছে। পাশাপাশি অপরাধ বিশ্লেষণমূলক ইউনিট হিসেবে অপরাধ প্রবণতা আগেই শনাক্ত করার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

ডিবির যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকার মতো ব্যস্ত ও অপরাধপ্রবণ মহানগরে ডিবি পুলিশ হয়ে উঠেছে এক আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক। প্রতিটি সফলতা শুধু একটি মামলার সমাধান নয়—তা একজন নাগরিকের শান্তি, একটি পরিবারে ফিরিয়ে আনা স্বস্তি, এবং সামগ্রিকভাবে একটি নিরাপদ শহরের আশ্বাস।’

‘রাজধানীতে হওয়া অপরাধ, যেকোনো ঘটনার রহস্য উদঘাটনসহ অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে মেধা, দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করে গোয়েন্দা সদস্যরা।’ যোগ করেন নাসিরুল।

ডিবির যুগ্ম কমিশনার তাদের সফলতার পেছনে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর নির্দেশনার কথাও উল্লেখ করেন। বলেন, ‘তার নির্দেশনায় আমরা অপরাধ দমনে কাজ করে চলছি। এরই ধারাবাহিকতায় যেকোনো অপরাধ সংঘটিত হলে আমরা অপরাধী শনাক্তে জোরদার গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে অপরাধী শনাক্তে সক্ষম হচ্ছি।’

(ঢাকাটাইমস/২৮জুন/এসএস/মোআ)