বিমানবন্দরকেও ঝুঁকিপূর্ণ করল বিতর্কিত শিল্পগ্রুপ ইউনাইটেড

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বিমানবন্দরের প্রবেশমুখের উত্তর পাশের এক সারি বহুতল ভবন। কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান বিমানবন্দর এলাকার ভেতর একসময় বন্ধ হয়ে যাওয়া এই প্রকল্প আবার চালু হয় আওয়ামী লীগের আমলে। এবার মালিকানা নেয় শেখ হাসিনা সরকারের সবচেয়ে সুবিধাভোগী শিল্পগ্রুপ ইউনাইটেড ও সামিট।
দেশের কেপিআইভুক্ত স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কেপিআই নীতিমালা লঙ্ঘন করেই নির্মাণ করা হয় ভবনগুলো। সুউচ্চ এসব ভবন থেকে বিমানবন্দরের প্রতিটি স্পর্শকাতর স্থান দৃশ্যমান। এসব ভবনের ছাদ বা কোনো অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবহার করে বিমানবন্দরে যেকোনো ধরনের নাশকতার ঝুঁকি রয়েছে, বলছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
এসব ভবনের মধ্যে রয়েছে ১২ ও ১৩ তলাবিশিষ্ট তারকা হোটেল, ছয়তলা শপিং কমপ্লেক্স, ১২ তলা কার পার্কিং ও অফিস কমপ্লেক্স এবং তিনতলা ব্যাংকুয়েট হল।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) স্পর্শকাতর এ এলাকায় এসব স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি কীভাবে দিল, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ভবনগুলো পুরোপুরি চালু হলে দেশের প্রধানতম আন্তর্জাতিক এই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। একই সঙ্গে বিমানবন্দরের সামনের ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের সৃষ্টি করবে যানজটের।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বিমান ওঠা-নামা ও নিরাপত্তার কারণে বিমানবন্দর এলাকার আশপাশে ছয়তলার বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণে বিধি-নিষেধ রয়েছে। কিন্তু কোনো ধরনের নিয়মনীতি না মেনে বিমানবন্দরের প্রবেশমুখেই গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবনের সারি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পতিত আওয়ামী লীগ আমলে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী শিল্পগোষ্ঠী এবং সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হওয়ায় ইউনাইটেড গ্রুপ ও সামিট গ্রুপকে এসব সুউচ্চ স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়। পরে অবশ্য সামিট গ্রুপ তার অংশ ইউনাইটেডের কাছে হস্তান্তর করে।
গত বছরের মে মাসে ইউনাইটেড গ্রুপ বিমানবন্দর সংলগ্ন সেন্টার পয়েন্ট শপিং মলে তাদের প্রতিষ্ঠান ইউনিমার্ট ও শেফস টেবিল এবং সিনেমা প্লেস চালু করে। তাছাড়া সেখানে দীর্ঘদিন ধরে চলছে ইউনাইটেড কনভেনশন সেন্টারের কার্যক্রম। অভিযোগ রয়েছে— এসব প্রতিষ্ঠান চালু থাকলেও সিভিল অ্যাভিয়েশন কোনো মুনাফা পাচ্ছে না।
সূত্র বলছে, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে ‘কী পয়েন্ট ইনস্টলেশন’ (কেপিআই) নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকার। ২০১৩ সালে এ নীতিমালা হালনাগাদ করা হয়। কেপিআইভুক্ত স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কেপিআই সীমানার ভেতরে কোনো ভবন নির্মাণ করতে হলে কেপিআইডিসির অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ আমলে কেপিআইডিসির অনুমোদন ছাড়া বেবিচক সিঙ্গাপুরের সংস্থা ইপকো ডেভেলপমেন্টকে ২০০০ সালে ৬০ বছরের জন্য ১৫ দশমিক ৭৪ একর জমি লিজ দেয়।
শুরুতে ইপকো ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড ও বেঙ্গল গ্রুপ যৌথভাবে ২০০০ সালেই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে হোটেল ও শপিং কমপ্লেক্সের নকশার অনুমোদন নেয়। এরপর বিমানবন্দরের প্রবেশমুখে এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিম পাশে কয়েকটি বহুতল স্থাপনা তৈরির কাজ শুরু হয়। ভবনগুলোর কাজ প্রায় অর্ধেক সম্পন্ন হওয়ার পর নির্মাণকাজ বন্ধ করা হয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পের মালিকানায় যোগ হয় ইউনাইটেড গ্রুপ ও সামিট গ্রুপ। ২০১১ সালে পুনরায় ভবনগুলোর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০২১ সালে শেষ হয় নির্মাণকাজ।
জানা যায়, ২০১৭ সালের ১৩ নভেম্বর বেবিচকের জরিপ কর্তৃপক্ষ কেপিআইডিসির কাছ থেকে ভবন নির্মাণের অনুমতি নেয়। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ (চিঠি) নেই কোনো সংস্থার কাছে। এমনকি চুক্তির বিষয়টি কেপিআইডিসির সভাপতি ও জরিপ কমিটির সভাপতিকে জানানো হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এই বিমানবন্দর দিয়ে দেশে আসা-যাওয়া করেন। অথচ এসব ভবনের ছাদ থেকে বিমান ওঠা-নামার দৃশ্য দেখা যায়। ফলে নিরাপত্তার জন্য এসব স্থাপনা হুমকির কারণ হবে। শুধু তাই নয়, এই ভবনগুলো চালু হলে দেশের সবচেয়ে ব্যস্ততম বিমানবন্দর সড়কে যানবাহন থমকে যাবে। যানজটের কারণে এ সড়কে চলাচল করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
সূত্র বলছে, এরশাদ সরকারের আমলে ব্যবসায়ী আবুল খায়ের লিটু ওই জায়গাটি লিজ নেন। পরে কয়েক হাত ঘুরে তা ইউনাইটেড ও সামিট গ্রুপের কাছে যায়। সর্বশেষ সামিট গ্রুপও ভবনগুলো ইউনাইটেড গ্রুপের কাছে হস্তান্তর করেছে বলে গুঞ্জন রয়েছে।
সেখানে একটি ১২ তলা পাঁচ তারকা হোটেল, একটি ১৩ তলা তিন তারকা হোটেল, একটি ছয়তলা শপিং কমপ্লেক্স, একটি ১২ তলা কার পার্কিং ও অফিস কমপ্লেক্স এবং একটি তিনতলা ব্যাংকুয়েট হলের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এরই মধ্যে ইউনাইটেড গ্রুপ ‘হলিডে ইন’সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সেখানে তাদের কার্যক্রম শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে সেখানে ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। এতে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের প্রধান বিমানবন্দরটি। এখন ভবনগুলো তো ভাঙা সম্ভব না। দেখার বিষয় সরকার ও দায়িত্বশীলরা কীভাবে এটা হ্যান্ডেল করবেন। কারণ দিন দিন বিমানবন্দরে যাত্রী ওঠা-নামার সংখ্যা বাড়ছে। সেই হিসেবে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা অত্যন্ত জরুরি।’
বেবিচকের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কেপিআই নীতিমালা না মেনে ভবনগুলো তৈরি করা হয়েছে। এতে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। তাছাড়া হোটেল ও মার্কেটের দুই শতাংশ মালিকানা রয়েছে সিভিল অ্যাভিয়েশনের। তাই এখনই ভবনগুলোর পুরোপুরি চালুর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
আইন লঙ্ঘন করে কিংবা শেখ হাসিনা সরকারের আনুকূল্য নিয়ে ইউনাইটেড গ্রুপ শুধু বিমানবন্দরের এই মহমূলবান জায়গার প্রকল্প নয়, আশুগঞ্জ পাওয়ার কমপ্লেক্সেরও একটি প্ল্যান্টেরও মালিকানা তবজা করেছে। আর বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে ইউনাইটেড তো লুটপাটের নজির হয়ে আছে। সরকারের কাছ থেকে বেআইনি সুবিধা নিয়ে বেশি দামে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ বিক্রির নানা খবর ঢাকাটাইমস ও অন্যান্য জাতীয় দৈনিকে ফলাও হয়েছে।
এ ছাড়া রাজউকের অনুমোদন ছাড়া ইউনাইটেড গ্রুপের বিশাল করপোরেট অফিস নির্মাণ, এমনকি ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটির ভবন নির্মাণে নকশা নিয়ে আছে জটিলতা। এ নিয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে রাজউক।
সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর গোয়েন্দা বিভাগের অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী এই শিল্পগ্রুপটি। এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ে গ্রুপের কয়েকজন পরিচালক কর ফাঁকি দিয়েছেন ৪০ কোটি টাকা।
এই শিল্পগ্রুপের মালিকদের বিরুদ্ধে আছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পতিত শেখ হাসিনা সরকারকে সহযোগিতার অভিযোগ। আন্দোলনের সময় ঢাকার প্রগতি সরণিতে গুলিবিদ্ধ বাহাদুর হোসেন মনির হত্যা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আসামি গ্রুপের কর্ণধার হাসান মাহমুদ রাজা, চেয়ারম্যান ও এমডি মঈনউদ্দিন হাসান রশিদ ও গ্রুপের কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) আফজাল। বিশেষ করে জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকারকে অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
(ঢাকাটাইমস/১৭মে/এসএস/মোআ)

মন্তব্য করুন