পল্লবীর সাহিনুদ্দিন হত্যার চারবছর: ডিবি-পিবিআই ঘুরে মামলা তদন্তে সিআইডি, কমেনি আউয়ালের দাপট

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ১৬ মে ২০২৫, ১৭:০৫| আপডেট : ১৬ মে ২০২৫, ১৭:৪০
অ- অ+

২০২১ সালে রাজধানীর পল্লবীতে সাত বছরের ছেলের সামনে বাবা সাহিনুদ্দিন সাহিনকে কুপিয়ে হত্যার মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া সব আসামিই এখন জামিনে মুক্ত। ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, ঘটনার চার বছর পার হলেও মেলেনি ন্যায় বিচার, উল্টো জামিনে বের হয়ে আসা মামলার আসামিরা হুমকি-ধামকি অব্যাহত রেখেছে।

জানা গেছে, এ মামলায় আদালতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দেওয়া অভিযোগপত্রে বাদীর নারাজির পর এখন মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ— সিআইডি। এর আগে মামলা তদন্ত করেছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাতেও নারাজি দেন বাদি।

চার বছর আগে ২০২১ সালের ১৬ মে সাহিনুদ্দিনকে পল্লবী ১২ নম্বর সেকশনের ৩১ নম্বর সড়কে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পরদিন ১৭ মে নিহতের মা আকলিমা বেগম পল্লবী থানায় ২০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।

মামলায় প্রধান আসামি করা হয় লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়ালকে। মামলার পর তাকে ভৈরবের একটি মাজার থেকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব। পাশাপাশি আরও ১৩ আসামি গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এছাড়া মামলার দুই আসামি মানিক ও মনির বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

সাবেক এমপি এম এ আউয়াল হ্যাভেলি প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের এমডি। ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান আউয়াল তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব। ২০১৮ সালে আউয়ালকে তরিকত ফেডারেশন বহিষ্কার করলে পরের বছরই নিজেই দল গঠন করেন।

সাহিনুদ্দিনকে হত্যার পর নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক সহসভাপতি সুমন ব্যাপারী ফোন করে এম এ আউয়ালকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘স্যার, ফিনিশ।’ এই কথোপকথনের অডিও ভয়েজটি পরীক্ষা করে পুলিশ ও র‍্যাব নিশ্চিত হয়েছে কণ্ঠটি সুমনেরই।

পল্লবীর উত্তর কালশীর সিরামিক এলাকার বাসিন্দা আকলিমার দুই ছেলের মধ্যে সাহিনুদ্দিন ছোট। বাউনিয়া মৌজার উত্তর কালশীর বুড়িরটেকের আলীনগর আবাসিক এলাকায় ১০ একর জমি রেখে গেছেন আকলিমার প্রয়াত স্বামী।

মামলায় বাদী আকলিমা অভিযোগ করেছেন, পল্লবীর আলীনগর এলাকায় তাদের প্রায় ১০ একর জমি জবরদখলের পাঁয়তারা করছিল আসামিরা। এর জের ধরেই এম এ আউয়াল তার ভাড়াটে খুনি দিয়ে সাহিনকে খুন করান।

২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সৈয়দ ইফতেখার হোসেন। অভিযোগপত্রে সুমন ব্যাপারী, মোহাম্মদ তাহের, মো. গোলাম কিবরিয়া খান, মোহাম্মদ মুরাদ, টিটু শেখ ওরফে টিটু, মোহাম্মদ রকি তালুকদার, নূর মোহাম্মদ হাসান, মোহাম্মদ শরীফ, ইকবাল হোসেন, মো. তরিকুল ইসলাম ইমন, তুহিন মিয়া, মো. হারুনুর রশিদ, মো. শফিকুল ইসলাম শফিক ও ইব্রাহিম সুমনকে আসামি করা হয়।

মামলার বাদী আকলিমা বেগম আদালতে এই অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি দিলে আদালত মামলাটি পিবিআইকে পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেয়। পরে দীর্ঘ তদন্তের পর পিবিআইয়ের পরিদর্শক মনির হোসেন আদালতে প্রতিবেদন জমা দেন।

মামলার এজাহারে আকলিমা বেগম উল্লেখ করেন, ঘটনার দিন সুমন ও টিটু নামের দুই যুবক তার ছেলেকে জমির বিরোধ মেটানো হবে জানিয়ে ফোন করে ডেকে নেন। এসময় তার সাতবছরের ছেলে মাশরাফিকে মোটরসাইকেলে নিয়ে পল্লবীর ডি-ব্লকের ৩১ নম্বর সড়কের ৪০ নম্বর বাসার সামনে গেলে সুমন ও টিটুসহ ১৪-১৫ জন মিলে তাকে টেনেহিঁচড়ে ওই বাড়ির গ্যারেজে নিয়ে যায়।

গ্যারেজে ঢুকিয়ে সাহিনকে চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল, রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। এরপর তাকে ওই গ্যারেজ থেকে বের করে ৩৬ নম্বর বাড়ির সামনে আবার কুপিয়ে ফেলে রেখে চলে যায়। ঘটনাস্থলেই সাহিনুদ্দিনের মৃত্যু হয়। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত মনির ও মানিক নামে দুই জন র‌্যাব ও পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান।

জমির দালাল থেকে যেভাবে উত্থান আউয়ালের

রাজনৈতিক ক্ষমতা আর নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনীর দাপটে কোনো কিছুই পরোয়া করতেন না এম এ আউয়াল। জাল-জালিয়াতি, ভূমি দখল ও প্রতারণায় সব সময় বেপরোয়া ছিলেন তিনি। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তা আরও বেড়ে যায় বহু গুণ। বাড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার। সেই সঙ্গে বেড়ে যায় তার মাস্তানিও। বাড়তে থাকে দখল ও হামলার দৌরাত্ম্য।

একসময় কিছুই ছিল না যার, সেই আউয়ালের উত্থান জমির দালালি দিয়ে শুরু। এরপর দখল-জালিয়াতির মাধ্যমে হয়েছেন বিপুল অর্থের মালিক। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিরপুরের পল্লবী এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন সাবেক এই এমপি। সাধারণ মানুষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা তার নেশা হয়ে গিয়েছিল।

জমি দখলে নিতে হত্যায় জড়ান আউয়াল

পৈতৃকসূত্রে মিরপুর সিরামিকসের ভেতরে এক বিঘার বেশি পরিমাণ জমির মালিক ছিলেন নিহত সাহিনের দাদা। পরবর্তী সময়ে এর মালিক হন তার বাবা জৈনুদ্দিন। তার মৃত্যুর পর সাহিনেরা (দুই ভাই) জমি দেখভাল করছিলেন।

আউয়ালের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ ডেভেলপার লিমিটেড’ কম টাকায় এই জমি কিনে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাতে রাজি না হওয়ায় সাহিনের দুই ভাইয়ের নামে চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, মাদক মামলা দেওয়া হয়। জমির দখল নিতে আউয়াল এসব কিছু করেন বলে বলে সাহিনের পরিবারের অভিযোগ।

নিহত সাহিনুদ্দিনের বড় ভাই মাঈনুদ্দিনের ঢাকাটাইমসকে বলেন, 'ডিবি ও পিবিআই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি আবদুর রাজ্জাক, শফিকুল, কামরুল ও লিটনকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দেয়। তারা আউয়ালের লোক। এই হত্যায় তারা জড়িত। আর আউয়ালের সহযোগী সুমন ওরফে ডিশ সুমন এই হত্যায় জড়িত থাকলেও তার নাম বাদ পড়ে। অভিযোগপত্রে তাদের নাম না এলে তারা তা মেনে নেবেন না।'

এখন তাকেও হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আউয়ালসহ বাকি আসামিরা তাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। এ নিয়ে থানায় জিডিও করেছে। এখন আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের। মাসখানেক আগে আউয়ালের নির্দেশে আসামিরা পল্লবীর বুড়িরটেকে তাদের ১২ কাঠা জমি দখল করে নিয়েছেন। বিষয়টি ডিএমপি কমিশনার বরাবর অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।'

এদিকে মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির উপপরিদর্শক (এসআই) সাফিউল আজম জানিয়েছেন, আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগ করে নারাজি আবেদনে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, সে বিষয়ে তদন্ত চলছে।

(ঢাকাটাইমস/১৬মে/এসএস/এমআর)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
আধাঘণ্টার ব্যবধান: মোহাম্মদপুরে ফটোগ্রাফার, হাজারীবাগে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাতে খুন
বিচারপতি আবদুর রউফ স্মরণে জীবনালেখ্য ও দোআ অনুষ্ঠিত
ইয়েমেনের দুই বন্দরে ইসরায়েলের বিমান হামলা
চাঁদপুরে পুলিশ কর্মকর্তার চুরি যাওয়া অস্ত্র ঢাকায় উদ্ধার, আটক ২
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা