কেন পিছিয়ে গেলেন এহসানুল হক মিলন, তার দক্ষতা কতটা কাজে লাগাল বিএনপি?

এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার হলের বাইরে কিছু মানুষকে তাড়া করছেন একজন তরুণ প্রতিমন্ত্রী। হলের ভেতরে অসাধু পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে উদ্ধার করছেন নকল। কোনো পরীক্ষার কেন্দ্রে এই প্রতিমন্ত্রীর আসার খবরে মুহূর্তে শুরু হয় দৌড়াদৌড়ি, ফাঁকা হয়ে যায় কেন্দ্রের চারপাশ।
এমনই দৃশ্য দেখা গেছে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার বিভিন্ন কেন্দ্রে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব দৃশ্য কমে আসে, যা ওই মানুষটির মহৎ চেষ্টার ফল। মানুষটি হলেন তখনকার বিএনপি সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহছানুল হক মিলন।
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে দেশে পাবলিক পরীক্ষা, তথা এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে নকলপ্রবণতা। ঢাকার বাইরে পরীক্ষাকেন্দ্রের চারপাশে নকল সরবরাহকারীদের ভিড় লেগে থাকত। পরীক্ষা শুরু হলেই তৎপর হয়ে ওঠে কেন্দ্রের বাইরের এই লোকজন। কেউ দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে, কেউ বাইরে থেকে ছুড়ে পরীক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেয় নকল।
আর পরীক্ষার হলে প্রবেশের সময়ও কোমরে বেঁধে, মোজায় গুঁজে নকল নিয়ে যায় অনেক পরীক্ষার্থী। সমাজের ভয়াবহ এই রোগ সারাতে পারছিলেন না কেউ।
১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে কচুয়া উপজেলা নিয়ে চাঁদপুর-১ আসন থেকে বিএনপির হয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন আ ন ম এহছানুল হক মিলন। বয়সে যুবক মিলন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরে যোগ দিয়েছেন রাজনীতিতে। সাংগঠনিক দক্ষতায় দ্রুতই নিজেকে চাঁদপুরে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন তিনি। কিন্তু ক্ষমতায় তখন আওয়ামী লীগ।
সেই সরকারের টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর চাঁদপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচন করবেন। তাই নানাভাবে মিলনকে হেনস্তা করতে থাকেন তিনি। এরপরও ২০০১ সালের নির্বাচনে মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে পরাজিত করে আবার সংসদ সদস্য হন এহছানুল হক মিলন।
আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থীকে পরাজিত করার পুরস্কার দেয় বিএনপি। তাদের সরকার গঠনের পর এহছানুল হক মিলনের স্থান হয় মন্ত্রিসভায়। তাকে দেওয়া হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব।
এহছানুল হক মিলনের মনে তখন দৃঢ় সংকল্প: নিজের মন্ত্রণালয়ে কাজ করে দেখাতে হবে। সেই কাজ এমন হবে, যা দীর্ঘকাল মনে রাখবে বাংলাদেশের মানুষ। সবচেয়ে কঠিন কাজের দায়িত্ব তুলে নেন নিজের কাঁধে। পাবলিক পরীক্ষায় নকলের ভাইরাস উচ্ছেদ করতে হবে।
এই কাজে নেমে সমাজের ভালো মানুষের সমর্থন যেমন পেয়েছেন, তেমনি বাধা আসে স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছ থেকে। তবে এসব বাধা তোয়াক্কা করেননি এহছানুল হক মিলন। সঙ্গে দু-একজন সাংবাদিক নিয়ে ছুটে গেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের পরীক্ষাকেন্দ্রে। বেশি বেশি কেন্দ্র পরিদর্শনের সুবিধার জন্য কখনো ব্যবহার করেন হেলিকপ্টার। এ নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখি হলে মিলন জানান হেলিকপ্টারের ভাড়া নিজের পকেট থেকে দেন তিনি।
কঠোর হাতে অদম্য মনোবলে চেষ্টা করেন পরীক্ষায় নকলবাজি দমনের। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরও দেন কঠিন বার্তা। নকলে সহযোগিতা করলে কোনো রকম ছাড় নেই।
এহছানুল হক মিলনের এই চেষ্টা সফল হয়েছিল। তিনি যত দিন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন, তত দিন নকল কমে গিয়েছিল উল্লেখযোগ্যভাবে। এই কাজের জন্য সমাজের সব অংশ থেকেই প্রশংসা পান তিনি।
২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপির হয়ে মাঠে-ময়দানে ছিলেন এহছানুল হক মিলন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবারও চাঁদপুর-১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পান। তবে সেবার আসনটি ছিনিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ। তখনো বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন এহছানুল হক মিলন।
নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবার মন্ত্রী হন মহিউদ্দিন খান আলমগীর। এবার দ্বিগুণ উদ্যমে নির্যাতন-নিপীড়ন শুরু করেন এহছানুল হক মিলনের ওপর। বিশেষ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে তিনি মিলনের বিরুদ্ধে দায়ের করেন শতাধিক মামলা। এর মধ্যে সত্তরোর্ধ্ব বয়সী নারীকে ধর্ষণ, ব্যাগ চুরির মামলাও দেন মিলনের বিরুদ্ধে।
সরকারি দলের এই নিপীড়নের মাঝেও এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন এহছানুল হক মিলন। কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতেও অংশ নেন নিয়মিত। আদালতে মোকাবেলা করেন মামলা-মোকদ্দমা। এত কিছুর পরও ধীরে ধীরে বিএনপিতে পিছিয়ে পড়তে থাকেন তিনি। নেতা থেকে সাধারণ কর্মী হয়ে যেতে থাকেন।
শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসাবে নকল উচ্ছেদে মিলনের প্রশংসা করেন সবাই। কিন্তু সংগঠনের কাজে প্রশংসা নেই। নেতা থেকে হয়ে যেতে থাকেন বিএনপির সাধারণ কর্মী।
২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। সবারই ধারণা ছিল সাবেক সফল প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলন ফের চাঁদপুর-১ আসনে দলের মনোনয়ন পাবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে মনোনয়ন পান মোশাররফ হোসেন নামের একজন।
এরপরও নিষ্ক্রিয় হননি এহছানুল হক মিলন। বরং আরো বেশি সক্রিয় থেকেছেন বিএনপির রাজনীতিতে। তবে তার সেই আগের জায়গাটি পুনরুদ্ধার হয়নি। বিএনপিতে কীভাবে যেন চলে গেছেন পেছনের সারিতে।
এরপর থেকে দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয় মিলনের। ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল এই সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীকে দলের কমিটিতে পদাবনতি দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক থেকে তাকে করা হয় কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের একটানা ১৬ বছরের শাসনক্ষমতার পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আবার আলোচনায় আসেন এহছানুল হক মিলন।
(ঢাকাটাইমস/৮জুলাই/মোআ)

মন্তব্য করুন