একই ঘটনায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে মামলা: কার চাপে মামলা নিল খুলশী থানা?

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ০১ জুলাই ২০২৫, ২২:১০
অ- অ+

ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ। এই ঘটনায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে পৃথক মামলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলা করেন ভুক্তভোগী নিজে। অপরটি করেন মানবাধিকার সংগঠনের নেতা ও ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি এম এ হাশেম রাজু।

এক ঘটনায় দুই থানায় দুটি মামলায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। একই ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা কীভাবে হলো? পুলিশ সরাসরি যাচাই ছাড়া কীভাবে থানায় মামলা নথিভুক্ত করল?

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আহত এমদাদের জোরাজুরিতে চট্টগ্রামের খুলশী থানা মামলা নিতে বাধ্য হয়। আর সেটি করতে গিয়ে এমদাদ বৈষম্যবিরোধী অনেককে দিয়ে থানায় চাপ সৃষ্টি করেন।

এর আগে ঢাকার শাহবাগ থানায় নিজেকে প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করে প্রথম মামলা করেন ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি এম এ হাশেম রাজু।

দুই মামলার তথ্য বলছে, সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ গত বছরের ৪ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের সময় ঢাকার পরীবাগ ও চট্টগ্রামের নিউমার্কেট মোড়ে গুলিবিদ্ধ হন।

একজন ব্যক্তির একই দিনে একই সময়ে দুই শহরে আহত হওয়া এবং দুই থানায় মামলার রহস্য এবং এ ব্যাপারে করণীয় জানতে পুলিশ, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মীর সঙ্গে কথা বলে ঢাকাটাইমস। তারা বলছেন এ ধরনের ঘটনা অসম্ভব এবং এ নিয়ে মামলা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

ঢাকার মামলার প্রায় তিন মাস পর চট্টগ্রামে মামলা হয়। কিন্তু চট্টগ্রামের খুলশী থানা ঢাকার মামলার কথা জানত না বলে দাবি পুলিশের।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘‘আমরা প্রথমে জানতাম না এই ঘটনায় ঢাকায় মামলার আবেদন করা হয়েছে। ভুক্তভোগী এমদাদ যখন থানায় আসেন, আমরা তাকে অনেক বুঝিয়েছি— সরাসরি থানায় মামলা না দিয়ে যেন আদালতের মাধ্যমে যেন মামলাটি আসে। তিনি (এমদাদ) নাছোড়বান্দা।

বৈষম্যবিরোধী অনেককে দিয়ে আমাদের চাপ দেওয়া হয়। পরে চাপে পড়ে মামলাটি থানায় নেওয়া হয়।’

কারা চাপ সৃষ্টি করেছে তাদের কারও নাম বলতে চাননি ওই কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই বুঝেছিলাম মামলাটি ব্যবসায়ী শ্রেণিসহ অনেককে হয়রানি করতে করা হয়েছে। তবে তখন মামলা না নিয়ে উপায় ছিল না আমাদের।’

ঢাকায় করা মামলা এজাহারে সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাস্থল দেখানো হয় শাহবাগ থানার পরিবাগ এলাকায়। গত ২০ মার্চ মামলাটির আবেদন করেন হাশেম রাজু। ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের পর প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেন আদালত।

তবে রাজু ও এমদাদের পক্ষ থেকে সহযোগিতা না পেয়ে পুলিশ বিষয়টি আদালতকে অবহিত করেন। একই সঙ্গে মামলা তদন্তে আরও এক মাস সময় চাওয়া হয়।

এই ঘটনার মধ্যেই চট্টগ্রামের খুলশী থানায় গত ১৭ জুন মামলা করেন সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৬৭ জনকে আসামি করা হয়।

এই মামলায় সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদের তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাস্থল দেখান চট্টগ্রামের নিউমার্কেট মোড়। তারিখ ৪ আগস্ট।

শাহবাগ থানায় আসা মামলার এজাহারের তথ্য বলছে, ৪ আগস্ট সকাল সাড়ে ১১টায় ঢাকার পরীবাগে ছাত্র-জনতার মিছিলে চোখে গুলিবিদ্ধ হন সাইফুদ্দীন। বাদী এম এ হাশেম রাজু নিজেকে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করেন। মামলায় পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন, জায়েদ খানসহ মোট ২০১ জনকে আসামি করা হয়।

অন্যদিকে, চট্টগ্রামের খুলশী থানায় করা মামলার বাদী স্বয়ং সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ এজাহারে বলেন, তিনি ৪ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে চট্টগ্রামের নিউমার্কেট মোড়ে আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। পরদিন ৫ আগস্ট ওয়াসা মোড়ে দ্বিতীয় দফায় গুলিবিদ্ধ হন।

সিএমপির উত্তর বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) আমিনুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, 'মামলায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। মামলাটি ওভাবেই রয়েছে। কারণ একটি ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। একটি মামলা বাতিল হতে পারে।'

উপপুলিশ কমিশনার বলেন, ‘যিনি ঢাকায় মামলা করেছেন তার সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার টিম ঢাকায় গেছে। কিন্তু তিনি দেখা দেননি। আবার টিম যাবে। আমরা চেষ্টা করছি বিতর্কিত এই মামলা যাতে প্রত্যাহার হয়। আর পুলিশ এই মামলা নিয়ে কাউকে হয়রানি করছে না।'

এদিকে ঢাকার মামলাটি এখনো থানায় মামলা হিসেব নথিভুক্ত হয়নি বলে জানান শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ খালিদ মনসুর। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘আমরা বাদী রাজুকে খুঁজছি। তাকে থানায় ডাকা হলেও আসছেন না।'

চট্টগ্রামে হওয়া অপর মামলাটির বিষয়ে শুনেছেন জানিয়ে শাহবাগ থানার ওসি বলেন, 'আমরা প্রয়োজনে আদালতকে বিষয়টি অবহিত করব।’

সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদের ঘটনা নিয়ে ঢাকায় মামলা থাকার কথা তাদের জানা ছিল না বলে জানান খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফতাব হোসেন।ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘আহত এমদাদ নিজে বাদী হয়ে আমাদের থানায় মামলা করেছেন। আগে এই ঘটনায় মামলা ছিল এটা আমাদের জানা ছিল না। দুই শহরে আহত হওয়া অবিশ্বাস্য। তদন্তেই সব বেরিয়ে আসবে।’

এর আগে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, ‘ঢাকায় মামলা হয়ে থাকলে চট্টগ্রামের মামলা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, এক ব্যক্তি দুটি ভিন্ন শহরে একই সময়ে গুলিবিদ্ধ হন— এমন ঘটনা অসম্ভব। চট্টগ্রামের মামলার এজাহারে উল্লেখ আছে, ১ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত চট্টগ্রামেই ছিলেন সাইফুদ্দীন। তাহলে তিনি ৪ আগস্ট ঢাকার পরীবাগে কীভাবে গুলিবিদ্ধ হন?

ঢাকার মামলার বাদী এম এ হাশেম রাজু এই প্রশ্নের উত্তরে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি নিজে তাকে পরীবাগে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছি এবং সেদিন রাতে চট্টগ্রামে পাঠিয়েছি।’

কিন্তু চট্টগ্রামের মামলায় বাদী সাইফুদ্দীন নিজে দাবি করেছেন, ১ আগস্ট থেকে তিনি চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন এবং গুলিবিদ্ধ হন নিউমার্কেট মোড়ে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুটি মামলার মধ্যে সময় ও ঘটনার প্রকৃত স্থান নিয়ে এই ধরনের অসংগতি ফৌজদারি আইনের গুরুতর লঙ্ঘন। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮২ ধারা অনুসারে, সরকারি কর্মচারীর কাছে মিথ্যা তথ্য দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

অপরদিকে, দণ্ডবিধির ২১১ ধারায় মিথ্যা মামলা দায়েরের জন্য ২ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘একই সময়ে ভিন্ন শহরে কারও আহত হওয়ার দাবি আইন ও বাস্তবতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এটা কোনো ভুল নয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আর এমনটি হলে তা শাস্তিযোগ্য।’

(ঢাকাটাইমস/১জুলাই/এসএস/মোআ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
মিটফোর্ড হাসপাতালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে শিক্ষার্থীদের ‘শাটডাউন’ ঘোষণা
সাজা মওকুফে আরও ২৯ বন্দির মুক্তি: ২০২৫ সালে মোট মুক্ত ১০৭ জন
আবু সাঈদ হত্যা ও ছয় মরদেহ পোড়ানোর মামলার আসামিরা ট্রাইব্যুনালে হাজির
প্রথম প্রেমের স্পর্শ: পাঠকের উদ্দেশ্যে লেখকের বার্তা
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা