ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-১৫

ইসলামি জীবনের ১৩টি আদেশ-নিষেধ

​​​​​​​মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী
| আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২৪, ২০:০০ | প্রকাশিত : ২৫ মার্চ ২০২৪, ২১:৩১

প্রিয় পাঠক,

আজ আমরা পবিত্র কোরআনুল কারীমের ১৫ তম পারা থেকে ধারাবাহিক তাফসির জানবো ইনশাআল্লাহ। মহামানব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইসরা ও মেরাজ নিয়ে ১৫ তম পারা শুরু হয়েছে এবং এ পারায় রয়েছে সূরা কাহাফ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সমূহ...

আগের পর্ব: আদম আ. সৃষ্টি ও ইবলিসের কর্মকাণ্ড

সূরা ইসরা

এটি মক্কি সুরা। আয়াত সংখ্যা: ১১১। রুকু সংখ্যা: ১২

নামকরণ

ইসরা অর্থ রাতে ভ্রমণ করা। যেহেতু এ সূরার শুরুতেই মিরাজের প্রথম অংশ তথা জিবরাইল আলাইহিস সালাম কর্তৃক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাতেরবেলা মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ হয়েছে, তাই একে সুরাতুল ইসরা বলা হয়।

মেরাজ

এটা তো অনস্বীকার্য যে, মেরাজ (ঊর্ধ্বলোক গমন) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক বিরাট মুজিজা। এর মাধ্যমে তাকে অত্যন্ত সম্মানিত করা হয়। গোটা মানবজাতির মধ্য থেকে এ সম্মান একমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই অর্জিত হয়েছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জাগ্রতাবস্থায় ঘটনাটি সংঘটিত হয়। স্বপ্নযোগে হলে কোরআনে এটা এতটা গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণিত হতো না। আর মুশরিকরাও তখন তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করত না। কেননা স্বপ্নে মানুষ আশ্চর্য থেকে আরও আশ্চর্যজনক দৃশ্য ও ঘটনা দেখে থাকে। কেউ একে মিথ্যা প্রতিপন্নও করে না।

এ সূরায় মিরাজের ঘটনা ব্যতীত যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বর্ণিত হয়েছে, নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো:

বনি ইসরাইলের বিশৃঙ্খলা

১. বনি ইসরাইলকে আগেই বলে দেওয়া হয়েছিল, শামে তোমরা দু-বার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। আর দু-বারই আমি আমার বান্দার মাধ্যমে তোমাদের শাস্তি দেব। প্রথমবার যখন তারা তাওরাতের বিরোধিতা করেছে, শোয়াইব আলাইহিস সালামকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে তখন বুখতে নাসারকে (প্যারিচাদ নেজার) দলবলসহ তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা গোটা জনপদে ছেয়ে যায়। আলেম ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নির্বিচারে হত্যা করে। তাওরাত পুড়িয়ে ফেলে। বাইতুল মাকদিসকে বিরান করে দেয়। অসংখ্য ইহুদিকে বন্দি করে নিয়ে যায়। দ্বিতীয়বার তারা হজরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামকে শহিদ করে দেয়। পাপাচারের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করে। এবার ব্যবিলন নগরীর বাদশাহ বেরডোস বা খেরডোসকে তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।'

ইহুদিদের ইতিহাস ফেতনা-ফাসাদে ভরপুর। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে তারা পাপাচার ও অপরাধের রাস্তা অবলম্বন করেছিল। মুসলমানদের তখন তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এসময় তাদেরকে আরব ভূখণ্ড থেকে বের করে দেওয়া হয়। নিকট-অতীতে হিটলার তাদের জন্য খোদায়ী আজাবের রূপ ধারণ করে। কথিত আছে, সে অনেক ইহুদিকে হত্যা করে। তাদেরকে সে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে। এখন পুনরায় তাদের ফেতনা প্রকট্য রূপ ধারণ করেছে। দেখার বিষয় হল আবার কখন তাদের উপর আল্লাহর আজাব নাজিল হয়!

ইসলামি জীবনের তেরোটি আদেশ-নিষেধ

২. কোরআনুল কারিমের শ্রেষ্ঠত্ব, মানুষের স্বভাবগত দ্রুততার প্রবণতা, প্রত্যেকের সাথে তার আমলনামা থাকার বিষয়টি উল্লেখ করার পর ইসলামি জীবনব্যবস্থা সম্পর্কিত প্রায় তেরোটি আদেশ-নিষেধ ও আদব-আখলাকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামি শিষ্টাচার ও উত্তম চরিত্রের কারণেই (যেমনি মুসলমানরা সম্মানিত হয়েছে, তেমনি তার ছায়াতলে এলে অন্য) যেকোনো জাতি সম্মানিত হতে পারে। এজন্য অনেকে এগুলোকে উন্নতির সোপান বলেও উল্লেখ করেছেন। ২৩-৩৯ নং আয়াতে এইসব বিধান ও আদব বিবৃত হয়েছে। নিম্নে তা উল্লেখ করা হল:

১. আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদত কোরো না।

২. মাতাপিতার সাথে সদ্ব্যবহার করো।

৩. আত্মীয়স্বজন, মিসকিন-মুসাফিরদের হক আদায় করো।

৪. অপচয় কোরো না।

৫. কার্পণ্য কোরো না।

৬. হাত এতটা প্রসারিত কোরো না, যাতে আগামীকাল তোমাকে আফসোস করতে হয়।

৭. দরিদ্রতার ভয়ে সন্তান হত্যা কোরো না।

৮. কোনো প্রাণীকে অন্যায়ভাবে হত্যা কোরো না।

৯. এতিমের সম্পদে অবৈধ হস্তক্ষেপ কোরো না।

১০. অঙ্গীকার করলে তা পূর্ণ করো।

১১. সঠিকভাবে ওজন করো।

১২. যে জিনিসের ব্যাপারে তোমার সঠিক জ্ঞান নেই, তার পেছনে পড়ো না।

১৩. জমিনে দম্ভভরে চলো না।'

পরিশেষে দু-দু'বার করে বলা হয়েছে, আল্লাহর সাথে কাউকে মাবুদ সাব্যস্ত করো না।

আল্লাহর সন্তান দাবি ও পরকাল অস্বীকারের খণ্ডন

*মুশরিকদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, তারা আল্লাহর সন্তান থাকার কথা বলে। (৪০) তারা পরকাল অস্বীকার করে। বড় আশ্চর্যের সাথে তারা বলে, মৃত্যুব পর যখন আমাদের হাড্ডি চূর্ণ-চূর্ণ হয়ে যাবে তখনও কি আমাদেরকে নতুনভাবে সৃষ্টি করা হবে! (৪০-৫২)

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তারা চাক্ষুষ মুজিজা চেয়েছিল। কখনো তারা বলেছে, যখন আমাদের জন্য জমিন থেকে ঝরনা প্রবাহিত করে দেওয়া হবে তখন আমরা ঈমান আনবো। কখনো তারা বলে, যখন আপনার খেজুর ও আঙুরের বাগান হবে বা আপনি আমাদের উপর আসমান ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলবেন কিংবা আল্লাহ ও ফেরেশতাদের আমাদের সামনে পেশ করতে পারবেন (তখন আমরা ঈমান আনবো)। কখনো তারা বলেছে, যখন আপনার কোনো স্বর্ণের ঘর হবে কিংবা আপনি আমাদের সামনে আকাশে আরোহণ করে সেখান থেকে কোনো লিখিত কিতাব নিয়ে আসবেন (আমরা তখন ঈমান আনবো)।' (৯০-৯৩)

এ ছাড়াও এ সুরায় কোরআনুল কারিমের শ্রেষ্ঠত্ব, সত্যতা, অবতীর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্য এবং তার মুজিজা হওয়ার বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে। (৯, ৮২- ৮৮) একইভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে সম্মানিত করা (৬১-৬৫) তাকে রুহ ও জীবনের নেয়ামত দেওয়ার কথা এসেছে। (৮৫) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাহাজ্জুদের নির্দেশ দেওয়া, (৭৮-৭৯) মুসা আলাইহিস সালাম ও ফেরাউনের ঘটনা, (১০১-১০৪) অল্প অল্প করে কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার হেকমত উল্লেখ করা হয়েছে। (১০৫-১০৬)

সুরার শেষে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রকার অংশীদার ও সন্তান থেকে পবিত্র। তিনি আসামায়ে হুসনা তথা সুন্দর গুণবাচক নামসমূহে গুণান্বিত।

সুরা কাহাফ'

এটি মক্কি সুরা। আয়াতসংখ্যা: ১১০। রুকুসংখ্যা: ১২

নামকরণ

কাহাফ অর্থ গুহা। আসহাবে কাহাফ অর্থ গুহাবাসী। এ সুরায় গুহাবাসীদের ঘটনা বর্ণিত হওয়ায় একে সুরা কাহাফ বলা হয়।

ফজিলত

সুরাটির ফজিলতের ব্যাপারে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আহমদ, মুসলিম ও নাসায়ি রহ, হজরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, যে-ব্যক্তি সুরা কাহাফের শেষ দশ আয়াত তেলাওয়াত করবে, সে দাজ্জালের ফেতনা থেকে নিরাপদ থাকবে। সুরা কাহাফের ফজিলত সম্পর্কিত হাদিসের আলোকে আলেমগণ বলেন, শুক্রবারে সুরা কাহাফ তেলাওয়াত করা সুন্নাত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে-ব্যক্তি জুমআর দিন সুরা কাহাফ তেলাওয়াত করবে দুই জুমআর মধ্যবর্তী সময় তার জন্য আলোকিত করে দেওয়া হবে।

সেই পাঁচ সুরার একটি

সুরা কাহাফ সেই পাঁচ সুরার একটি, যা আলহামদু লিল্লাহ শব্দ দ্বারা শুরু হয়েছে। বাকি চার সুরা হল সুরা ফাতিহা, সুরা আনআম, সুরা সাবা ও সুরা ফাতির।

এ সুরার তাফসিরে স্বতন্ত্র কিতাব

সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদবি রহ. এ সুরার তাফসিরে স্বতন্ত্র একটি কিতাব লিখেছেন, যাতে তিনি বলেছেন, দীর্ঘ চিন্তাভাবনার পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, এ সুরার বিষয় হল ঈমান ও বস্তুবাদের সংঘাত। এই সুরার সাথে শেষ জমানার ফেতনার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। দাজ্জাল হবে এ ফেতনার সবচেয়ে বড় পতাকাবাহী। এ সুরা মুসলমানদের দাজ্জালের ফেতনা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত করে।' সুরায় উল্লেখকৃত ঘটনা ও দৃষ্টান্তসমূহ দ্বারা ঈমান ও বস্তুবাদের সংঘাতের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

সুরা কাহাফে তিনটি ঘটনা এবং তিনটি দৃষ্টান্তের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।

প্রথম ঘটনা: আসহাবে কাহাফ

প্রথম ঘটনাটি আসহাবে কাহাফের। কিছু মুমিন যুবককে বাদশাহ দাকিয়ানুস মূর্তিপূজায় বাধ্য করেছিল। যারা তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিরক না করত, সে তাদেরকে হত্যা করে ফেলতো। এসব যুবককে প্রলোভন দেখানো হয় যে, যদি তারা এই শিরকি আহ্বানে সাড়া দেয় তা হলে তাদেরকে অঢেল ধনসম্পদ, উঁচু পদ ও সম্মানিত জীবনের ব্যবস্থা করা হবে; অন্যথায় তাদেরকে হত্যা করা হবে। এই যুবকরা অন্যান্য জিনিসের উপর ঈমানের সংরক্ষণকে প্রাধান্য দেয়। ঈমান বাঁচানোর জন্য তারা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। চলতে চলতে তারা শহর থেকে অনেকদূরে অবস্থিত একটি পাহাড়ের নিকট পৌঁছে। তারা সে পাহাড়ে আত্মগোপন করার ইচ্ছা করে। যখন তারা গুহায় প্রবেশ করে, আল্লাহ তাদের চোখে গভীর নিদ্রা ঢেলে দেন। এমনকি তারা ৩০৯ বছর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে।

ঘুম ভাঙলে তারা ক্ষুধা অনুভব করে। তাদের একজন খাবার ক্রয় করার জন্য শহরে আসে। লোকেরা তাকে দেখে উৎসুক হয়ে ওঠে। গত তিনশ বছরে অবস্থার

অনেক পরিবর্তন ঘটেছিল। পৌত্তলিকদের রাজত্ব বহু আগেই খতম হয়ে গিয়েছিল। তখন মুমিন বাদশাহর রাজত্ব চলছিল। ঈমানের খাতিরে ঘরবাড়ি ত্যাগ-করা এসব যুবক লোকজনের দৃষ্টিতে জাতীয় বীরের মর্যাদায় ভূষিত হয়েছিল।'

ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায়, ঈমানের ব্যাপারে মুমিনের উপলব্ধি থাকা উচিত। আল্লাহ না করুক, যদি কখনো ঈমান ও বস্তুবাদের মধ্য থেকে একটি বিষয় নির্বাচনের পালা চলে আসে তা হলে তখন ঈমানকে সবকিছুর উপর প্রাধান্য দেওয়া আবশ্যক।

দ্বিতীয় ঘটনা: মুসা ও খাযির আলাইহিমাস সালামের সফর

মুসা আলাইহিস সালাম যখন জানতে পারলেন সমুদ্র-তীরে এক ব্যক্তি রয়েছেন, যার নিকট এমন জ্ঞান রয়েছে, যা তার অজানা। তখন তিনি সেই ব্যক্তির সন্ধানে বের হয়ে পড়েন। চলতে চলতে একসময় তিনি সমুদ্র-তীরে পৌঁছেন। তখন খাযির আলাইহিস সালামের সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটে। মুসা আলাইহিস সালাম তার সঙ্গে থাকার অনুমতি প্রার্থনা করেন। কোনো প্রশ্ন না করার শর্তে খাযির আলাইহিস সালাম তাকে থাকার অনুমতি প্রদান করেন।

এরপর তিনটি আশ্চর্য ঘটনা সংঘটিত হয়।

প্রথম ঘটনায় খাযির আলাইহিস সালাম একটি নৌকা ছিদ্র করে ফেলেন। অথচ নৌকার মালিক বিনাভাড়ায় তাকে নৌকায় উঠিয়েছিল। দ্বিতীয় ঘটনায় তিনি এক নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করে ফেলেন।

তৃতীয় ঘটনায় তিনি এক জনপদের অধঃপতিত দেয়াল উঠিয়ে দেন; অথচ একসময় এই জনপদবাসীরাই তাকে খানা খাওয়াতে অস্বীকার করেছিল!

মুসা আলাইহিস সালাম এ তিন জায়গার কোথাও চুপ থাকতে পারেননি। তিনি প্রতিবারই খাযির আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞেস করেছেন কেন আপনি এমন করলেন? তৃতীয়বার জিজ্ঞাসা করার পর খাযির আলাইহিস সালাম তার থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, আপনি সামনে আর আমার সাথে থাকতে পারবেন না।

তবে এই তিন ঘটনার বাস্তবতা তিনি তার সামনে স্পষ্ট করে দেন। তিনি বলেন, নৌকা ছিদ্র করার কারণ হচ্ছে সামনে এক জালেম বাদশাহ ছিল। সেই বাদশাহ নতুন ও ভালো নৌকাগুলো ছিনিয়ে নিচ্ছিল। আমি তা ত্রুটিযুক্ত করে দেওয়ায় নৌকাটি সেই জালেম বাদশাহর হাত থেকে বেঁচে গেল। দরিদ্র মাঝির জীবনোপকরণ রক্ষা পেল।

শিশুটিকে হত্যা করার কারণ হচ্ছে, বড় হয়ে সে পিতামাতার জন্য ফেতনার কারণ হয়ে দাঁড়াতো। তার কারণে পিতামাতারও কুফরিতে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। অথচ আল্লাহ তায়ালা চাচ্ছিলেন, এই নেককার মাতাপিতা যেন সাম্রাশঙ্কা মহব্বতে ঈমান থেকে বঞ্চিত না হয়। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা তাকে হত্যা করার এবং তার পরিবর্তে এক নেককার ও অনুগত সন্তানের ফয়সালা করেছেন।

পতিত দেয়াল উঠিয়ে দেওয়ার কারণ হচ্ছে, দেয়ালটি দুটি এতিম শিশুর। তাদের মাতাপিতা আল্লাহর নেককার বান্দা ছিল। দেয়ালের নিচে তাদের ধনভাণ্ডার ছিল। যদি সেই দেয়াল ধসে পড়ত তা হলে দেয়ালটি উঠিয়ে লোকজন সে সম্পদ নিয়ে নিতো। নেককার পিতামাতার সন্তানরা তা থেকে বঞ্চিত হতো। আমি দেয়ালটি উঠিয়ে দিলাম, বড় হয়ে যেন তারা এই সম্পদ বের করে নিজেদের কাজে লাগাতে পারে।'

মুসা আলাইহিস সালাম ও খাযির আলাইহিস সালামের ঘটনা দ্বারা আমরা এই শিক্ষা পাই যে, আমাদের সামনে দিবারাত্রি যেসব ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে-যৌবনেই কারও মৃত্যু চলে আসছে, কেউ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে, আহত হচ্ছে, কারও বাড়ি ধসে পড়ছে, কারও ব্যবসায় লোকসান হচ্ছে-এসবের পেছনে বড় আশ্চর্য হেকমত ও রহস্য নিহিত রয়েছে। দুনিয়ার জাহের (বাহ্য অবস্থা) ও বাতেন (অন্তর্নিহিত অবস্থা) এর মাঝে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। মানুষ শুধু জাহেরই দেখে; বাতেন তাদের গোচরে আসে না, সেই পর্যন্ত তার ভাবনা পৌঁছে না।

এ ঘটনা বস্তুবাদের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে এক দলিল। তারা জাহেরকেই সব মনে করে। বিশ্বজগতের পেছনে একজন হাকিম ও সর্বজ্ঞ সত্তার অস্তিত্ব থাকার বিষয়টি তারা অস্বীকার করে।

তৃতীয় ঘটনা: হজরত জুলকারনাইনের প্রাচীর

তৃতীয় ঘটনাটি জুলকারনাইনের। ষোলোতম পারায় আমরা তা উল্লেখ করব ইনশা আল্লাহ।

তিনটি দৃষ্টান্ত: ঘটনা-তিনটি ছাড়াও এ সুরায় তিনটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে।

প্রথম দৃষ্টান্ত

প্রথম দৃষ্টান্তটি (৩২-৪৪নং আয়াতে) ঘটনা আকারে উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনাটি এক ধনাঢ্য ব্যক্তির, যে ফলে-ফুলে সমৃদ্ধ একটি মূল্যবান বাগানের মালিক ছিল। এ ছাড়াও সম্পদ উপার্জনের তার অনেক মাধ্যম ছিল। সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে সে অহংকার করত। বড় বড় কথা বলত।

তার মনে একটা ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে, এসব সম্পদ সারা জীবন থাকবে। কখনোই তা নিঃশেষ হবে না। তার বিশ্বাস ছিল কখনো কেয়ামত হবে না। যদি হয়ও তা হলে তখনও সে সুখী জীবন লাভ করবে। তার এক মুমিন বন্ধু ছিল। সে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, এসব উপায়-উপকরণকে মাবুদ মনে কোরো না। একেই সব মনে কোরো না। কখনো আল্লাহকে ভুলে যেয়ো না। তিনি যা চান শুধু তা-ই হয়।

ধনসম্পদ তার চোখে পর্দা ফেলে দিয়েছিল। সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বলতর বিষয়ও তার বোধগম্য হয়নি। এরপর একদিন আল্লাহর আজাব চলে আসে। তার বাগবাগিচা জ্বলে-পুড়ে কয়লা হয়ে যায়। এসব ধ্বংসের পর সে আফসোস করতে থাকে, হায়, যদি আমি শিরক না করতাম! উপায়-উপকরণকে যদি মাবুদের স্তরে না নিয়ে যেতাম! কিন্তু এ আফসোস তার কোনো কাজে আসেনি।

এটা তো স্পষ্ট যে, সে আল্লাহকে ঠিকই মানতো। কেয়ামতের ব্যাপারে একধরনের বিশ্বাস রাখত। তার বক্তব্য 'যদি আমি শিরক না করতাম'-এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, 'শিরক ফিল আসবাব' তথা উপায়-উপকরণ ও ধনসম্পদকে সবকিছু মনে করা। আর উপকরণের স্রষ্টাকে ভুলে যাওয়া। অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে অমুসলিমরা তো বটেই; বহু মুসলিমও এ ধরনের শিরকে লিপ্ত। এতে সন্দেহ নেই যে, আসবাব-উপকরণ গ্রহণ করা ঈমান পরিপন্থি নয়; কিন্তু আসবাবকে সবকিছু মনে করাই ঈমান পরিপন্থি।

দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত

দ্বিতীয় দৃষ্টান্তের ব্যাপারে (৪৫নং আয়াতে) আল্লাহ তায়ালা বলেন, তাদের নিকট পার্থিব জীবনের উপমা পেশ করুন। তা পানির ন্যায়, যা আমি আকাশ থেকে নাজিল করি। অতঃপর এর সংমিশ্রণে শ্যামল-সবুজ ভূমিজ লতা-পাতা নির্গত হয়। একসময় তা এমনভাবে শুকিয়ে যায় যে, বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ সবকিছুর উপর শক্তিমান।

অর্থাৎ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দিক থেকে পার্থিব জীবন বৃষ্টির পানির মতো, আকাশ থেকে যা বর্ষিত হয়। যার ফলে জমিন শস্য-শ্যামল হয়ে ওঠে। ফসল ফলে। ফুল ফোটে। চতুর্দিকে নয়নাভিরাম দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। এরপর একসময় তার ক্রান্তিকাল শুরু হয়। ফুল মরে যায়। পাতা ঝরে পড়ে। ফসল তোলা হয়। পায়ের নিচে ফেলে তাকে মাড়ানো হয়। তেমনিভাবে মানুষের জীবন-যৌবন, হাসি-আনন্দ সবকিছুই কৃত্রিম। কেবল বোকারাই এর ফলে ধোঁকা খায়। জ্ঞানীরা জানে যে, এসব শুধুই পার্থিব সৌন্দর্য। একমাত্র নেক আমল, সদকা-খয়রাত, জিকির-তেলাওয়াত, উত্তম চরিত্র ও সহানুভূতি চিরস্থায়ী, পরকালে যা কাজে আসবে।

তৃতীয় দৃষ্টান্ত

তৃতীয় দৃষ্টান্তটি গর্ব ও অহংকার সংক্রান্ত। এতে আদম আলাইহিস সালামের সাথে ইবলিসের সংঘটিত ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ সত্ত্বেও ইবলিস অহংকারবশত আদম আলাইহিস সালামের সামনে সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানায়। তার ধারণা ছিল 'আমি উত্তম। আর এটা কীভাবে সম্ভব হতে পারে যে, উত্তম জন অনুত্তম কাউকে সিজদা করবে!'

এ ঘটনার মাধ্যমে মানুষকে বোঝানো হয়েছে, তারা যেন কখনো গর্ব ও অহংকারে লিপ্ত না হয়। আল্লাহর নির্দেশের সামনে যেন মুখ না খোলে। বন্দেগি ও দাসত্বের দাবি হল মাথা নত করা। আনুগত্য করা। অনুসরণ করা। মোটেই দলিল- অনুসন্ধান আর অস্বীকার করা নয়।

চলবে ইনশাআল্লাহ...

লেখক: আলেম ও ওয়ায়েজ; খতীব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।

(ঢাকাটাইমস/২৫মার্চ/এসআইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :