ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-১৪

​​​​​​​আদম আ. সৃষ্টি ও ইবলিসের কর্মকাণ্ড

মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী
| আপডেট : ২৫ মার্চ ২০২৪, ১১:২৩ | প্রকাশিত : ২৪ মার্চ ২০২৪, ২১:১৭

প্রিয় পাঠক,

আজ আমরা পবিত্র কুরআনুল কারীমের ১৪তম পারার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোকপাত করবো ইনশাআল্লাহ। আজ আমাদের আলোচনা শুরু হবে সূরা হিজর দিয়ে।

আগের পর্ব: এসো রমাজানে কোরআনকে জানি (১৩তম পর্ব)

সুরা হিজর

এটি মক্কি সুরা। আয়াতসংখ্যা: ৯৯। রুকুসংখ্যা: ৬

নামকরণ

এতে হিজর উপত্যকায় বসবাসকারী সম্প্রদায়ের আলোচনা এসেছে বিধায় একে সুরা হিজর বলা হয়। হিজর উপত্যকাটি মদিনা ও শামের মাঝামাঝি অবস্থিত। বা এই সূরার শুধু প্রথম আয়াতটি তেরোতম পারায়, বাকি পূর্ণ সুরা চোদ্দতম পারায় অবস্থিত। এ সুবাটিও হরফে মুকাত্তায়াত দ্বারা শুরু হয়েছে। এর প্রথম আয়াতে কোরআনুল কারিমের প্রশংসা ও গুণ বর্ণনা করা হয়েছে। সুরাটিতে ইসলামের

মৌলিক আকিদার বিষয়টি প্রমাণ করা হয়েছে। এই সুরাতে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ হয়েছে, নিম্নে তা তুলে ধলা হল :

হায়, আমরা যদি মুসলমান হতাম!

১. কেয়ামতের দিন কাফেররা আজাবের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে বলে উঠবে, হায়, আমরা যদি মুসলমান হতাম! কিন্তু সেদিন ঈমান ও ঈমান আনার কামনা কোনোটাই কাজে আসবে না। আজ যখন আল্লাহর রাসুল তাদেরকে ঈমান আনার দাওয়াত দিচ্ছেন তখন তারা তাকে পাগল আখ্যা দিচ্ছে, তারা তার দাওয়াত অস্বীকার করছে, তাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করছে, পূর্ববর্তী সম্প্রদায়গুলো যেমন তাদের নবীদের নিয়ে করেছিল।

কোরআন হেফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ

২. কোরআনের এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এর হেফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন। পক্ষান্তরে অন্যান্য আসমানি কিতাব হেফাজতের দায়িত্ব সে সম্প্রদায়ের কাঁধেই ছিল, যার কারণে মানুষের হস্তক্ষেপ থেকে তা রেহাই পায়নি। কিন্তু বহু শতাব্দী অতিক্রান্ত হওয়ার পরও কোরআন সবধরনের পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও বেশকম থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র ও নিরাপদ রয়েছে। সংরক্ষিত হওয়াটা কোরআনের অন্যতম প্রধান মুজিজা। সংরক্ষণের জন্য আল্লাহ তায়ালা এ কোরআন মুখস্থ করা সহজ করে দিয়েছেন। পৃথিবীর এমন কোনো অঞ্চল নেই, যেখানে কোরআনের হাফেজ পাওয়া যাবে না। ছোট মাসুম বাচ্চারা যেখানে মাতৃভাষায় ছোট্ট কোনো পুস্তিকাও মুখস্থ রাখতে পারে না সেখানে তারা এতো বড় কিতাব মুখস্থ করে নিতে পারে!

আল্লাহ তায়ালার কুদরত একত্বের দলিল এবং মানব-সৃষ্টির ঘটনা

৩. এ সুরার বহু আয়াতে আল্লাহ তায়ালার কুদরত ও তার একত্বের দলিল উল্লেখ করা হয়েছে, যা চিৎকার করে বিশ্বজগতের স্রষ্টার অস্তিত্ব ও তার বছরের সাক্ষ্য দিচ্ছে। এ দলিল-প্রমাণগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মহান আল্লাহর সৃষ্টিবাজিতে। আসমান-জমিন, চন্দ্র-নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, মাঠ-ঘাট, নদী সাগর, গাছগাছালি ও পশুপাখিতে। বলা হয়েছে, আমি আকাশে বুরুজ বানিয়েছি। দর্শকদের জন্য তাকে আমি সজ্জিত করেছি। (১৬)

এর দুই আয়াত পরে বলা হয়েছে, আমি ভূপৃষ্ঠকে বিস্তৃত করেছি এবং তার উপর পর্বতমালা স্থাপন করেছি। এবং প্রত্যেক বস্তু তাতে সুপরিমিতভাবে উৎপন্ন করেছি। (১৯)

কোথাও বলা হয়েছে, আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু পরিচালনা করি, অতঃপর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করি। এরপর তোমাদেরকে তা পান করাই। বস্তুত তোমাদের কাছে এর ভাণ্ডার নেই। (২২)

বাতাস হাজার হাজার টন পানি বহন করে। এরপর আল্লাহ যেখানে নির্দেশ দেন সেখানে তা বর্ষণ করে। এই বাতাসে প্রাণী ও গাছগাছালির নর-মাদি উপাদান ও রেণু থাকে।

৪. তাওহিদ কুদরতে ইলাহির দলিল উল্লেখ করার পর মানব-সৃষ্টির ঘটনা বর্ণনা

নিঃসন্দেহে প্রথম মানব হজরত আদম আলাইহিস সালাম আল্লাহ তায়ালার কুদরতের এক বড় নিদর্শন। প্রাণহীন মাটি থেকে আল্লাহ তায়ালা প্রাণবিশিষ্ট মানুষ সৃষ্টি করেছেন, যে নড়াচড়া করতে পারে। উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে ও চিন্তাভাবনা করতে পারে। বিভিন্ন জিনিস নিজের আয়ত্তে আনতে পারে। নিঃসন্দেহে এটা আল্লাহ তায়ালার পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাবান হওয়ার সবচেয়ে বড় দলিল।

হজরত আদম আলাইহিস সালামের ঘটনা একজন মাত্র ব্যক্তির নয়; বরং গোটা মানব-সভ্যতার ঘটনা। আল্লাহ তায়ালা আদম আলাইহিস সালামকে নিজহাতে সৃষ্টি করেছেন। ফেরেশতাদের তার সামনে সিজদা করার নির্দেশ দিয়েছেন। এসব বিষয় যেমনিভাবে আদম আলাইহিস সালামের সম্মান ছিল তেমনি এর দ্বারা তার সন্তানদেরও সম্মানিত করা হয়েছে।

ইবলিস

ফেরেশতাদের সিজদা করার নির্দেশ দেওয়ার পর ইবলিস ব্যতীত সকলেই সিজদা করে। আলেমদের নিকট নির্ভরযোগ্য কথা হচ্ছে, ইবলিস কোনো ফেরেশতা নয়; করার প্রকৃতপক্ষে সে এক জিন।' তবে সে ফেরেশতাদের মাঝেই থাকত। সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে তাকে আসমান থেকে বের করে দেওয়া হয়। চিরকালের জন্য সে অভিশপ্ত হয়। আদম আলাইহিস সালাম থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সে আল্লাহর নিকট কেয়ামত দিবস পর্যন্ত সুযোগ প্রার্থনা করে। আল্লাহ তায়ালা তাকে সেই সুযোগ দেন।

আদমসন্তানকে পথভ্রষ্ট করার জন্য সে নিজেই অবকাশ চেয়েছিল। কোনো রাখঢাক ছাড়াই স্বীয় উদ্দেশ্য প্রকাশ করেছিল। সে বলেছিল, 'হে আমার পালনকর্তা, আপনি যেমন আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তাদের সবাইকে পৃথিবীতে নানা সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করব এবং তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করে ফেলব।' (৩৯)

তার উত্তরে বলা হয়েছে, তোমার যা খুশি করতে পারো। যারা আমার বান্দা, তাদের উপর তোমার কোনো ক্ষমতা থাকবে না; কিন্তু যারা তোমার পথে চলে, সেই পথভ্রষ্টদের কথা ভিন্ন। তাদের সবার নির্ধারিত স্থান হচ্ছে জাহান্নাম। এর সাতটি দরজা রয়েছে। প্রত্যেক দরজার জন্য (জাহান্নামিদের) পৃথক পৃথক দল ভাগ করা আছে। (৪২-৪৪)

কোরআনের রীতি হচ্ছে, এতে ভীতিপ্রদর্শনের সাথে সাথে সুসংবাদও দেওয়া হয়, জাহান্নামের সাথে জান্নাতেরও আলোচনা করা হয়। এ কারণে শয়তানের অনুসারীদের আলোচনা করার পর ওইসব মহান ব্যক্তির আলোচনা করা হয়েছে, যারা শান্তি ও নিরাপত্তার ঠিকানা জান্নাত লাভ করবে। সেখানে তারা কোনো ধরনের কষ্ট-মুসিবত ও ক্লান্তির সম্মুখীন হবে না। তাদের অন্তর ঘৃণা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হবে।

আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ রহমত

৫. সুরা হিজরে সুখ-শান্তি, আনন্দ ও নিরাপত্তার ঠিকানা জান্নাতের আলোচনার পর বান্দাদের উপর আল্লাহ তায়ালার কৃত অনুগ্রহ ও রহমতের আলোচনা করা হয়েছে। বান্দা যতই গুনাহগার হোক না কেন, তাকে আল্লাহর রহমত থেকে কখনো নিরাশ হওয়া যাবে না। কেননা আল্লাহ সব ধরনের গুনাহ মাফ করে

দেন। তার রহমত তার ক্রোধের উপর জয়ী হয়। বলা হয়েছে, হে নবী, আপনি আমার বান্দাদের বলে দিন আমি বড় দানশীল ও অনুগ্রহকারী আর আমার আজাব অত্যন্ত ভয়াবহ। (৪৯-৫০)

এই অয়াতসমূহে আশা ও ভীতিকে একত্র করা হয়েছে। মুনিনের অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকার পাশাপাশি তার রহমতের আশাও থাকা উচিতনে

ঘুবরাহিম আলাইহিস সালাম * আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহের বর্ণনার পর ইবরাহিম আলাইহিস সালামের

নিকট মানুষের সুরতে মেহমান হিসেবে যে ফেরেশতা এসেছিল, তাদের

আলোচনা করা হয়েছে। সন্তানের সুসংবাদ দেওয়ার জন্য তারা এসেছিলেন।

বলা হয়, তখন তার বয়স ছিল ১২০ বছর। স্ত্রীও ছিলেন অনেক বয়স্ক। তিনি

সন্তান জন্মানোর বয়সে ছিলেন না। তার বয়স ছিল ৯৯ বছর।' এই কারণে সন্তানের সুসংবাদ শুনে খুশি হওয়ার পাশাপাশি তিনি ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। ফেরেশতাদের সামনে তিনি আশ্চর্য ভাব প্রকাশ করলে তারা বলে যে, আমরা আপনাকে সত্য সংবাদ শোনাচ্ছি। আপনি নিরাশ হবেন না। তিনি

উত্তরে বলেন, (আল্লাহর রহমত থেকে আমি নিরাশ হবো কেন?) পথভ্রষ্ট

লোকেরাই তো তার রহমত থেকে নিরাশ হয়ে থাকে। (৫৬) বরং আমার

প্রশ্নের উদ্দেশ্য হচ্ছে, বৃদ্ধবয়সে কীভাবে আমার সন্তান হবে? আমার যৌবন

ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নাকি অন্য কোনো নারীকে বিয়ে করার মাধ্যমে?

লুত আলাইহিস সালাম

ফেরেশতারা ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে সুসংবাদ শুনিয়ে লুত আলাইহিস সালামের নিকট হাজির হয়। তাকে বলে, আপনি আপনার পরিবার-পরিজনকে নিয়ে রাতের আঁধারে এই জনপদ থেকে বের হয়ে যাবেন। কেননা তারা অবাধ্যতা ও গুনাহর ক্ষেত্রে এতটাই সীমালঙ্ঘন করেছে যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের জমিন থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ফয়সালা করেছেন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, অতঃপর সূর্যোদয়ের সময় তাদেরকে এক বিকট শব্দ এসে পাকড়াও করল। আমি জনপদটি উপর-নিচ করে উলটে দিলাম এবং তাদের উপর পাথরধারা বর্ষণ করলাম। (৭৩-৭৪)

হজরত সালেহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়

৮. হিজর উপত্যকায় বসবাসকারী হজরত সালেহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় অত্যাচারের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করেছিল। অনেক বোঝানোর পরেও তারা প্রতিমাপূজা থেকে বিরত হয়নি। তাদেরকে বিভিন্ন মুজিজা দেখানো হয়েছে। বিশেষত পাথরের পাহাড় থেকে উষ্ট্রী বেরিয়ে আসার মুজিজা দেখানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল অনেক মুজিজার সমষ্টি। যেমন: পাথরের পাহাড় থেকে উদ্ভী বের হওয়া, বের হওয়া মাত্র বাচ্চা প্রসব করা, উষ্ট্রীর শরীর অস্বাভাবিক রকমের বড় হওয়া, অনেক দুধেল হওয়া। কিন্তু হতভাগারা এ মুজিজার কোকে মূল্যায়ন করেনি। ঈমান আনার পরিবর্তে তারা সেই উন্ত্রীকে হত্যা করে ফেলে। তাই হিজরবাসীদের উপর আজাব নেমে আসে।

সুরা হিজরের শেষে কোরআনের নেয়ামতের আলোচনা করা হয়েছে। এ নেয়ামত যার অর্জিত হবে, তার জন্য ধনাঢ্যদের প্রতি দৃষ্টিপাত করা অনুচিত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আপনার নিকট যে হক (কোরআন) অবতীর্ণ করা হয়েছে, আপনি তা প্রকাশ্যে বর্ণনা করুন। পূর্বের সুরার মতো এ সুরারও শুরু-শেষ কোরআন সংক্রান্ত আলোচনায় সমাপ্ত হয়েছে।

সুরা নাহল

এটি মক্কি সুরা। আয়াতসংখ্যা: ১২৮। রুকুসংখ্যা: ১৬

নামকরণ

মৌমাছিকে আরবিতে নাহল বলা হয়। এ সুরায় যেহেতু মৌমাছির আলোচনা করা হয়েছে এজন্য একে সুরা নাহল বলা হয়।

মৌমাছির ইতিবৃত্ত

মৌমাছি অন্যান্য মাছির মতোই এক প্রজাতির মাছি। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার কুদরতে সে এমন বিস্ময়কর কাজ করে থাকে, যা ভাবতে গিয়েও মানুষ অক্ষম হয়ে যায়। যেমন: চাক তৈরি করা, পরস্পর দায়িত্ব বণ্টন, দূরদূরান্তের গাছপালা, বাগান, ফলফসল থেকে ফোঁটা ফোঁটা মধু সংগ্রহ ইত্যাদি। মোটকথা তাদের প্রতিটি কাজই আশ্চর্যজনক। তাদের বানানো চাকে বিশ থেকে ত্রিশ হাজার ঘর থাকে। প্রতিটি ঘর ছয় কোণবিশিষ্ট। এই চাকে মধু জমা করার গুদাম, সন্তান প্রসবের ঘর, পেশাব-পায়খানা করার কক্ষ সবকিছুর জন্যই পৃথক পৃথক জায়গা রয়েছে।

হাজার হাজার মৌমাছির উপর রানি মৌমাছি রাজত্ব করে। এ ছোট রাজ্যে তার নামেই সব চলে। তার নামে দায়িত্ব বণ্টিত হয়। চাকে যেসব মৌমাছি কাজ করে, তাদের কেউ দারোয়ানির দায়িত্ব পালন করে। কেউ ডিম সংরক্ষণ করে। কেউ ছোট

বাচ্চাদের দেখাশোনা করে। কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং ও চাক নির্মাণের কাজ করে। কোনো মৌমাছি যখন তালাশ করে কোথাও মধুর সন্ধান পায় তখন সে বিশেষ সংকেতের মাধ্যমে সাথি মৌমাছিদের সেখানে পৌঁছার রাস্তা বলে দেয়। যে ফুল থেকে

মধু নিংড়ে নিয়েছে, সে তাতে এক আলামত রেখে আসে, যাতে এতে বসে তার সাথি মৌমাছিদের সময় নষ্ট না হয়। যদি কোনো মৌমাছি ভুলে কোনো নোংরা ও ময়লার উপর বসে যায় কিংবা কোনো বিষাক্ত উপাদান নিয়ে আসে তা হলে চেকিংয়ের দায়িত্বে থাকা মৌমাছিরা তাকে বাইরে থেকে প্রতিরোধ করে। তাকে এজন্য শাস্তি প্রদান করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমার নির্দেশেই মৌমাছি এসব কাজ করে থাকে। তিনি বলেন, নিঃসন্দেহে চিন্তাশীলদের জন্য এতে নিদর্শন রয়েছে। (মুঞ্জব যদি সুস্থ বিবেকসম্পন্ন কোনো মানুষ মৌমাছির জীবনপ্রণালির প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টি দেয় তা হলে সে আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব এবং তার কুদরতের কথা স্বীকার করতে বাধ্য হবে।'

সুরা নিয়াম

সুরা নাহলকে সুরা নিয়ামও বলা হয়। কেননা এতে অধিক পরিমাণে আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতের কথা আলোচিত হয়েছে। সুরার শুরুতে কেয়ামত নিকটবর্তী হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। (২)

এরপর ধারাবাহিকভাবে আল্লাহ তায়ালার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা আলোচনা করা হয়েছে। তিনি পৃথিবীকে বিছানা বানিয়েছেন। আকাশকে ছাদ বানিয়েছেন। মানুষকে বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছেন। বিভিন্ন উপকার দিয়ে চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন, যা নিয়ে মানুষ গর্ব করে থাকে। তিনি ঘোড়া, গাধা, খচ্চর সৃষ্টি করেছেন, যা বোঝা বহনের কাজে আসে। উপরন্তু এতে সৌন্দর্যও রয়েছে।

তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন। সে বৃষ্টির মাধ্যমে যাইতুন, খেজুর, আঙুরসহ অনেক ফলমূল ও শস্যদানা তৈরি হয়। চন্দ্র-সূর্যকে তিনি মানুষের সেবায় নিয়োজিত রেখেছেন। সমুদ্র থেকে তাজা গোশত (মাছ) ও অলংকারের ব্যবস্থা করেন। তার হুকুমেই সমুদ্রে জাহাজ ও নৌকা চলাচল করে।

এসব নেয়ামত উল্লেখ করার পর আল্লাহ তায়ালা বলেন, যদি তোমরা তার নেয়ামত গণনা করতে চাও তা হলে গণনা করে শেষ করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু। (১৮)

মানুষ যখন আল্লাহর নেয়ামতই গণনা করতে পারে না তখন তারা কীভাবে তার শুকরিয়া আদায় করবে? মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কথা চিন্তা করুন, যদি তাতে কোনো ধরনের সমস্যা হয়ে যায় তা হলে জীবনের আনন্দ বিনষ্ট হয়ে যায়। দুনিয়ার সমস্ত ধনসম্পদ, অর্থ-কড়ি ব্যয় করে হলেও মানুষ এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে চায়। বদহজম দেখা দেয় তা হলে খানাদানা কিছুই ভালো লাগে না। যদি পাকস্থলিতে কোনো জখম হয়ে যায় বা পেশাব বন্ধ হয়ে যায় কিংবা ।বদ হজম দেখা দেয় তাহলে খানাদানা কিছুই ভালো লাগেন।

যদি যকৃত বিনষ্ট হয়ে যায় বা হৃদপিণ্ডে সমস্যা দেখা দেয় তখন কষ্টের যাতনায় মানুষ মৃত্যু কামনা করতে থাকে। গাফেল মানুষদের কি খবর আছে যে, তার পরিচালিত হচ্ছে? যদি শুধু শরীরে শরীরের বার বুলানো হয় তা হলেই তো মানুষ এটা স্বীকার করতে বাধ্য হবে লো আসলে এসব নেয়ামত গণনা করা সম্ভব নয়।

কোরআনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ আয়াত

এ সুরায় সেই সমৃদ্ধ আয়াত রয়েছে, যার ব্যাপারে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, এই আয়াত সকল ভালোমন্দ ও কল্যাণ-অকল্যাণের নির্দেশনা সন্নিবেশনকারী।' এ আয়াত শুনে ইসলামের ঘোর শত্রু ওয়ালিদ বিন মুগিরাও প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছিল।' সমৃদ্ধির কারণে হজরত উমর বিন আবদুল আবদুল আজিজ রহ. এর যুগ থেকে সকল খতিবই তা জুমার খুতবায় পাঠ করে থাকে।

সুরা নাহলের ৯০নং আয়াতই সেই আয়াত। এই আয়াতে তিনটি বিষয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং তিনটি বিষয় বারণ করা হয়েছে। ইনসাফ, ইহসান এবং নিকটাত্মীয়দের (তাদের হক) দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সব ধরনের (কথা ও কাজের) অশ্লীলতা ও (শরিয়তনিষিদ্ধ) মন্দ এবং সীমালঙ্ঘন থেকে বারণ করা হয়েছে।

১. ইনসাফের হুকুমটি ব্যাপক। সব ধরনের আমল ও লেনদেনের ক্ষেত্রে তা রক্ষা করা আবশ্যক। ফরজ-ওয়াজিব বিধান পালন, সন্তানসন্ততি, শত্রু-মিত্র, পাড়া- প্রতিবেশী, সাথি-সঙ্গী, স্ত্রী-খাদেম সবার সাথেই ইনসাফ করা আবশ্যক।

২. প্রত্যেক ভালো কাজই ইহসান। ইহসানের সম্পর্ক যেমন আল্লাহর সাথে রয়েছে, তেমনিভাবে মানুষের সাথেও এর সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি চতুষ্পদ জন্তুর সাথেও ইহসানের হুকুম দেওয়া হয়েছে।

৩. দরিদ্র ব্যক্তিদের সাহায্য করা উচিত। তবে নিকটাত্মীয়দের সাহায্য করলে এতে দ্বিগুণ সাওয়াব পাওয়া যাবে।

৪. ফাহশা )فحشاء(: কথা ও কাজের প্রত্যেক মন্দ কাজ হচ্ছে ফাহশা। যেমন, 'ব্যাভিচার, পুংমৈথুন, মদ, জুয়া প্রভৃতি।

২. মুনকার (৩০৯) : শরিয়তের দৃষ্টিতে যেটা মন্দ এবং সুস্থ বিবেক যাকে গুলার দৃষ্টিতে দেখে।

৬. বাগ (খে)। মানুষের মোল ইজ্জত-সম্মানের উপর সীমালঙ্ঘন করা। সুরার শেষে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের প্রশংসা করা হয়েছে। সারা জীবন তিনি খালেস তাওহিদের উপর ছিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার অনুসরণের হুকুম দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, আপনি লোকদের হেকমত (প্রজ্ঞা) ও মাওয়িযায়ে হাসানা তথা উত্তম উপদেশের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি আহ্বান করুন।' এ পথে আসা বিপদ-মুসিবতে ধৈর্য ধারণ করুন।

সুরার শুরু আয়াতগুলো সেইসব ব্যক্তির উত্তরে অবতীর্ণ হয়েছে, যারা আজাব দ্রুত আসতে বলেছিল। তাদের এসব বেহুদা দাবির ব্যাপারে সুরার শেষে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ধৈর্য ধারণ করার এবং হীনম্মন্য না হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর দ্বারা সুরার শুরু ও শেষের মধ্যে সুস্পষ্ট মিল বুঝে আসে।

চলবে ইনশাআল্লাহ...

লেখক: আলেম ও ওয়ায়েজ; খতীব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।

(ঢাকাটাইমস/২৪মার্চ/এসআইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :