আজ পবিত্র আশুরা শোক ও ত্যাগের মহিমাময় দিন

আজ রবিবার মহররমের দশ তারিখ, পবিত্র আশুরা। আরবিতে ‘আশারা’ অর্থ দশ। সেখান থেকেই মহররমের ১০ তারিখকে ‘আশুরা’ বলা হয়। ইসলামের ইতিহাসে আশুরা এক অসামান্য মাহাত্ম্য-তাৎপর্যে উজ্জ্বল। ইবাদত-বন্দেগির জন্যও এ দিবস অতুলনীয়।
হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত। আল্লাহতায়ালা যে চার মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ এবং বিশেষভাবে সম্মানিত করেছেন, মহররম তার অন্যতম। কোরআন-হাদিসের আলোকে যে কয়টি মাস বিশেষ তাৎপর্যের এর অন্যতম এই মহররম। বিশেষ করে মহররমের ১০ তারিখ যা ‘আশুরা’ হিসেবে পরিচিত, এদিন আল্লাহর রহমত ও বরকতের ধারা চালু হয়।
ইসলাম আসার পর সকল মাসের নাম বহাল থাকলেও একমাত্র এই মাসের নাম পরিবর্তন করে ‘মহররম’ রাখা হয়েছে। ইসলাম আসার আগে এই মাসের নাম ছিল ’সাফারুল আউয়াল।’ (শরহুস সুয়ুতি আলা মুসলিম: ৩ / ২৫২)
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মহররম মাস আল্লাহর মাস।’ (সহিহ্ মুসলিম: ১১৬৩)
এই দিনে পৃথিবীর ইতিহাসে বড় বড় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আশুরার রোজা রাখলে বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। (সহিহ্ বুখারি: ২০০৪)
হিজরি ৬১ সনের এই দিনেই নবীদৌহিত্র হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) ও তার অনুসারীরা কারবালার ময়দানে ইয়াজিদের বাহিনীর হাতে শাহাদাতবরণ করেন। এই ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে।
কারবালার মর্মন্তুদ শোকগাথা এ দিবসকে গভীর কালো রেখামালায় উৎকীর্ণ করে রেখেছে। ৬১ হিজরি সালের এই দিনে হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ইয়াজিদের সৈন্যদের হাতে কারবালার ময়দানে শহিদ হন। পবিত্র আশুরা তাই মুসলিম উম্মাহর জন্য এক তাৎপর্যময় ও মর্মস্পর্শী বিয়োগাত্মক-শোকাবহ দিন। দিনটি মুসলমানদের কাছে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠারও দিন। এ দিনটি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে খুবই প্রিয়। তাই তিনি এ দিনে রোজা পালনের সওয়াব প্রদান করে থাকেন বহুগুণে।
মুসলমানদের কাছে বিগত বছরের গোনাহর কাফফারা হিসেবে মহররমের দুটি রোজা রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত: হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো আল্লাহর প্রিয় মহররম মাসের রোজা এবং ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ হলো রাতের (তাহাজ্জুদ) নামাজ (সহিহ মুসলিম)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনায় আগমন করলেন তিনি আশুরার দিনে ইহুদিদের রোজা পালন করতে দেখলেন। ‘ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় এসে দেখলেন যে, ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। তিনি তাদের জিগ্যেস করলেন, এটা কোন দিন যে তোমরা রোজা পালন করছ? তারা বলল, এটা এমন এক মহান দিবস যেদিন আল্লাহ মুসা (আ.) ও তার সম্প্রদায়কে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরআউনকে তার দলবলসহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন। মুসা (আ.) শুকরিয়া হিসেবে এ দিনে রোজা পালন করেছেন। এ কারণে আমরাও রোজা পালন করে থাকি। এ কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাদের চেয়ে আমরা মুসা (আ.)-এর অধিকতর ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তী। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোজা পালন করলেন ও অন্যদের রোজা পালনের নির্দেশ দিলেন (বুখারি ও মুসলিম)। আবু কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আশুরার রোজা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো, তিনি বললেন, আমি আশা করি আল্লাহর কাছে এটি বান্দার বিগত এক বছরের গুনাহসমূহের কাফফারা হিসেবে গণ্য হবে (মুসলিম হা/১১৬২; মিশকাত হা/২০৪৪)।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ রোজা ছাড়া অন্য কোনো রোজাকে এত গুরুত্ব দিতে দেখিনি। আর তা হলো আশুরার রোজা ও এই রমজান মাসের রোজা (বুখারী ও মুসলিম)। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার রোজা পালন করলেন ও অন্যকে পালন করার নির্দেশ দিলেন, তখন সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেন, এটা তো এমন এক দিন যাকে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা সম্মান করে থাকে। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আগামী বছর আসলে ইনশা-আল্লাহ আমরা নবম তারিখে রোজা পালন করব। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, পরবর্তী বছর আসার আগেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করলেন (মুসলিম)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা আশুরা দিবসে রোজা পালন কর ও এ ক্ষেত্রে ইহুদিদের বিরোধিতা কর।
মহররম মাসে বহু স্মরণীয় ও যুগান্তকারী ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় বিভিন্ন দিক দিয়ে এ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। মহররমের দশম দিবসে অর্থাৎ আশুরার দিনে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলির মধ্যে রয়েছে—
এই দিনে আকাশ-জমিন পাহাড়-পর্বত সবকিছুর সৃষ্টি। আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়। নূহ (আ.) মহাপ্লাবন শেষে জুদি পাহাড়ে অবতরণ। হজরত ইব্রাহিম (আ.) নমরুদের প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তিলাভ করেন এই দিনে।
প্রথম মানব হজরত আদম (আ.)-কে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় এই দিনে।
দীর্ঘ ১৮ বছর রোগ ভোগের পর হজরত আইয়ুব (আ.) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ করেন।
হজরত সুলাইমান (আ.)-কে পৃথিবীর একচ্ছত্র রাজত্বদান।
হজরত ইউনুস (আ.)-কে ৪০ দিন পর দজলা নদীতে মাছের পেট থেকে উদ্ধার করা হয়।
হজরত মুসা (আ.) ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা পান।
হজরত ঈসা (আ.)-এর পৃথিবীতে আগমন এবং জীবিতাবস্থায় আসমানে উত্তোলন, যা পবিত্র কোরআনে সুরা আল ইমরানের ৫৫ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে।
এই দিনে হজরত ইদ্রিস (আ.)-কে আসমানে উত্তোলন। হজরত দাউদ (আ.)-কে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হয়।
গাজওয়ায়ে খায়বার বিজয় অর্জন হয় এই দিনে। মাদায়েন ও কাদিসিয়ার যুদ্ধে বিজয় অর্জন।
হজরত আদম (আ.)-কে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় পাঠানো এবং গুনাহ মার্জনার পর তার সঙ্গে বিবি হাওয়াকে আরাফাতের ময়দানে জাবালে রহমতে পুনঃসাক্ষাৎ লাভ।
হজরত নূহ (আ.)-কে তুফান ও প্লাবন থেকে পরিত্রাণ।
হজরত সোলায়মান (আ.)-কে হারানো বাদশাহি ফিরিয়ে দেয়া।
হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর হারানো পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ।
প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করতে মদিনায় যান।
হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তাঁর ৭৭ ঘনিষ্ঠজন স্বৈরশাসক ইয়াজিদের সৈন্যের মাধ্যমে কারবালা প্রান্তরে নির্মমভাবে শাহাদতবরণ করেন।
নমরুদ বাহিনী যখন মুসলিম জাহানের পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে, আল্লাহ তাঁর অশেষ মেহেরবানিতে সেখান থেকে তাকে মুক্তি দেন। একই দিনে হজরত মুসা কালিমুল্লাহ (আ.) নীল নদ পার হয়ে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পান। ফেরাউন দলবলসহ নীল নদে ডুবে মারা যায়। এই দিনেই দীর্ঘ সময় প্রবল বন্যার পর হজরত নুহ (আ.)-এর নৌকা জুদি পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে ঠেকে। তিনি ও তার অনুসারীরা বেঁচে যান। একই দিনে হজরত ইউনুস (আ.) রাতের অন্ধকারে, পানির গভীরে ও মাছের পেটে-এই তিন স্তরের অন্ধকার থেকে মুক্তি পান।
এই দিনেই হজরত আইউব (আ.) সুদীর্ঘ ১৮ বছর রোগভোগের পর পূর্ণ সুস্থতা লাভ করেছিলেন। হজরত ঈসা মাসিহ (আ.) এই দিনেই জন্মগ্রহণ করেন। আল্লাহর অশেষ কুদরতে তাকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়, যা পবিত্র কুরআনে সুরা আল ইমরানের ৫৫ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। এই দিনেই হজরত মুসা (আ.) আল্লাহর সঙ্গে তুর পাহাড়ে গিয়ে কথা বলেন। আল্লাহর কাছ থেকে ঐশী গ্রন্থ তাওরাত লাভ করেন। এই দিনেই হজরত ইয়াকুব (আ.) তাঁর অতি স্নেহের সন্তান হজরত ইউসুফ (আ.)-কে বহুকাল পরে ফিরে পান। তার সন্তান হারানোর বেদনার অবসান হয়। এই দিনেই হজরত সোলায়মান (আ.)-এর সিংহাসনে অভিষেক হয়। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় তিনি সৈন্যসামন্ত নিয়ে এক মাসের ভ্রমণে বের হতেন, যা পবিত্র কুরআনের সুরা সাবার ১২ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। এই দিনেই আল্লাহ তায়ালা এই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলে করিম (সা.) হিজরত করে মদিনায় আসার পর দেখলেন, ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা রাখে। নবী (সা.) কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, এই দিনে হজরত মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইল শত্রুবাহিনী থেকে মুক্তি লাভ করেছিলেন, তাই এই দিন হজরত মুসা (আ.)-এর শুকরিয়া আদায় করতে তারা রোজা রেখেছেন শুনে রাসুল (সা.) বললেন, হজরত মুসা (আ.)-এর অনুসরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার। তাই এই দিনে তিনি রোজা রেখে অন্যদেরও রোজা রাখার হুকুম দেন।
ইসলাম ধর্মের বর্ণনা মতে, কেয়ামতের দিন আশুরার দিন ঘটবে বলে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। আশুরার দিনে আল্লাহ তায়ালা অনেক নবী ও তাদের অনুসারীদের বিভিন্ন বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। পবিত্র আশুরার দিনে আল্লাহ তায়ালা আদম (আ.)-এর তওবা কবুল করেছিলেন। এই ঘটনাগুলো পবিত্র আশুরার দিনকে মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্ববহ এবং তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। আমরা যেন এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।
পবিত্র আশুরা উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করছে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, বেসরকারি টিভি চ্যানেলসমূহ বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে। সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ প্রবন্ধ নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। পবিত্র আশুরা উপলক্ষে আজ সরকারি ও বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান এবং সংবাদপত্র অফিসসমূহে ছুটি রয়েছে। পবিত্র আশুরা উপলক্ষে মসজিদ, মাদ্রাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ আলোচনা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। ইসলামী ফাউন্ডেশন আলোচনার আয়োজন করেছে। আশুরা উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিবৃতি দিয়েছেন।
(ঢাকাটাইমস/৬ জুলাই/আরজেড)

মন্তব্য করুন