অনুমোদনহীন কর্পোরেট ভবন
রাজউকের চিঠিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি, পদে পদে অনিয়মের চর্চা— কী প্রমাণ করতে চায় ইউনাইটেড গ্রুপ?

পতিত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ইউনাইটেড গ্রুপ রাজধানীর ভাটারার মাদানী এভিনিউয়ে অনুমোদনহীন ভবন গড়ে তাদের কর্পোরেট সাম্রাজ্য চালাচ্ছে। শুধু তাই নয়— হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে শুরু করে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা সব জায়গায় ছড়ি ঘোরাচ্ছে এই প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীটি।
তবে অনুমোদন ছাড়া ভবন নির্মাণ ইস্যুতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ইউনাইটেড গ্রুপকে একাধিকবার চিঠি দিলেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। অথচ রাজধানীতে সাধারণ মানুষ অনুমোদনবিহীন ভবন নির্মাণ করলে অভিযান চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় রাজউক।
প্রশ্ন উঠেছে, কেন ইউনাইটেড গ্রুপের অবৈধ ভবনের বিরুদ্ধে রাজউক আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কীভাবে রাজউকের চিঠি উপেক্ষা করে তারা দিনের পর দিন ওই ভবনে কার্যক্রম পরিচালনা করছে? তাহলে কী স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের অন্যতম সুবিধাভোগী এই ইউনাইটেডকে বাঁচাতে কেউ পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে?
গত বছরের ২১ জুন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ হলে তার চিকিৎসায় ওষুধ এবং অ্যাম্বুলেন্স সহায়তা চাওয়া হয় ইউনাইটেড হাসপাতালে। তবে সরাসরি তা নাকচ করে দেয় স্বৈরাচার হাসিনার সহযোগী এই প্রতিষ্ঠানটি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে স্বৈরাচার সরকারকে সরাসরি আর্থিক সহায়তা করেছে ইউনাইটেড গ্রুপ— এমন অভিযোগ বেশ পুরোনো। তাদের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তিনটির বেশি হত্যা মামলা হয়েছে। তবে সরকারের তরফে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কিন্তু দোসর শেখ হাসিনার সহযোগী বেক্সিমকোসহ অনেক শিল্পগোষ্ঠীর কর্তাব্যক্তিরা কারাগারে রয়েছেন। তাদের উপার্জিত সম্পদ ও অর্থ জব্দ করা হয়েছে। শুধু ব্যতিক্রম ইউনাইটেডের বেলাতেই।
রাজউকের নথি অনুযায়ী, ইউনাইটেড গ্রুপের বিভিন্ন ভবন এখনো সম্পূর্ণভাবে অনুমোদন পায়নি। বিমানবন্দর, ধানমন্ডি, গুলশান, বসুন্ধরা ও তেজগাঁও এলাকায় তারা যে হাইটেক বিল্ডিং তৈরি করেছে, অনেক ক্ষেত্রেই নকশা অনুমোদনের শর্ত ভঙ্গ করে ফ্লোর বাড়ানো হয়েছে।
রাজউকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা বারবার নোটিশ দিয়েছি। কিন্তু ইউনাইটেড গ্রুপের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে প্রভাবশালী মহলের চাপ থাকে। ফলে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।’
মাদানী এভিনিউয়ে যে ইউনাইটেড সিটির কথা বলা হচ্ছে, সেখানে ইউনাইটেড গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ের পাশাপাশি আইটি পার্ক, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ফার্মাসহ গ্রুপটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ও রয়েছে।
ইউনাইটেডের কিছু ভবনে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ একাধিকবার অগ্নি নিরাপত্তা ঘাটতির কথা জানিয়েছে। তাদের হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে এমন ঝুঁকি মারাত্মক হতে পারে। কিন্তু নির্দেশনা সত্ত্বেও তারা পূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বড় অবকাঠামো প্রকল্পের কন্ট্রাক্ট পেয়েছে তারা। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেও তারা নিজের অবস্থান শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। সরকারের ভিতরেই ঘাপটি মেরে বসে আছে ইউনাইটেড চক্রের লোকজন। তাই প্রশাসনিক কোনো বাধা কার্যকর হচ্ছে না।
অর্থনৈতিক গোয়েন্দা সংস্থা (ইড) ও এনবিআরের খাতায় ইউনাইটেড গ্রুপের বিরুদ্ধে কর ফাঁকি ও টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগও রয়েছে। তবে তদন্তগুলো কখনো আলোর মুখ দেখে না। বেসরকারি ব্যাংক, ফাইন্যান্স কোম্পানি থেকে অস্বচ্ছ ঋণ নেওয়ার অভিযোগও বহুদিনের।
তাদের মালিকানাধীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই কোর্স চালু, টিউশন ফি নির্ধারণে অনিয়ম, শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি— সব মিলিয়ে শিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধ।
রাজউকের চিঠি ও নিষ্ক্রিয়তা
গত ৩ নভেম্বর রাজউকের মহাখালী জোনের অথরাইজড অফিসার-৪/১ ইমরুল হাসান স্বাক্ষরিত নোটিশটি পাঠানো হয় ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান মঈনউদ্দিন হাসান রশীদের কাছে। নোটিশে বলা হয়, ঢাকার মাদানী এভিনিউয়ের বড় কাঠালদিয়া মৌজায় রাজউকের মহাপরিকল্পনাভুক্ত এলাকায় ইউনাইটেড গ্রুপের একটি পাঁচতলা ইমারত (ভবন) রয়েছে, যা ড্যাপের আওতাধীন এলাকায় পাঁচতলা ভবনটি ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২ সালের ধারা-৩ এবং ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা-২০০৮ লঙ্ঘন করে রাজউক হতে অনুমোদন না নিয়েই করা হয়েছে। উল্লেখিত ইমারত ব্যবহার আইন ও বিধির প্রতি অশ্রদ্ধার শামিল।
রাজউকের অনুমতি ছাড়া ভবন নির্মাণ এবং এই স্থাপনা কেন ভেঙে অপসারণ এবং মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে ইউনাইটেডকে চিঠি দেয় রাজউক।
চিঠি পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে ইউনাইটেড গ্রুপকে জবাব দেওয়ার কথা উল্লেখ করে নোটিশে বলা হয়, অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে রাজউক কর্তৃপক্ষ। তবে প্রথম চিঠি অগ্রাহ্য করে ইউনাইটেড। পুনরায় আরও একটি চিঠি দেওয়া হলে তারা দৌড়ঝাঁপ শুরু করে।
অভিযোগ আছে, বিগত সরকারের আমলে আইনের তোয়াক্কা না করে রাজধানীর ভাটারা থানাধীন মাদানী এভিনিউয়ে পাঁচতলা সুবিশাল ভবনটি নির্মাণ করা হয়। ১০০ ফুট রাস্তা নামে পরিচিত এই সড়কের পাশেই ইউনাইটেড সিটি। ২৫ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা এই সিটিতে রয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপের প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনা।
সেসময় রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সিদ্দিকুর রহমান ঢাকাটাইমসকে জানান, যথাসময়ে চিঠির উত্তর না দেওয়ায় তাদেরকে জরিমানা করা হবে। একইসঙ্গে তারা অনুমতি ছাড়া যে ভবন নির্মাণ করেছে এজন্য মোটা অঙ্কের আর্থিক জরিমানা হবে। এক্ষেত্রে তাদেরকে কোনোভাবে ছাড় দেওয়া হবে না।
তবে সিদ্দিকুর রহমান বদলি হলে চেয়ারম্যানের নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম। এরপর আর আগাইনি ইউনাইটেড গ্রুপের ফাইল। বিষয়টি নিয়ে রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আগের চেয়ারম্যান বিষয়টি অনেকদূর এগিয়েছিলেন। তবে এখন অনেকে নতুন, এ কারণে ফাইল নড়ছে না। আর তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে সে সংক্রান্ত কোনো বোর্ডও বসেনি।’
ইউনাইটেডের অভিযোগ বিষয়টি জানতে ফোন করা হয় রাজউকের সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) শেখ মতিয়ার রহমানের সঙ্গে। তবে তিনি সাড়া দেননি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন ও বিধি সকল নাগরিকের জন্য সমান হতে হবে। ইতোপূর্বে যারা আইন মানেনি, ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে নজির তৈরি করতে হবে। তাহলেই এমন অপকর্ম রোধ করা সম্ভব।
পরিবেশ আন্দোলন বাংলাদেশের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যেটা অনুমতি ছাড়া তৈরি, রাজউকের উচিত সেটা দ্রুত অপসারণে কাজ শুরু করা। এর আগে অনুমোদন না থাকা র্যাংগস ভবন, বিজিএমইএ ভবন ভাঙতে দেখেছি।’
এই পরিবেশবিদ মনে করেন, মানুষকে নিয়ম মানাতে রাউজউকের যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। যেকোনো ভবন তৈরির আগে রাজউক কর্তৃপক্ষকেই অনুমতি বা অনুমোদন কড়াভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বেগম খালেদা জিয়াকে শহীদ মইনুল সড়কের বাড়ি থেকে উচ্ছেদে সাবেক সেনাপ্রধান আব্দুল মুবীন ছিলেন অন্যতম কারিগর। সেই মুবীনকে ইউনাইটেড গ্রুপ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসিয়ে রেখেছে। তিনিই ইউনাইটেড গ্রুপ ও তার কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যাতে ব্যবস্থা নেওয়া না হয় সেটা নিশ্চিত করেন থাকেন। একারণে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ মুবীন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ করেন।
বিমানবন্দরকেও ঝুঁকিপূর্ণ করল বিতর্কিত শিল্পগ্রুপ ইউনাইটেড
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বিমানবন্দরের প্রবেশমুখের উত্তর পাশের এক সারি বহুতল ভবন। কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান বিমানবন্দর এলাকার ভেতর একসময় বন্ধ হয়ে যাওয়া এই প্রকল্প আবার চালু হয় আওয়ামী লীগের আমলে। এবার মালিকানা নেয় শেখ হাসিনা সরকারের সবচেয়ে সুবিধাভোগী শিল্পগ্রুপ ইউনাইটেড।
কেপিআই নীতিমালা লঙ্ঘন করেই নির্মাণ করা হয় ভবনগুলো। সুউচ্চ এসব ভবন থেকে বিমানবন্দরের প্রতিটি স্পর্শকাতর স্থান দৃশ্যমান। এসব ভবনের ছাদ বা কোনো অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবহার করে বিমানবন্দরে যেকোনো ধরনের নাশকতার ঝুঁকি রয়েছে, বলছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর গোয়েন্দা বিভাগের অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপ। এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ে গ্রুপের কয়েকজন পরিচালক কর ফাঁকি দিয়েছেন ৪০ কোটি টাকা। এই শিল্পগ্রুপের মালিকদের বিরুদ্ধে আছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পতিত শেখ হাসিনা সরকারকে সহযোগিতার অভিযোগ।
আন্দোলনের সময় ঢাকার প্রগতি সরণিতে গুলিবিদ্ধ বাহাদুর হোসেন মনির হত্যা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আসামি ইউনাইটেড গ্রুপের কর্ণধার হাসান মাহমুদ রাজা, চেয়ারম্যান ও এমডি মঈনউদ্দিন হাসান রশিদ। বিশেষ করে জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকারকে অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।

মন্তব্য করুন