নির্বাচন ও রাষ্ট্রপতির অপসারণসহ নানা গুঞ্জন বাতাসে, কতটা সত্য...

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন তোলপাড় বেশ কিছু গুঞ্জনে। তার মধ্যে বহুল প্রচলিত তিনটি গুঞ্জন হলো- রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের বিদায় কি আসন্ন? আবারও কি ফিরে আসছে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার? আগামী ফেব্রুয়ারিতে কি নির্বাচন হবে?
এই গুঞ্জনে অবশ্য দুটি দলের নামও আসছে সামনে। তাদের নিয়েও প্রশ্ন উঠছে- নির্বাচন ঘিরে কোন চাল চালছে না তো জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)? এমন প্রশ্ন ওঠার কারণ দল দুটি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে অনীহ বলে প্রচার আছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে ভেসে বেড়ানো এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত গুঞ্জনগুলো কোনো পটভূমি ছাড়াই ছড়িয়েছে, তা নয়। তবে কোনটা নিছকই গুজব আর কোনটার সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এটি সময় ও আলোচনাসাপেক্ষ।
সর্বশেষ বড় গুঞ্জনটি তৈরি হয়েছে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে ঘিরে- তাকে নাকি সরে যেতে হচ্ছে। সেটি কীভাবে- রাষ্ট্রপতি কি পদত্যাগ করছেন, নাকি তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে? এই গুঞ্জনের তাওয়ায় ঘি ঢেলেছে দুদিন আগের একটি ঘটনা। বিদেশে বাংলাদেশের সব কূটনৈতিক মিশন, কনস্যুলেট এমনকি কূটনীতিকদের বাসভবন থেকেও রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের ছবি সরিয়ে ফেলতে মৌখিক নির্দেশ দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তবে, এই নির্দেশনার কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি নেই। এই নজিরবিহীন ও গোপনীয় নির্দেশনাই জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যেহেতু বর্তমান রাষ্ট্রপতি আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নিয়োগ পেয়েছেন, তাই অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে তার দূরত্ব তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এর আগেও, পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ নেই, রাষ্ট্রপতির এমন মন্তব্যকে ঘিরে তাকে অপসারণের দাবি উঠেছিল। সেবার সাংবিধানিক শূন্যতার দোহাই দিয়ে বিএনপির আপত্তির কারণে টিকে যান তিনি।
তবে এটা ঠিক, সংসদ বিদ্যমান না থাকায়, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা একটি জটিল প্রক্রিয়া। আবার তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলে, কে তার স্থলাভিষিক্ত হবেন, তা নিয়েও রয়েছে সাংবিধানিক প্রশ্ন।
সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন জাতীয় সংসদের স্পিকার বা তার অবর্তমানে ডেপুটি স্পিকার। তারাও সেই দায়িত্ব নিতে না পারলে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি কে হবেন, এর কোনো ব্যাখ্যা নেই।
স্পিকার বর্তমান সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন, আর ডেপুটি স্পিকার কারাগারে। তাই, ছবি সরানোর ঘটনাটি রাষ্ট্রপতির ‘নীরব বিদায়’-এর ইঙ্গিত দিলেও, বিষয়টি এখনো ধোঁয়াশায় ঘেরা।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগাম হাওয়া বইতে শুরু করেছে সারা দেশে। নির্বাচনী আলাপের শুরুতে জামায়াতে ইসলামী আগামী রোজার আগে ফেব্রুয়ারি মাস ভোটের উপযুক্ত সময় বলে মত দিয়েছিল। সেই তারাই এখন উল্টো কথা বলছে। নতুন দাবি নিয়ে হাজির হয়েছে।
তরুণদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি রাষ্ট্র সংস্কার (সংবিধান সংশোধনসহ) ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের আগে নির্বাচন নয়, এ কথা বলে আসছে বহুদিন ধরে। এই দুই শর্ত কত দিনে পূরণ হয় সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না।
তাই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এনসিপিও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে গুঞ্জন ভাসছে বাতাসে।
এনসিপি বলছে, বর্তমান সংবিধানের অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। দলটি একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিতে অনড়।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী একদিকে ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে, আরেক দিকে পিআর (সংখ্যানুপাতিক) পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন হতে দেবে না বলছে। তাদের এই অবস্থানকে রহস্যময় বলে মনে করছেন অনেকে।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, দুই দলের এই অবস্থান আদতে বিএনপিকে চাপে রাখার একটি কৌশল হতে পারে। আগামী দিনের সরকারে নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতেই জামায়াত ও এনসিপি এই চাপ প্রয়োগের কৌশল নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই তাদের এই বিরোধিতা নির্বাচন বানচালের চেয়ে রাজনৈতিক দর-কষাকষি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
যে গুঞ্জনটি চায়ের কাপে ঝড় তুললেও প্রকাশ্যে কেউ বলতে চায় না, তা হলো সেনাবাহিনীর ক্ষমতায় অংশগ্রহণ। নির্বাচনের আগে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে পারেন, যেখানে বর্তমান সরকারের অনেকের ঠাঁই হবে না- এমন একটা কথা শোনা যাচ্ছে। সেই সরকার আবার সেনাসমর্থিত হতে পার - এমন আশঙ্কার কথা অভিযোগের সুরে বলেছেন এনসিপির এক নেতা।
তবে এই গুঞ্জনের সপক্ষে কোনো শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান বারবার বলেছেন, সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করতে চায় না।
প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহম্মদ ইউনূসও বলে আসছেন- ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন তারা। এসব কথার আলোকে সেনাসমর্থিত নতুন সরকার গঠনের গুঞ্জন ভিত্তিহীন বলেই মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন একটি সংবেদনশীল বাঁকে দাঁড়িয়ে। রাষ্ট্রপতির ভবিষ্যৎ, নির্বাচন নিয়ে প্রধান দলগুলোর অবস্থান এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চূড়ান্ত লক্ষ্য- এই সবকিছুই নির্ধারণ করবে দেশের আগামী দিনের পথচলা।
গুঞ্জন থাকবে, বিতর্কও চলবে। তবে প্রতিটি নাগরিকের প্রত্যাশা সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচনের মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নশীল বাংলাদেশ।
(ঢাকাটাইমস/১৮আগস্ট/মোআ)

মন্তব্য করুন